স্মৃতির জলে ঢেউ : ভয় পর্ব

ফারুক হাসান এর ছবি
লিখেছেন ফারুক হাসান (তারিখ: বুধ, ১৫/১০/২০০৮ - ১:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাঝে মাঝে এরকম হয়। স্মৃতির নিস্তরঙ্গ জলে ঢেউ জাগে। দ্রবীভূত মনের ঘাটে সেই ঢেউ এসে আঘাত করে, নিঃশব্দে, মৃদুতালে। তখন আর ভালো লাগে না কিছুই। আবার কখনো কখনো নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসলে আপন মনে ঢিল ছুড়ি সেই জলে। জানি, জল কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না।

ভয়
আরো কিছু সময় বয়ে যাবার পর আমরা, মানে আমি ও আমার ফুফাতো ভাই খোরশেদ, বুঝতে পারি যে সামনের জংলা আর ডোবামত জায়গায় আমাদের জন্য সান্ধ্যকালীন ভূতের ভয় ওত পেতে আছে, ভীষণ লম্বা দুটি পায়ের আরো লম্বা লম্বা নখ কাদায় ডুবিয়ে, জটা চুলের পেত্নি আর সাপমুখো শয়তান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, ক্রমশই তাদের একজনের ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না আর অন্যজনের দড়াম দড়াম হাসি বাতাসের পর্দায় ঢেউ তুলছে, যে কোনো মুহুর্তেই তা আমরা শুনতে পাবো, আর তাহলেই শেষ- কেউ আমাদের আর খুঁজে পাবে না কোনোদিন। ডোবার পাড়ে দুই বালক হতবিহবল হয়ে দাড়িয়ে থাকি, এই অপেক্ষায় যে হয়ত হাট ফেরতা কোনো বয়ষ্ক মানুষ এই পথে চলে আসবে আর আমরা তার সাথে সাথে সামনের এই বিস্তৃত ভয়ংকর জমিনটুকু আজকের মত পেত্নি কিংবা শয়তানের হাতে ধরা না দিয়েই পার হয়ে যাবো। কিন্তু কেউ আসে না আর।

আমরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে আরো অপেক্ষা করি, যোগ্য কোনো সময়ের জন্য, সাহসের উপর ভর করার জন্য। যখন ভয় কিছুটা কেটে যাবে, তিনবার আল্লা আল্লা বলে বুকে ফু দিয়ে দুমুঠোতে সব সাহস ভরে চোখ বন্ধ করে ঝেড়ে দৌড় লাগাবো। কেবল কয়েক মুহুর্তের তীক্ষ্ন ভয়, যদি কেউ থাবা বাড়িয়ে আমাদেরকে ঝোপের মধ্যে টেনে নেয়, কিন্তু মুহুর্তগুলো পেরিয়ে গেলেই বাড়ির উত্তরপাশটা দেখা যাবে, হয়তো কোনো কামলাকে দেখতে পাবো, আর যাই হোক ভূতের ভয় থাকবে না। কিন্তু আমাদের দুজনের সব আশাকে নিভিয়ে দিতেই যেন একের পর এক অন্ধকারের পর্দা নামতে থাকে, আর সাথে সাথে বাড়তে থাকে ভয়। দেরি করে বাড়ি ফেরার ভয়টুকু তখন আর থাকে না, মনে হয় ছোট্ট এইটুকু জীবনের সমাপ্তি হতে আর বেশি বাকি নেই, মায়ের মুখ মনে পড়ে, সাথে সাথে ছোট্ট বোনটিরও। আমরা মামাতো-ফুফাতো দুই ভাই কোনো কথা বলি না, আমাদের নিঃস্তব্ধতা এই সন্ধ্যার বাতাসকে ভারী করে তোলে।

এরকম এক পরাবাস্তব পরিবেশের কারণেই হোক কিংবা দুর্বল হৃদয়ের অবচেতন চেষ্ঠার কারণেই হোক, আমার ক্লাস ফোর পড়ুয়া ক্ষুদ্র মনে প্রথমবারের মত এক মহাজাগতিক জিঙ্গাসার জন্ম নেয়। যদি মরে যাই, তবুও কি পৃথিবী এরকমই থাকবে? দিনের শেষে হয়ত কালকেও শতাব্দীপ্রাচীন তোরাফ ফকিরের লাঠিতে ভর করে এরকম সন্ধ্যে নামবে ধীরস্থির, শফির বাবা এসে কানে ধরে খেলার মাঠ থেকে ওকে তুলে নিয়ে যাবে মসজিদের গোড়ায়, ভদ্র ছেলের মত ওজু করে নামাজ পড়তে শেষ কাতারে দাড়াবে, শফি আর দরগা পাড়ার কয়েকটা দুষ্ট ছেলে, তারপর, শয়তানের প্ররোচনায় অহেতুক হাসির দমক লুকাতে গিয়ে হেচকি তুলবে অবিরাম। হয়তো খোরশেদ কালকে আরো ভয় পাবে, ওকে এই পথটুকু পাড়ি দিতে হবে একাই , হয়ত সে আর মাঠ থেকেই নড়বে না যতক্ষণ বাড়ি থেকে কামলা আব্বাস এসে ওকে নিয়ে যায়।

তবুও তো সে একসময় বাড়ি যাবে। গিয়ে টিউবয়েলে হাত পা ধুয়ে দোয়াতের আলোয় আরবি বই নিয়ে পড়তে বসবে, খাবে, ঘুমোবে, তারপর সকালে উঠে পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পড়ে মাদ্রাসায় যাবে। কেবল আমি থাকবো না। তবু কেন থাকবে যা কিছু আছে যে রকম? কিংবা ...

হঠাত্ই খোরশেদ, যে কিনা আমার চেয়ে বয়সে তিন বছরের বড়, তার পাঁচ আঙ্গুলের নখ দিয়ে আমার কবজিতে দাঁত বসায়, গলার কাছে আটকে থাকা যাবতীয় ভয় হঠাত্ কিলবিল করে নড়ে উঠে আমাকে হতবিহবল করে তোলে, আমি ছিটকে দূরে সরতে গিয়ে আছাড় খাই। আকষ্মিক স্পর্শে মনে হয় সেই পেত্নি বুঝি আমাকে টানছে জঙ্লার গাঢ় সবুজ আর অন্ধকারে মিশে যাওয়া তেল চিটচিটে রংয়ের ঝোপের দিকে।

ঘর ফেরতা শেষ পাখিটার ডানায় ভর করে ভেসে আসা মসৃণ হিমশীতল কৃষ্ণকালো ভয় দুহাতে ঠেলে সামনে দৌড়াতে থাকি, দৌড়াতে থাকি, অনন্তকাল।


মন্তব্য

অভ্রনীল এর ছবি

তারপর, শয়তানের প্ররোচনায় অহেতুক হাসির দমক লুকাতে গিয়ে হেচকি তুলবে অবিরাম।

নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল... পাড়ায় মিলাদ হলে সব শয়তান পোলাপান একসাথে বসতাম... তারপর কি হত কে জানে... একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালেই কেবল হাসি আসত... সে কি হাসি... সেই হাসি চেপে রাখতে গিয়ে পুরো শরীর কাঁপতো... মাঝেমধ্যে হাসি আটকাতে না পেড়ে মুখ দিয়ে একধরনের বিদঘুঁটে শব্দ বের হত... শব্দটা হাসি আর হেঁচকির মাঝামাঝি একধরনের শব্দ... আর ঐ শব্দে মুরুব্বীরা পাড়লে তখনই উঠে এসে মার লাগায় আরকি!

_________________________________
| নাদানের ছোট্ট জগৎ |
auto

ফারুক হাসান এর ছবি

এইরকম ঘটনা ছাড়া ছোটোবেলায় কখনো নামাজ পড়েছি বলে মনে পড়ে না। জুমার নামাজে বাচ্চাদের কাতার (অবধারিতভাবে শেষ কাতার) মানেই ছিল হাসি, কান্না, হেঁচকি, কুস্তি, ঠ্যালাঠেলি, চিমটি, মারামারি, টোকাটুকি, ইত্যাদি ইত্যাদির অসাধারণ সমাহার।
তবে একবারের ঘটনা বলি। সেসময় ততটুকু বাচ্চা ছিলাম যতটুকু থাকলে আছরের নামাজের পর কলোনীর সব বাচ্চাদের সাথে গিয়ে সিপারা পড়তে হত মসজিদে। সুতরাং পড়তে হত আছরের নামাজও। একদিন বাসা থেকে সিপারা হাতে নিয়ে বের হয়ে তখনই মসজিদে না গিয়ে কয়েক বন্ধু মিলে শুরু করলাম মার্বেল খেলা। তারপর গিয়ে দেখি নামাজ শুরু হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করে নামাজে দাড়াতে গিয়ে কার মার্বেল কে কোথায় রাখলো আল্লা মালুম। অতঃপর রুকুতে যেতেই একজনের শার্টের পকেট থেকে মার্বেলগুলো সুন্দর মত গড়িয়ে পড়লো মসজিদের মোজাইকে, এবং টাশ টাশ টাশ...

বলাই বাহুল্য, সেদিন শেষ রাকাতের মুসুল্লিদের কারোরই সালাম ফেরানো পর্যন্ত মসজিদে থাকতে দেখা যায়নি।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আকষ্মিক স্পর্শে মনে হয় সেই পেত্নি বুঝি আমাকে টানছে জঙ্লার গাঢ় সবুজ আর অন্ধকারে মিশে যাওয়া তেল চিটচিটে রংয়ের ঝোপের দিকে।

হো হো হো
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

ফারুক হাসান এর ছবি

আমি পাইলাম ভয়, আর আপনি হাসেন!?

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ভাবার মতো বিষয়।

কীর্তিনাশা এর ছবি

কাহিনী ও লেখনি দুটোতেই মুগ্ধ হলাম।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

ফারুক হাসান এর ছবি

হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।