শেরালী-দশ (মুক্তির মন্দির সোপান তলে-২)

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: বুধ, ০৪/০৬/২০০৮ - ২:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জগৎবাসী একবার আসিয়া
সোনার বাংলা যাও দেখিয়া রে।।
ওরে পাকিস্তানের বর্বর ইয়াহিয়া
মেশিন গান আর বেনেট, বুলেট দিয়া
সোনার বাংলা করল শ্মশাণ রে।।
ভাদ্র মাসের জল ডালিমের রসের মতন। দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সে জলে সাধু সওদাগর পানসীতে ভেসে চলে। এমন পানির বহর অনেক বছর হয়নি। না ডুব ,না সাঁতার। নৌচলাচলের বিশেষ উপযোগী, সে টা শত্রু-মিত্র সবার জন্যই। চাল কুমড়া আর মিষ্টি কুমড়া ছাড়া আছে ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা। বারমাসি ফলের মধ্যে নাড়িকেল, কলা। শেরালীর খাদ্য তালিকায় শুধু শষা। রতনের কবরে গাঁথা বঁরই গাছের ডালটা অনুকূল আবহাওয়ায় নতুন কঁচি পাতা মেলছে। কবরের চার কোনায় গুজে রাখা রসুনের কোয়া এখন গাছ হয়েগেছে। কবরস্থানটা গ্রামের মাঝখানে। একটা আলাদা বাড়ীর মতন। কড়ই, তাল আর কয়েকটা বেন্না গাছ ছায়া দিচ্ছে ঘুমন্ত মানুষ গুলির অদৃশ্য শরীরে। পানির এক হাত উঁচুতে মটকুরার ঝোপের মাথায় চুলের মত বিছিয়ে আছে স্বর্ণলতা। দু'একটা ঘুঘুর ডাক কবরস্থানের মৌনতায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। শেরালী দুপুরের দিকে প্রায় প্রতিদিন এখানে আসে। কোন কারণ ছাড়াই। মনে মনে বলে: রতন তুই বড় হলি কেন! আমার মত ছোট থেকে গেলে তোর এত ঝামেলা হত না। টুপ করে একটা তাল পড়ল পানিতে। রতন ফেলল নাতো! শেরালী সেখানে যেতে যেতে তালটা জল থেকে ভেসে উঠেছে। তালটাকে বুকের নীচে রেখে ক্ষেতের আইলের উপর দিয়ে সাঁতরে বাড়ি গিয়ে দেখে, হুলুস্থুল কান্ড।

ডিঙ্গি নৌকায় সাত আট জন পান্জাবী আর লোকমান রাজাকার। এখন ওরা গ্রামেও টহল দিচ্ছে। এতদিন বাজার আর রাস্তার টহলেই ব্যস্ত থাকতো। রতনের মৃত্যুর পর এক সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই পাঞ্জাবীরা লঞ্চ নিয়ে গ্রামে আসে, মুক্তি ফৌজের খোঁজে। কিন্তু দিনের বেলায় মুক্তি বাহিনী ঘরে বসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করবে! এত আহাম্মক হলে যুদ্ধ করে কী ভাবে!
গাছের ফল, গোয়ালের গরু, এমনকি হাঁস মুরগীও বাদ গেলনা। মুক্তি বাহিনীতে গেছে এমন সব পরিবারের গোলার ধান সহ, সব লঞ্চে তুলে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিল পাহ হানাদার আর রাজাররা। নজরুলের (ছাত্রলীগের ডাকসুর সদস্য) বাপকে চোরের মত পেছনে হাত বেঁধে সঙ্গে নিয়ে গেল হানাদারে দল। এপাড়ায় জ্বলছে পাঁচটা বাড়ি। টিনের ঘর আগুনে জ্বলার মত শুধু কাঠ। তাই তেমন বেশী আগুন দেখা যাচ্ছেনা। কালো ধোঁয়া নীল আকাশে কাজল পড়াচ্ছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে এখন ঋষিপাড়া। সবই ছনের ঘর। লাল লেলিহান শিখা সূর্যকে হার মানাচ্ছে। হিন্দুদের টিনের ঘর রাজাকারেরা ভাগ বাটোয়ারা করে যে যার বাড়ি নিয়ে গেছে। তাই হিন্দুদের ছনের ঘর গুলিই শুধু জ্বলছে।

নজরুলের বাপের লাশ তার পরের দিন বৈশার চরে পাওয়া গেছে। গ্রামের মানুষ ভেবেছিল এই শেষ। পানজাবীরা আর গ্রামে আসবেনা। কিন্তু এখন শেরালী দেখে এরা তাদের বাড়ী! বাবাকে ডিওটিতে রেখে রতনের মৃত্যুতে তার মাকে সমবেদনা জানাতে এসেছে। শেরালীকে আদর করে একজন কাছে ডাকল। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল শেরালী। লোকমান রাজাকার অভয় দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে ওরা বিদেয় হল। রতনের মৃত্যুর পর বাবা শুধু দিনেই ডিউটি করে। ঘরের পরিবেশ খুব শান্ত।

মনের ভুলে মা আজও রতনের থালায় ভাত দিল। বাবা দেখি তেমন কিছু বলল না। খাওয়ার মাঝখানে মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। এ কান্না কি কোন দিন থামবে! কারওই ভাল করে খাওয়া হলনা।

মায়ের গো গো, ফিস-ফিসানী আর ধস্তা ধস্তিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল শেরালীর। কি হল, কি না হল, ভাল করে কিছু বোঝার আগেই, বেশ কয়েক জন ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবার মায়ের চিৎকার কানে এল।
আফনে গো হাতে ধরি, পায়ে পরি আমারে রারী কইরেন না। আমার পোলাডা গেছে, আমার জামাইডারে ছাইরা দেন। খোদার দোয়াই লাগে।

বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ওদের পেছনে পেছনে।
কিন্তু এতক্ষনে দ্রুত বৈঠা চালিয়ে ওরা অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। পড়শীরা ওদের চলে যাওয়ার পর, নিরাপদ বোধ হাওয়ায় ঘটনা জানতে এসেছে।

মুক্তি বাহিনী কেরামত রাজাকারকে ধরে নিয়ে গেছে।
ক্রমশ...


মন্তব্য

তীরন্দাজ এর ছবি

কালো ধোঁয়া নীল আকাশে কাজল পড়াচ্ছে।

উপমাটি অস্বাভাবিক ভালো লেগেছে। আরো আরো অনেক সুন্দর মূল্যবান উপমার সমারোহ আপনার লেখায়! কিশোর শেরালীর অনুভূতির প্রকাশও আপনার কলমে অসাধারণ!

সামনের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ তীরুদা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পড়তেছি আর ভোট দিতেছি... মন্তব্য হবে সবশেষে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ পড়া আর ভোটের জন্য।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

শাহীন হাসান এর ছবি

ভাদ্র মাসের জল ডালিমের রসের মতন। দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
টলটলেজল দেখতে পাচ্ছি ...। ভাল লাগছে, পুতুল।
কিন্তু একটা বিষয় বলতে হচ্ছে, শেরালী, আর উত্তম পুরুষ (আমি)র মধ্যে একটা জটিলতা লক্ষ করছি, বলেই মনে হচ্ছে আমার?
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

স্পর্শ এর ছবি

এই পর্ব আর গত পর্বে সমস্যাটা চোখে পড়েনি আমার। আগের পর্বগুলোতে অবশ্য লেখককে বলেছিলাম। আপনি কি জটিলতা টা এ পর্বে পেয়েছেন?

[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ গুরু। কিন্তু এখন থেকে নাম পুরুষেই লিখব।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

পাঁচ তারা!!!
কোনো কথা নাই!

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ কবি।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

অসাধারণ

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ প্রিয় নুশেরা তাজরীন |
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

স্পর্শ এর ছবি

এইতো দেখতে দেখতে দারুণ হচ্ছে গল্পটা! কিছু পর্ব পড়ে মনে হয় 'এত ছোট কেন?' আসলে ভাল লাগে বলেই এরকম হয় সম্ভবত। এই পর্বটাও সেরকম। হাসি

[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ খুব কাছে থেকে শেরালীর খোজ খবর নেয়ার জন্য।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।