অজানা ভাইরাসের উৎপাত

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: বুধ, ১৬/০৪/২০০৮ - ১১:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoSV40 ভাইরাসের গল্পও ইউজেনিক্সের মতই বিজ্ঞানের আরেক ভয়াভহ ইতিহাস। পোলিও রোগের কথা সবাওই জানা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যে সব রোগের ওষুধ আবিষ্কারের জন্য সারা পৃথিবীতে গবেষণা শুরু হয়েছিল - পোলিও তাদের মধ্যে অন্যতম। পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবার পরে পোলিও রোগাক্রান্তদের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৮৮ সাল থেকে সারা পৃথিবীব্যাপি পোলিও ভাইরাস খাওয়াবার উদ্যোগ নেওয়ার পরে পোলিও রোগ-সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ থেকে কমে সাড়ে মাত্র হাজারখানেকে এসে দাঁড়িয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে সারা পৃথিবীতে এখনও পোলিও রোগীর সংখ্যা এক থেকে দু'কোটির মধ্যে। আবার ভ্যাকসিনের গল্পে ফেরত যাওয়া যাক। ১৯৫২ সালে আমেরিকায় পোলিও মহামারী আকারে দেখা যায়, সে বছরই প্রায় আটান্ন হাজার পোলিও রোগের কথা জানা যায়, তার মধ্যে তিন হাজারেরও বেশী লোক মারাও যায়, তার থেকেও অনেক বেশী লোকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবে বিজ্ঞানীমহলেও এ নিয়ে একটা তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয় - কে আগে ভ্যাকসিন বের করে ফেলতে পারে। পোলিও ভাইরাস মানুষের আগের জানা ভাইরাসগুলোর থেকে একটু আলাদা ছিল - এই ধরণের কোনো রোগে আগে টিকা ব্যবহার হয়নি। তখনও অবধি বিশ্বাস করা হত যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা জন্মাতে হলে মৃদু বা দুর্বল ভাইরাস সংক্রমণ হওয়া দরকার। আর পোলিও ভাইরাসের মৃদু সংক্রমণ করানোটাও ছিল খুব ঝুঁকির। জোনাস সাল্ক দেখলেন যে ফর্মালডিহাইডে মৃত পোলিও ভাইরাসকেও মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারলেও মানুষের পোলিও রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা বেড়ে যায়। সমাধান হয়ে গেল একটা বড় সমস্যার। কিন্তু এত পোলিও ভাইরাস পাওয়া যাবে কোথায়? সে সমাধানও অচিরেই পাওয়া গেল। বানরের কিডনীর একধরণের (এপিথেলিয়াল) কোষে যদি এই ভাইরাসকে রাখা যায় তাহলে তা সংখ্যাবৃদ্ধি করে কিন্তু বানরের কিছু হয় না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কিছুদিনের মধ্যেই বানরের কিডনী থেকে টিকা-আকারে মৃত ভাইরাস চলে এল বাজারে - প্রতিষেধক আকারে। তার আগে সাল্ক নিজে আর তার স্ত্রী-সন্তান এই ভ্যাকসিনের টেস্ট করলেন নিজেদের শরীরে ভ্যাকসিন ও পোলিও ভাইরাস নিয়ে। ১৯৫৫ সাল থেকে আমেরিকায় শুরু হল জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচী। কয়েক বছরের মধ্যেই প্রায় শুধু আমেরিকাতেই কয়েক কোটি বাচ্চাকে এই পদ্ধতিতে পোলিও টিকা দেওয়া হল। এ ছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, কোরিয়া ও চিনেও এই একই ভাবে টিকা দেওয়ার প্রচলন হল। সাল্ক তো রাতারাতি হিরো হয়ে গেলেন।

এই টিকার প্রথম সমস্যাটা ছিল পদ্ধতিগত। এমনিতে তো বোঝা সম্ভব নয় ভাইরাস মরে গেছে কিনা, তাই কিছু কোম্পানীর তৈরী ভ্যাকসিনের সাথে জ্যান্ত ভাইরাসও ঢুকে গেল। টিকা নিয়েও কিছু মানুষ মারা কিছুদিনের মধ্যেই গেল। তাও মোটের ওপর টিকাকরণ ভালই চলছিল। কিন্তু শেষটায় বাধ সাধল আরেকটা আবিষ্কার। ১৯৬০ সালে আবিষ্কৃত হল যে এই প্রজাতির বানরের (রীস্যাস বানর - যা দক্ষিণ এশিয়ায় পাওয়া যায়) কিডনীতে SV40 (সিমিয়ান ভাইরাস ৪০) ভাইরাস পাওয়া স্বাভাবিকভাবে যায়। আর তা ফর্মালডিহাইডে মরে না। তার মানে যে পোলিও ভ্যাকসিন বিশ্বজুড়ে খাওয়ানো হয়ে গেছে বা হচ্ছে, তার মধ্যে কিছু হলেও এই SV40 ভাইরাসও রয়ে গেছে। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অবিলম্বে বিজ্ঞানীমহলে এও দাবী উঠল যে এই ভাইরাসের উপস্থিতিতে ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। প্রায় অর্ধেক টিউমারের মধ্যে এই ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ইঁদুরের মধ্যে ভাইরাসের প্রভাবে টিউমার সৃষ্টি পরীক্ষা করে দেখানো গেল। তার মানে কি যারা টিকা নিয়েছেন তারা ক্যান্সারের কবলে পড়তে চলেছেন? এই প্রশ্নই জনসাধারণের মধ্যে ঘুরেফিরে আসতে লাগল। আমেরিকার কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে অন্য প্রজাতির আফ্রিকান বানরের কিডনীতে পোলিও ভাইরাসের চাষ শুরু করল। ১৯৬৩ সালে যখন নতুন প্রজাতির বানর থেকে তৈরী টিকা বাজারে এল, ততদিনে কিন্তু শুধু আমেরিকাতেই প্রায় দশ কোটি মানুষের টিকাকরণ হয়ে গেছে। অনেক পরে অনেক গবেষণা করেও অবশ্য সঠিকভাবে কিছু বলা সম্ভব হয় নি যে সত্যিই SV40 ভাইরাসের সাথে মানুষের ক্যান্সারের কোনো বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক আছে কিনা। বৈজ্ঞানিকেরা আজও এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। তবে সম্পর্ক থাকলেও যে তা খুব গভীর সম্পর্ক নয় - হলেই পোলিও আটকাতে গিয়ে ক্যান্সারের মহামারীতে লোকে মারা যেত। আর ক্যান্সারের আবার ওষুধও হয় না।

কিন্তু SV40 ভাইরাসের এই সমস্যা মানবজাতিকে অন্য এক দুর্দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কি হত যদি সত্যি SV40 ভাইরাস ক্যান্সারের জন্য দায়ী হত? কি হত যদি ১৯৬০ সালের জায়গায় আরো দশ বছর পরে এই ভাইরাস আবিষ্কৃত হত। কেউ তো হলফ করে কখনই বলে দিতে পারে না যে আমরা যে যে ওষুধ খাচ্ছি আজকের দুনিয়ায়, তার সবকিছুই ১০০% নিশ্চিত ভাবে নিরাপদ। আজ না হলেও কাল তো এরকম বিপদ হতেই পারে। কে হবে দায়ী যদি পরে অন্য কিছু আবিষ্কৃত হয়? বিজ্ঞানী? সত্যিই কি সাল্ককে এই ক্ষেত্রে দায়ী করা যেত? তিনি তো প্রথমে নিজেই নিজের পরিবারকে ভ্যাকসিন দিয়েছিলেন। আর তাকে যখন ভ্যাকসিনের পেটেন্টের কথা জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি অকপটে বলেছিলেন - "কিসের পেটেন্ট? সূর্যের কখনও পেটেন্ট হবে নাকি"? নাকি সরকারের গাফিলতি? ঘটনা হল, কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব ছিল না সত্যিটা কারণ তা তখনও আবিষ্কৃতই হয় নি। তাই আজকেও আমরা যা যা ব্যবহার করি, তাও কিছুটা হলেও ঝুঁকি নিয়েই করি। পরে অন্য কোনো বিপদ্দজনক সত্য বেরিয়ে এলে আমাদের হাতে খুব একটা কিছু করার থাকে না।


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

পড়লাম। ভালো লেখা.......

আজ আমরা বিজ্ঞানের অগ্রগতির উপর বিশ্বাস রেখে চোখ বুঁজে যেসব ঔষধ খেয়ে ফেলি কিছুদিন পর হয়তো সেইসব ঔষধ মানুষ কিভাবে খেত চিন্তা করে সবাই শিউরে উঠবে।


কি মাঝি? ডরাইলা?

শিক্ষানবিস এর ছবি

চমৎকার তথ্য জানলাম একটা। আমিও তো পোলিও'র টিকা নিয়েছিলাম। না জানি ভবিষ্যতে কি হয়!দেঁতো হাসি

পেটেন্ট না করার বিষয়টা খুব ভাল লেগেছে। কিছু কিছু বিষয়ে এখন পেটেন্ট চর্চা আসলেই ছেড়ে দেয়া উচিত।

দিগন্ত এর ছবি

পেটেন্ট বিষয়ক একটা লেখা আসবে আশা করছি।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

দিগন্ত এর ছবি

ইসসসসসসসস ... প্রবাসীদের এরকম কথা শোনাতে নেই। আমি একাই আছি ... দেখি বাড়িতে গিয়ে কিছু লুচি-মাংস পারলে রান্না করে সচলে পোস্ট করে দেব।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

হিমু এর ছবি

এথোলজি আর সোশিওবায়োলজির অন্যতম স্তম্ভ বিল হ্যামিলটন কঙ্গোতে পোলিওর ওরাল ভ্যাকসিনের সাথে সেখানে এইডস এর প্রাদুর্ভাব নিয়ে বেশ শোরগোল তুলেছিলেন। এ সংক্রান্ত যে আর্টিকেলটি তিনি লিখেছিলেন, সেটি সম্ভবত "নেচার" বা "সায়েন্স" (ঠিক মনে নেই) প্রকাশ করা থেকে বিরত ছিলো। ক্ষেপে গিয়ে হ্যামিলটন মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের জন্যে কঙ্গোতে যান, ম্যালেরিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। আপনার লেখা পড়ে ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো।

শিক্ষানবিসকে অনুরোধ করবো বিল হ্যামিল্টনের ওপর কিছু লিখতে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

দিগন্ত এর ছবি

কালকে পড়তে গিয়ে হ্যামিল্টনের কথাও এল। সত্যি কোনটা যে ঠিক আর বেঠিক সেটার কোনো হদিস নেই।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।