রঙিলা - ৯

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/১০/২০০৯ - ১০:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
মানুষ অনেক খারাপ অভ্যাস নিয়ে জন্মায়। পরে পৃথিবীর আলোবাতাসে ধীরে ধীরে অভ্যাসগুলো পরিবর্তিত হয়, সুঅভ্যাস রপ্ত হয়, কুঅভ্যাস ছাইচাপা পড়ে কিংবা পাথরচাপা; কেউ কেউ আবার পটল তোলানোর ক্রেডিটও নিতে চায়। তবে সাবেক পাতিমন্ত্রী পটলের গাঞ্জুইট্টা চোখ দেখলে বোঝা যায় পটল তোলানোর দাবিটি নিছকই বাড়াবাড়ি। সভ্যতা একটা মুখোশমাত্র এবং এই মুখোশটিকেই ধরা হয় উন্নতির মাপকাঠি। প্রায় সব মানুষই উন্নতি চায়, যারা চায় না, তাদের আসলে চাওয়া পাওয়ার আর কিছু বাকি নাই।

আমার যেহেতু চাওয়া পাওয়ার ক্যাচাল এখনো শেষ হয় নাই, সেহেতু মুখোশে আপত্তি নাই, উন্নতিও চাই, উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছেও রাতদিন অহরহ সজ্ঞানে হোক আর অজ্ঞানে। তো এই কাহিনী হইলো সেই প্রস্তর যুগের যখন মিঃ মুখোশ নিতান্তই শুককীট অবস্থায় আছে। পান থেকে জর্দা খসলে রাগারাগি, ভাঙচুর করি, পরীক্ষায় ১০ এ ৯ পাইলে গাল ফুলাইয়া কাঁদি আর জ্ঞানের সমুদ্রে নিউটনের নুঁড়ি কুড়ানোর রেকর্ড ভঙ্গের জন্য পারলে জীবন বিলাইয়া দেই। তবে বই পড়ার বদভ্যাসটা ছিলো নেশার মতো, তারচেয়েও বেশি নেশা ছিলো কোন কোন মহাজ্ঞানী লেখক কোন কোন মহান কথাবার্তা লিখে গেছেন, তা ডায়েরীতে টোকা। টোকাটুকির কাজটা আবার বিরাট ঝামেলা, তাতে বই পড়ায় ছন্দ পতন হয়। সুতরাং যখন পড়তে বসি, তখনই হাতে থাকে পেন্সিল। বইয়ের পাতায় দাগ দিয়ে যাই। এরমধ্যে কোন লেখকের লেখায় যেন পাই, ধরাধামে যখন এসেই পড়েছিস, তখন দুটো দাগ রেখে যা। আমি দাগ রাখতে পারি আর না পারি, আমার হাতের পেন্সিল ঠিকই দাগ রেখে যায়।

এই দাগাদাগি যে আমপাবলিকের পছন্দ না, এইটা তখনও বুঝতে পারি নাই। কারণ, নিজের বইয়ে নিজে দাগালে কার বাপের কি। আর অন্যের বই এনে পড়ার পরে যেহেতু ফেরত দেই না, সেহেতু বইমালিকের বাপেরও সাধ্যি নাই আমি বইতে দাগ দেই, নাকি মোনালিসা আঁকি, সেটা বের করার। কিন্তু গোল বাঁধে সেই চশমাওয়ালীর হাতে।

এমনিতে চশমাওয়ালা পোলাপান আমার দুই চোখের বিষ। কিছুটা শ্রেণীবিদ্বেষও কাজ করতো হয়তো। আমরা দশ-পাঁচ টাকার পুঁটি-চেলা-বাতাসী কিনে খাই আর উনাদের গুঁড়া মাছ মুখে রোচে না। কাঁটা বেছে বড়ো মাছ খাওয়ার জন্যই যে এই অভিশাপ তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। আর সুন্দরী মাইয়া চশমাওয়ালী হইলে অবস্থা আরো কেরোসিন। এমনিতে কেমন দিঘীর মত টলটলা চোখ, টিপ দিলেই রাঙা হইয়া যায় ফেসের উপ্রে এমন স্কিন; কিন্তু চশমা চোখে দিলেই যেন মুরব্বি, যেন বেত হাতে তেড়ে আসা মাস্টারনী। মাস্টারদের সম্পর্কে আমার কিছু ভয়ডরও আছে। প্রথম টীচার হিসেবে মা আমারে যেমন কইরা পিটানি দিছে, পাল বংশের মহাপালেরাও তার কাছে নস্যি। ভালোছাত্র হওয়ার পরেও টীচারেরা কেমন সন্দেহের চোখে দেখতো। স্কুল হোক আর কলেজ হোক আমার খাতির সমসময় তথাকথিত বদ পোলাপানের সাথে। এদের সাথে মেশার পরেও কিভাবে অংকে লেটার পাই, শ্রদ্ধেয় মাস্টার-মাস্টারনীরা মনে হয় তাতে আরো কনফিউজড হয়ে যেতেন। আমিও পারতপক্ষে তাদের এড়িয়ে চলতাম। তাদেরকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও সবসময় সম্ভব হতো না, অনেক সময়ই ক্লাসে গণপিটুনীর সময় আমার ভাগে একটু বেশিই পড়তো।

তবে চশমাওয়ালী ক্লাসমেটদের এড়িয়ে চলা সহজ। 'যা তোর সাথে মিশলাম না' মনে মনে এমন ভাবলেই হয়। আরেকটা কারণ আছে, তাহলো যে মাইয়ার সাথে ভাবভালোবাসার কথা বলা যায়, তার প্রথম কথাই যদি হয় ওমুক সাবজেক্টের নোট আছে, তমুক সাবজেক্ট কোন স্যারের কাছে পড়ো -ইত্যকার বিপদে ফেলা প্রশ্ন দিয়ে, তাইলে মেজাজমুজাজ ঠিক রাখতে পারে, এমন কোন পালোয়ান আছে দুনিয়ায়?

মিনতির সাথে অবশ্য তারপরেও কেমন করে যেন খাতির হয়ে যায়। প্রধান কারণ হয়তো আমার বই পড়ার বদভ্যাস আর তার অফুরন্ত বইয়ের সাপলাই। তবে এর পরেও তার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগতো না। একটু কড়া স্বভাবের হলেও রসিকতা বুঝতো এবং সর্বোপরি অংক বিজ্ঞানের নোটের আলাপে যেতো না।

প্রথম দফায় সে আমাকে তিনটা বই দেয়। নাম মনে নাই। বই এবং সিনেমা দেখে আমার সাধারণত নাম মনে থাকে না। অনেকটাই ওয়ানটাইম ইউজের মতো, যখন পড়ি, যখন দেখি, তখন আনন্দ পেলেই হলো, তবে বইয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকলে তো দাগিয়েই রাখি। সে মাফিক বই পড়ি আর দাগাই, এভাবে তিনটা বই-ই পড়া শেষ হয়ে যায়। তার কাছে আরো বইয়ের জন্য যাই। আগের বইগুলো ফেরত চায়। আমি বলি, সেগুলো পরে একসময় দিয়ে যাবো। এই মাইয়া আবার আমার উপ্রে দেড়হাত শেয়ান। বলে, আগে সেইগুলা ফেরত দাও, তাইলে নোতুন বই।

কী আর করা! পরের দিন জীবনে প্রথম মারতে ব্যর্থ হয়ে তিনটা বই-ই ফেরত নিয়ে যাই। বইগুলো আমার সামনেই উলটে পালটে দেখে। আমার বিরক্ত লাগে। আমারে কি সে বইয়ের ভেতরে প্রেমপত্র দেয়া উতুপুতু টাইপ লালটু ভাবছে নাকি! কিছু বলি না; বরং তার মুখের ভঙ্গিমা ফলো করতে থাকি। সেখানে অনবরত টাইটানিক মুভির মতো দৃশ্যবদল হয়। আমি ভাবি, মর জ্বালা! প্রেম পত্র না পেয়ে আবার রাগ করলো নাকি!

তিনখান বই উলটানোর পরেই সোজা চোখের দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন,
- "দাগাইছো কেন?"
- "কি দাগাইছি?" তার প্রশ্নে আমি কিছুটা তালগোল হারিয়ে ফেলি। বই দাগানোটা যে পাপ, তা ততোদিনে বুঝতে পারি নাই।
- "কি দাগাইছো, বুঝছো না? বই তো একটারও কোনো পৃষ্ঠা বাকি রাখো নাই!"

আমার মুখে আর কথা সরে না। বুঝে গেছি, কেস সিরিয়াস। 'বই চাই না, মার ঠেকাও' ফর্মূলায় কেটে পড়তে চাই। সেও ধীরে ধীরে বই তিনখানা কলেজ ব্যাগে ঢুকিয়ে আর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে চলে যায়। আমার তখন কোনো নবীরাসুল দরকার, চাঁদ না হোক, ধরণী দ্বিধা হইলেও মান রক্ষা হয়। তবে মানের যে কিছু আর অবশিষ্ট নাই, তা বেশ বুঝতে পারি। কোন কুক্ষণে যে কোনো চশমাওয়ালীর সাথে ভাব হইছিলো!

২.
এরপর থেকেই তাকে এড়িয়ে চলি। ক্লাস শুরুর পরে গিয়ে পেছনের বেঞ্চিতে বসি; আবার ক্লাস শেষের সাথে সাথেই বের হয়ে যাই। ফ্রেন্ডদের সাথে মেলামেশা কমিয়ে দেই। অপমান জিনিসটা আমার ধাতে সয় না। তারওপর নিজের নির্বুদ্ধিতায় অর্জিত অপমানের দায় আরেকজনকে দিয়েও মুক্তি পাওয়া যায় না। মনে মনে সাতপাঁচ ভাবি। চশমাওয়ালী আরেকটু উদার হলে কি হতো, তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করি। কিন্তু অন্যের উদারতার ওপরে আমার হাত নাই আর টেকনিক্যালি যে সে-ই কারেক্ট এটা বুঝতেও সমস্যা হয় না। সুতরাং মোটামুটি একটা দমবন্ধ পরিবেশে নিজের সাথেই নিজের যুদ্ধ চলে।

এরমধ্যে শুধু একবার তার সামনে পড়তে গিয়েছিলাম। দোতলায় উঠবো, মাত্র সিঁড়ির গোঁড়ায়, দেখি সে ওপর থেকে নামছে। আমি আর উঠি না, তড়িঘড়ি অন্যদিকে চলে যাই। সে দেখেছে টের পাই, তবে বাড়তি কোনো আগ্রহ দেখায় নি। চশমাওয়ালীরা তো এমনই হয়!

তবে ধরা একদিন ঠিকই খাই। যথারীতি ব্যাক বেঞ্চিতে বসতে গিয়ে দেখি ফার্স্ট বেঞ্চির মাল লাস্ট বেঞ্চিতে। আমারে শুধু চুপচাপ বলে, ক্লাস শেষের পরে কথা আছে। আমি ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারি না। এক খুনে আবার দুই ফাঁসি হবে কিনা, সেই আতঙ্কে আছি। সেরকমটা হলে ছেড়ে কথা বলবো না ভেবে নিজেকে মোটিভেট করার চেষ্টা করি; কিন্তু মিইয়ে যাওয়া ভাবটা কিছুতেই দূর করতে পারি না।

ক্লাস শেষে দুজনেই বাইরে যাই। একটু নিরিবিলি একপাশে গিয়ে হেসে বলে,
- "আমাকে ভয় পাও কেন? আমি কি হালুম?"
- "না, না, ভয় পাবো কেন!" আমতা আমতা করি। হাসির জবাবে একটু হাসতে চেষ্টা করি হয়তো। কিন্তু আমার তাললয় ঠিক থাকে না। এমনিতেই এমন ব্যবহার আশা না করায় কিছুটা হকচকিয়ে গেছে, তারপরে তার এমন হাসিতে আমার পুরা চন্দ্রাহত অবস্থা।

সে বেশি কথা বাড়ায় না। ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে। তারপরে হাতে দিয়ে বলে, "নাও, এটায় যতো ইচ্ছা দাগ দিও!"

৩.
এই বইটার নামও আমার মনে নাই।


মন্তব্য

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

এই বইটার নামও আমার মনে নাই।

হো হো হো

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

হো হো হো

কার লেখা বই ছিল, সেটা মনে আছে? দেঁতো হাসি

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হুমায়ূন কাকু হইতারে। দেঁতো হাসি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

স্নিগ্ধা এর ছবি

এই বইটার নামও আমার মনে নাই।

ছিহ্‌!!!! দিক্কার দিতে দিতে গলা চিড়ে গেল!

অমুক সাবজেক্টের নোট, আর তমুক সাবজেক্টের স্যারের কথা বলে কি বলে না এই নিয়ে এত্তো মাথা ঘামালেন যে আসলে কী বললো সেইটাই বুঝলেন না - আপনার বই পড়া ব্যান করে দেয়া উচিত! (হতাশার ইমো)

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হে হে, এই জন্যই এখন আর বই পড়ি না। তবে আসলে যে কি বললো, সেইটা আসলেই বুঝি নাই। (ডাবল হতাশার ইমো)

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

তানবীরা এর ছবি

সে দেখেছে টের পাই, তবে বাড়তি কোনো আগ্রহ দেখায় নি। চশমাওয়ালীরা তো এমনই হয়!

হুমম ছিলারে বলবো লেন্স বাদ দিয়া চশমা পরতে।
আজকাল সচলে বাল্যকালের প্রেম রিভিউ মৌসুম দেখছি, ভালু ভালু

**************************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

উরে, না রে!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সৌরভ এর ছবি

হাহা। মনে রাখার কী দরকার?
অনেকদিন পরে রঙিলা পড়লাম।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

গত কয়েক মাসে কয়েকটা পোস্ট লেখা শুরু করে আর শেষ করতে পারি নাই। টানা দেড় ঘন্টার মিটিং শেষ করে, যেখানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমিই বক্তা, ভাবলাম একটা রঙিলাই লিখি। সচলের সাম্প্রতিক পাত্রীকর্তৃক বই দেয়ার ঘটনা থেকে কপিকাট করে মেরে দিলাম। তা ও মাঝপথে একবার মনে হলো, লিখতে ভাল্লাগছে না। কোনোমতে শর্টকাটে শেষ।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

স্বপ্নহারা এর ছবি

বইয়ের নাম মনে রাখার কি দরকার...যে দিছে তারেতো ঠিকই মনে রাখছেন...দেঁতো হাসি
ভাল্লাগছে...হাসি

-------------------------------------------------------------
স্বপ্ন দিয়ে জীবন গড়া, কেড়ে নিলে যাব মারা!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হ, সে হালকার ওপরে ঝাপসা একটা আঁচড় দিয়া গেছিলো। চোখ টিপি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আমার ক্লাসমেট এক চশমাওয়ালীরে ছুটোবেলায় কী যে ভালো পাইতাম!! মঞ্চাইতো বিয়া কইরালাই... আফসুস- আমি আপনার মত সাহস কইর‌্যা তার কাসে বই চাইতারিনাই।
... আজকাল প্রায়ই তার লগে ফেসবুকে চ্যাট করি- আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি...
ইশশশ...

---------------------------------------------------------------------------

মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক

বর্ষা এর ছবি

'প্রথম টীচার হিসেবে মা আমারে যেমন কইরা পিটানি দিছে, পাল বংশের মহাপালেরাও তার কাছে নস্যি। '---সবাই মনে হয় তাই খাইসে।।।।এইটা সত্যি কাহিনি না কি জানিনা।।।।আমার এরপর কি হইলো জানতে ইচ্ছা করতেছে।

********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।

********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।