সসেমিরা, শব্দের উৎস

গেছোদাদা এর ছবি
লিখেছেন গেছোদাদা (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৬/০৪/২০১৭ - ৬:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'সসেমিরা' একটি বিশেষ্য পদ যার অর্থ সঙ্কটজনক অবস্থা অথবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। শব্দটি কালিদাসের 'দ্বাত্রিংশৎ-পুত্তলিকা' আখ্যানকাব্যে বর্ণিত চারটি শ্লোকের প্রত্যেকটির আদ্যাক্ষরের সমষ্টি।

রাজা বিক্রমাদিত্যের বত্রিশ সিংহাসন এবং ভোজরাজাকে নিয়ে মহাকবি কালিদাস রচিত ‘দ্বাত্রিংশৎ-পুত্তলিকা’র এক গল্পে রাজপুত্র জয়পাল বিপদে আশ্রয়দাতা ভাল্লুকের ক্ষতি করতে গেলে ভাল্লুক টের পেয়ে জয়পালকে অভিশাপে পিশাচ করে দেয় আর বাকশক্তি হরণ করে শুধুই ‘সসেমিরা’ শব্দটি উচ্চারণ করার শাপ দেয়। এরপর রাজপুত্রের এই অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের জন্য চারটি শ্লোক পাঠ করা হয় যাতে রাজপুত্রের মুখ থেকে এক এক করে স-সে-মি-রা চলে গিয়ে শাপমুক্তি ঘটে। বত্রিশ সিংহাশন অথবা বত্রিশ পুতুলের গল্প আগে অনেকবার পড়া হলেও, এই সসেমিরার শ্লোকগুলি জানা ছিল না। শ্লোকগুলোর মূল সংস্কৃত রূপগুলো খুঁজছিলাম অনেকদিন ধরেই। অবশেষে ইন্টেরনেটেই মূল সংস্কৃত এবং অনুবাদ একসাথে পেয়ে গেলাম। আগ্রহী পাঠকদের জন্য নীচে শ্লোকগুলো এবং অর্থ সংযুক্ত করা হলো -

সদ্ভাবপ্রতিপন্নানাং বঞ্চনে কা বিদগ্ধতা। অঙ্কমারুহ্য সুপ্তানাং হন্তুঃ কিং নাম পৌরুষম্‌।।

অর্থাৎ, সদ্ভাবে সম্মিলিত সুহৃদব্যক্তিকে বঞ্চনা করিয়া কি নৈপুণ্য প্রকাশ হইয়াছে ? যে ক্রোড়ে আরোহণ করিয়া প্রসুপ্ত আছ, তাহাকে বধ করিলে কি পৌরুষলাভ হইতে পারে?

সে

সেতুং গত্বা সমুদ্রস্য গঙ্গাসাগরসঙ্গমম্‌। ব্রহ্মহত্যা প্রমুচ্যেত মিত্রদ্রোহী ন মুচ্যতে।।

অর্থাৎ, সমুদ্রের সেতু অর্থাৎ সেতুবন্ধ রামেশ্বর ও গঙ্গাসাগর-সঙ্গমে গমন করিলে ব্রহ্মহত্যা-পাপ দূরীভূত হয়, কিন্তু মিত্রদ্রোহী ব্যক্তি কোথাও মুক্তিলাভ করিতে পারে না।

মি

মিত্রদ্রোহী কৃতঘ্নশ্চ যশ্চ বিশ্বাসঘাতকঃ। ত্রয়স্তে নরকং যান্তি যাবদাহূতসংপ্লবম্‌।।

অর্থাৎ, মিত্রদ্রোহী, কৃতঘ্ন ও বিশ্বাসঘাতক এই তিন ব্যক্তি প্রলয়কাল পর্যন্ত নরকে বাস করিয়া থাকে।

রা

রাজন্‌! তব চ পুত্রস্য যদি কল্যাণমিচ্ছসি। দেহি দানং দ্বিজাতিভ্যো দেবতারাধনং কুরু।।

অর্থাৎ, রাজন্‌! আপনি যদি নিজ পুত্রের কল্যাণকামনা করেন, তবে দ্বিজগণকে দান ও দেবতাদিগের আরাধনা করুন।

পাদটীকা


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

এরকম সংক্ষেপ করার চল একই সময়ে ল্যাটিন ভাষাগুলোতে ছিল?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

এরকম সংক্ষেপ করার চল একসময় বাংলা ভাষায়ও ছিল- লেজেহোমো। দেঁতো হাসি

হাসিব এর ছবি

সেটা তো সাম্প্রতিক উদাহরণ হল। ৮০০ বা ১০০০ বছর আগে এখানে সংক্ষেপ করার চল ছিলও এটা জানলাম এই পোস্ট পড়ে। আমার কথা হল ইউরোপেও কী এই জিনিস ছিল সমসাময়িককালে?

হাসিব এর ছবি

আরেকটা বিষয়। অনেকেই দেখি এই সসেমিরার কথা জানে। অথচ আমি জানলাম এই পোস্টে এসে। বোকা বোকা লাগছে নিজেকে।

এক লহমা এর ছবি

(১) কতকাল বাদে যে কেউ সসেমিরা কথাটা তুলে আনলেন! এইসব প্রাপ্তির জন্যও ত সচলায়তনে আসা! কেউ কিছু লেখেনা কেন? গেল কোথায় সব?
(২) আসল কথা শেষে ছিল, সেইটে কিছু দামি - "দ্বিজগণকে দান ও দেবতাদিগের আরাধনা করুন" গড়াগড়ি দিয়া হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মন মাঝি এর ছবি

কেউ কিছু লেখেনা কেন? গেল কোথায় সব?

গুড কোয়েশ্চেন! হাসি

আমার ধারণা ঘরের খেয়ে বনে মোষ পর্যন্ত তাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু ড্রাগন না! বনে এখন ড্রাগন এসেছে, তাই আয়নাদিদির ভাষায় "দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া। কেউ শোনে না কারো কড়া নাড়া।" ড্রাগনের বিষ নিশ্বাসের হলকায় কারও দেহ গেছে, বাকিদের মনে হয় সেই আঁচে মন গেছে।

রূপকথার জীব যখন বাস্তব জীবনে হামলে পড়ে, কিম্বা অচেনা বাস্তবতা যখন রূপকথার বুদবুদ বা আশার ভ্রান্তিবিলাস ভেঙে খানখান করে দেয় - অনেকের মনোজগতে তখন মনে হয় একধরণের প্যারাডাইম শিফট ঘটে যায়, যার থেকে সৃষ্টি হয় কনফিউশন, প্যারালিসিস আর আত্নসংকোচন। এক কথায় সসেমিরা-দশা!!!

তাছাড়া, 'বুড়োরা' যারা আগে লিখতেন আর নিদেনপক্ষে বনের মোষটা অন্তত তাড়াতেন, তারা একেবারেই 'বুড়িয়ে' গেছেন এখন। সংসারধর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করছেন। অন্য কিছুতে সময়, শক্তি বা উৎসাহ পান না। আর এযুগের 'নতুন'রা অনেক ইশ্মার্ট, বনের মোষ তাড়ানোর গাধামিতে তারা গোড়া থেকেই অনাগ্রহী। তাঁরা নিজেদের নিয়ে থাকতেই বেশি ভালবাসেন।

আমাদের সসেমিরামুক্তির মন্ত্র কি হবে, কোথায় পাবো, কবে পাবো, আদৌ পাবো কিনা - জানি না। আনটিল দেন, স্টে টিউন্ড অর টিউন আউট। ইয়োর চয়েস। হাসি
হাসি

****************************************

মেঘলা মানুষ এর ছবি

গেল কোথায় সব?

জানতে হলে বাউন্টি হান্টার ভাড়া করতে হবে মনে হয় শয়তানী হাসি

মন মাঝি এর ছবি

আমার উপ্রের কমেন্টের লাস্ট দেড় লাইনে ঘ্যাচাং! হাসি

****************************************

সত্যপীর এর ছবি

চমৎকার!

দ্বিজগণকে দান করার ঘটনা বুঝায় কন। দ্বিজগণটা কে?

..................................................................
#Banshibir.

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

দ্বিজগণটা কে?

এহেন মূর্খতার অপরাধে আপনার রৌরব নরকবাসের সমূহ সম্ভাবনা আছে। যিনি দুইবার জন্মগ্রহণ করেন, তিনিই হলেন দ্বিজ। সে হিসাবে বাংলাদেশের প্রায় সকল বিদ্যালয়গামী মানুষই হলেন দ্বিজ, কারন একবার তাঁদের জন্ম আঁতুড় ঘরে, পুনর্বার তাঁদের জন্ম বিদ্যালয়ে। এ দেশে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কোন কোন মহীয়সী নারী চার পাঁচ সাত বার পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন বলিয়া জানা যায়। পরিতাপের বিষয়, তাঁহাদের কী নামে ভূষিত করা উচিৎ, বৈদিক কিংবা পৌরাণিক, সকল পণ্ডিতগনই সে বিষয়ে বিশেষ নীরবতা পালন করিয়া গিয়াছেন।

আরও এক শ্রেণীর মানুষও দ্বিজ বলিয়া পরিগণিত হয়েন। মাতৃগর্ভ থেকে নিষ্ক্রমণের সময় একবার এবং উপনয়নের সময় নবজন্ম লাভ করেন বলিয়া ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য জাতির পুরুষসকলও দ্বিজগণ বলিয়া পরিগণিত হইবার অধিকার ধারন করেন।

তবে দানধ্যানের ব্যাপার যখন আসে, তখন দ্বিজ টাইটেলটা সাধারণত ব্রাহ্মণদের অধিকারেই চলিয়া যায়।

সত্যপীর এর ছবি

ভেম হইয়া গেছে। মাপ কইরা দেন।

আপনের শেষ লাইনটাই আসল কথা।

..................................................................
#Banshibir.

নীড় সন্ধানী এর ছবি

মিত্রদ্রোহী, কৃতঘ্ন ও বিশ্বাসঘাতক এই তিন ব্যক্তি প্রলয়কাল পর্যন্ত নরকে বাস করিয়া থাকে

স-সে-মি-রা শব্দটির এই ব্যাখ্যাটা জানা ছিল না। পড়ে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ সসেমিরা উৎপাদনে বিশ্বরেকর্ড নিয়া বসে আছে বহুকাল যাবত। আনাচে কানাচে সসেমিরা গুণীজনেরা আলোকিত করে যাচ্ছে দেশের আকাশ বাতাস। শুদ্ধতার জন্য এখন প্রলয়কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এবং তারপর নিশ্চিত নরকবাস।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

মনটাই খারাপ হয়ে গেলো এই লেখাটি দেখে। বত্রিশ পুতুলের গল্প পড়েছি কম করে হলেও বত্রিশ বছর আগে। এতো সব এটা সেটার ভিড়ে আজকের কিশোর কি আর এসব নিয়ে মাথা ঘামায়! হয়তো পড়ে, হয়তো না। হয়তো রয়ে গিয়েছে আমার মতো মাঝবয়সীদের স্মৃতিতেই। গেছোদাদাকে অনেক ধন্যবাদ, আরেকবার পুরনো সব গল্পকথা পড়ার আগ্রহটা জাগিয়ে দিলেন।

--মোখলেস হোসেন

দেবদ্যুতি এর ছবি

বাহ্! ছোটবেলায় সসেমিরা নিয়ে গল্প শুনেছিলাম। এই ব্যাখ্যাটা সুন্দর- শ্লোকগুলো পছন্দ হয়েছে।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

সোহেল ইমাম এর ছবি

জানতামনা, জেনে ভালো লাগলো। কত কিছুই যে জানা হয়নি এখনো।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

আয়নামতি এর ছবি

দারুণ!

এক. সসেমিরা শব্দের উৎস সম্পর্কে জানা ছিল না। জানলেম।

দুই. সচলে টারজানের বাংলা ভার্সন ভাই আছেন সেইটেও জানা ছিল না। জানলেম।

উত্তর তো পাবো না, কাজেই সেটি করে শক্তিক্ষয়ে গেলেম না আর দেঁতো হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।