শেরালী-নয় (মুক্তির মন্দির সোপান তলে)

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/০৬/২০০৮ - ৪:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চৈত্রের খরতাপে প্রকৃতির রং ধূসর মলিন। শীত, বসন্ত পিছনে ফেলে বৈশাখের আশায়, গ্রীষ্মের মরন কামড় সয়ে নিচ্ছে ধরণী। কালবৈশাখীর প্রলয় নাচন না হলে এ খড়ার তাড়না থেকে মুক্তির ঊপায় কী!

কাল সাপের ফনার মত বন্দুক উঁচু করে আসছে হায়েনার দল। তাদের পূজো দিতে রাজাকার দাঁড়িয়ে গেছে সারি সারি। সংগতি সম্পন্ন হিন্দুরা প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। সহায় সম্বলহীন হিন্দুরা কর জোরে দাঁড়িয়ে আছে শিকারী বিড়ালের সামনে, ইঁদুরের মত। ধর্ম তুমি এত নির্মম কেন! কোথায় তোমার শান্তির বাণী?

কেরামত মাওলা খুব সুযোগ সন্ধানী মানুষ। বড় ছেলে রতনকে নিয়ে, দাঁড়িয়ে গেছে রাজাকারদের কাতারে। আটা, তেল, নূন কোন কিছুর অভাব নেই শেরালীর ঘরে। ডান্ডি কার্ড দেখিয়ে কেরামত মাওলা বেতনের টাকা আর রেশনের মাল আনছে ঘরে। চমৎকার মানিয়েছে খাকী পোশাকে রতনকে। কে বলবে এ ছেলের জন্ম বাঙ্গালীর ঘরে! 'হ্যায়' বলা রপ্ত করে নিয়েছে মাত্র কয়েক দিনে। কাঁধের রাইফেলের বেয়নেটটা উঁকি দিচ্ছে মাথার উপর সাপের জিহ্বার মত। শহরেই হানাদার হায়েনার হত্যাযজ্ঞ চরম প্রকৃতির। তার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায়, অনেক চাকুরীজিবী পালিয়ে এসেছে গ্রামে। কিন্তু ইতিমধ্যে ওরা গ্রামকেও গ্রাস করেছে। তৈরী হয়েছে শান্তি কমিটি। পালা করে রাজাকার শান্তি কমিটির সদস্য আর পাক হানাদাররা রাতের বেলায় রেল সড়কের পুল পাহারা দেয়। মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত রেখে স্থানীয় মুসলিম লীগের মেম্বার, চেয়ারম্যানদের সহযোগীতায়, শনাক্ত করছে আওয়ামীলীগ কারী, মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেয়া পরিবার গুলোর তালিকা।

বোয়ালমারী বাজারে আজ হাটের দিন। রাজাকার, তাদের সাথী সংগঠন জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, আর পাকিস্তানী প্রভুরা মিলে হিন্দুদের সব দোকানপাটের মাল নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছে। দোকানীদের হাত এবং চোঁখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেল ব্রীজের উপর। খালি দোকানে আগুন দেয়া হল। বাজারটা জ্বলছে দাউ দাউ করে। সব হিন্দুদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হল। পুঁটি মাছের ঝাঁকের মত মানুষ ছুটে পালাচ্ছে প্রাণ ভয়ে, যে যেদিকে পারছে। আগুনের লেলিহান শিখা আর রাইফেলের প্রাণসংহারী হুংকারে আকাশ ফেঁটে চৌচির। নাপিত আবু কর সারির একদম শেষ ব্যাক্তি, রাইফেলের ম্যাগজিন খালী। লোকমান রাজাকার ম্যাগজিনে গুলি ভরছে। খুনের নেশায় রাজাকার লোকমান এতই মত্ত যে, ইতিমধ্যে আবু করকে খুন না করার পাক কমান্ডারের ইংগিত বুঝতেই পারেনি। রাইফেল চোঁখ বাঁধা আবু করের বুকে তাঁক করেছে, ট্রিগারে আঙ্গুল, এমন সময় মেম্বার মতি ডাক্তারের ধমকে অতি ধীরে নামাল বন্দুক। আবু কর দ্বিতীয় জীবন পেল, এক ভয়ংকর শাস্তির।

এই বিভীষিকায় আক্রান্ত হল রমিজ রাজাকার। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল হাতের ষ্টেনগান নিয়ে অজানায়। হয়তঃ এবার মোহমুক্তি ঘটেছে তার। ঘোর অন্ধকার, জোনাকীর আলোই একমাত্র আগুনের চিহ্ন এই তমসার গায়। পুলে পাহারায় পাকিস্তানীরা জোনাকী দেখলে মনে করে মুক্তি ফৌজ বিড়িতে টান দিচ্ছে প্রতিশোধের নেশায়। ছোড়ে গুলি জোনাকীর গায়! লক্ষ্য যত অভ্রষ্টই হোকনা কেন, গুলি কি আর লাগে জোনাকীর আলোয়! লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলি বিঁধে স্তন্যপান রত অবুঝ শিশুর বুকে। এদের বর্বরতায় শিশুরাও প্রাণ হারায়।

বুকে ডিনামাইট; মাথায় কচুড়ীপানার টুপি। আমনের ক্ষেতের আইল ধরে ভেসে যেতে হবে পুলের নীচে। দূর থেকে ডিনামাইট ফাটানোর বারুদের দড়ি, নাটাই থেকে ছাড়ছে অন্য জন। মাঝে মাঝে রাজাকারদের শক্তিশালী টর্চলাইটের আলো এসে পড়ছে কচুড়ীপানায়, চমকে দিচ্ছে ক্ষনিকের জন্য মুক্তি যোদ্ধাদের মন। কিন্তু স্থির থাকতে হবে এ যাত্রায়। ক্ষেতের ভেতর ঢুকলে বিপদ কম; কিন্তু ধানের পাতা নড়লে গর্জে উঠবে রাজাকারের রাইফেল। এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে একজন পুলের নীচে, পাহারায় রত রাজাকারের চোঁখকে ফাঁকি দিয়ে। পুলের পাঁকা পিলারে বেঁধে ফেলেছে ডিনামাইট। ডানের পিলারে একটা, তার পর বায়ে এক খুঁটি বাদ দিয়ে আরেকটা। এবার বারুদের রশিটা দুটো ডিনামাইটে যুক্ত করতে হবে; তার পর পলায়ন। দ্রুত কাজ শেষ করে ডুব দিয়ে, নাটাই হাতে অপেক্ষারত সহ যোদ্ধার পাশে নিরাপদে ফিরে এসেছে সে । এবার একটা গ্রেনেট ছুড়ে দিল অন্যদিকে, যাতে রাজাকাররা ঐ দিকে গুলি ছোড়ে। এখন অগ্নি সংযোগ বারুদের দড়িতে। ভেঙ্গে যাক হানাদারদের যোগাযোগের সব মাধ্যম, এই ব্রীজটার মতন।

হলদে পাট ফুলের ধূসর পাঁপড়ি গুলো পাটের ফলে ঝুলে আছে পরিত্যাক্ত পালকের মত। ফড়িং গুলো উড়ে বেড়াচ্ছে ইতস্ত-বিক্ষিপ্ত। টুনটুনির বাচ্চা গুলো লাফ দিয়ে ডালে ডালে ঘুড়ে বেড়ানোর সময় ডানা মেলে উড়াল দেয়ার প্রশিক্ষন নিচ্ছে। ধুতুরার ফুল মেলে ধরেছে বিষের ডালা। বাবুদের বাগানে সবুজের সাথে পালা করে ফুটেছে, হলুদ-সাদায় কদমের ফুল। পাঁপড়ি লুকিয়ে সবুজ শরীরে, কান্ডে ঝুলে আছে অসংখ্য ডুমুর। অতি যত্নে সাজিয়েছে বেন্না, ফুলের ডালা। সবুজের পাতায় মোড়া হলদে পাঁকা গাবের রং উঁকি দিচ্ছে আব্রু ভেদ করে। এতো সমারহো বৈচিত্রের পাশে গাবই একমাত্র আহারের উপযোগী ফল।

কিন্তু শেরালীর মন ঝুকেছে আজ শিকারের দিকে। গোলা-বারুদ জমে আছে পাটের বিচি হয়ে অতিরিক্ত ভাবে। মাহাল বাঁশের গিট্টু হীন একটা খন্ড আর জিংলার ট্রিগার। প্রথম বিচিটা বাঁশের ছিদ্রে ঢুকে জিংলার গুতোয়, পরের ছিদ্রের মুখে গুলি হয়ে অপেক্ষা করবে। শিকার দেখে শেরালী দ্বিতীয় গুলি বাঁশের ছিদ্রে ঢুকিয়ে দিবে ধাক্কা, জিংলার ট্রিগার দিয়ে। লুটিয়ে পড়বে শিকার। কিন্তু টুনটুনির বাচ্চা গুলো এত চঞ্চল, শেরালী লক্ষ্য স্থির করার আগেই লাফ দিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য ডালে। পাট খড়ীর আগায় কাফিলার কষ লাগিয়ে ফড়িং ধরা খুব সহজ বলে, বাঁশের বন্দুকে পাখি শিকারের সাধ হয়েছিল তার।

সূর্যটা গাব ফলের রং নিয়ে রাঙ্গিয়েছে পশ্চিমের আকাশ। গোমতীর জলে তার প্রতিচ্ছবি আগুনের মত জ্বলে। শেরালী পরাজিত সৈনিকের মত অবহেলায় বাঁশের বন্দুক কাঁধে ঝুলিয়ে এবার ঘরমুখো হল।
পাটের ক্ষেত প্রায় জঙ্গলের মত। নদীর জল বোরো ধানের জমি গ্রাস করে এই উঠল বলে পাট ক্ষেতে। মাত্র বিঘত খানেক বাকি। আকাশের আগুন জ্বলে ধীরে ধীরে ছাই হচ্ছে, কালো কয়লায় ঢেকে যাচ্ছে চরাচর। ইঁদুর আর ব্যাঙ খেতে তীরের কাছে আনাগোনা করছে বোয়াল মাছ। ধূর্ত শেয়াল ডাঙ্গায় বসে লেজ নাড়াচ্ছে জলের উপড়। শেরালি ওৎ পেতে বসে গেছে চিতা বাঘের সর্তকতা নিয়ে। শিয়াল এক লাফে ঢুকে গেছে পাট ক্ষেতের ভেতর। ইঁদুর ভেবে শেয়ালের লেজে কামড় দিয়ে ঝুলে থাকা বোয়ালটা নিয়ে লড়াই হবে শেয়ালের সাথে শের-এর।

পাড়ায় কেউ তেমন একটা খেয়াল করল না শেরালীর সাফল্য। শুধু আনন্দে মায়ের মুখখানা উদ্ভাসিত হল, কুপির ঝাপসা আলোয়।
রাত দুপুরে পুড়োটা পাড়া ভেঙ্গে পড়েছে শেরালীর ঘরে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে শেরালী চমকে উঠল মায়ের রণ-রঙ্গিনী রূপ দেখে। কেরামত মাওলা মাটির মানুষ হয়ে গেছে। মায়ের খিচুনী, বকুণী, কিল খামচির কোন প্রতি আক্রমন তো দূরের কথা প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে ভুলে গেছে। চোখের জল দাড়ি বেয়ে ঝরে পড়ছে অঝরে হোগলায় পেচানো একটা কিছুর উপড়। মা সেটা কোলে করে এবার মন দিলেন বিলাপে।
আমনে আমার এই দুধের শিশু লইয়া গেলেন পুল ডিওটিতে।

মুক্তি বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে পুল উড়িয়ে দিয়েছে। পাহারারত আরো কয়েক জনের সাথে খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেছে রতনের দেহ। তারই কয়েকটা অংশ এই হোগলায় পেচানো।

ক্রমশ...


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চিত্রটা পরিষ্কার হবে আর কিছুক্ষণ পর।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

পুতুল এর ছবি

তাই, মুক্তি যুদ্ধের মত একটা বিশাল ব্যপার এক পর্ব কী ভাবে শেষ করি!
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

শব্দবাক্যে গাঁথা মহৎ চলচ্চিত্র

পুতুল এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

স্পর্শ এর ছবি

দৌড়ের উপর আছি। পড়ব একটু পরে! আপনার লেখা গুলো মন দিয়ে পড়ি তো। হাসি
শুভেচ্ছা।
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পুতুল এর ছবি

ঠিক আছে।
আপনার আন্তরিক মতামতগুলো খুব কাঝে লাগে।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

এনকিদু এর ছবি

আগের খন্ডেই বলেছিলাম, গল্পের বর্তমান শুরু হয়েছে । এখন মনে হচ্ছে গল্পের ঘটনাটাও শুরু হল । পুতুল মনে হচ্ছে সময় নিয়ে প্রতিটা খন্ড লিখছেন । সময় নিন, লেখাটা ভাল হোক । তাড়াহুড়ো করে নষ্ট করার মানে হয় না ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

পুতুল এর ছবি

সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
চেষ্টা করছি, সময় পাওয়াই কঠিন!
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

লোকমান রাজাকার, রমিজ রাজাকার....এই দু'জনের বিষয়টা একটু যেন বুঝতে পারিনি।

এর বাইরে লেখা আর বর্ণনা প্রতিবারের মতোই অসাধারণ! সামনের পর্বের অপেক্ষায় আছি....!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

পরের পর্ব গুলোতে লোকমান রাজাকারকে আরো ভাল করে চেনা যাবে। তবে রমিজ রাজাকারের ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যেত।
মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ তীরুদা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

শাহীন হাসান এর ছবি

পাহারারত আরো কয়েক জনের সাথে খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেছে রতনের দেহ। তারই কয়েকটা অংশ এই হোগলায় পেচানো।
ভাল-হচ্ছে, চলুক ...।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ কবি।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

স্পর্শ এর ছবি

নৈসর্গিক বর্ণনা বরাবরের মতই দারুণ!!
শেয়ালের মাছ ধরার ব্যপার টা ভাল লেগেছে।
রাজাকার রা বেশী ফোকাস পেয়েছে। কাহিণীর প্রয়োজনেই মনে হয়।
পরের পর্বের অপেক্ষায়... হাসি
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পুতুল এর ছবি

স্পর্শ, ধন্যবাদ আপনাকে।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।