অনির্দিষ্টকালের তত্ত্বাবধায়ক: সুশীল-অসুশীল ভাবনা

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৩/০৮/২০০৭ - ২:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(বিশাল সাইজ দেইখা ঘাবড়াইয়েন না। পার্ট বাই পার্ট পড়লেও চলবো। হাসি

আমি রাজনীতি অজ্ঞ। অতএব, এটা শুধু একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার প্রশ্ন, আমার উত্তর, আমার অনুভূতি। তথ্য বা তত্ত্বের ভুল থাকলে ধরিয়ে দিবেন, সানন্দে আপডেট করে দিবো।)

১.

কম্পুটারের সামনে বসি প্রতিদিন। আছে ইন্টারনেট। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের তুলনায় আমি নিশ্চয়ই সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীকে রিপ্রেজেন্ট করি। উন্নত বিশ্বের আধুনিক সুবিধা ভোগ করি, খালি পায়ে বাইরে বেরোনোর চিন্তা করতে পারি না, ভিতরে যতই চাপা আক্রোশ থাক কাউকে খোলা ময়দানে চুদির ভাই বলতে পারি না, আমি নিশ্চয়ই সুশীল সমাজের প্রতিনিধি।

এই সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হয়ে আমি বুঝতে পারি না, কানসাটের ওই হাঁড় জিরজিরে কৃষকেরা কেন অকাতরে জীবন দিয়ে দেয়। আরে বাপ, ইলেকট্রিসিটি যখন আসে নি, তখনও তো চলতে পেরেছিস। এখনও চালিয়ে নে। এই সামান্য জিনিসের জন্য জীবন দেয়া কেন? আমি বুঝতে পারি না, হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসা একটি সংগ্রামী ছেলে যার টিউশনির টাকায় শুধু নিজের পড়াশুনোর খরচ নয়, চলে গোটা সংসার, সে কেন এইসব মিটিং মিছিল করবে, কেন সেনা পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়ে দাড়াবে? আরে বাপ! তুই গরীব ঘরের পোলা। পড়াশুনা শেষ করে একটা চাকরি বাগিয়ে সুখে-শান্তিতে ঘরসংসার কর। তা না! খালি ঝামেলা পাকাতে চাস। আমি আরও বুঝতে পারি না, দিন এনে দিন খাওয়া একজন রিক্সাচালক যার ঘরে জ্বরে কাতরায় ক্ষুধার্ত শিশুটি, সেও কেন মিছিলে শরীক হয়ে শ্লোগান দেয় সরকারের বিরুদ্ধে। আরে বাপ, সরকার অনেক বড় জিনিস। তোর জায়গায় তুই থাক!

আমি বুঝতে পারি না, আমি পৌঁছতে পারি না ওই মানুষগুলোর লেভেলে, সুশীলত্বের নিরাপদ আবহে বসে কেবল নাক সিঁটকাই, মানুষগুলো কত বোকা! অবশ্য ওদেরকে মানুষই বা বলে কে! জানোয়ারের সাথে এই হিংস্র আদমসন্তানগুলোর পার্থক্যটা তো আমার তেমন চোখে পড়ে না!

২.

স্বাধীনতা এসেছিলো। তারপর একের পর এক সরকার এসেছে। কেউই দেশের জন্য কিছু করে নি। গণতন্ত্র একটা অছ্যুৎ ব্যাপার হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের মুন্ডুপাত করি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো দারুণ কাজ করছে। ৩৬ বছরে যে আগাছা জন্মেছে, তা একে একে উপড়ে ফেলছে। সবচেয়ে ভালো হয় সেনাবাহিনী এবার দয়া করে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে আসলে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গৌরব। তারা নিশ্চয়ই দেশের স্বার্থে কাজ করবে, দেশকে সুখে-শান্তিতে ভরে দিবে। সবচেয়ে বড় কাজ হবে ওই হাঁড় জিরজিরে হাফ জানোয়ারদেরকে শৃঙ্খলা শেখানো।

ওরা আবার প্রশ্ন করে গণতন্ত্র নিয়ে। প্রশ্ন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে। প্রশ্ন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন ৯০ দিনের কথা বলে এখন হরিচরি শুরু করেছে? আরে বেটা, তোরা বুঝোসটা কি? পারলে উত্তর দে:

ক) তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে নির্বাচন দিবো, সেই নির্বাচন করতে একটা ভোটার লিস্ট লাগবো। তোদের গণতান্ত্রিক সরকার তো ভোটার লিস্টের বারোটা বাজিয়ে রেখে গেছে। সেই ভোটার লিস্ট কি তিন মাসে সম্ভব?

খ) গণতন্ত্র তোদেরকে এতদিনে কি দিয়েছে? হাসিনা খালেদা সব শালী খারাপ। অতএব গণতন্ত্র খারাপ। তোরা গণতন্ত্রের উপযুক্ত আগে হ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা সেনাবাহিনী আগে তোদেরকে গণতন্ত্রের উপযুক্ত করুক, তারপরে গণতন্ত্র নিয়া চিল্লাস।

গ) এই যে ছাত্রদের নামে আন্দোলন চলছে, এতে তো ওই পঁচা পলিটিশিয়ানদের সুবিধা। ছাত্ররা কেন তাদের হয়ে কাজ করছে?

ঘ) বিকল্প অপশন কি?

ঙ) তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো একটা ডেডলাইন দিয়েছে। তারা ডিসেম্বর ২০০৮ এর মধ্যে নির্বাচন দিবে। এখনই এটা নিয়ে হৈচৈ করিস কেন? ওয়েট কর। ২০০৮ এর ডিসেম্বর যাক, তারপরে কথা বলিস।

৩.

আরো প্রশ্ন করার আগেই কে যেন আমাকে ধাক্কা মারে। জোরে। একদল প্রতিবাদী মানুষের মিছিলের মাঝখানে এসে পড়ি। পুলিশের টিয়ার গ্যাসে চোখ অবসন্ন; কিন্তু ওই টিয়ারগ্যাসের প্রভাবই হবে হয়তো, চেতনা যেন একটু একটু করে একটি নতুন জগতকে আমার সামনে নিয়ে আসে। এইসব খেটে খাওয়া মানুষের কাতারে আসার যে চেষ্টাটা এতদিন করে ব্যর্থ হয়েছি, এক ধাক্কায়ই যেন এসে যাই সেই কাতারে। এদেরকে তখন আর জানোয়ার মনে হয় না। এদের ভিতরটা যে আমার চাইতে অনেক বেশি পবিত্র। নিজের করা সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরও এক এক করে নিজের কাছেই ফিরে আসতে থাকে।

ক) নির্বাচন করতে যে সময় লাগে, সেটা হিসেব করেই তো ৯০ দিন ঠিক করা হয়েছিলো। আচ্ছা, এবার নতুন যোগ হল বিশুদ্ধ ভোটার লিস্ট। একটা ভোটার লিস্ট করতে কতদিন লাগে? ২ বছর? অনির্দিষ্টকাল? ভোটার লিস্ট করার স্টেপগুলো কি কি? কারা লিস্ট করবে, তাদেরকে নিয়োগ দেয়া। এটা দিতে কতদিন লাগে? এরা একটা এলাকায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে। একটা এলাকা চক্কর দিতে কতদিন লাগে? সেই র তথ্যগুলো স্ট্যান্ডার্ডাইজড করতে হবে। আচ্ছা, এটা করতে কতদিন লাগে? নাহ! ২ বছরের হিসেব মিলছে না। এটা করতে তো খুব বেশি হলে ২ মাস লাগবে। তার বেশি না।

খ) হাসিনা-খালেদা খারাপ; হ, শালীরা খারাপই। এই পয়েন্টে সুশীলদের সাথে আমারও তেমন কোন পার্থক্য নাই। কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক দলগুলোর উৎপত্তি লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে কে কতোটা গণতান্ত্রিক। খালকাটা শহীদ জিয়া? উহু, উনি সামরিক মাল। বিএনপির উৎপত্তি ক্যান্টনমেন্টে, জনগণে না। এরশাদ? হে হে। উনি তো এক দশক একাই নিয়ে নিয়েছেন। নারীলিপ্সুতা ডমিনেট না করলে উনার জাতীয় পার্টিও আজ অনেক বেশি শক্তিশালী থাকতো। জামাত? ওরা কারা। আচ্ছা, বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিলো, তারাই তো। ওরা বাংলাদেশে কি করে? ওরা বাংলাদেশে কিছু করে না, বাংলাদেশকে করে। ওদেরকে এই করার সুযোগটা কে দিয়েছিলেন? হুম। আমাদের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেব। উনি স্বাধীনতার ঘোষকও ছিলেন। নাহ মিয়া, আপনে সব গুবলেট পাকাচ্ছেন। বুঝা যায়, আপনি আওয়ামী লীগের দালাল। স্টেরিওটাইপড কইরা দিলেন? আওয়ামী লীগও আইতাছে। বাংলাদেশের বড় দলগুলোর একমাত্র আওয়ামী লীগই জনগণের মাঝ থেকে উঠে আসা। কিন্তু তাতে কি সাত খুন মাফ হয়ে যায়? না। মাফ হয়ে যায় না বাকশালী গণতন্ত্রের অপতন্ত্র। মাফ হয়ে যায় না শেখ হাসিনার অযোগ্য শাসন, স্বজনপ্রীতি এবং বিরোধীদের প্রতি অত্যাচার।

তাহলে? তাহলে তো সুশীলদের কথাই ঠিক। গণতন্ত্রই খারাপ। ৩৬ বছর........রাখেন মিয়া ৩৬ বছর! এরশাদ-জিয়াদের সামরিক শাসনও কি গণতন্ত্র? ওটা বাদ দেন। দেখবেন, ৩৬ বছরের কত বছর থাকে গণতন্ত্রের জন্য। আর এই সময়টায় কতবার গণতন্ত্রকে পলিউট করা হয়েছে সামরিক শাসন দ্বারা! জনগণ ভুল লোককে সিলেক্ট করবে; কিন্তু একসময় তারা নিজেরাই সেই ভুলকে সংশোধন করবে। জনগণের ভাগ্য জনগণের ওপর ছেড়ে দিন। বারবার আর্মি দিয়ে তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করা হলে জনগণের দোষ কেন? গণতন্ত্রের দোষ কেন? নাকি আর্মিই সমস্ত সমাধান করে দিবে, চোখ বন্ধ করে সেটা মেনে নিতে হবে? তাহলে তো আর্মির হাঁটুতে আপনার মাথাটা বন্ধক রেখে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো উচিত।

গ) এইবার মোক্ষম যুক্তি আপনার। এইসব ছাত্র আর খেটে খাওয়া মানুষেরাই পলিটিশিয়ানদেরকে সুবিধা দিচ্ছে। আহা, অপূর্ব! সুশীল মাথাও কি হাঁটুতে থাকে ভাই? কারা করাপ্ট পলিটিশিয়ানদের সুবিধা করে দেয়? কারা তাদেরকে বীর বানিয়ে দেয়? হ্যা, আপনার পেয়ারের সামরিক লোকজনই। স্বৈরাচারের অত্যাচারে অতিষ্ট মানুষ তখন পঁচে যাওয়া হাসিনা-খালেদাকেই তুলনামূলক ভালো ভাবতে শুরু করে। অথচ এই মানুষগুলো আজ হোক, কাল হোক ঠিকই করাপ্টেড পলিটিশিয়ানদের রিজেক্ট করতো। ১০ বছর সামরিক কুশাসনের পর হাসিনা-খালেদারা আবার জনগণের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের সমর্থন নিয়ে আবারো সরকার করবে।

ঘ) বিকল্প অপশন কি? হ্যা, এটা সুশীলদের খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তাদের ধারণা, বিকল্প অপশন নেই। অতএব, আর্মি। হাসিনা-খালেদা খারাপ। অতএব, তত্ত্বাবধায়ক জামাই। তারা যতদিন ইচ্ছা ক্ষমতায় থাক। আচ্ছা বিকল্প অপশন নেই বা আসবে না, আপনাকে কে বললো? ডঃ ইউনুস তো প্রায় এসে গিয়েছিলেন। তার কথা কে ধারণা করেছিলো? দেশে কি আর কোন মানুষও নেই, যারা জনগণের জন্য একটি বিকল্প ডাইমেনশন নিয়ে আসতে পারতো? আপনি আগে থেকে কিভাবে বলেন? আর্মি ব্যাকড তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমস্ত রাজনৈতিক অ্যাকটিভিটি ব্যান করে কি জনগণের জন্য কারো এগিয়ে আসাটাকেই ব্যাহত করছে না?

আচ্ছা, বিকল্প অপশন থাকুক, না থাকুক, অনির্বাচিত একটি সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আমরা কেন মেনে নিবো? জনগণের সমস্যা জনগণকে সমাধান করতে দিন। তারা ভুল করলে তারা পস্তাবে, ভুল থেকে শিখতে শিখতে একসময়ই ঠিকই সঠিক লোককে নির্বাচিত করবে। তাদের সমস্যা তারাই সমাধান করুক। জনগণকে ভোদাই মনে করা কোন সুশীল জনগণের জন্য কেন ভালো করবে? যে শাসনে জনগণের মতামতের কোনো মূল্য নেই, এমনকি মতপ্রকাশটাও দাবিয়ে রাখা হবে, অপরাধ বলে গণ্য হবে, সে শাসন জনগণ কেন মেনে নিবে?

ঙ) তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ২০০৮ ডিসেম্বরের ডেডলাইন দেওয়ার দায়িত্বটা কে দিলো? জনগণ দিয়েছে? ৯০ দিনের কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা বললো, নাহ! ৯০ দিনে হবে না। ২ বছর আমাদেরকে শান্তিতে থাকতে দাও বাপু, ২ বছর পরে এসে একবার খবর নিয়ে যেও। সুশীল চক্ষু কি এতই অন্ধ যে, তাদের এই স্পষ্ট প্রতারণাও কারো চোখে পড়ে না?


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি


.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

বদ্দা কইলো ৫, রেটিং দেখায় ১। বদ্দারে আইজ খাইছি!!!!!!!!!!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

অছ্যুৎ বলাই লিখেছেন:
বদ্দা কইলো ৫, রেটিং দেখায় ১। বদ্দারে আইজ খাইছি!!!!!!!!!!

বদ্দা, আপনি এইটা কী করলেন?

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

দুঃখ কইরেন না, পোষায় দিলাম।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

৫ই তো দিলাম!
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

অমিত আহমেদ এর ছবি
অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

৫ দেন আর ১ দেন, কোনো আপত্তি নাই। হাসি
তয় ১ দিলে কোথায় ভুল বইলা দিবেন, নাইলে বুঝুম কেমনে?

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

ভাস্কর এর ছবি

এই পোস্ট ১ কেনো! সুমন চৌ জবাব চাই!


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

সাধক শঙ্কু এর ছবি

১ দিছে ক্যাঠা?


গড়ি দালানকোঠা ফেলে দিয়ে শ্মশাণে বৈঠকখানা

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

১ কুনু পরোবলেম না। হাসি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।