ডেয়র ষ্টেপেনবল্ফ (বা বাংলায় কাঁশবনের বাঘ)- হেরমান হেসে। প্রকাশকের কথা-২

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: মঙ্গল, ১৬/০৬/২০০৯ - ১২:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

http://www.sachalayatan.com/doll/24878 (১ম পর্ব এখানে)
হারি হালার দেখতে কেমন, সেটা প্রথম সাক্ষাতের পর আপনাদের একটু আভাস দিয়েছিলাম। লোকটা দেখলেই মনে হয় একজন গুরুত্বপূর্ণ, সচরাচর চোখে পড়ে না এমন জ্ঞানী ব্যক্তি। প্রগাঢ় পান্ডিত্যের স্পষ্ট ছাপ চেহারায়। অবিচলিত প্রশান্তির মোলায়েম এবং আন্তরিক আহবানের একটা রেশ মুখে থাকায়, মানুষ অতি অল্পেই হারি হালারের প্রতি আগ্রহী হতে বাধ্য। আলোচনায় ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং ভাবনা খুব কম ব্যবহার করতেন। কিন্তু মাঝে মাঝে প্রচলিত রীতি ভেদ করে হারি হালার “কাঁশ বনের বাঘ” হয়ে যেতেন এবং আলোচিত বিষয়ে তার মতামত বলতেন যা শুনে শ্রদ্ধায় মাথা আপনা থেকেই নুয়ে আসতো। এমন পরম কথা কেবল গভীর চিন্তাশীল মানুষদের বিষয় সংশ্লিষ্ট নিশ্চিৎ পর্যবেক্ষন এবং অনুধাবন দাড়াই সম্ভব। অথচ তাদের কোন প্রকার সিদ্ধি বা স্বীকৃতির লিপ্শা ছিল না। তার প্রকাশ ভঙ্গিতে জ্ঞানের কোন অহংকার থাকতো না। নিজের পান্ডিত্য প্রচার বা অন্যকে মূর্খ প্রমানের জন্য কখনো হারি হালারকে কথা বলতে আমি শুনিনি।

এ ধরনের একটা মন্তব্য যা আসলে কোন মন্তব্য ছিলনা, চোখের একটা দৃষ্টি মাত্র, হারি হালার করেছিলেন, আমাদের বাড়িতে থাকার শেষের দিকে, কোন একটা অনুষ্ঠানে। আমাদের শহরের পুরানো শিল্পকলা ভবনে, ইউরুপের বিখ্যাত এক ইতিহাস-দার্শণিক এবং শিল্প সমালোচক ভাষণ দেবেন। কোন প্রকার আগ্রহ না থাকা সত্বেও হারি হালার আমার বিশেষ অনুরোধে সেখানে যেতে বাধ্য হন। শ্রোতাদের সাড়িতে আমরা পাশাপাশি বসে ছিলাম। অনেকে পয়গাম্বরের প্রতীতি নিয়ে ইতিহাস-দার্শণিক এবং শিল্প সমালোচকের আর্বিভাবের অপেক্ষায় ছিলেন। তারাই সবচেয়ে বেশী নিরাশ হলেন। এমন পরিপাটি সাজ-পোষাক আর চটকদার সম্ভাষণ, জ্ঞানের বাণীর চেয়ে বাহারী পন্যের বিজ্ঞাপনেই ভাল মানায়। অসংখ্য শ্রোতার উপস্থিতিতে উৎফুল্ল বক্তা, কথার মালায় ডালা সাজিয়ে দর্শকদের ধন্যবাদান্তে তার নিবেদন শুরু করলেন। হারি হালার আমার দিকে একবার তাকালেন! উপস্থিত বক্তার সম্পূর্ণ সমালোচনা সেই এক দৃষ্টিতেই বলা হয়ে গেল। ওহ! সেই অসহ্য চাহুনি ভুলার মত নয়! ঐ এক পলকের ব্যাখ্যা করতে একটা বই লেখা যায়! প্রখর কিন্তু কর্কশ ছিলনা হারি হালারে চোখ। সে চোখে তিনি কেবল ঐ বক্তারই সমালোচনা করেননি যা যর্থাথই ছিল। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল তার দৃষ্টির নিরাশার বিষন্ন মেঘের আড়ালে হাড়িয়ে যাওয়া সব নিস্ফল কামনা। ক্রমাগত হতাশার আরেকটি নিশ্চৎ পরিনতি সেই বোবা চাহুনীর বক্তব্য। তার নিস্ফল কামনার চোখের তারায় শুধু যে নিমিশেই চটকদার বক্তা, সমবেত সূধীমন্ডলীর আশা, অনুষ্ঠানের শীরোনাম সম্পূর্ণ পরিবেশ উদ্ভাসিত হল তা নয়; কাঁশ বনের বাঘের দৃষ্টি আমাদের পুরো সময়টাকে ঘিরে। আমাদের সব কর্ম, কলাকৌশল, চেষ্টা, চটকাদার সব লোকদেখানো অহংকারী জ্ঞানের চর্চা। দুর্ভাগ্যক্রমে তার দৃষ্টি গেল আরো গভীরে, আমাদের সময়ের দারিদ্রতা এবং নৈরাশ্যের তলা ভেদ করে আমাদের চিন্তার সংস্কৃতিতে। মানব সভ্যতার রন্দ্রে রন্দ্রে পলির মত জমে থাকা অসংগত কৃতিত্বের সমালোচনা একদৃষ্টিতেই করলেন সম্ভবত একজন যোগ্য চিন্তাবিদ। দেখ আমরা এই সব বানরের পাল। দেখ এই সবই মানুষ।আমাদের বিখ্যাত বিদ্যান- পন্ডিতদের চিন্তার ফসল নিমিশেই একটা বানরের পালের খেলার সাথে মিলিয়ে দিল হারি হালারের দৃষ্টি!

ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা ভঙ্গ করে, হারি হালার সম্পর্কে আমি আপনাদের অনেক কথা বলে ফেলেছি। ভেবেছিলাম হারি হালারের সাথে আমার পরিচয়ের পথ ধরে আপনাদের সামনে তার একটা চিত্র তুলে ধরব। এর মধ্যে মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলা হয়ে গেছে।
এত কথা যখন বললামই, তাহলে হারি হালারের কল্পনাতীত বেখাপ্পা আচরণ এবং তার ফলে ভয়ংকর নিসঙ্গ জীবনের সাথে কি ভাবে আমার পরিচয় হল, তাও বলি। সেটেই ভাল, কারণ নিজেকে বড় করার জন্য উপন্যাস বা মনোবিজ্ঞান চর্চার কোন ইচ্ছা আমার নেই। রাজসাক্ষীর মত, “কাঁশবনের বাঘ” পান্ডুলিপির লেখককে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

প্রথম বার যখন হারি হালার গেটদিয়ে, ঢুকে আধো আলো আধো ছায়ায় দাড়িয়ে, পাখির ঠোটের মত নাকটা ডানে বামে ঘুড়িয়ে, ঘ্রান নিয়ে খালার কাছে, বাড়ির সুগন্ধের তারিফ করছিল; সেই থেকেই লোকটার বিশেষত্ব অনুমান করি। আর তাকে কিছুটা সরল সন্দেহের চোখে দেখতে থাকি। সন্দেহ হচ্ছিল (আমার খালা আমার মত বুদ্ধিবৃত্তির লোক না হয়েও আমার মতই সন্দেহ করছিলেন)-লোকটা অসুস্থ, মানুষিক বা স্বভাবগত কোন সমস্যায় ভূগছে, সে কারণে আমার সুস্থ চিন্তায় তাকে এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহন করি। সময়ের সাথে এড়িয়ে চলার নীতি সহমর্মিতা এবং মমত্ব বোধ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হল। এই অসম্ভব রকম একাকীত্বে আক্রান্ত মানুষটির জন্য মায়া হতে লাগল। সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পরলাম, লোকটার অসুস্থ রকম একাকীত্বের যাতনা কোন শারীরিক বা মানুষিক অসংগতি থেকে উদ্ভূত নয়, বরং তার বুদ্ধিদীপ্ত মুক্ত চিন্তার অসীম ক্ষমতার সীমিত প্রকাশ প্রকৃয়া। আমার মনে হত হেলার নিস্যের (জার্মান দের্শনিক) নীলকন্ঠ। ধীরে ধীরে মনে হতে লাগল; তার কষ্টের কারণ বিশ্ব বেহায়াপনার বিরোদ্ধে নয়, নিজের অক্ষমতার বিরোদ্ধে। যে কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যাক্তির সমালোচনার আগে কঠোর এবং কঠিন সমালেচনার তীরটা নিজের দিকেই তাক করতো হালার। আপনার প্রতিই ছিল তার কঠোর সমালোচনা আর ঘৃণা।
(জনগন চাইলে চলবে...)


মন্তব্য

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চলতেই হবে

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই,
সাথে আছেন যেনে উৎসাহ এবং সাহস পাচ্ছি। আশা করি সামনেও এভাবে সঙ্গ দেবেন।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

স্পর্শ এর ছবি

আমি চাচ্ছি।
আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। থামবেন না।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

স্পর্শ এর ছবি

জার্মান শিখিনি বলে দুঃখ হয়। ফ্রেঞ্চ শিখিনি বলেও দুঃখ হয়। একদিন শিখে ফেলব। হাসি
তার আগ পর্যন্ত আপনার অনুবাদ।
কাঁশ বনের বাঘ বইটা হাতে পেতে ইচ্ছা হচ্ছে এখনি।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পুতুল এর ছবি

জার্মান শিখিনি বলে দুঃখ হয়। ফ্রেঞ্চ শিখিনি বলেও দুঃখ হয়।

দুঃখের কিছু নেই। পৃথিবীতে এত ভাষা! তার কয়টা আমাদের পক্ষে শেখা সম্ভব?
তবে আমার দুঃখ হয় ভাল করে ইংরেজী শিখিনি বলে। সব বই ইংরেজীতে ভাল অনুবাদ হয়। কারণ পাঠক বা ক্রেতা সমাজ খুব বড় পাওয়া যায়। এবং প্রকাশনা সংস্থাগুলো অনেক বিনিয়োগ করতে পারে। যার ফলে উচু মানের অনুবাদকের অভাব হয় না।
একদিন শিখে ফেলব।

অবশ্যই সুযোগ থাকলে শিখুন। এতে লাভই হয়। আরেকটা সংস্কৃতি এবং ভাষার সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। আমি জর্মান শিখেছি অনেকটা পেটের দায়ে। তাও খুব ভাল পারি না। একটা লেখা পড়ে তার মজাটা নিতে পারি। কিন্তু নিজে বাংলাই ভাল লিখতে পারি না। জার্মান লিখব কি করে!

বইয়ের ব্যাপারে মনে হয় এখনি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। তবুও এমন একটা আশা সামনে থাকলে কাজটা করার উৎসাহ বেড়ে যায়। আপনার উৎসাহের জন্য ধন্যবাদ।
তবে আগেই বলে রাখছি ডেয়ার ষ্টপের বল্ফ তিশ পৃষ্ঠার একটা বিশাল বই। অনেক সময় লাগবে। ঘর সংসার ঠিকঠাক রেখে তারপর একটু সময় পেলে অনুবাদ। আশা করি ধৈর্য্য ধরে ততদিন সাথে থাকবেন।

**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।