শেরালী-ষোল (সোনার বাংলা)

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: শনি, ২১/০৬/২০০৮ - ৪:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কাচি ডেহার (বাছুরের) কান্দে জোয়ালের মত, শেরালীর ঘাড়ে সংসারের ঘানি টানার দায়ীত্ব পড়ল। কাজের জন্য খুব সন্ধান করতে হলনা! দুলু কাকুর কথামত খড়ের বিড়া (পাগড়ী) মায়ের ছেঁড়া শাড়ীতে পেঁচিয়ে রেখেছে।
আপন হাতের মুঠোয় পুড়ে বিশ্ব জগৎ দেখার সঙ্কল্প নিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মনে হয়নি যে, ঊষার আলো রাঙ্গা প্রভাত আনার আগেই, বিশ্ব দেখা কত কঠিন! মুসাফিরের মত কাঁধে গাটুরি ঝুলিয়ে দুলু কাকুর পিছে দুলতে দুলতে এ বিরাট পৃথিবীর মহা পরাক্রমশালী বীরদের মত মজুরী নামক রাজ্যের সন্ধানে পা বাড়ালো শেরালী।
মাটি আর মানুষের জোগানে ভাটা পড়ার সম্ভবনা নেই বলেই এ সময়ে ইটের ভাটায় কাজের জোয়ার আসে। শীত বসন্তের বৃষ্টিহীন শুষ্কতায় খোলা আকাশের নীচেই তাবৎ বিশ্বের যাবতীয় নির্মাণ কাজের কাঁচা মাল "ইট" পুড়িয়ে নেয়া হয়। নতুন রাজ্যে অবরোধকারী বাহিনীর তাবুর মত অস্থায়ী এ সব ইটভাটা, বিজিত রাজ্যের লুন্ঠিত দুর্গের মত পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে থাকবে, ধর্ষীতা রমনী যেন! শেরালীরা সে দুর্গের সৈনিক।
শিশির সিক্ত শেফালী ফুলের ঘন সৌরভ নয়, নগ্ন পদে, ব্যাথিত ধরনীর শীতল অশ্রুর মত ঘাসের ডগায় জমে থাকা বিষ, প্রতি চুম্বনে জানিয়ে দিচ্ছে "পথ বন্দুর"। সে সর্তকতায় সাবধান থাকার কারণে মঙ্গল বা কল্যানের জন্য মুয়াজ্জিনের আহ্বানে সাড়া দেয়া গেল না। মানুষের কাছে ঘুম থেকে কাম উত্তম। অন্ধকার দূর করতে ঊষার আলো এখনো পথ পরিষ্কার করেনি। আলোর উৎস পিছনে থাকলে সামনে নিজের ছায়া যেমন, অনেকটা তেমনি দুলু কাকুকে অনুসরণ করছে শেরালী।
মাথায় মায়ের আঁচল পাগড়ীর মত বেঁধে, বিড়াটা দড়ি দিয়ে থুতনির সাথে বাঁধা। কাঠের পিঁড়ির মত একটুকরো কাঠ বিড়ার উপড় বিছিয়ে তাতে দু'হাতে দুটো ইট রাখলো; আবার দুটো। এভাবে ছয়টি ইট মাথায় নিয়ে পৃথিবীর বোঝা টানায় যোগ দিলো শেরালী।
এখন ঊষার আলো মাথার ভারী বোঝার মত জ্বালা দিয়ে যাচ্ছে। ইট থেকে খসে পড়া বালি ঘামের বিন্দুতে মিশে কলুর বলদ কুলিকে মাটির মানুষ করে দিয়েছে। বোঝাই মেস্তুরী পোড়ানোর জন্য থরে থরে সাজিয়ে রাখছে কাঁচা ইট। পোড়াই মেস্তরী তদারকী করছে ইটের ভাঁজে ভাঁজে আগুনের পরশের পথ ঠিক আছে কি না! মাথা থেকে নামিয়ে একটা একটা করে ইট সাজানো হচ্ছে। শেরালী একটু একটু করে বড় হচ্ছে। পরের বোঝা যেন আরো দ্রুত পৌঁছে দিতে পারে বোঝাই মিস্তিরির হাতে। ইট নিয়ে যাওয়ার পথে, লাল পোড়া ইট নিয়ে যাতায়াত করে ট্রাক্টর নামের যন্ত্র দানব। সর্তক না থাকলে তার তলায় পিষ্ট হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে মাটির শরীর!
যুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীর ডিনামাইটে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ব্রীজ চালু করতে হবে জলদি। তাই সব দিকে সাড়া জেগেছে, সবাই কাজের চাপে অস্থির।

যুদ্ধের ভয়াবহ সময় চালের দাম ছিল মনপ্রতি ৪০ টাকা। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা স্বাধীন সোনার বাংলায় ৪০ টাকা দরা (৫ সের) চাল। এখন আর মনের হিসাব কেউ করে না। তাই ৫ সেরে এক দরা নামে নতুন একক তৈরী হয়েছে। শেরালী এক দরা চাল কেনার স্বপ্ন দেখে। গত সপ্তাহর রেজা-টানায় (ইটের বোঝা) চালের সাথে আনুসাঙ্গিক বাজার করতে গেলে বড় জোর ১ সের চাল কেনা যায়। বাজারের অন্য অনেক ক্রেতার মত শেরালীর মাথায়ও এখন বেশী প্রয়োজনীয় জিনিসটি স্থির করা বড়ই কঠিন।

শেখ মুজিবের কম্বল আর ছেঁড়া কাঁথায় তিন জনের শীত কোন ভাবে কেটে যায়। কিন্তু শেরালীর মায়ের পরনের কাপড় জোড়া তালি দিয়েও আর আব্রু ঢাকে না। মায়ের জন্য যেভাবেই হোক একটা শাড়ী কেনা চাই। সব চেয়ে কম দামী শাড়ী কেনার টাকাও শেরালী গত এক সপ্তাহে রোজগার করতে পারে নাই। পাঁচসিকার লুঙ্গি দুলুকাকু পাঁচ টাকা দিয়েও কিনতে পারে না। বেপারী দশ টাকার কমে বিক্রি করলে লাভ তো দুরের কথা চালান উঠা দায়।
ক্ষুধায় আর লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মত জিনিস পত্রের দামে সবাই দিশেহারা। কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত আবুকরের উলঙ্গ নৃত্য। আবু কর কিছুদুর গিয়েই নিজের লিংগটা উঁচু করে ধরে চিৎকার বলে, সোনার বাংলা... হেঃ হেঃ হেঃ সোনার বাংলা। যুদ্ধের সময় পাক হানাদার আর রাজাকারা অন্য সব হিন্দু ব্যবসায়ীর সাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে আবু করকেও গুলি করে। কিন্তু আবু করের গায়ে গুলি লাগে নাই। দ্বিতীয বার আবু করকে আর গুলি করে নাই হায়েনারা। আবু কর বেঁচে গেল, তবে সে থেকেই পাগল। এবার দুলুকাকুর সামনে এসে বিশেষ ভঙ্গিতে লিঙ্গটা উঁচু করে ধরে আবু কর সোনার বাংলা বলতেই, কিছু বুঝে উঠার আগেই দুলু কাকুও ছেঁড়া গামছাটা খুলে ফেলে দিয়ে, আবু করের ভঙ্গিতে লিঙ্গটা ধরে বলতে লাগল সোনার বাংলা হেঃ হেঃ হেঃ সোনার বাংলা...
ক্রমশ...


মন্তব্য

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

উদ্ধৃতি
ধর্ষীতা রমনী যেন!
আমাদের প্রিয় লেখকের ব্যবহৃত চিত্রকল্পটিতে আমার আপত্তি।
যুক্তি ১. এমন হলে পুরুষদের ০.০০১% ও ভালো না।
২. নারীর অবমাননা নির্বিচারে।
বাকিগুলোর জন্য আগের মতই আন্তরিক ধন্যবাদ।

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পুতুল এর ছবি

বেশী ওস্তাদী করতে গিয়া ধরা গাইছি। পরিবেশ দূষনের কতা বুঝাইতে চাইছি। পড়ার জ্য ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

এনকিদু এর ছবি

পুতুল, সময় নিন । আপনার পাঠকেরা পালাবে না ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ এনকিদু। লেখাটির পেছনে একটু তাড়া ছিল।
পরের পর্বে সময় নিতে হবে।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

স্পর্শ এর ছবি

ভাল লাগলো যথারীতি! যুদ্ধোত্তর সময় টা বোঝার চেষ্টা করছি।
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কীর্তিনাশা এর ছবি

এনকেদু ভাইর সাথে একমত আপনার লেখকরা পালাবে না।

-----------------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

শাহীন হাসান এর ছবি

বিলম্বে হলেও পড়েছি, ভাল হয়েছে, পুতুল।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।