পরীক্ষা পেছানো: দোষ কার?

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: শুক্র, ০৯/১১/২০০৭ - ৫:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

মৃদুল আমার খুব কাছের বন্ধু। গত জানুআরিতে বিয়ে করেছে। ভিসার পুলসিরাত পার হয়ে ভাবী এখানে আসতে আসতে জুন মাস। ভাবী দেশে এখনো স্টুডেন্ট। ব্যাচেলর শেষ হয় নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে অনার্স থার্ড ইয়ার। অক্টোবরের ২৯ তারিখে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিলো। মূল পরীক্ষার আগে আবার নাকি কিসব টিউটোরিয়াল দিতে হয়। ফলাফল, এখানে আসার দুই আড়াই মাসের মধ্যেই অর্থাৎ আগস্টের মাঝামাঝি ভাবী আবার দেশে।

কিন্তু বিধিবাম! অক্টোবর, ২০০৭-এর পরীক্ষা এখন ২০০৮ জানুআরির ২১ তারিখে শুরু হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। মৃদুল পড়েছে মহা বিপাকে। দেশে গিয়ে সর্বোচ্চ ৬ মাস থাকা যাবে, তারচে' বেশি হলে ভিসা ক্যানসেল। সে অনুযায়ী ভাবী সর্বোচ্চ ফেব্রুআরির মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে স্টে করতে পারবেন। সমাধান, এর মধ্যে একবার এসে আবার যাওয়া, যার অর্থ অন্তত ২০০০ ইউরো গচ্চা। এবং মৃদুলের বাবা-মা হজ্জ্ব করতে যাওয়াসহ কিছু সামাজিক কর্তব্যে তিনি এখন আসতেও পারবেন না। ফলাফল, তার এ বছর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। আগামী বছরেও আবার ঠিক এরকম বা এরচেয়েও খারাপ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

২.

পরীক্ষা পিছানোর জন্য বুয়েটের দুর্ণাম সুবিদিত। প্রতিবারই কোনো না কোনো কারণে পরীক্ষা পিছিয়ে যেত। ক্লাস শুরুর আগে আড়াই বছরের (কৃতজ্ঞতা: শিক্ষাবোর্ড এবং বুয়েট দুয়েরই) সেশন জ্যাম ছাড়াও দুটি প্রায় বছর-দৈর্ঘের সেমিস্টার পার করতে হয়েছে। এ নিয়ে হৈচৈ হয়েছে, গবেষণা হয়েছে, কিছু ছাত্রকে উচ্ছৃঙ্খলতার দায়ে সাজা পেতে হয়েছে; কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান কিছুই হয় নি। পরীক্ষা আবারও পিছিয়েছে, ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকেছে, হল ভ্যাকেন্ট করে অনিশ্চিত জীবনের অধিবাসী হয়েছে হাজার-হাজার ছাত্র-ছাত্রী।

বুয়েটের সমস্যা প্রতিবারই যেন একই টেমপ্লেট ফলো করে সৃষ্টি করা। সৃষ্টি কে বা কারা করে অথবা কেন করে, এটা নিয়ে বিতর্ক-কুতর্কের অভাব নেই। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে সাধারণত ছড়ানো হয়, ছেলেপেলেরা টিউশনি করে, কোচিং সেন্টারে পড়ায়, রাজনীতি করে, সারা সেমিস্টার পড়াশুনা করে না। অতএব, পরীক্ষার আগেভাগে তাদেরকে আন্দোলন করতে হয় পরীক্ষা পেছাতে। সুশীল ছাত্র-ছাত্রীগণও এ ব্যাখ্যায় পুরোপুরী সন্তুষ্ট হয়ে ওসব কুশীল ছাত্রদের মুন্ডুপাত করে চোথা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে আবার বলেন, ভ্যাকেশন ক্রিয়েট করে শিক্ষকদের খ্যাপ মারার সুবিধা সৃষ্টি করতেই এসব ঘটানো হয়। তবে পরের সেমিস্টারে আবারও একই ঘটনা ঘটে। আবারও সবাই কুশীল ছাত্রদের মুন্ডুপাত করতে করতে চুপ হয়ে যায়।

যাহোক, টেমপ্লেটটির কথা বলি। সেমিস্টার চলার সময়ে ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত ক্লাসটেস্ট এবং সেশনাল (ল্যাব কোর্স) নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। অধিকাংশ শিক্ষকই প্রথম দিকে ঢিলামী দিয়ে সেমিস্টারের শেষ দিকে এসে বস্তায় বস্তায় ক্লাস টেস্ট এবং সেশনাল কুইজ ধরিয়ে দেন। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় এগুলো শেষ হতেই সেমিস্টারের ক্লাস শেষ এবং পিএল (পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ২ সপ্তাহ লিভ) শুরু। কুইজের ধকল সামলিয়ে সেমিস্টার ফাইনালের পড়াশুনায় গিয়ার তুলতে তুলতে ৩/৪ দিন সময় নষ্ট হয়।

এটা অবশ্য বড় কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা অন্য খানে। প্রায় প্রত্যেকটা সেমিস্টারের প্লানই এমনভাবে করা হয়, যাতে পরীক্ষার সময় একটা না একটা উপলক্ষ থাকেই। মনে করেন, সেমিস্টার শুরুর আগে ২ মাসের বিশাল একটা গ্যাপ রেখে এমনভাবে প্লান করা হল যে, পিএল এর মধ্যে ঈদের ছুটি এবং ঈদের ছুটির ৩/৪ দিন পরেই পরীক্ষা শুরু। ওই দুইমাসের গ্যাপটা ১ মাস করলেই পরীক্ষা দিয়ে সবাই ফ্রি থেকে ঈদ করতে পারে। সেটা করা হবে না। ফলাফল, ঈদের পরে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করবে পরীক্ষা '১ সপ্তাহ' পেছানো হোক। কর্তৃপক্ষের সাথে সাধারণ ছাত্ররা আলোচনায় বসবে; কর্তৃপক্ষ নাছোড়বান্দা, তারা জীবন চলে গেলেও ১ সপ্তাহ পরীক্ষা পিছাবেন না। এরকম অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কেউই ঠিকমতো পড়াশুনায় মন বসাতে পারবে না, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে মিছিল শুরু হবে, কাঁচ ভাঙ্গা হবে, ল্যামপোস্টের লাইটগুলো ভাঙ্গা হবে, টীচার্স কোয়ার্টারে ইট পড়বে, পুলিশ আসবে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে 'অপারগ' হয়ে 'অনির্দিষ্টকালের জন্য' পরীক্ষা স্থগিত করতে কর্তৃপক্ষ 'বাধ্য' হবেন।

৩.

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা কেন পিছায়, কিভাবে পিছায়, সেটা আলোচনা করা যেতে পারে, তবে তারা প্রায় প্রতিবারই পরীক্ষা পিছায়। দোষ দেয়া হয় সাধারণত 'উদ্ভূত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা'র। এবার অবশ্য সেই সমস্যা তেমন নেই। তত্ত্ব সরকার বেশ আসন গেড়ে বসেছেন, জরুরী আইনের ডান্ডা দিয়ে সব রাজনৈতিক গ্যাঞ্জাম ঠান্ডা করে তারা দেশে স্থিতিশীলতার প্লাবন বইয়ে দিয়েছেন। হয়তো সে প্লাবনে অনুপ্রাণিত হয়েই অরিজিনাল প্লাবনে দেশের একটি বড় অংশ প্লাবিত হয়। জাতীয় ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ এ সুযোগ লুফে নেন। বন্যা চলে গেলেও মাসের পর মাস ধরে কয়েক দফায় ইন্স্ট্যান্ট নোটিশে পিছিয়ে অবশেষে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষাকে অক্টোবরে শুরু করতে পারেন। তাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল। এরপর ৩ দিন গ্যাপ দিয়ে সেকেন্ড ইয়ার, চলবে ঈদের আগ পর্যন্ত। থার্ড ইয়ার অবশ্য এত তাড়াতাড়ি শুরু হচ্ছে না। ঈদের খানাপিনা শেষে জাবর কাটতে বর্তমান নোটিশ অনুযায়ী তাদের অন্তত একমাস সময় লাগবে। তারপর ইচ্ছে করলে শুরু করবেন আর কোনো অজুহাত পেলে তো কেল্লাফতে!

৪.

আমাদের শিক্ষা জীবনের ৩ থেকে ৪ বছর সময় নষ্ট হয় এরকম সেশন জটে। সবসময়ই দোষ দেওয়া হয় ছাত্রদের। তারা মিছিল করে, পড়াশুনায় ফাঁকি দেয়, ভাংচুর করে। আচ্ছা, ঠিকাছে। সব দোষ ছাত্রদের। কিন্তু তোমরা যারা 'কর্তৃপক্ষ', তাদের কাজ কি বাপ? তোমাদের কাজ তো বসে বসে গাঁজা খাওয়া না, তোমাদের কাজ এসব সমস্যার সমাধান করা। প্রতিবারই ছাত্রদের ওপর দোষ চাপিয়ে পার পেয়ে যাওয়া কেন? সেমিস্টারের শুরুর প্লানে ঘাপলা না করলে বুয়েটে পরীক্ষা পেছানোর কোনো কারণ নেই। ছাত্রদের স্বার্থে ১ সপ্তাহ ছাড় দিলেও বড় কোনো সমস্যা নেই, যেখানে সেই ছাড় না দেয়ার গোয়ার্তুমি 'অনির্দিষ্টকাল'-এ গিয়ে ঠেকে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় খুব সহজেই দুই ইয়ারের পরীক্ষা একসাথে নিতে পারতো। জনবল, রুমসংকট-এসব প্রশ্ন আসবে। কিন্তু পরীক্ষায় ওভারল্যাপ তারা দুয়েকবার করেছেও। জনবল, পরীক্ষার রুম - এসব বড় কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা সদিচ্ছার অভাব; আর সদিচ্ছা থাকলে বুঝতে হবে, তাদের যোগ্যতার অভাব। বুয়েটের কর্তৃপক্ষ হোক আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তারা যদি এসব ম্যানেজ না করতে পারে, তাহলে 'কর্তৃপক্ষের' আসনে কেন? যাদের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, তাদেরকে ম্যানেজ করতে ব্যর্থতার দায়ভার তাদের ওপরেই চাপিয়ে আর কতকাল!

এখন ডালখোর অবৈধ তত্ত্ব সরকার আরো বড় নেশা ধরেছে। ক্ষমতা একবার যখন পেয়েছি, সেটাকে চিনে জোঁকের মত আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে, ছলে-বলে-কৌশলে সংস্কারের নামে 'অনির্দিষ্টকাল' ধরে মসনদ চাই। এরকম নীরব সময়েও শিক্ষা সেক্টরের যে অবস্থা, তাতে বুঝাই যায়, কোন মহৎ সংস্কার সাধনায় তারা মন দিয়েছে!


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

সাইজ দেইখাই মনে হয় সবাই ডরাইছে। হাসি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

কনফুসিয়াস এর ছবি

আমি পড়লাম পুরাটা।
ঢাবি-র অভিজ্ঞতা থেকে একটু আলাদা, আমাদের ইয়ার সিস্টেম চালু ছিলো, তাই সেমিস্টার না, বছর শেষে আন্দোলন শুরু হত।
শিক্ষা সংস্কারের মতন মহৎ উদ্দেশ্য এই সরকারের আছে বলে মনে হয় না!

-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

ডিইউর সিস্টেমটা কি? সেশন জ্যামের অবস্থাই বা কেমন? আমাদের ব্যাচ ডিইউতে আমাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলো। বুয়েটে সবার (ব্যাচ, ডিপার্টমেন্ট)একসাথে পরীক্ষা হওয়াটা একটা সমস্যা। ডিইউতে সম্ভবত এই সমস্যা নেই।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

পড়ে এসে পড়বনে। কিছু বলার সুযোগ আছে মনে হচ্ছে।
...............................
আমার লেখাগুলো আসে স্বপ্নের মাঝে; স্বপ্ন শেষে সেগুলো হারিয়ে যায়।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

ফাস্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স শুনতে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। বর্তমান অবস্থা কেমন? শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক উন্নয়নের খুব তোড়জোড় চলছিলো মাঝে........

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সৌরভ এর ছবি

বুয়েটের কথা তো জানি।
সেখানে ছাত্রদের অতিরিক্ত সিরিয়াসনেস আর শিক্ষকদের অতিরিক্ত ইগোর একটা রশি টানাটানি চলে পরীক্ষা পেছানোর সময়গুলোতে। পরীক্ষার সিস্টেমটাই বদলে ফেলা উচিত।

অন্যদের সিস্টেম তাও ভালো আছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটাই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। পুরো একটা লেজেগোবড়ে অবস্থা সেখানে।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

কোন সিস্টেমে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যাবে? আমার কাছে কর্তৃপক্ষের ইগোকেই সবচেয়ে বড় বাধা মনে হয়।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

দারুন বিশ্লেষণ।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

থ্যাংক্স। এই বিশ্লেষণ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুব সুখকর না। হাই-জিপিএ 'ভালো ছেলেরা' সাধারণত এসব শুনলে তেড়ে আসে। চোখ টিপি

সুমন বুয়েটে জয়েন করছিলা নাকি? আচ্ছা, এই সমস্যা নিয়ে টীচারদের ওভারঅল সচেতনতা এবং সমাধানে সদিচ্ছা কেমন?

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।