ক্লাস টেন

বাউলিয়ানা এর ছবি
লিখেছেন বাউলিয়ানা [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১৬/০৬/২০১০ - ৮:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তখন মাত্র ক্লাস টেনে উঠেছি। স্কুলের সবচেয়ে সিনিয়র হিসেবে একটু গরম গরম ভাব দেখাই। যেকোন অনুষ্ঠান আয়োজনের একচ্ছত্র এবং অলিখিত ভার আমাদের উপর। কোন স্যারের বিদায় অনুষ্ঠান, ঈদে মিলাদুন্নবীর মিলাদ মাহফিল কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল স্মরণে আলোচনা অনুষ্ঠান সব দায়িত্ব আমাদের। স্যারেরাও আমাদের উপর ভার দিয়ে ঝামেলা মুক্ত থাকতে চান। আমরা মাইক ভাড়া করা, ডেকোরেটর ভাড়া করা, মানপত্রের অর্ডার দেয়া, বিভিন্ন উপহার সামগ্রী কেনাকাটা ইত্যাদি আগ্রহের সাথে করতাম। সব অনুষ্ঠান শেষে খরচের একটা হিসাব দিতে হয়। ভাউচার জমা দিয়ে বাকী টাকা অফিসে জমা দিয়ে দিতাম। সেই প্রথম কিভাবে ভাউচার বানাতে হয় এবং চা-নাস্তার জন্য কিছু টাকা বাড়তি লিখে দিতে হয় তা শিখে যাই। অফিসের কেরানী শামসু চাচাকে কিছু বলতে হয়না কারণ এগুলো অলিখিত নিয়মের মধ্যে পড়ে। শামসু চাচা পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসেন আর একটা চোখ টিপ মারে। আমরা এই সমস্ত মহান(!) কাজগুলো খুব নিষ্ঠার সাথে করতে শিখেছিলাম মূলত আমাদের সিনিয়র ভাই, যাদের আমরা মাত্রই বিদায় জানিয়েছি, তাদের থেকে।

তো দুবছর আগে এই ক্লাস টেনের ছাত্ররা এক তুমুল আন্দোলন করেছিল যার মূল হোতা ছিলেন ততকালীন স্থানীয় কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা। সেই আন্দোলন হয়েছিল মূলত প্রাইভেট পড়ানোকে কেন্দ্র করে রেষারেষি করা কিছু শিক্ষকের অপসারণের দাবীতে। সেই ঘটনার কিছুটা এখানে লিখেছিলাম। তারপর দুবছর নির্বিঘ্নে কেটে যায়। আমরাও দিনে দিনে বড় হয়ে যাই অনেক! কিন্তু কথায় আছে না, সুখে থাকলে ভুতে কিলায়। আমদেরও হয়েছিল সে দশা। ক্লাস এইটে থাকতে যে আন্দোলন চোখের সামনে দেখেছি, ছোট বলে কেউ তেমন পাত্তা দেয়নি, ক্লাস টেনে এসে বারুদের গন্ধ পেয়েই আর তর সইছিল না। সেই ঘটনাই এখানে বলব।

আমাদের মফস্বল শহরটা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে, ঢাকা থেকে যোগাযোগ ভাল ছিলনা বিধায় দৈনিকা পত্রিকা পেতাম বিকেলের পর, কখনো কখনো সন্ধ্যায়। তো একবার খবর এলো কাগজ-কলম সহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীতে বিক্ষোভ। আমাদেরতো আর এত কিছুর দিকে খেয়াল থাকেনা, কিন্তু বড় ভাইয়েরা আছেন কী জন্য? তারা কলেজ থেকে এসে বললেন, "আরে মিঞা সারা দেশে আগুন জ্বলতেছে, আর তোমরা এখানে বইসা বইসা মাছি মার!"
আমরাতো হা হয়ে গেলাম, বলে কী!
তারপর তারা পুরা ঘটনা খুলে বললেন আর এও বললেন "জাতির এই ক্রান্তি লগ্নে এভাবে বসে থাকলে চলবে না। আমাদেরও আন্দোলনে যেতে হবে। কাল থেকে আমরা কলেজ বন্ধ করে দিতেছি, তোমরা স্কুল বন্ধ কর দাও-কোন ক্লাস হবে না। যতদিন না আমাদের এক দফা এক দাবী মেনে নেয়া হবে, ততদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ।"

আমরাতো বড় ভাইদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে পুরা কনভিন্সড্‌। ক্লাস টেনের সবার মাঝে প্রবল উত্তেজনা, কিছু একটা করতে হবে। প্ল্যান করতে লাগলাম কিভাবে কী করা যায়। অনেক চিন্তা ভাবনার পর ঠিক করা হলো, আগের মত সবাই অ্যাসেম্বলীতে দাঁড়াবে তারপর তা শেষ হলে লাইনে লাইনে ক্লাসে না গিয়ে মিছিল আকারে স্লোগান দিতে দিতে স্কুল বাউন্ডারী থেকে বের হয়ে আসবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, শিক্ষকদের জানানো হবে কিনা, বা জানানো হলে তাঁরাতো নিষেধ করবেই তখন কী করা হবে? পরে সিদ্ধান্ত হলো তাঁদের জানানো হবে না কারণ এতে শুধু শুধু সময় নষ্ট!
আচ্ছা স্কুল থেকে তো বের হলাম তারপর কী করা হবে? প্ল্যান হলো স্কুল থেকে স্লোগান দিতে দিতে বের হয়ে গার্লস স্কুলে যাওয়া হবে, সেখান থেকে মেয়েদের বের করে নিয়ে এসে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নেওয়া হবে।

পরদিন সকালে সব জুনিয়র ক্লাসের ক্যাপ্টেনদের বলে দেয়া হলো, কেউ যেন অ্যাসেম্বলী শেষে ক্লাসে না যায়। সবাই মিছিলে যোগ দিতে হবে। সবাই উত্তেজনায় লাল হয়ে লাফ দিচ্ছি, হম্বি তম্বি করছি। কারও কারও এত মাথা ব্যথা নেই, একদিন ক্লাস করতে হবে না এটাই অনেক খুশির ব্যপার।

তো যথারীতি সবকিছুই প্ল্যানমাফিক হলো, আমরা স্লোগান দিতে দিতে গার্লস স্কুলে গেলাম-"জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো" (যেকোন আন্দোলনের জন্য কমন স্লোগান), "আমাদের দাবী আমাদের দাবী, কাগজের/কলমের দাম কমাতে হবে", "একদফা একদাবী, মানতে হবে মেনে নাও"। সেখান থেকে মেয়েদের নিয়ে গেলাম প্রেস ক্লাবের সামনে। সেখানে কলেজের বড় ভাইদের থাকার কথা ছিল। কিন্তু গিয়ে দেখি কেউ নেই!

পরদিন হেড স্যার ক্লাস টেনের কয়েকজনকে ডেকে পাঠালেন। ওনার অফিসে গিয়ে দেখি উনি ছাড়াও আরও কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক আছেন। সবার সামনে হেড স্যারের তীব্র তিরষ্কারের মুখে পড়ি। সবাই মুখ নিচু করে আছি-আমাদের কিছুটা আন্দাজ ছিল এরকম কিছু হতে পারে, আগেও হয়েছে তো! হেড স্যার নানারকম নীতি বাক্য ঝেড়ে গেলেন অনেক্ষন। আমরা খুব একটা কান দিচ্ছিনা সেসব কথায়। শুধু কিছুক্ষন পর পর একটা শব্দ কানে বাজছিল, "হ-র-তা-ল"। হেডস্যার ছিলেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের। আমরা যেভাবে "হরতাল" উচ্চারন করি তিনি সেভাবে করতেন না। তিনি প্রতিটা অক্ষর আলাদা উচ্চারন করতেন। এর কারণ বোধহয় "র" এর নিচে হসন্ত নেই, তাই। শেষে বললেন, আমাকে কথা দাও তোমরা আর হ-র-তা-ল করবে না। আমরা কথা দিয়ে স্যারের রুম থেকে বের হয়ে এলাম। অদুরেই কালাডেবা পাহাড়ের ওপাশে সূর্যটা তখন আস্তে আস্তে ডুবে যেতে দেখি, আমাদের কানে বাজতে থাকে হ-র-তা-ল, হ-র-তা-ল...


মন্তব্য

বোহেমিয়ান এর ছবি

ভালো লাগল চলুক

_________________________________________

_________________________________________
ওরে! কত কথা বলে রে!

বাউলিয়ানা এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার
______________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

বাউলিয়ানা এর ছবি

তাই নাকি!
হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ক্লাস টেনে পড়ছি মাত্র এক বছর। কিন্তু স্মৃতির কথা মনে পড়লে মনে হয় বছর কয়েক পড়ছি মনে হয়। এতো স্মৃতি।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বাউলিয়ানা এর ছবি

বস্‌, কিছু স্মৃতি নিয়ে লিখে ফেলেন একটা পোষ্ট।

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো হো
গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

অতিথি লেখক এর ছবি

স্কুলের দিনগুলির কোনো তুলনা হয়না!

<ভীত মানব>

তিথীডোর এর ছবি

চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।