শেরালী-বারো (শহীদ পট)

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: সোম, ০৯/০৬/২০০৮ - ৩:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভরা যৌবন পেরিয়ে বর্ষা এখন বিজ্ঞ গৃহিণী। ধীরে ধীরে আর সব রমনীয় ভাটার অমোঘ টানে ভেসে যাবে। সঞ্চিত অভিজ্ঞতার মত ঘন হচ্ছে জল। প্রসূত মাছের পোনারা আগামী বরষায় প্রজননের লোভে বেড়ে উঠছে। আমনের গলা ফুলেছে। সাবধানী চাষী দু"একটা ধানের গলা ছিঁড়ে আগমনী ফসল কল্পনা করে নিচ্ছে। বৃষ্টির উপদ্রব আর নেই। প্রকৃতি এখন কত শান্ত!
অশান্ত শুধু পাক হানাদার আর রাজাকরদের মন। মুক্তি ফৌজের হামলা এখন যখন তখন যেখানে সেখানে ঘটতে পারে। এত ভয় নিয়ে মানুষ শান্ত থাকে কি করে! অশান্তির কারনেই অতিরিক্ত সতর্কতা। খুব বেশী সতর্ক থাকতে গেলেই ভুলও খুব বেশী হয়। অতর্কিত আক্রমনে প্রতিদিনই পাক বাহিনী বা দু"একজন রাজাকার মারা যাচ্ছে।
এমন সাফল্যে অতি উৎসাহী হয়েই নজরুল এই ভুলটা করে বসল। পিতার খুনী লোকমান রাজাকার আর পাক হানাদারদের আক্রমন করল। সাথী যোদ্ধারা মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু নজরুলের বুকের আগুন তাতে আরো জ্বলে উঠল। তাকে নেভাবে কে? পিস্তলের সব গুলি শেষ হলে, গ্রেনেটটা ছুড়ে দিল। তাতে শত্রুর সব বাংকার ধ্বংস হয়নি। অথচ নজরুলের হাতে আর কোন অস্ত্র অবশিষ্ট নেই। বুকের উপর রাইফেল তাক করে নজরুলের হাত বেঁধে ফেলল লোকমান রাজাকার। কমান্ডারের ইশারায় নজরুলকে মারা হলনা। বোয়ালমারী বাজারের ক্যাম্পে নিয়ে আসা হল। রাজাকার নজরুলের সব পরিচয় প্রভু পাক বাহিনীর কাছে প্রকাশ করল।
নজরুলের মামা হুদা সাহেব মুসলীম লীগের এম পি প্রার্থী ছিলেন। তাকে খবর দেয়া হল। সারা রাত পাক হানাদার আর রাজাকারদের অকথ্য নির্যাতনে নজরুলের শরীর ন্যূজ। কিন্তু চোখ দুটি যেন তারার মত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। রাতের মধ্যেই দূরদূরান্তের গ্রামের মানুষেরা এখবর পেয়ে গেছে। ভোর থেকেই দলে দলে মানুষ নজরুলকে একবার চোখের দেখা দেখতে বাজারটা জনসমুদ্রে পরিনত করে ফেলেছে। মানুষের ঢল থামাতে হানাদাররা অনেক ফাঁকা আওয়াজ করেও ব্যর্থ হয়েছে। পাক হানাদার আর রাজাকার, বেষ্টনী করে, নজরুলকে ঘিরে রেখেছে। নজরুলের হাত পেছনে বাঁধা, চোখ বাঁধা হলো। কোন বিয়োগান্তক গ্রীক নাটকের মঞ্চ। তার চারিদিকে উৎকীর্ণ উত্তেজিত দর্শকের উপচেপরা ভীড়।

মামা পাক কমান্ডারকে করজোরে অনুনয় করে বললেন: ছোর দেও উস্কো। ইয়ে মেরা বহিন কা বেটা।
মে পাকিস্তান কা শান্তি কমিটিমে হু। মেরা বাত মানলিজিয়ে। এয়ে মেরা বেটা যেছে। ছোর দেও ইসকো।
মজার খেলা পেয়ে পাক কমান্ডার মজা করেই বলেন:
লেকিন ইয়ে মুক্তি ফৌজ হে। হাম লোক আপকা বহিনকা বেটাকো, মেরা বহিনকা বেটা মান্তা হো। এতনা পেয়ারছে ইনকু সিনামে মিলাতুহু। লেকিন স্রেফ এক বাত ইনকু বাতানা হে? মুক্তি ফৌজ ছোরকে ইয়ে হামার সাথ দেনা হে। হামলোক ইনকো কেপ্টেন বানায়েগী।

আহত বাঘের হুংকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে: হাত পা চোখ বাঁধা। মুখ তো বাঁধা নয়! ড্রাগনের মুখের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত মুখ থেকে বেরিয়ে আসে; আমার মায়ের, আমার বোনের ধষর্ক; আমার ভায়ের, আমার পিতার ঘাতক; শুনে রাখ: তোদের অত্যাচার, অন্যায়ের প্রতিকার করতে নজরুলরা অস্ত্র হাতে নিয়েছে। তোদের বিষ দাঁত ভেঙ্গেই তবে ক্ষান্ত হব। ক'জন নজরুলকে তোরা স্তব্ধ করবি! ঐ চেয়ে দেখ স্বাধীন বাংলার পতাকা হাতে বিদ্রোহী জনতা ধেয়ে আসছে। এখনো সময় আছে প্রাণে বাঁচতে চাইলে, পালা। স্বাধীন বাংলার জয় পতাকা উড়ল বলে। জয় বাংলা।
জনতার মুখে তা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে দিগন্তে ছড়িয়ে গেল। নবদিগন্তের ঘোষনার এই প্রতীক্ষায়ই যেন জড়ো হওয়া মানুষ গুলো প্রত্যাশা করছিল! তাদের তৃপ্ত প্রতি ধ্বনিতে হায়েনার দল দিশেহারা হয়ে গেল।
সদ্য জল মুক্ত স্কুলের খেলার মাঠে, ডিনামাইট পিঠে বেঁধে, নজরুলকে শোয়ানো হল। কি বীরবিক্রমে নজরুল, স্বাধীনতা নামক ঈশ্বরের বেদীতে, বাংলার মানুষের মুক্তির অর্ঘ্য হয়ে রইল! কাপুরুষ ঘাতকের দল, নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বারুদে অগ্নি সংযোগ করে, নজরুলের মুক্ত নিঃশ্বাস চীরতরে স্তব্ধ করে দিতে।
কিন্তু তারা জানেনা; নজরুলের রক্তে রঞ্জিত এই বাংলায়, স্বাধীনতার পত্রে-পুষ্পে, ফুলে-ফলে সুশোভীত, এ জাতীর গায়ে মায়ার লাল-সবুজের চাদর, চীরদিন অম্লান হয়ে, রয়ে যাবে! একটি মাত্র নজরুলের বুক থেকে বিস্ফোরিত ডিনামাইট, পৃথিবীতে স্বাধীন বাংলার তোপধ্বনি করল। সুজলা-সুফলা সোনার বাংলাকে উর্বর করতে, বাতাসে ভেসে, নজরুলের আত্মা বাংলার আকাশে মিশে গেল।
আজো তারা পলাশ, কৃষ্ণচূড়া আর শাপলা হয়ে বাংলায় ফোঁটে। দোয়েল, শালিক বলাকার বেশে বাংলার আকাশে উড়ে।


মন্তব্য

স্পর্শ এর ছবি

সকল শহীদকে সালাম!

অসাধারণ লিখেছেন! অসাধারণ...
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ,
সকল শহীদকে সালাম।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখা আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। তবে মন্তব্য করা হয় না নিয়মিত আলসেমি করে। বরাবরের মতো অসাধারন আপনার লেখা। হৃদয় ছুঁয়ে গেল।

কীর্তিনাশা

পুতুল এর ছবি

এভাবে মাঝে মাঝে ভাল লাগাটুকু জানিয়ে গেলে উৎসাহ পাই, লেখায় জোর আসে। ধন্যবাদ কীর্তিনাশা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

সাবধানী চাষী দু"একটা ধানের গলা ছিঁড়ে আগমনী ফসল কল্পনা করে নিচ্ছে।

কিন্তু তারা জানেনা; নজরুলের রক্তে রঞ্জিত এই বাংলায়, স্বাধীনতার পত্রে-পুষ্পে, ফুলে-ফলে সুশোভীত, এ জাতীর গায়ে মায়ার লাল-সবুজের চাদর, চীরদিন অম্লান হয়ে, রয়ে যাবে! একটি মাত্র নজরুলের বুক থেকে বিস্ফোরিত ডিনামাইট, পৃথিবীতে স্বাধীন বাংলার তোপধ্বনি করল। সুজলা-সুফলা সোনার বাংলাকে উর্বর করতে, বাতাসে ভেসে, নজরুলের আত্মা বাংলার আকাশে মিশে গেল।
আজো তারা পলাশ, কৃষ্ণচূড়া আর শাপলা হয়ে বাংলায় ফোঁটে। দোয়েল, শালিক বলাকার বেশে বাংলার আকাশে উড়ে।

খুব ভাল লাগছে। অসাধারণ সব বর্ণনা, অসাধারণ আবেগ স্বাধীনতাকে ঘিরে, এদেশের সাধারণ মানুষকে ঘিরে....!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ গুরু, উদ্ধৃতিগুলো তুলে ধরে এমন ভাবে মন্তব্য করেন,
লেখার পরিশ্রমটা সার্থক মনে হয়।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

তীরন্দাজের কথাগুলোই বলতে চেয়েছিলাম।
শুধু '৭১ নিয়েই বিশাল একটা উপন্যাসের দাবী জানাচ্ছি।

পুতুল এর ছবি

আসলেই আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে খুব বেশী সাহিত্য নেই! সময় সুযোগ পেলে হয়তো চেষ্টা করবো। আমাকে স্বাধীনতা নিয়ে উপন্যাস লেখার যোগ্য মনে করেছেন বলে কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

আহত বাঘের হুংকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে: হাত পা চোখ বাঁধা। মুখ তো বাঁধা নয়! ড্রাগনের মুখের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত মুখ থেকে বেরিয়ে আসে; আমার মায়ের, আমার বোনের ধষর্ক; আমার ভায়ের, আমার পিতার ঘাতক; শুনে রাখ: তোদের অত্যাচার, অন্যায়ের প্রতিকার করতে নজরুলরা অস্ত্র হাতে নিয়েছে।

কী সাংঘাতিক বর্ণনারে ভাই! পুরোটাই অসাধারণ!

পুতুল এর ছবি

আখতার ভাই অনেক অনেক ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

শাহীন হাসান এর ছবি

স্বাধীন বাংলার জয় পতাকা উড়ল বলে। ........
উড়ুক ...।

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

পুতুল এর ছবি

গুরু মনে হয় বেশ ক'দিন দেখিনি! আশা করি ভালছিলেন।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

Pagol  mon এর ছবি

আজ কাল এখানে আসিই যেন আপনার এই লেখা পড়তে ..... চোখ ভিজে ওঠে .... চমৎকার /

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ "পাগল মন"। খুব ভাল লাগল। আশা করি সব সময় সাথে থাকবেন।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।