কসাই কাদেরের টাইমলাইন

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র এর ছবি
লিখেছেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/১২/২০১৩ - ১০:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কসাই কাদেরের উত্থান:

কসাই কাদেরের ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করে।

১৯৬৬ সালে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় কসাই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র রাজনৈতিক শাখা ইসলামি ছাত্র সংঘে (বর্তমানে ছাত্র শিবির) যোগ দেয় এবং পরবর্তীতে কলেজ শাখার সভাপতি হয়।

কসাই রাজেন্দ্র কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে স্নাতোকত্তর অধ্যয়ন করার জন্য ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি ছাত্র সংঘের শহীদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি হয়।

একাত্তরে কসাই কাদের:

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কসাই কাদের মোল্লা ইসলামী ছাত্র সংঘের (ছাত্র শিবির) সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানী আধা-সামরিক বাহিনী আলবদরে যোগ দেয় এবং নারকীয় বাঙালী গণহত্যা ও নিপীড়ণে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে।

যুদ্ধের পর জামাতকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং কাদের মোল্লা সে সময় আত্মগোপন করে।

কসাই কাদেরকে পূর্নবাসন:

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসঘাতকদের হাতে শহীদ হবার পর, জেনারেল জিয়ার সরকার একাত্তরের পর নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতকে পুনরায় এই দেশে রাজনীতি করার অনুমতি প্রদান করে।
কসাই কাদের এই দলের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল।

তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করার জন্য তাকে দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদক করা হয় ও বাংলাদেশ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যপদ দেয়া হয়।

যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু:

২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা, বর্তমানের বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার করার জন্য জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাব পাশ হয়।

২০০৯ সালের ২৫ মার্চ, পাশকৃত এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে সরকার বিদ্যমান "আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট-১৯৭৩" অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে কসাই কাদের:

২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর: মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত করে কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা করা হয়।

২০০৮ সালে পল্লবী থানায় যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আরো একটি মামলা হয়।

২০১০ সালের ১৩ জুলাই: কাদের মোল্লাকে পল্লবী থানা এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১১ সালের ০১ নভেম্বর: যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্ত শেষে প্রতিবেদনে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ তথা, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ।

২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর: ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গ্রহণ করে।

২০১২ সালের ২৮ মে: ট্রাইব্যুনাল-২ খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী ছয়টি অভিযোগের বিচার শুরু হয়।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগসমূহ হলো:

এক. ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ, কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে, দুই বছরের এক ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আলী লস্করের এগারো বছরের এক শিশুকন্যা ধর্ষণ ও ভয়ংকর অত্যাচারের শিকার হয়েও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। পরবর্তী, এই কন্যা কসাই কাদেরের মামলায় রাজস্বাক্ষীতে পরিণত হয়। (লিংক)

দুই. ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ, কসাই কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা মিরপুরে কবি মেহেরুননিসা ও তার মা এবং দুই ভাইকে তাঁদের নিজ বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করে।

তিন. ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ, আরামবাগ থেকে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে অপহরন করে কসাই কাদের পাম্পহাউস জল্লাদখানায় জবাই করে হত্যা করে।

চার. ১৯৭১ সালের ০৫ এপ্রিল, মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে কসাই কাদেরের আদেশে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পাঁচ. ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল, কাদের মোল্লার সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মিরপুরের আলোকদী গ্রাম আক্রমন করে ৩৪৪ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করে।

ছয়. ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর, কাদের মোল্লা নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটারচরে শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যা করেন। রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশন এই অভিযোগ প্রমান করতে পারেননি।

২০১৩ সালের ০৫ ফেব্রুয়ারি: কাদের মোল্লাকে 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল' মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩৪৪ জন নিরীহ ব্যাক্তি হত্যা ও অনান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে।

এই রায় মেনে নিতে পারে না বাঙালী।
ফুঁসে উঠে বাঙলা।
শুরু হয় বাঙালীর গণজাগরণ...
৫২, ৬৬, ৬৯, ৭৯, ৭১, ৯০'র গণজাগরণের মত আবার ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে বাঙালীর চেতনার উন্মেষ ঘটে।
সারাদেশের কোটি কোটি মানুষ প্রতিটি স্থানে গণজাগরণ মঞ্চ গঠন করে সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি সহ যুদ্ধাপরাধী-সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাতে থাকে।

২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী: গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রেখে "আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন বিল-২০১৩" জাতীয় সংসদে পাস হয়।

২০১৩ সালের ০৩ মার্চ: রাষ্ট্রপক্ষ কসাই কাদেরের সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে।

২০১৩ সালের ০৪ মার্চ: কাদের মোল্লার আইনজীবিরা তাকে বেকসুর খালাস দেওয়ার জন্য আপিল করে।

২০১৩ সালের ০১ এপ্রিল: আপিলের শুনানি শুরু হয়।

২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর: সর্বোচ্চ আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমানিত হওয়ায় যাবজ্জীবন করাদন্ডের পরিবর্তে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড দেয়।

২০১৩ সালের ০৫ ডিসেম্বর: জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি আপিল বিভাগ প্রকাশ করে; যার ফলে সাজা কার্যকর করার পথে আর কোনো বাঁধা থাকে না।

২০১৩ সালের ০৮ ডিসেম্বর: যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয় এবং লাল সালুতে মোড়া সেই পরোয়ানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দেয়া হয়।

২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর: যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারকে চিঠি পাঠিয়ে রাত ০৮ টার মধ্যে কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করতে বলে কারা কর্তৃপক্ষ।

২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর, রাত ১২ টা ০১ মিনিটে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়ার কথা থাকলেও এবং কারা কর্তৃপক্ষ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর আব্দুল কাদের মোল্লার আইনজীবীদের আবেদনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বুধবার (১১/১২/২০১৩) সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করেছে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন(লিংক)

২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর: সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেয়; ফলে, কসাই কাদেরের ফাঁসি হতে আর কোন বাঁধা রইল না। (লিংক)

২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর, রাত ১০ টা ০১ মিনিট:
অনেক নাটকীয়তার পর একাত্তরের ঘাতক-দালাল কসাই আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। (লিংক)

.......কসাই কাদের মোল্লা একাত্তরের প্রথম যুদ্ধাপরাধী যার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শহীদ হওয়া ত্রিশ লক্ষ বাঙালী ও ধর্ষিত চার লক্ষ মায়ের রক্তঋণের দায়মুক্তির সূচনা হয়।

আর এরই সাথে নতুন প্রজন্মের বাঙালীরা ৪২ বছরের কলঙ্কমোচনের সূচনা করে।

জয় বাংলা...


মন্তব্য

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি


V

____________________________

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

জয় বাংলা... হাসি

চোখ থেকে মুছে ফেল অশ্রুটুকু... এমন খুশির দিনে কাদঁতে নেই...

হারানো স্মৃতির বেদনাতে, একাকার করে মন রাখতে নেই, ওরা আসবে চুপি চুপি…
কেউ যেন ভুল করে গেয়োনাকো, মন ভাঙ্গা গান...

সব ক’টা জানালা খুলে দাও না...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আয়নামতি এর ছবি

এই পিচাশটার বৃত্তান্ত যত্ন করে সংরক্ষণ করা হোক।
পরবর্তীতে এরে ঘিরে যাতে ওর স্যাঙ্গাতেরা পীরবাবাগিরি করার মত র্নিলজ্জ কাজে মাতলেই আয়নাখান সামনে ধরা যায়।

হাসিব এর ছবি

এইসবের ডকুমেন্টেশন খুব জরুরী।

স্যাম এর ছবি

চলুক চলুক

চরম উদাস এর ছবি

চলুক

রানা মেহের এর ছবি

খুব প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ধুসর গোধূলি এর ছবি

আরও একটা ব্যাপার টাইমলাইনে যোগ করা যেতে পারে বৈকি!
রিভিউ আবেদন নিয়ে রাজ্জাক উকিল ত‌্যানা প্যাচাইতে গিয়ে বিচারকদের কাছে সার্ফ এক্সেল ধোলাই খেয়েছেন। এটা খোলাসা হওয়া জরুরী ছিলো। এখন বাকি দণ্ড কার্যকরের সময় রাজ্জাক উকিলের বাকওয়াজি কিছুটা হলেও কম হবে বলে ধারণা করছি।

যাইহোক, এখন বুঝতে পারছি কাদিরার রিভিউ আবেদন খারিজের পর উকিল-রাজ-রাজ্জাক মুখ কেনো বাংলা ৫ এর মতো করে রেখেছিলো!

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।