মোবাইল যোগে প্রেম করা সহজ নয়

দ্রোহী এর ছবি
লিখেছেন দ্রোহী (তারিখ: বুধ, ০৪/০৭/২০০৭ - ১১:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবলমাত্র ভর্তি হয়েছি। মোট ছাত্র-ছাত্রী 36 জন। তখন মোবাইল সস্তা হতে শুরু করেছে। পনের থেকে বিশ হাজার টাকা খরচ করতে পারলেই একটি মোবাইলের গর্বিত মালিক হওয়া সম্ভব। ইতিমধ্যেই পাঁচজন অতি উৎসাহী গর্ভধারণ এর কাজটি সুসম্পন্ন করে ফেলেছে। তারা আমাদের সামনেই আয়েশ মিটিয়ে তাদের গর্ভপ্রসুত মোবাইল খানা টিপাটিপি করে! আমরা গরীবেরা নিজেরা টিপতে পারিনা। কার্জন হলে- টিএসসিতে টিপাটিপি দেখেই আমাদের দিন কেটে যায়! মাঝে মাঝে বন্ধুদেরটা হাতে নিয়ে টিপি! বেশ আরাম আরাম লাগে! খুব বেশী ভাগ্যবান হলে বাবার অফিসেরটা হাতে পাই! তখন বেশ আরাম করে সময় নিয়ে টিপি। ধীরে ধীরে, তারিয়ে তারিয়ে রসাস্বাদন করি!

২.

আমার বোনের বিবাহ উপলক্ষ্যে আমার বন্ধুরা বেশ খানাখাটুনি করেছে। বাবা তাই আমাদের কিছু টাকা দিয়ে বললেন কোন একটা রেষ্টুরেন্ট এ গিয়ে উদরপুর্তি করতে। আমরা চার বন্ধু ফুলবাবু সেজে খেতে এসেছি শুক্রাবাদের "চিলিস"-এ। ভাব মারার জন্য বোনাস হিসাবে বাবার অফিসের মোবাইল ফোনটা নিয়ে এসেছি। আমাদের পাশের টেবিলে একটা ফ্যামিলি বসেছে। সাথে একটা সুন্দরী মেয়ে- আমাদের চাইতে দুই-তিন বছরের ছোট হবে হয়তো! সুন্দরী স্যুপ খায়- তাকে দেখে আমরা খাবি খাই। বন্ধু সঞ্জয় দেখতে বেশ সুদর্শন ছিল- তাকে দেখলেই সবাই জিজ্ঞেস করতো, "আপনি কি রোমানা পেইন্টের সেই ছেলেটি?" সঞ্জয় বেশ ভাব নিয়ে এমনভাবে মাথা ঝাঁকাতো যার অর্থ দুটোই হতে পারে। সঞ্জয় সেই সুন্দরীর চর্ম-চক্ষুর দখল নেবার জন্যই আমার কাছ থেকে সঙ্গোপনে মোবাইলটা চেয়ে নিল। তারপর রিংগারটা একটুখানি বাজিয়ে ফোন রিসিভ করার ঢঙে কাল্পনিক কার সাথে যেন লাখ টাকার কারবার নিয়ে কথা বলা আরম্ভ করলো! তার কারবার দেখে আমরা স্যুপ ছেড়ে বাতাসে খাবি খেতে লাগলাম! "চোরের একদিন আর গৃহস্তের দশদিন"- কথাটাকে প্রমাণ করার স্বার্থেই ঠিক সেই মুহুর্তে মোবাইলটা সশব্দে বেজে উঠলো। পাশের টেবিলের সবার ভাবভঙ্গী দেখে মনে হল কথা বলার সময় মোবাইলে রিং বাজাটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা! আর এদিকে সঞ্জয়ের বন্ধু হবার সুবাদে আমাদের মাথা লজ্জায় গলে গিয়ে বুক বেয়ে গড়িয়ে কোমরের কাছাকাছি চলে এসেছে!

৩.

আমাদের ক্লাসে মোবাইলের মালিক পাঁচজন। বাকী 31 জনের মোবাইল নেই। যাদের মোবাইল আছে তারা ভাব দেখায়- "তাদের মোবাইল আছে"। আর আমাদের যাদের মোবাইল নেই, আমরা ভাব দেখাই, "আমাদের মোবাইল নেই, কারন উহা অতি অচ্ছুৎ বস্তু!" মোবাইলের মালিকগন তাদের সেই ফোন দিয়ে কারও সাথে কথা বলে না কারন টাকা খরচ হবে। তাদের সেই মোবাইলের একমাত্র ব্যবহার রাত্রীকালীল মিসকল-মিসকল যুদ্ধে! দু একজন সুদক্ষ যুদ্ধবাজ ততোদিনে আবিষ্কার করে ফেলেছে- কম্পিউটারের মনিটরের পাশে বসে মিসকল মিসকল যুদ্ধ খেলতে বিজয় সুনিশ্চিত! আমিও সুযোগ পেলে বাবার ফোন নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমি ও নিপুন কম্পিউটার মনিটরের সামনে বসে গবেষণার পর আবিষ্কার করেছিলাম, গ্রামীন ফোন ব্যবহার করে কাউকে মিসকল দিলে নেটওয়ার্ক টোনের ঠিক তিন সেকেন্ড পর কেটে দিতে হয়। তাহলে কারও বাপের সাধ্যি নেই সেই মিসকল রিসিভ করে! কালক্রমে বাবার ফোন দিয়ে যুদ্ধ করেই আমি মিসকল যুদ্ধের জগতে এক খ্যাতিমান জেনারেল হিসাবে পরিগণিত হতে থাকি!

পরম করুনাময় সর্বশক্তিমানের কৃপায় একদিন জানা গেল আমাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধু "আশিকুন নবী মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান পলাশ" ওরফে "আবদার আলী" তার আবদারের টাকায় কেনা মোবাইলটা হারিয়ে ফেলেছে! শুনে আমরা দুঃখ প্রকাশ করলেও অন্তরের অন্তঃস্থলে খুশির বন্যাটুকু টের পেলাম ঠিকই! আবদার আলী এখন আর "একটি মোবাইলের গর্বিত মালিক" ভাবটুকু নিতে পারবেনা।

কয়েকদিন পরই আমাদের কপালে ঝাঁটা মেরে আবদার আলী নতুন একটি ফোন কিনল। ক্লাসের সবাইকে উৎসাহ ভরে তার নতুন নাম্বার জানালো। মিলন নামের বন্ধুটি দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেসময় ঢাকাতে অবস্থান না করার কারনে নাম্বারটি জানতে পারলোনা। ইত্যবসরে একটি জটিল বুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলিয়া গেল। আবদার আলীকে পরামর্শ দেয়া হল যেন সে রাতের বেলায় নিয়ম করে প্রতিদিন 2/3টা মিসকল দেয় মিলনকে। মিলন ছিল কিঞ্চিত কঞ্জুস প্রকৃতির- আমরা জানতাম সে কখনোই পয়সা খরচ করে মিসকল দাতার পরিচয় বের করতে উৎসাহী হবেনা। সেই সুবাদে তাকে ঘোল খাওয়ানো যাবে। কয়েকদিন মিসকল দেবার পর বিপরীত দিক থেকে মিলনের সাড়া মিললো। একটি মিসকলের জবাবে মিলন দুই-তিনটি করে মিসকল দিতে লাগলো। কয়েকদিন পর সিদ্ধান্ত নেয়া হল- মিলনকে একটি প্রাণঘাতী এস.এম.এস পাঠানো হবে। এস.এম.এস পাবার পর মিলনের সাড়া লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেল। ইতিমধ্যেই মিলন ঢাকায় ফিরে এসেছে। আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আশিকের নতুন মোবাইলের খবর মিলনের কাছ থেকে গোপন রাখা হবে।

মিলন একদিন শামীমকে ডেকে আড়ালে নিয়ে গেল- শামীম ফিরে এসে সবাইকে জানালো মিলনকে কে যেন প্রতিদিন মিসকল দিচ্ছে, মাঝে মাঝে দুই-একটা প্রলোভনযুক্ত এস.এম.এস ও পাঠাচ্ছে। আমরা সবাই একবাক্যে সাড়া দেই- তাকে বুঝাতে চেষ্টা করি যে বিপরীত দিকে যে আছে সে মেয়ে না হয়েই যায় না! তাকে এটাও বলতে ভুলিনা যে তার জায়গায় আমরা থাকলে এই প্রলোভনে ষাঁড়ের মতই সাড়া দিতাম। আমাদের এই ষাঁড়ম্বর সাড়ায় মিলন আশ্বস্ত হয়। সেদিন রাতেই সে আবদার আলীকে পয়সা খরচ করে ফোন করে বসে! মিলনের এই হঠাৎ আক্রমনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে আবদার আলী। সে ভয়ে ফোন রিসিভ করা থেকে বিরত থাকে- শেষে নিজেই রিসিভ হয়ে যায় মিলনের কাছে এই ভয়ে! এদিকে মিলন কামাবেগাক্রান্ত হয়ে এস.এম.এস পাঠায়- "ফোন ধরো না কেন সোনা?" পরদিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ফোন রিসিভ করা হবে।

যথারীতি রাতের বেলায় মিলনকে মিসকল দেয়া হল। প্রত্যুত্তরে মিলন ফোন করে বসলো। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবদার আলী ফোন রিসিভ করে একটা চুমু দিয়েই সাথে সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরদিন আমরা সবাই অবাক হয়ে সেই চুম্বনের ফলাফল দেখি। মিলন ক্লাসে এসেছে! পরনে নতুন শার্ট, নতুন প্যান্ট, জেল দিয়ে ভাঁজ দেয়া চুল!

মিলনকে পাঠানোর জন্য সুন্দর সুন্দর এস.এম.এস লিখে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রতিদিনকার এস.এম.এস নির্বাচন করা হয়। দিনে দিনে মিলন এস.এম.এসের ভাঁজে পড়ে খাপে খাপে বসে যাচ্ছে। একদিন আবদার আলী জানায় মিলন তার সাথে দেখা করতে চাইছে। এস.এম.এস দিয়ে তার মন ভরছেনা। তাই চর্ম-চোক্ষে দেখে চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে চায় সে! প্রত্যুত্তরে তাকে জানানো হয়, আগামী সোমবার দুপুরে নায়িকা তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে "বিগ বাইটে" মিলনের সাথে দেখা করে চর্ম-চক্ষুর কাতর তৃষ্ণা মেটাবে।

দেখা করার কয়েকদিন আগে ক্লাসে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার সময় দুভাগর্্যজনকভাবে আমরা সবাই মিলনের কাছে হাতে-নাতে ধরা খাই। ফলাফলঃ মিলন আমাদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয় কিছুদিনের জন্য। আবদার আলীকে সে কখনোই ক্ষমা করতে পারেনি।


লেখাটি ইতিপূর্বে সামহোয়্যারইন ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল


মন্তব্য

দৃশা এর ছবি

এইগুলানতো পড়ছি...গরররররররর
নতুন কিছু কবে দিবেন?
ইয়ে দ্রৌহী ভাই কন না কেন ভাবী কই?

দৃশা

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

দ্রোহী, এরকম লেখা পড়ে পিঠ না চুলকাই ক্যামনে! বলেন!!!

কেমিকেল আলী এর ছবি

না চুলকাইয়া থাকা গেল না।

দ্রোহী এর ছবি

হায়রে, সবাই খালি পিঠ চুলকায়! অন্যকোন জায়গার ব্যাপারে কারো কোন উৎসাহ দেখি না!
__________
কি মাঝি? ডরাইলা?

দ্রোহী এর ছবি

দৃশা আফা, আপনের ভাবী তার বাপের বাড়ীতে নাইওর গেছে।
__________
কি মাঝি? ডরাইলা?

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

অনেকদিন পরে আবার পিঠ চুলকাইলাম। চোখ টিপি

দ্রোহী এর ছবি

আহারে। আসলেই কতদিন পিঠ চুলকাই না!!!!!!!!


কি মাঝি? ডরাইলা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।