কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পথে: অভিজ্ঞতার অবৈজ্ঞানিকতা

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি
লিখেছেন ধ্রুব বর্ণন (তারিখ: শনি, ১০/০৩/২০১২ - ৫:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটা খুব প্রাচীন প্রশ্ন হচ্ছে, মন কি বিজ্ঞান দিয়ে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব? এই ধরনের প্রশ্ন পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যতোটা সন্দেহ নিয়ে করা হয়, তার চেয়ে বেশি সন্দেহ নিয়ে করা হয় মনোবিজ্ঞান, নিউরোবিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে। এর কারণ যতোটা না মনের জটিলতা, মানুষের আচরণের জটিলতা, তার চেয়ে অনেক বড় কারণ হলো মানুষের ব্যক্তিক, প্রথম পুরুষের দিক থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা। একটা সিস্টেম জটিল হবার অর্থ এই নয় যে সেটা বিজ্ঞানসাধ্য নয়। কিন্তু মানুষের প্রথম পুরুষগত অভিজ্ঞতাটি জটিলতার চেয়েও বেশি কিছু। এর সাথে পর্যবেক্ষণসাধ্যতা ও পুনরুৎপাদনযোগ্যতার প্রশ্ন জড়িত, যেগুলো বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি। মানুষের ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার প্রকৃতিটাই এমন, যার সাথে বৈজ্ঞানিকতার অসঙ্গতি আছে।

আমাদের যে ব্যক্তিক প্রথম পুরুষের অভিজ্ঞতা-অনুভূতি, এটা কি সম্পূর্ণ ভৌত ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে প্রকাশযোগ্য? ঠিক কোন বস্তুটি রাগকে ধারণ করে? হয়তো রাগ করলে একটা নির্দিষ্ট শারীরীক প্যাটার্ন দেখা যায়, রক্তচাপে, হৃদস্পন্দনে ও মস্তিষ্কে নিউরনের সঞ্চালনে। কিন্তু সেটা কি হুবহু একটা প্রথম পুরুষের যে রাগের অনুভূতি, সেটাকে প্রকাশ করে? যদি তাই করে, তার মানে এই দাঁড়ায় যে আমার শরীরের হুবহু একই অনু পরমাণুর সজ্জা দিয়ে গঠিত আরেকটি শরীরে যদি হুবহু ওই একই শারীরীক প্যাটার্ন তৈরি করা যায়, তাহলে আসলে আমি নিজে রাগ বোধ করবো। কিন্তু ভিন্ন একটি শরীর, যেটা হুবহু আমার কপি, যার প্যাটার্নও আমার রাগান্বিত অবস্থার প্যাটার্নের কপি, তার ওই প্যাটার্নের কারণে কি আমি রাগান্বিত বোধ আসলে করবো? হয়তো বলা হবে যে না, সেক্ষেত্রে ওই শরীরধারীজন তখন রাগান্বিত বোধ করবে। কিন্তু তার মানে হলো আমার রাগ করার প্রথম পুরুষ থেকে প্রাপ্ত অনুভূতিটা পুরনুৎপাদনযোগ্য থাকছে না। তাছাড়া, অভিজ্ঞতাটি যেহেতু একান্তই ব্যক্তিক, এটা নৈর্ব্যক্তিকভাবেও অনুভবযোগ্য বা পর্যবেক্ষণযোগ্য নয়। তার মানে প্রথম পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের অনুভূত অভিজ্ঞতাগুলো সম্পূর্ণরূপে ভৌত অস্তিত্বে প্রকাশযোগ্য নয়। এর মানে কিন্তু দাঁড়ায় যে ব্যক্তির অনুভূত একান্ত অভিজ্ঞতা বিজ্ঞানের আলোচনার বাইরেই থাকে।

এভাবে যারা ভাবেন, তারা এই অনুভূতিগুলোর নাম দেন কোয়ালিয়া। কোয়ালিয়া আমাদের অনুভূতির সেই অভিজ্ঞতাগুলো, যেগুলোর ভৌত প্রকাশ সম্ভব নয়। তা সকলে কোয়ালিয়ার ধারণাটা পছন্দ করেন না। কিন্তু তার মানে কিন্তু এই নয় যে প্রথম পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে অনুভূত অভিজ্ঞতাগুলোর কোনো সন্তোষজনক ভৌত প্রকাশের সন্ধান তারা দিতে পারেন।

তেমনটা হবারই কথা। কথাটাই তো ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা। আপনার অনুভূতি কখনোই আরেকজন নিশ্চিতভাবে অনুভব করতে পারে না। সত্যি কথা বলতে, আপনি ছাড়া আদৌ অন্য কেউ প্রথম পুরুষগত অভিজ্ঞতা অর্থে অনুভূতিশীল কিনা, সেটাও নৈর্ব্যক্তিভাবে আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না। কারণ অনুভূতি একান্তই ব্যক্তিক। বিজ্ঞান নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানে আগ্রহী। সে ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার ছায়া নিয়েও কাজ করতে পারে, যেমন আপনি রাগ করলে রক্তচাপ বেড়ে যায়, যেটা দশজনে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। কিন্তু একান্তই যে ব্যক্তিক অনুভূতি, তাকে নৈর্ব্যক্তিক করে তোলা বলতে আদৌ কী বোঝাতে পারে, সেটা পরিষ্কার নয়। ফলে নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানচর্চার হাতিয়ার বিজ্ঞান এখানে সীমাবদ্ধ। কারণ সবকিছু নৈর্ব্যক্তিক নয়। বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রকৃত অভিজ্ঞতার কিছু ছায়া প্রতিনিধি ব্যবহার করে কিছু ধারণা পেতে পারেন। কিন্তু আমার প্রথম পুরুষগত অভিজ্ঞতা যেহেতু আপনার পক্ষে পাওয়া সম্ভব না, তাই আপনি বা অন্য কেউ কখনো নিশ্চিত হতে পারেন না সেটা ঠিক কী রূপ।

এটুকু যদি সততার সাথে স্বীকার করা যায় যে সবকিছু নৈর্ব্যক্তিক নয় এবং ফলত সবকিছুকে নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানে, ভৌত কোনো অস্তিত্বে প্রকাশ করা যায় না, এরপরে কিন্তু আর হতাশার তেমন কিছু নেই। আমরা যে রঙ দেখি, সেটাও কিন্তু অন্তপ্রকৃতিগতভাবে ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা। বিজ্ঞানের কাছে রঙের কোনো মৌলিক প্রকাশ নেই। আছে ছায়া প্রকাশ। আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দিয়ে। আমরা লাল রঙ দেখলে আমাদের যে দেখাটা হয়, সেটার সম্পূর্ণকে কেবলই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাতে কিন্তু বিজ্ঞান হীন বোধ করে না যে সে সবটা করতে পারলো না। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য রঙের অনুভূতিকে ছায়াগতভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে রঙকে সম্পূর্ণ ভৌতভাবে প্রকাশ করা না গেলেও রঙের পর্যবেক্ষণযোগ্যতা ও পুনরুৎপাদনযোগ্যতার প্রয়োজনীয় জ্ঞান রঙের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যসংক্রান্ত প্রকাশে ঠিকই উপস্থিত আছে। ফলে ঠিক লাল রঙের যে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য, সেটা আপনার চোখে উপস্থাপন করলে আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে পাবো যে হ্যাঁ আপনি লাল রঙই দেখছেন। যদিও লাল রঙ বলতে আপনি সত্যি সত্যি কী যে দেখেন সেটা আপনি ছাড়া আর কারোপক্ষে নিশ্চিতভাবে জানার কিন্তু কোনো প্রকার উপায় নেই। কিন্তু বিজ্ঞান তারপরেও ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাগুলোকে নিয়ে কাজ চলার মতো প্রকাশ ঠিকই তৈরি করতে পারে।

ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্রে প্রত্যেকজন দর্শক আসলে সত্যি সত্যি কী দেখেন তাও কিন্তু প্রকৌশলী জানেন না। তিনি বড়জোর আশা করেন যে তিনি যেমনটা দেখেন অন্যরাও তেমনটাই দেখেন। অন্যদেরকে একই দৃশ্য দেখতে দিয়ে মুখের বর্ণনা শুনে একধরনের নিশ্চিতি লাভ করেন যে সম্ভবত একই অভিজ্ঞতাই দর্শকরা পাচ্ছেন। কিন্তু দৃশ্যের ও চোখের নিউরনের বিশেষ যে প্যাটার্ন থাকলে মানুষ একই অনুভূতি পাবার কথা বর্ণনা করেন, সেটা খুব নিশ্চয়তার সাথেই কিন্তু ব্যবহার করা যায়। অন্যকে অন্তত মুখে বলানো সম্ভব হয় যে তারা একই বস্তু দেখছেন। এ কারণে ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়। অন্যে কী দেখছে কখনোই বলা সম্ভব নয় নিশ্চিতভাবে কারণ দেখা একটি ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা। কিন্তু বিজ্ঞান তারপরেও কতো দৃঢ়তার সাথে বলতে পারে যে সে ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্র তৈরি করতে পারে যেটা দেখে দর্শকদের প্রায় একই রকমেরই অভিজ্ঞতা হয়। অর্থাৎ অভিজ্ঞতা ব্যক্তিক হলেও সেটার কাজের জ্ঞানগুলো পুনরুৎপাদনযোগ্যভাবে বোঝার ক্ষমতা বিজ্ঞানের আছে।

ফলে দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞান ইতোমধ্যেই দৃষ্টি-অনুভূতির মতো একটি বিষয় নিয়ে সফলতার সাথে কাজ করেছে, যেটার সাথে মানুষের প্রথম পুরুষগত অভিজ্ঞতা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। দৃষ্টিতে মানুষের প্রথম পুরুষের অভিজ্ঞতাটি প্রকৃত অর্থে কেমন, সেটার সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক বা ভৌত প্রকাশের অসম্ভাব্যতা সত্ত্বেও সেটা নিয়ে কাজের গবেষণা করতে বিজ্ঞান অতোটুকুও অসমর্থ হয় নি। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান এতোটাই সফল যে আমরা ভুলেই যাই - দৃষ্টি মূলত একটি ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা। ফলে একটা বিষয়কে ভৌতভাবে বোঝার জন্য যে ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাকে বোঝার অসম্ভাব্যতাটা কোনোই বাধা নয়, তেমন উদাহরণ আমাদের হাতে ইতোমধ্যেই আছে। আরো একটা উদাহরণ হলো উড্ডয়ন। মানুষ পাখির মতো ওড়া বলতে কী বোঝায় সেটা কখনো অনুভব না করেও উড়োজাহাজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, আবার পাখির ওড়ার সম্পূর্ণ ডাইনামিক্সটা উদ্ধার করতে সক্ষম হচ্ছে। পাখির ওড়ার ভৌত জ্ঞান অর্জনের জন্যে কিন্তু প্রথম পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে পাখির মতো উড়ে অভিজ্ঞতা নেওয়ার প্রয়োজন মোটেও পড়ে না।

তেমনি, মনের ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাটার সম্পূর্ণটাও ভৌতভাবে অপ্রকাশযোগ্য হওয়ার মানে এই নয় যে মনের ভৌত আলোচনাটা বিজ্ঞান বহির্ভূত। বরং বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে যে মনকে ভৌতভাবে পুরোপুরিই বোঝা সম্ভব। এভাবে ভাবুন যে দৃষ্টি নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীরা প্রথম কাজ করেছিলেন, তারা যদি মানুষের দৃষ্টির অভৌত, ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাকে বোঝার অসম্ভাব্যতাটা দ্বারা নিরুৎসাহিত হতেন, তাহলে কি দৃষ্টিবিজ্ঞান এতোটা এগুতো? তেমনি ভাবেই, বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মনকে বুঝতে গেলে একটা হার্ড লাইন ম্যাটারিয়ালিস্ট অবস্থান নেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সীমাটা বোঝাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর সীমাটাকে বুঝতে গেলে ঘুরে ফিরে আমার বলা সেই আগের কথাতেই চলে যেতে হয়, যে বিজ্ঞানে পর্যবেক্ষণঅসাধ্যের আলোচনা অর্থহীন

এই চিন্তাভাবনাটার উৎপত্তি মূলত একটা বহুল আলোচিত প্রশ্ন থেকে। অনেকেই জানতে চান, যদি মানুষের মতো আচরণ করা একটি রোবট তৈরি করা যায়ও, সে তো মূলত কিছু গণনাই করছে। কীভাবে বলা যাবে যে রোবটটি সত্যি সত্যি আমার মতো অনুভূতি অনুভব করছে, কেবল অনুভূতি পাবার অভিনয় করছে না। তাদের জন্য আমার প্রশ্ন, কীভাবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন যে আপনি ছাড়া অন্য কোনো মানুষও সত্যি সত্যি আপনার মতোই অনুভূতি অনুভব করছে, কেবল অনুভূতি পাবার অভিনয় করছে না?


মন্তব্য

স্বাধীন এর ছবি

তোমার মৌলিক অধিকারের উপর লেখাটা দেখি না কেন? ওটা কি নাই হয়ে গেলো?

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

অন্যত্র পোস্ট করার জন্যে সরিয়েছি।

স্বাধীন এর ছবি

সেটা কি ঠিক হলো? মন খারাপ লেখাটিতে অনেকের মন্তব্য ছিল, বেশ সুন্দর কিছু আলোচনা ছিল।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

লেখার পেছনে ব্যয়িত পরিশ্রমের অনুপাতে মূল বিষয় নিয়ে যথেষ্ট আলাপের সুযোগ না পেলে আলাপ করার সুযোগ চাওয়াটাই তো ঠিক লাগছে আমার কাছে।

কাজি মামুন এর ছবি

তেমনি, মনের ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাটার সম্পূর্ণটাও ভৌতভাবে অপ্রকাশযোগ্য হওয়ার মানে এই নয় যে মনের ভৌত আলোচনাটা বিজ্ঞান বহির্ভূত। বরং বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে যে মনকে ভৌতভাবে পুরোপুরিই বোঝা সম্ভব।

আমার প্রশ্ন হল, যা 'ভৌতভাবে অপ্রকাশযোগ্য' তাকে কি করে 'পুরোপুরি বোঝা সম্ভব'? আপনি রং নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন,

যদিও লাল রঙ বলতে আপনি সত্যি সত্যি কী যে দেখেন সেটা আপনি ছাড়া আর কারোপক্ষে নিশ্চিতভাবে জানার কিন্তু কোনো প্রকার উপায় নেই। কিন্তু বিজ্ঞান তারপরেও ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাগুলোকে নিয়ে কাজ চলার মতো প্রকাশ ঠিকই তৈরি করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, 'কাজ চলার মত প্রকাশ' আর 'পুরোপুরি বোঝা' কি এক হল? সবাই একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের রং দেখে; কিন্তু তবু রং পছন্দের ক্ষেত্রে যে তারতম্য হয়, তা তো নির্ভর করে ব্যক্তি-মূল্যায়নের উপরই।
পোস্ট বরাবরের মতই অসম্ভব চিন্তা-জাগানিয়া।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

খুব ভালো প্রশ্ন।

আমার প্রশ্ন হল, যা 'ভৌতভাবে অপ্রকাশযোগ্য' তাকে কি করে 'পুরোপুরি বোঝা সম্ভব'?

এজন্য বলেছি ভৌতভাবে পুরোপুরিই বোঝা সম্ভব। বোঝাতে চেয়েছি যে, মনের যে ভৌত প্রকাশগুলো, সেগুলোকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব। যেই অংশগুলো 'ভৌতভাবে অপ্রকাশযোগ্য', সেগুলো নিয়ে বৈজ্ঞানিক তর্ক তো অপ্রাসঙ্গিকই। তর্কটা আসলে অনেকটাই "বিজ্ঞান দিয়ে মনের গবেষণা অফলপ্রসূ, কারণ মনের একটা বড় অংশ ব্যক্তিক" এই দাবিকারীদের সাথে। প্রশ্ন হচ্ছে মানসিক অভিজ্ঞতায় ব্যক্তিক বা 'ভৌতভাবে অপ্রকাশযোগ্য' অংশ থাকার ফলে কি এটাও সম্ভব যে সে ভৌতভাবে প্রকাশযোগ্য অংশগুলোকেও দুর্বোধ্য করে দিচ্ছে। আমাদের হাতে থাকা উদাহরণগুলো বলছে যে না। বরং ভৌতভাবে প্রকাশযোগ্য অংশগুলো পুরোপুরিই বোঝা যাচ্ছে।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

প্রশ্ন হচ্ছে, 'কাজ চলার মত প্রকাশ' আর 'পুরোপুরি বোঝা' কি এক হল?

আবার, ভৌতভাবে পুরোপুরি বোঝা হলো বলাই যায়।

তবে,

সবাই একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের রং দেখে; কিন্তু তবু রং পছন্দের ক্ষেত্রে যে তারতম্য হয়, তা তো নির্ভর করে ব্যক্তি-মূল্যায়নের উপরই

এই ব্যক্তি মূল্যায়নের তারতম্যটা কিন্তু ভৌতভাবে অপ্রকাশযোগ্য না। কারণ এর ফলে মস্তিষ্কে তরঙ্গের যে পার্থক্য তৈরি হবে, সেটা পর্যবেক্ষণে ধরা পড়বে। আমি বলতে চেয়েছি যে, লাল রঙ দেখা বলতে আপনার যে অনুভূতিটা, তার সম্পূর্ণটা তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর চোখের পর্যবেক্ষণসাধ্য প্যাটার্নগুলোতে দ্রবীভূত করা সম্ভব নয়। একজন বর্ণঅন্ধ রঙ সংক্রান্ত একই তথ্যগুল জানা সত্ত্বেও কিন্তু আপনার লাল রঙ দেখার অনুভূতিটা অনুভব করতে পারবে না। অর্থাৎ প্রথম পুরুষের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণটা ভৌতভাবে প্রকাশযোগ্য না। লাল রঙ বলতে আপনি যা দেখেন, আমি ঠিক তা-ই আসলে দেখি কিনা, সেটা যাচাইযোগ্যভাবে নিশ্চিত হবার জন্যে আমার প্রথম পুরুষের অভিজ্ঞতাটা আপনার থাকতে হবে। সেটা ব্যতিরেকে আমার চোখের উপর আপতিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর মস্তিষ্কের প্যাটার্ন, ইত্যাদি থেকে আপনি বড়জোর একটা ছায়া নিশ্চয়তা পাবেন। কিন্তু আমার লাল রঙ দেখার অনুভূতিটা আপনি কীভাবে অনুভব করবেন? ব্যাপারটা ব্যক্তি মূল্যায়নের পার্থক্য থেকে ভিন্ন বিষয়। ব্যাপারটা হলো প্রথম পুরুষে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

এই ব্যক্তি মূল্যায়নের তারতম্যটা কিন্তু ভৌতভাবে অপ্রকাশযোগ্য না। কারণ এর ফলে মস্তিষ্কে তরঙ্গের যে পার্থক্য তৈরি হবে, সেটা পর্যবেক্ষণে ধরা পড়বে।

এবং ফলে ব্যক্তিমূল্যায়নের এই পার্থক্যটা ব্যাখ্যা করা বা পূর্বাভাসযোগ্যভাবে প্রকাশ করা অসম্ভব না।

মন মাঝি এর ছবি

কিন্তু আমার লাল রঙ দেখার অনুভূতিটা আপনি কীভাবে অনুভব করবেন?

এবং তারও আগে এই 'অনুভূতিটা' ঠিক কি - সেটাও একটা পূর্ণাঙ্গ ও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বা বিবরণের দাবী রাখে।

****************************************

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

নিচে আমার মন্তব্যগুলো পড়ে যদি আরেকটু স্পষ্ট না হয় বিষয়টি তাহলে আবার একটু জানান। ধন্যবাদ।

নীল রোদ্দুর এর ছবি

আমাদের যে ব্যক্তিক প্রথম পুরুষের অভিজ্ঞতা-অনুভূতি, এটা কি সম্পূর্ণ ভৌত ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে প্রকাশযোগ্য?

আমার মতে সম্ভব। এইখানে দুটো আলাদা ব্যাপারে মনোযোগ আকর্ষণ করব।
১। অভৌততা একটি ধারণা, যা আমরা (২)/অনুধাবণ করতে পারি।
২। অনুধাবণ একটি ঘটনা।

একটি ধারণা ভৌত বা অভৌত যাই হোক না কেন, একে অনুধাবণ করতে মস্তিষ্ককে কিছু কাজ করা লাগে। এই কাজটি পরিমাপযোগ্য এবং পুনউৎপাদনযোগ্য। কিভাবে? আমাদের মানব শরীরের কাজগুলো অতিমাত্রায় গাণিতিক এবং অভিযোজনযোগ্য। ধরুণ আপনি হাতে একটি ভারী বই ধরে আছেন। বইটির সঠিক ওজন কত তা ডিজিটাল অয়েট মেশিনের মত ডিজিট গুনে আপনি বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারবেন বইটি কি রকম ভারী। এইবার তারচেয়ে হালকা একটা বই আপনার হাতে দিলাম, আপনি অনুভব করবেন, এটার ওজন কম, এবারেও ডিজিট মেপে নয়, কিন্তু বুঝবেন ঠিকই। এবং মজার ব্যাপার হল, ভৌত ওজন থেকে অনুভূত ওজন অর্থাৎ ফিজিকাল সিগ্যনাল ট্রান্সডিউসড হয়ে সেন্সড সিগ্যনালে হচ্ছে, তখন সেই সেনসড সিগ্যনালকেও মাপা যায় এবং এই দুই সিগনালের মধ্যকার আন্ত সম্পর্ক নিরুপণ করা যায়। আপনি মুক্তমনায় আমার অ্যাকশন পটেনসিয়াল সম্পর্কিত লেখাটা পড়ে থাকতে পারেন, নিউরণের মধ্য দিয়ে যা যাচ্ছে তা শেষ অব্দি একটি সিগন্যালই, নিশ্চিত ভাবেই পরিমাপ যোগ্য।

এইবারে অভৌত পরিমাপক সম্পর্কে বলি, একটা ছবি, সুন্দর! আপনি সুন্দরের একটা অনুভূতি পাচ্ছেন। এমনি কিন্তু নয়। কিছু লাইন স্ট্রোক, কিছু রঙের তীব্রতা বা স্বল্পতা, কিছু আলোর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি, এই সব ভৌত ব্যাপারগুলোই শেষ অব্দি আপনাকে অনুভব করাচ্ছে, ছবিটা সুন্দর। ছবিটা যে সুন্দর, তা আপনি অনুভব করেও যদি মুখে বা আচরণে প্রকাশ না করতেন, ছবিটা সুন্দর, তবে কি আপনার সুন্দর লাগাটা মিথ্যে হয়ে যেতো। তা কিন্তু নয়। তাহলে, ছবিটা সুন্দর কিনা, তার পরিমাপক আচরণ নয়। এর পরিমাপক আপনার ব্রেইন একটিভিটি, আপনার ব্রেইনে জেনারেটেড সিগন্যাল। এই সিগনাল মাপার জন্য ইইজি, এফ এম আর আই, পিইটি অনেকরকমের টেকনোলজী মানুষের ইতিমধ্যে আছে, সেটা এখনো তার ডেভেলপমেন্টাল ফেজের চূড়ান্ত অবস্থায় পৌছায় নি।

তার মানে এই দাঁড়ায় যে আমার শরীরের হুবহু একই অনু পরমাণুর সজ্জা দিয়ে গঠিত আরেকটি শরীরে যদি হুবহু ওই একই শারীরীক প্যাটার্ন তৈরি করা যায়, তাহলে আসলে আমি নিজে রাগ বোধ করবো। কিন্তু ভিন্ন একটি শরীর, যেটা হুবহু আমার কপি, যার প্যাটার্নও আমার রাগান্বিত অবস্থার প্যাটার্নের কপি, তার ওই প্যাটার্নের কারণে কি আমি রাগান্বিত বোধ আসলে করবো? হয়তো বলা হবে যে না, সেক্ষেত্রে ওই শরীরধারীজন তখন রাগান্বিত বোধ করবে। কিন্তু তার মানে হলো আমার রাগ করার প্রথম পুরুষ থেকে প্রাপ্ত অনুভূতিটা পুরনুৎপাদনযোগ্য থাকছে না

অনুভূতি পুরউৎপাদন যোগ্য। একই মলিকুল, একই জেনেটিক সিকোয়েন্স, একই ডেভেলপমেন্টাল ফেজ, একই পরিবেশে আরেকটি শরীর তৈরী করুন, এবং তাকে একই ফিজিক্যাল সিগনাল দিন, সেই আরেকটি শরীর আপনার অনুরূপ একই রকম অনুভব করবে। যে কারণে আপনি রাগছেন, সেও সেই একই কারণে রাগবে। আপনি যেভাবে রাগবেন, সেও সেভাবেই রাগবে। কিন্তু দুজন আলাদা আইডেন্টিটিতে, আলাদা ফিজিকাল পজিশনে। আপনার দেহের বাউন্ডারী আর তার দেহের বাউন্ডারী আলাদা। এক দেহ নন, আপনাদের নার্ভাস সিস্টেমও কানেঙ্কটেড নয়। তাই আপনি রাগলেই সে তার দেহে রাগ অনুভব করবে না। আপনি তার জন্য সিগনাল সোর্স নন। বরং তার এবং আপনার দুজনর সিগনাল সোর্স তৃতীয় কোন বস্তু বা ব্যক্তি, যেখান থেকে সিগন্যাল আপনার দুজনেই পাচ্ছেন এবং দুজনের মস্তিষ্কের একই রকম কাজ বা রেস্পন্স হচ্ছে বা একই রকমের ফিজিকাল প্যাটার্ণ পাওয়া যাচ্ছে। পুনঃউৎপাদনযোগ্যতা মানে আপনার দেহের সিরিজে আরেকটি অনুরুপ দেহ, অনুরুপ অনুভূতি নয়।

আমার প্রথম পুরুষগত অভিজ্ঞতা যেহেতু আপনার পক্ষে পাওয়া সম্ভব না, তাই আপনি বা অন্য কেউ কখনো নিশ্চিত হতে পারেন না সেটা ঠিক কী রূপ

যখন আমি আপনি আলাদা দেহে, আলাদা জেনেটিক সিকোয়েন্স, আলাদা পরিবেশ, আলাদা ব্যাকগ্রাউন্ড, তখন আমি একটি ভিন্ন স্বত্তা, আপনার প্রতিরূপ নই, তাই, আমি আসলেই জানিনা, আপনি কি অনুভব করলেন, আপনিও জানেন না, আমি কি অনুভব করলাম। কিন্তু এটা জানি, একই গোলাপ দেখে, আমরা দুজনেই বলছি, গোলাপটা লাল। কারণ আমাদের দুজনের ফটোরিসেপটরে একই তরংগ দৈর্ঘের আলো, একই অবস্থান থেকে একই সময়ে গেছে। আমাদের দুজনকে একই ট্রেইনিং দেয়া হয়েছে, এই রেঞ্জের তরঙ্গ দৈর্ঘের আলোকে লাল বলা হয়।

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

নীল রোদ্দুর এর ছবি

এভাবে ভাবুন যে দৃষ্টি নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীরা প্রথম কাজ করেছিলেন, তারা যদি মানুষের দৃষ্টির অভৌত, ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাকে বোঝার অসম্ভাব্যতাটা দ্বারা নিরুৎসাহিত হতেন, তাহলে কি দৃষ্টিবিজ্ঞান এতোটা এগুতো?

সিগন্যাল সোর্স নির্দিষ্ট, সিস্টেমের(মস্তিষ্কের) গঠন প্রত্যেকটা মানুষে ভিন্ন, ফলশ্রুতিতে প্রত্যেকের অনুভব ভিন্ন। ব্যাপারটা খুবই ভৌত। মস্তিষ্ক একরকম হলে প্রত্যেকের দর্শনানুভূতি এক হত। এটাকে কি ঠিক অভৌত বলা চলে?

একটা উপন্যাসের ভাষার গাঁথুনি চমৎকার, মনের কাছে আকর্ষণীয়, এই আকর্ষণীয় ব্যাপারটা অভৌত। এই আকর্ষণীয় ধারণাটা অভৌত। কতটা আকর্ষণীয়, কম না বেশী, বেশী হলে কতটা বেশী, এটা আপনি পরিমাপ করতে পারেন না। আপনার ব্রেইনে একধরণের কার্যক্রমের ফলে আপনি বলছেন, চমৎকার। আপনি, উপন্যাসের ভাষা থেকে উপস্থাপনার/প্যাটার্ণের একটা ভঙ্গিকে বলছেন চমৎকার। এই যে প্যাটার্ণটাকে আপনি চমৎকার বলছেন, এই প্যাটার্ণটা যে আপনার শেখা, জানা প্যাটার্ণ থেকে কিঞ্চিত ভিন্ন, এর গ্রামারটা আপনার জানা ঠিক জানা নেই। আপনি এটাকে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। তাই আপনার এই জটিল অনুভূতিটা আপনার কাছে অভৌত/অ্যাবস্ট্রাক্ট/ ঠিক প্রকাশযোগ্য নয়, যাকে এক শব্দে বলছেন চমৎকার। আমি কি অভৌতের ব্যাপারটা ঠিক বোঝাতে পেরেছি?

কীভাবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন যে আপনি ছাড়া অন্য কোনো মানুষও সত্যি সত্যি আপনার মতোই অনুভূতি অনুভব করছে, কেবল অনুভূতি পাবার অভিনয় করছে না?

অন্য কোন মানুষ তো অনুভূতি পাবার অভিনয় করছে না ভাইয়া, সে যা অনুভব করছে, তাই প্রকাশ করছে, প্রকাশ করছে সেভাবেই যেভাবে সে প্রকাশ করতে শিখেছে। Mimicking আর Expressing ব্যাপার দুটো তো আলাদা ভাইয়া।

আমি আসলে আপনার লেখা পড়ে যা যা বুঝেছি আর যে যে পয়েন্টে দ্বিমত এসেছে সেগুলো বলেছি। এমন হতেও পারে, আপনি ঠিক যা বলেছেন আমি তা বুঝতে পারিনি। বোঝার ভুল হয়ে থাকলে বললে ভালো হয়।

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। বোঝাবুঝির পার্থক্যই ঘটেছে। প্রথমে পরিষ্কার করে নেই যে আপনার দাবিগুলো সম্পর্কে আমার দ্বিমত নেই।

প্রথম মন্তব্যের প্রথম প্যারায় বলেছেন "অনুধাবণ করতে মস্তিষ্ককে কিছু কাজ করা লাগে। এই কাজটি পরিমাপযোগ্য এবং পুনউৎপাদনযোগ্য।" এ ব্যাপারে একমত। মুক্তমনায় আপনার অ্যাকশান পটেনশিয়ালের লেখাটা পড়েছি। তারও অনেক আগে ঠিক এই বিষয়ের উপর একটা কোর্স করেছি, যেখানে এই বিষয়ে পড়েছি। ব্যাপারটা আমার জানা। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমার এই দাবিতে দ্বিমত নেই। আমার বক্তব্যগুলো এর বিরুদ্ধে ছিলো না। বরং লেখাতেই বলেছি যে "রাগ করলে একটা নির্দিষ্ট শারীরীক প্যাটার্ন দেখা যায়, রক্তচাপে, হৃদস্পন্দনে ও মস্তিষ্কে নিউরনের সঞ্চালনে।" এভাবে শরীরে যে অনুভূতিগুলোর কম্পিউটেশন পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে সংক্ষেপে বলেছি।

দ্বিতীয় প্যারায় যে বলছেন সুন্দর লাগার সাথে ব্রেইন অ্যাকটিভিটির একটি করেসপন্ডেন্স আছে, তাতেও কোনো দ্বিমত নেই।

তবে আপনি ভৌত অভৌতের পার্থক্যটা টানার জন্যে যেমন সুন্দর লাগার অনুভূতিটা আনলেন, আমি কিন্তু সেই অর্থে অভৌতকে দেখছি না। বরং সুন্দর লাগার ব্রেইন অ্যাকটিভিটি আমার কাছে ভৌতই। বিভিন্ন প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে এই মানুষের এই সুন্দর লাগাকে পুনরুৎপাদনযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা করা ও অনেকটা নিখুঁততার সাথে পূর্বাভাস করাও সম্ভব।

কিন্তু বলছি যে এই প্রতিটি অনুভূতিরই আবার অভৌত অংশ আছে। অর্থাৎ এমন নয় যে কিছু অনুভূতি ভৌত, কিছু অনুভূতি অভৌত। বরং প্রতিটি অনুভূতিরই ভৌত তথা মস্তিষ্কে পর্যবেক্ষণযোগ্য সিগন্যালের অংশ আছে। আবার আরেকটা অংশ আছে, সেটা হচ্ছে ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা।

চিন্তা করুন। মস্তিষ্ক তো গণনাই করছে। তাহলে এর বিপরীতে ফার্স্ট পার্সনে একটা দৃশ্যপটের মতো অভিজ্ঞতা অনুভব করার বাধ্যবাধকতা কোথায়? এমন কি হতে পারতো না যে সকল মস্তিষ্ক কম্পিউটেশানই করছে, কিন্তু এর বিপরীতে আমাদের কোনো ফার্স্ট পার্সন কোনো অনুভব হচ্ছে না। যেমনটা আমরা কম্পিউটারের ক্ষেত্রে ভাবি। আমরা মনে করি না যে একটা ওয়েব ক্যাম কম্পিউটারে লাগালেই সে দেখার অনুভূতি পায়। যদিও ফাংশনালি আমাদের চোখও তার উপর আপতিত আলোকে গণনা করে, ওয়েব ক্যাম আর কম্পিউটার মিলেও সেই আলোকে গণনাই করে। আমাদের এই মস্তিষ্কের গণনার সাথে এই ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতাটার সংযোগটা কোথায়? কেনো মস্তিষ্কের গণনার পাশাপাশি আমরা অনুভব করি? আমরা এতোটা অবধারিতভাবে জানি যে আমরা অনুভব করি যে আমরা আর প্রশ্ন করি না কেনো গণনার সাথে অনুভব করা যুক্ত। এবার একটা ভিন্ন জন্তুর কথা চিন্তা করুন। তারও নার্ভাস সিস্টেম আছে। তার সম্পূর্ণ আচরণ, এমন কি অনাচরণেও মস্তিষ্কে প্যাটার্ন তৈরি হচ্ছে, সিগন্যাল তৈরি হচ্ছে। সে তার নার্ভগুলো দিয়ে ইনপুট নিচ্ছে, মস্তিষ্কে গণনা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোটর নিউরনে ফায়ারিং হচ্ছে, ক্রিয়া সঞ্চালন হচ্ছে। হতে পারে সে চিতা বাঘ। এখন আপনাকে প্রশ্ন করা হলো যে জন্তুটির ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা আছে কিনা। অর্থাৎ আপনার আমার সামনে যেভাবে অভিজ্ঞতা আপতনের দৃশ্যপট অনুভূত হয়, সেভাবে চিতাবাঘের সামনেও ফার্স্ট পার্সনের একটা অভিজ্ঞতা অনুভূত হয় কিনা। নাকি সে একটা যন্ত্রের মতো কেবল গণনা করে করেই এগিয়ে যায়। এর বিপরীতে তার কোনো ফার্স্ট পার্সন অনুভূতি হয় না? ফিজিওলজিক্যালি যদি চিন্তা করেন, চিতা বাঘের শারীরিক এই গণনাটা কিন্তু ব্যাখ্যা করতে পারে না যে চিতা বাঘের আমাদের মত ফার্স্ট পার্সন অনুভূতি আছে কিনা। চিতা বাঘের ফার্স্ট পার্সন অনুভূতি আছে কিনা - এটা জানার ইনাফ জ্ঞান কিন্তু চিতাবাঘের সম্পূর্ণ ফিজিওলজিক্যাল ডেটার মধ্যেও নেই। এই জ্ঞানটা অভৌত। এটা চিতাবাঘের ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন বলে এটা বৈজ্ঞানিক প্রশ্নই থাকে না। কিন্তু তার মানে কিন্তু এই না যে এটা অবৈধ প্রশ্ন। এই প্রশ্ন একটা বোধগম্য প্রশ্ন।

এভাবে আমাদের প্রতিটি অনুভূতিরই মস্তিষ্কে একটা করেস্পন্ডেন্স আছে যেটা দিয়ে পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্ভব। আবার কেনো মস্তিষ্কের এই গবেষণার পাশাপাশি আমাদের ফার্স্ট পার্সন সেনসেশান হয়, যেখানে এটা না হলেও গণনাগুলো ঘটতে পারতো, সেই অভৌত ব্যাপারটি জড়িত। এটাকে কোয়ালিয়া বলে। আপাতত উইকিপিডিয়ায় দেখতে পারেন এ ব্যাপারে। তবে পদার্থবিদ স্রোডিঞ্জারের এ ব্যাপারে একটি উক্তি উদ্ধৃত না করলেই নয় -

The sensation of colour cannot be accounted for by the physicist's objective picture of light-waves. Could the physiologist account for it, if he had fuller knowledge than he has of the processes in the retina and the nervous processes set up by them in the optical nerve bundles and in the brain? I do not think so.

লক্ষ্য করুন, কোয়ালিয়ার মতো একটি অভৌত প্রপার্টি থাকার অর্থ কিন্তু এই নয় যে এটা ভৌত পর্যবেক্ষণগুলোকে দুর্বোধ্য করে দেয়। বরং আপনি যদি ধরেও নেন যে আপনার সাব্জেক্টের কোনো প্রকার ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা নেই, তাতেও কিন্তু তার ব্রেইন অ্যাক্টিভিটি, তার আচরণগুলো নিয়ে গবেষণা করতে আপনার বিন্দুমাত্র সমস্যা হবার কথা না। কারণ এই বিষয়ক অনুমানে পর্যবেক্ষণসাধ্য ডেটাগুলোর কোনো কিছু এসে যায় না। সাব্জেক্টের ফার্স্ট পার্সন ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা আছে কি নেই এই অনুমানটি বা প্রশ্নটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অবান্তর। যদিও প্রশ্ন হিসেবে এটা বোধগম্য ও বৈধ।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

যদি উপরের আমার মন্তব্যটির মাধ্যমে আমাদের বোঝাবুঝিটা সারিবদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে এই মন্তব্যে আলোচনা করা যেতে পারে।

আপনি বলেছেন "অনুভূতি পুরউৎপাদন যোগ্য" যাতে আমার দ্বিমত নেই। কিন্তু আমি বলেছি "প্রথম পুরুষ থেকে প্রাপ্ত অনুভূতিটা পুরনুৎপাদনযোগ্য থাকছে না।" এখন ভাবুন, আপনার ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতাটি ভৌতভাবে সম্পূর্ণ পুনরুৎপাদনযোগ্য করার অর্থ কী? এর অর্থ হলো ভৌত যেসব বস্তু আছে, তাতে আপনার ফার্স্ট পার্সন সেনসেশানগুলো দ্রবীভূত। ওই ভৌত পদার্থগুলোর একই সন্নিবেশ ঘটালে "আপনার" একই সেনসেশান ঘটবে। ধরুন আমরা বের করলাম যে ঠিক অমুক অমুক অনুপরমাণুর সজ্জায় আপনার ঠিক একটি বিশেষ সেনসেশান ঘটে। এখন হুবহু একই সন্নিবেশ যদি আমরা আপনার শরীরের বাইরে ঘটাই, তাতে যদি আপনার সেনসেশান না ঘটে, আপনি হয়তো বলবেন যে ওই সজ্জাটি এখন যার শরীরে, তার এখন সেই সেনসেশানটি ঘটবে। আমি লেখাতেও তা বলেছি - "হয়তো বলা হবে যে না, সেক্ষেত্রে ওই শরীরধারীজন তখন রাগান্বিত বোধ করবে।" কিন্তু ভৌতভাবে সজ্জা দুটি যদি হুবহু হয়, তাহলে আর কী পার্থক্য থাকছে যার কারণে একটাতে সেনসেশান হচ্ছে আপনার ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতায়, আরেকটাতে হচ্ছে অন্যজনের? ভৌতভাবে তারা তো হুবহু স্বীকারই করে নিয়েছি। আর এখানে তো আমরা কেবলই অনুভূতির পুনরুৎপাদন ঘটাচ্ছি না। ঘটাচ্ছি আপনার ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতার পুনরুৎপাদন। তাহলে আপনার ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতার পুনরুৎপাদন ভৌতভাবে কীভাবে ঘটানো যাবে? দুটো হুবহু সজ্জা এমন কি হুবহু শরীরের মাঝে ঠিক কী ভৌত পার্থক্য আর বাকি থাকে যে দুটোর সেনসেশান দুটো ভিন্ন ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতায় উৎসারিত হয়?

অন্য কোন মানুষ তো অনুভূতি পাবার অভিনয় করছে না ভাইয়া, সে যা অনুভব করছে, তাই প্রকাশ করছে, প্রকাশ করছে সেভাবেই যেভাবে সে প্রকাশ করতে শিখেছে। Mimicking আর Expressing ব্যাপার দুটো তো আলাদা ভাইয়া।

এই ধাঁধাটাকে আরো ঘনীভূত করি। আমি অভিনয় বলতে কিন্তু নাটক সিনেমার অভিনয় বোঝাই নি। মানুষ রোবটের ক্ষেত্রে যখন বলে যে - এটাতো কেবল গণনাই করছে, সত্যি সত্যি অনুভব নিশ্চয়ই করছে না - তখন যেই অর্থে ভাবে যে রোবটটি অভিনয় করছে, সেই অর্থে বুঝিয়ছি। অর্থাৎ অনেকে ভাবে যে রোবট কেবলই গণনা করছে, তার বিভিন্ন ইনপুট সেন্সর দিয়ে সিগন্যাল প্রবেশ করছে। তার ভেতরের কম্পিউটারটি সিগন্যালগুলো গণনা করছে। বিভিন্ন যান্ত্রিক মোটর এর ভিত্তিতে সঞ্চালন করছে। এই জায়গায় রোবটের একটা ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা হচ্ছে কিনা, এই প্রশ্ন কিন্তু অনেকটাই অবান্তর। কিন্তু রোবটটি যদি মানুষের মতো আচরণ করে? সে হয়তো বলছে যে, কী সুন্দর গোলাপ! ভালো লাগছে। হাসি পাচ্ছে। কান্না পাচ্ছে। এমন কি হয়তো বলছে, অবশ্যই আমার ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এগুলো সে বলছে মানে কিন্তু এই নয় যে রোবটটির ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা আছে। বরং এভাবে ভাবা যায় যে সে এগুলো বলছে কারণ তার ভিতরে এগুলো বলার মতো গণনাগুলো ঘটছে। এই গণনাগুলো ঘটার জন্যে কিন্তু সত্যি সত্যি আপনার মতো ফার্স্ট পার্সন থেকে অনুভব করার তার কোনো ভৌত প্রয়োজন আছে কি? ফলে কেউ ভাবতে পারে যে রোবটটি অনুভব পাবার অভিনয় করছে। অর্থাৎ যে গণনাগুলো ঘটলে সে এই কথাগুলো বলতো, সেই গণনাগুলো তার কম্পিউটারে ঘটছে। কিন্তু সে আসলে এগুলো সত্যি সত্যি মানুষের মতো অনুভব করছে না।

এখন তুলনা করে আমি বুঝিয়েছি যে, একই কথা একজন মানুষের ক্ষেত্রেও বলা যায়। আপনি জানেন আপনার ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা আছে। আমি জানি আমার আছে। কিন্তু আপনি কীভাবে নিশ্চিত হবেন যে আমার ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা আছে? আমার মস্তিষ্কের প্যাটার্নগুলো দেখে বড়জোর আপনি বলতে পারেন যে আমার মধ্যে গণনা ঘটছে। কিন্তু তার জন্যে আমার ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা থাকার কিন্তু কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন আমার ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা আছে কিনা। আমি বলবো আছে। কিন্তু রোবটের মতো আমার ক্ষেত্রেও কিন্তু ভাবা সম্ভব যে ঠিক যে গণনাটি করলে আমার এই কথাটি বলার কথা, আমার মস্তিষ্কটি ঠিক সেই গণনাটি কেবল করছে। আমি বলছি মানে কি এই যে সত্যি সত্যি ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা পাচ্ছি? এটা এতোটা অভিয়াস। অথচ এতোটাই ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা যে এটা নৈর্ব্যক্তিক তথা বৈজ্ঞানিক গবেষণার বাইরে। এমন হওয়াটা অসম্ভব ছিলো না যে মস্তিষ্কে গণনাগুলো ঠিক এখন যেভাবে ঘটে, সেভাবেই ঘটছে, কিন্তু আমাদের কারো কোনো ফার্স্ট পার্সন অভিজ্ঞতা নেই। আমাদের সামনে একটা কালো পর্দা বা আমরা সত্তা হিসেবে অস্তিত্ববানই বোধ করি না কেউ বা তেমনটা বোধ করার অনুভূতি আমরা কেউ পাই না। পৃথিবীটা আমাদের মতো শরীর দিয়ে ভরা। তাদের মস্তিষ্কে একই গণনাগুলোই ঘটছে। ফলে তারা বলছে তাদের ফুল সুন্দর লাগে। তাদের হাসি পায় কান্না পায়। পর্যবেক্ষণগত সিগন্যালগুলোতে কোনোই পার্থক্য আসার প্রয়োজন পড়তো না তাতে। এই যে আমাদের বোধ করাটা, এটা ভৌত বিচারে বাড়তি। এটা না থাকলেও মস্তিষ্কের একটা গণনাযন্ত্র হিসেবে কিছুই আসতো যেতো না।

নীল রোদ্দুর এর ছবি

আপনার পুরো বক্তব্যের সাথে সহমত। স্নায়ুবিজ্ঞানে সচেতনতা বা কনসাসনেস বলে যে ব্যাপারটা আছে, এইখানে হাত দিতে সাহস লাগে। সচেতনতা কি? এর শ'খানেক ফিলোসফিকাল উত্তর পাওয়া গেলেও একটাও বৈজ্ঞানিক উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। নিজেকে, ব্যক্তিকে অনুভব করা কেবল মস্তিষ্কের উপস্থিতির কারণেই সম্ভব হয়। কি হবে যদি, হৃদপিন্ড, ফুসসুস ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণটুকু মস্তিষ্কে রেখে বাকি সংযোগ গুলো বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে একটা কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করে দিলে যা কিনা মস্তিষ্কের মত সব গনণা করতে পারে? আমাদের সচেতনতা কি অক্ষত থাকবে? আমি কি অনুভব করতে পারবো, আমি আমিই? এর উত্তরটা অজানা। ব্যক্তি বোধটা তো মস্তিষ্কেরই সৃষ্টি। তবে এই প্রশ্নে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা চুপ হয়ে যায় হাসি

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

আলামিন এর ছবি

ধন্যবাদ সুন্দর লিখাটির জন্য।
ডেভিড চালমার এর সাক্ষাতকারটি হয়ত সহায়ক হবে।

http://www.youtube.com/watch?v=NK1Yo6VbRoo

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

ধন্যবাদ লিংকটার জন্যে। হার্ড প্রবলেমের করুণ সমস্যা আছে। হার্ড প্রবলেম সচেতন অভিজ্ঞতা-অনুভব তথা কোয়ালিয়া সম্পর্কে নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানার্জনে আগ্রহী। কিন্তু অন্যদিকে হার্ড প্রবলেম কোনো বিজ্ঞানসাধ্য প্রবলেম না। আর বিজ্ঞানসাধ্য নয় এমন সমস্যা নিয়ে যাচাইযোগ্যভাবে নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানার্জন অসম্ভব। ডেভিড চালমারকে হার্ড প্রবলেমটা উপস্থাপনের জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু ওনার এই সমস্যা সমাধানের সকল আশার গুড়ে আমি বালি দিতে চাই।

এ ব্যাপারে ড্যানিয়েল ডেনেটের আর্গুমেন্টগুলো পড়তে পারেন উইকির পাতাতেই। ওনার বক্তব্য মোটামুটি এমন যে কোয়ালিয়া ব্যাপারটা ভৌত অনুসন্ধানে কোনো উপায়তেই ম্যাটার করে না। আমার লেখাটার সমাপ্তি বক্তব্যও তাই।

আলামিন এর ছবি

David Chalmer এর ধারনাও তাই, হার্ড প্রব্লেম সমাধারনের আশা নাই। আর সেজন্যই সেটা হার্ড প্রব্লেম।
আপনার ১৩ ও ১৪ নং মন্তব্য "subjective experience" মত কঠিন বিষয় সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন।
"subjective experience" কে ব্যাখ্যা করার কেবল দুইটা উপায় আছে, হয় "dulalism" কে স্বীকার করে নেয়া অথবা নিজেকে "নাই" ভাবা । আপনার অন্য একটি লেখাতে আপনি আত্মার অস্তিত্বে দৃঢ় ভাবে ভেটো দিয়েছেন। তাই ধরে নেয়া যায় আপনি দ্বিতীয় পথের পথিক। সেক্ষেত্রে, নিজের (সেলফ) অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে আপনার সমস্ত ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা তথা আনন্দ-বেদনা, ভাললাগার অনুভুতি, কিংবা রং-ধনুর রঙ, গোলাপের সুবাস সবই তো illusion ভিন্ন আর কিছুই নয়। আর "dulalism" বাদ দিয়ে ফ্রী উইল তো অসম্ভব। যে ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করে, তাঁকে বলা হয় নাস্তিক। কিন্তু যে নিজেকেই অস্বীকার করে তাঁকে কি বলবেন?
বিজ্ঞানে, আত্মার অস্তিত্বে ভেটো দিতে বলা হয়, "Interaction between Immaterial soul and material brain" সম্ভব না। তাহলে, চুম্বক আর চৌম্বক আবেশের Interaction এর ব্যাপারে কি বলবেন?

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

আপনার আলোচনা ভালো লেগেছে।

অনেকগুলো বিষয় খুব সংক্ষেপে একত্র হয়ে গেছে আপনার মন্তব্যে। দেখি আলাদা করে বিচার করতে পারি কিনা।

"subjective experience" কে ব্যাখ্যা করার কেবল দুইটা উপায় আছে, হয় "dulalism" কে স্বীকার করে নেয়া অথবা নিজেকে "নাই" ভাবা ।

এর কোনোটাই ভৌত অনুসন্ধানের জন্য ম্যাটার করে কি? মানে প্রশ্নটা সম্পূর্ণ মেটাফিজিক্যাল, নাকি না?

আপনার অন্য একটি লেখাতে আপনি আত্মার অস্তিত্বে দৃঢ় ভাবে ভেটো দিয়েছেন।

আপনার বক্তব্যটা পরিষ্কার হবার জন্যে ওই লেখাটার লিংকটা একটু দিবেন। আত্মা সংক্রান্ত আমার অবস্থান কোয়ালিয়ার চেয়েও খারাপ। কোয়ালিয়াকে আমার এপিফেনোমেনন মনে হয়। অর্থাৎ অভৌততে উদ্ভূত, অভৌততেই সীমাবদ্ধ। ভৌতকে সে পরিবর্তন করতে পারে না। এখন আমার ভৌত শরীর আর আমার ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা বা কোয়ালিয়া, এই দুটোর বাইরে আত্মা বলতে আর কোন বস্তু? এটা কি ভৌতকে প্রভাবিত করতে পারে?

তাই ধরে নেয়া যায় আপনি দ্বিতীয় পথের পথিক

আমি নিজেকে নাই ভাবি না। বরং কিছু থাকলে সেটা অন্তত আমি, এমনটা ভাবি। আমার নাস্তিক মুসলমান লেখায় বলেছি দেখুন

নিজের অস্তিত্বের চাইতে সত্য বইলা আর কি কিছু আছে? দেখা জগতের বস্তুরে দেইখা যাচাই করতে হয়। অদেখা জগতের বস্তুরে বিশ্বাস কইরা নিতে হয়। আপন সত্তাই একমাত্র বস্তু, যা দেখাও যায় না, কিন্তু বিশ্বাসও করা লাগে না। আর কিছু থাক না থাক, আমি যে আছি তাতে সন্দেহ কোথায়? আমি না থাকলে চাঁদ দেখতেছি কথাটার মানে কী থাকে, খোদায় বিশ্বাস করতেছি কথাটারও অর্থ কী দাঁড়ায়? নিজের অস্তিত্বের চাইতে পরম সত্য আর কিছু নাই।

কোয়ালিয়াকে উড়িয়ে না দেওয়ার কারণে আমি হয়তো হার্ডলাইন মেটারিয়ালিস্ট নই। বরং স্রোডিঞ্জারের মতো কাউন্টার মেটারিয়ালিস্ট একটা অংশ আমার অবস্থানে আছে। তবে ভৌত অনুসন্ধানে ড্যানিয়েল ডেনেটের মেটারিয়ালিস্ট অবস্থানের সাথে আমার কোনো দ্বিমতও কিন্তু নেই। আমি মনে করি অভৌত ভৌতকে পরিবর্তন করে না। ফলে অভৌতের অনুমান ভৌত অনুসন্ধানে অবান্তর।

"dulalism" বাদ দিয়ে ফ্রী উইল তো অসম্ভব।

কথাটার মধ্যে এটা অনুমিত যে dualism ধরে নিলে ফ্রি উইল সম্ভব। কিন্তু duality এর সফট অংশটি যদি এপিফেনোমেনন হয় মানে যা ভৌতকে পরিবর্তন করতে পারে না, সেক্ষেত্রেও কিন্তু ফ্রি উইল অসম্ভব। অর্থাৎ dualism মাত্রই ফ্রি উইল আছে, তেমনটা ধরতে পারছি না। আমি যেহেতু মনে করি যে কোয়ালিয়া এপিফেনোমেনন, এবং ভৌত অনুসন্ধানে এগুলোর আনয়ন নিষ্প্রয়োজন, ফলে আমি মনে করি ফ্রি উইল একটা ইল্যুশন। এ ব্যাপারে আমার স্বাধীন-ইচ্ছা বলে কি কিছু আছে? লেখাটি দেখতে পারেন।

অর্থাৎ শরীরে ভর করা আমাদের সচেতন, ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাটি হাতির পিঠে চড়া বালকের মতো, যে ভাবে যে তার শাসনেই হাতিটি চলছে, কিন্তু হাতিটি আসলে নিজের মতোই চলছে। শরীরের ভৌত, কম্প্লিট সিস্টেম এখানে আছে, কোয়ালিয়াও আছে, কিন্তু ফ্রি উইল নেই। (আত্মা তো দূরের কথা)

"Interaction between Immaterial soul and material brain" সম্ভব না। তাহলে, চুম্বক আর চৌম্বক আবেশের Interaction এর ব্যাপারে কি বলবেন?

দুটোর তুলনাটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। অভৌত আত্মা ধারণাটি সংজ্ঞাগতভাবেই ভৌতভাবে অপর্যবেক্ষণযোগ্য। এর কোনো পর্যবেক্ষণগত ছায়া বা আলামতও থাকার নয়। কিন্তু চুম্বক আর চৌম্বক আবেশের ক্ষেত্রে কি তাই? এদের কি কোনোই পর্যবেক্ষণগত ছায়া বা আলামত নেই? চৌম্বক আবেশ কি Immaterial? পর্যবেক্ষণসাধ্য একটা ধারণাকেই কিন্তু চৌম্বক আবেশের সংজ্ঞায় নিবদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে শারীরিক কোনো পর্যবেক্ষণসাধ্য ফাংশনের জন্যেই কিন্তু আত্মা ধারণার আনয়নের প্রয়োজন নেই।

আর

নিজের (সেলফ) অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে আপনার সমস্ত ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা তথা আনন্দ-বেদনা, ভাললাগার অনুভুতি, কিংবা রং-ধনুর রঙ, গোলাপের সুবাস সবই তো illusion ভিন্ন আর কিছুই নয়।

নিজের অস্তিত্বকে স্বীকার করলেও কিন্তু এক অর্থে এগুলোকে non-illusion প্রমাণ করতে পারবেন না। illusion non-illusion হলো objective reality এর প্রশ্ন। বিজ্ঞানের মূলধারার (লজিক্যাল পজিটিভিজম ও ভেরিফিকেশানিজম) দর্শনানুসারে বিজ্ঞান objective reality এর অনুসন্ধান করে না। বিজ্ঞানের কাজ পর্যবেক্ষণকে পুনরুৎপাদন ও যাচাইযোগ্যভাবে পূর্বাভাস করা। পর্যবেক্ষণ তার পরশ পাথর। সেই পর্যবেক্ষণ নিজে আবার বাস্তব পর্যবেক্ষণ না illusion সেটা যাচাই করার জন্যে বাড়তি কোনো পরশপাথর আর বিজ্ঞানের কাছে মজুদ নেই। ফলে আমি নিজেকে অস্তিত্ববান মনে করলেও আমার অভিজ্ঞতায় আপতিত এই সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি illusion না real সেটা 'যাচাই' করার কোনো ইন্সট্রুমেন্ট আমার হাতে নেই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।