এক ক্লাউদিয়া আর কিছু অন্ধবিশ্বাসী

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: রবি, ২৩/১১/২০০৮ - ৭:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ক্লাউদিয়া ক্যাস্টিলো ত্রিশ বছর বয়সী এক কলম্বিয়ান মহিলা। তার আর দশটা মানুষের মত সবকিছুই স্বাভাবিক, কিন্তু সমস্যা একটাই। দীর্ঘদিন টিউবারকুলোসিসে ভুগে তার বাঁদিকের ফুসফুস একেবারে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। এখন তাকে সুস্থ করে তোলার উপায় ছিল একটাই - বাঁ দিকের ফুসফুস বাদ দেওয়া। অথবা, সমগ্র শ্বাসনালীটা বদলে ফেলা। এতদিনের রক্ষণশীল চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রথমটাই করার কথা - যদিও তাতে আয়ু কমে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। স্পেনের বার্সেলোনায় শয্যাশায়ী ক্লাউদিয়ার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা একটু অন্যরকমই ভেবেছিলেন। আর তাদের অন্যরকম চিন্তার সুফল হিসাবে আজকে ক্লাউদিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ।

অনেকেই ভেবে জিজ্ঞাসা করবেন হয়ত, শ্বাসনালী তো একটা মৃতের শরীর থেকে নিয়ে প্রতিস্থাপন করলেই কাজ সহজে হয়ে যায়, এর জন্য এত চিন্তার কি আছে? ঘটনা হল, অন্যের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপন অনেক সময়ই শরীর "সহজ ভাবে" মেনে নেয় না। কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া উপদ্রুত হলে শরীর যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেভাবেই নতুন অঙ্গকেও বহিরাগতদের দলে ফেলে আর রোগ-প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি তাকে আক্রমণ করে। এর ফলে সেই নতুন সিস্টেমে শ্বাসনালীও সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। একে বলে ট্রান্সপ্লান্ট রিজেকশন। শ্বাসনালীর মত অঙ্গের ক্ষেত্রে এই রিজেকশনের সম্ভাবনা প্রবল।

তাহলে নতুন শ্বাসনালী আসবে কি ভাবে? ক্লাউদিয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারেরা তার শরীরের এক বিশেষ ধরনের কোষ এ কাজে ব্যবহার করলেন - তার নাম স্টেম সেল। ক্লাউদিয়ার শরীরের স্টেম সেল তার অস্থিমজ্জা থেকে সংগ্রহ করে তা থেকে তৈরী করা হল শ্বাসনালীর কোষ। এরই মধ্যে এক মৃতের শ্বাসনালী সংগহ করে সেখান থেকে জীবকোষগুলোকে একে একে সরিয়ে ক্লাউদিয়ার নিজের স্টেম সেল থেকে উৎপাদিত কোষ দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত করা হল। তাহলে যে শ্বাসনালী পাওয়া গেল তাকে শরীর আর বহিরাগত ভাবতে পারবে না, কারণ শরীরের আর দশটা কোষের সাথে তার হুবহু মিলে যায়। এবার সেই "নিজস্ব" শ্বাসনালী প্রতিস্থাপিত করা হল ক্লাউদিয়ার শরীরে। প্রত্যাশামতই দিন-দশেকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠল ক্লাউদিয়া। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আর স্টেম সেল গবেষণায় এ এক যুগান্তকারী অধ্যায়।

কি এই স্টেম সেল যা ভেল্কিবাজী দেখিয়ে কোষ পুনরুৎপাদন করে ফেলছে? এটা জানতে গেলে আমাদের স্কুলে পড়া জীববিজ্ঞানের দুটো টুকরো জ্ঞানের কথা মনে করতে হবে। স্কুলে নিশ্চয় পড়েছিলেন যে মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের কোষ আছে - কোনোটা চ্যাপ্টা, কোনোটা লম্বা, কোনোটা অনেক অক্সিজেন ধরতে পারে, কোনোটাতে নিউক্লিয়াস নেই আবার কোনোটাতে অনেকগুলো নিউক্লিয়াস। আবার স্কুলেই এটাও পড়া হয়েছিল যে মানুষের শরীর ভ্রূণাবস্থায় শুরু হয় একটি মাত্র কোষ থেকে - সেই কোষই বিভাজিত হয়ে সারা শরীরের কোষ তৈরী হয়। তাহলে কিভাবে একই কোষ বিভাজিত হয়ে ভিন্ন-ভিন্ন ধরণের কোষে রূপান্তরিত হয়? ভ্রূণাবস্থায় প্রথম কোষটি কয়েকবার বিভাজিত হবার পরে একধরণের কোষ তৈরী হয় যা বিভাজিত হয়ে যে কোনো ভিন্ন ধরণের কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। তারাই হল স্টেম সেল। পূর্ণ মানুষের শরীরেও কোষ পুনরুৎপাদনের জন্য স্টেম সেল কাজে আসে। কোনো ক্ষতের ওপর চামড়া গজানোর জন্য একধরণের স্টেম সেল বিভাজিত হয়ে কোষ সরবরাহ করে। কিন্তু এটাও লক্ষ্যণীয়, যে পূর্ণ মানুষের শরীরের স্টেম সেল আর যেকোনো ধরণের কোষ তৈরী করতে পারে না। তাই বড়সড় ক্ষত হলে, তার ওপর চামড়া গজায়, কিন্তু মাংসটা আর গজায় না। স্টেম সেলের পুনরুৎপাদন-ক্ষমতা বয়সের সাথে সাথেই সীমিত হয়ে যায়।

বিজ্ঞানীরা আশা করেন যে ভবিষ্যতে স্টেম সেল থেকে যে কোনো ধরণের কোষই তৈরী করা সম্ভব হবে। ধরা যাক কারো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, তার হার্টের দুর্বলতর বা অকেজো কোষগুলোকে যদি স্টেম সেল থেকে পাওয়া হার্টের কোষ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে ফেলা যায়, তাহলে সেই হার্ট সুস্থভাবে কাজ করবে, হার্ট অ্যাটাকের রুগীকে আর মৃত্যুর জন্য দিন গুণতে হবে না। ইঁদুরের ওপর এই পরীক্ষা করে দেখাও গেছে যে তা হার্ট অ্যাটাকের পরে সুস্থ হয়ে উঠছে।

তাহলে সমস্যাটা কোথায়? বিজ্ঞান তো নিজের পথেই এগোচ্ছে। সমস্যাটা স্টেম সেল নিয়েই। স্টেম সেলের গবেষণা করতে গেলে যুক্তিসঙ্গত হিসাবেই অনেক স্টেম সেল লাগে। সহজ হিসাবে সেই স্টেম সেল পাওয়া যেতে পারে দুভাবে - পূর্ণ মানুষের শরীর থেকে সীমিত ক্ষমতার স্টেম সেল আর মানব-ভ্রূণের প্রাথমিক দশা থেকে। প্রথমটার ক্ষমতা সীমিত তাই বিজ্ঞানীদের অতটা আগ্রহ নেই তা নিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় ধরণের স্টেম সেল নিয়ে নিলে ভ্রূণের একরকম "প্রাণনাশ" হয়। তাতেই রক্ষণশীলদের আপত্তি। যা এক একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারত, তাকে "মেরে" ফেলে গবেষণার কাজে লাগানো হবে - বিজ্ঞানীদের এত স্পর্ধা? এর পরে তো দুদিন পরে কোনো রোগের গবেষণায় বাচ্চাদেরও গিনিপিগ হিসাবে কাজে লাগানো হবে। অনেক ধর্মমতে ভ্রূণের মধ্যেই আত্মা প্রবেশ করে, তাই ভ্রূণহত্যা মানবহত্যার সম-অপরাধ। সেই "অপরাধ" কেবল মাত্র গবেষণার কাজে করতে দিতে তারা রাজী নন। স্বাভাবিক ভাবেই, সরকারী টাকায় স্টেম সেলের গবেষণা আমেরিকার মত রক্ষণশীল দেশে চালানো সম্ভব হয় না।

একদিন টিভিতে দেখলাম, এক বিজ্ঞানী তার ল্যাবে দেখাচ্ছেন দুটো রেফ্রিজারেটর - দুটোর আলাদা পাওয়ার লাইন। একটার জিনিস অন্যটাতে রাখাও যায় না। কেন? না একটাতে স্টেম সেলের গবেষণা চলে, যাতে সরকারী রিসোর্স ব্যবহার করা যায় না। এরকম হাস্যকর দ্বিচারিতা কিসের জন্য? না, কিছু সাধারণ বহুকোষী প্রাণী - যা থেকে পরে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারত - তার হত্যা যাতে না হয় সে জন্য - বা, বহুকাল আগের কিছু অন্ধ সংষ্কার অনুসারে আত্মার প্রবেশ হবার পর সেই আত্মা ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচাতে। ক্লাউদিয়ার মত কিছু মানুষ কি সর্বব্যাপী অন্ধবিশ্বাসের কাছে ভাগ্যবান বলেই বিবেচিত হবেন? ভবিষ্যত আর কতকাল আমাদের অতীতের কাছে বন্ধক রেখে চলবে?

দুটো তথ্য সূত্র -
১) সি এন এন প্রশ্নোত্তর
২) হাউ স্টাফ ওয়ার্ক্স - স্টেম সেল
৩) খবরটা পড়তে পারেন এখানে


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

যথারীতি চমৎকার পোস্ট।
কথায় বলে প্রয়োজনই মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেয়।
অতএব, প্রয়োজনই একদিন ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতাকে ঝেঁটিয়ে ঠিকই বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করতে বাধ্য হবে। অন্ধ লাফালাফি যৌক্তিক কারণেই অনন্ত দীর্ঘ হতে পারে না।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

জিজ্ঞাসু এর ছবি

সহজবোধ্য লেখার জন্য ধন্যবাদ।
মানুষের জন্মের কোন পর্যায়ে আত্মার সংযোগ ঘটে সেটা বিবেচনা না করেও যেহেতু প্রাণের শুরু হচ্ছে ভ্রুণ থেকে সেক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্ন ওঠে।
অন্যদিকে স্টেমসেল গবেষণা যে চিকিৎসাক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে তাও মানবহিতৈষী উদ্যোগ। বিকল্প কোন উপায়ে গবেষণার উদ্যোগ নিশ্চয়ই সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

দিগন্ত এর ছবি

ঠিক কোথা থেকে প্রাণের শুরু, সেটা খুব বিতর্কিত বিষয়। ভ্রূণকে শুরু ধরলে শুক্রাণু আর ডিম্বাণু কি দোষ করে?


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দা এক্স ফাইলসের লেটেস্ট সিনেমা "আই ওয়ান্ট টু বিলিভ" দেখার পরেই স্টেম সেল নিয়ে অনেক আগ্রহের জন্ম হয়েছিল। আপনার লেখাটা খুব ভাল লাগল। ব্যক্তিগতভাবে আশা করব, স্টেম সেলের উপর রিসার্চ চলুক আরো, কারণ এ থেকে নিঃসন্দেহে অনেক যুগান্তকারী কিছু বেরিয়ে আসবে।

অভিজিৎ এর ছবি

চমৎকার পোস্ট। দিগন্ত ইদানিং অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ হয় উঠায় ভাবছিলাম, বিজ্ঞান নিয়ে বুঝি তার আগ্রহ ফুরিয়েছে! কিন্তু এই পোস্টটি প্রমাণ করল দিগন্ত আমাদের আগের দিগন্তই আছে। দিগন্ত এখন সব্যসাচি লেখক।

বাংলায় স্টেম সেল নিয়ে খুব বেশি লেখা বোধ হয় নেই। দিগন্তের লেখা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

সবজান্তা এর ছবি

দুর্দান্ত লাগলো লেখাটা। গত কয়েকদিনের সীমাহীন ব্যস্ততার কারণে লেখাটা মিস হয়ে গিয়েছিলো, আজ পড়ে দারুন লাগলো।

কিছুদিন আগে আমার খুব কাছের এক বন্ধুর মায়ের লিভারের সমস্যার জন্য নেটে কিছু ঘাটাঘাটি করছিলাম। সেখানে দেখলাম, লিভার ট্রান্সপ্লান্টের সাফল্য হার এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। এর কারণ হিসেবে ডাক্তাররা বলেছেন, ট্রান্সপ্লান্টেশন রিজেকশন এখন কমে গিয়েছে অধুনা আবিষ্কৃত কিছু ঔষধের কারণে, যেগুলো অনেকটা সময়ের জন্য শরীরের এন্টিবডিকে অকার্যকরী করে রাখে, যাতে সে সময়ের মধ্যে ফরেইন অর্গান নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়।

আশা করছি, স্টেম সেলের ব্যবহার সকল ধরণের ট্রান্সপ্লান্টেশনের ঝুঁকিই কমিয়ে দিবে...


অলমিতি বিস্তারেণ

ধ্রুব হাসান এর ছবি

ভালো লাগলো চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।