পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতির জন্য অপেক্ষা আর কতোদিন?

গৌতম এর ছবি
লিখেছেন গৌতম (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৯/০১/২০০৯ - ১:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকের পত্রিকা থেকে খবর পেলাম, বর্তমান সরকার ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের আলোকে শিগগিরই নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করবে। গতকাল এক বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ কথা বলেছেন। সেখানে শিক্ষানীতি কীভাবে প্রণয়ন করা হবে, কী থাকবে ইত্যাদি বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এই লেখাটি যখন শেষ করি, তখনও সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি নি। এমনকি এই বৈঠক সম্পর্কেও জানতে পারি না। তাহলে হয়তো আরো কিছুদিন পরে লিখতাম। ফলে কিছু কিছু কথা পুরনো মনে হতে পারে। তাছাড়া এই লেখায় কিছু আহ্বানও আছে- এমনও হতে পারে এই আহ্বানগুলো আগেই বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং পাঠককে সেভাবেই পড়ার অনুরোধ জানাব।

পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি ছাড়াই একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চলছে- ভাবতে অবাক লাগলেও আমাদের দেশের জন্য এটি সত্যি। স্বাধীনতার পর গঠিত প্রতিটি জাতীয় শিক্ষা কমিশন দায়িত্ব অনুযায়ী রিপোর্ট প্রদান করলেও ক্ষমতার পালাবদল বা অন্য কোনো কারণে সেগুলোর শিক্ষানীতি হিসেবে আলোর মুখ দেখে নি। ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হকের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট প্রদানের পর তৎকালীন সরকার আরেকটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি শামসুল হক কমিশন প্রণীত রিপোর্টের আলোকে আরেকটি ছোট এবং খণ্ডিত প্রতিবেদন তৈরি করে যা জাতীয় সংসদে আলোচনার পর জাতীয় নীতি হিসেবে গৃহীত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই একমাত্র শিক্ষা বিষয়ক নীতি যা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে সরকার বদলের পর ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞার নেতৃত্বে আরেকটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। খণ্ডিত বা অপূর্ণাঙ্গ হলেও একটি নীতি থাকার পর আরেকটি কমিশন গঠনের অর্থ দাড়ায় তৎকালীন সরকার সেটি নিয়ে আর ভাবতে চায় না। কিন্তু মিঞা কমিশন সরকারকে যে রিপোর্ট প্রদান করে, সরকার সেটিকেও আনুষ্ঠানিকভাবে নীতি হিসেবে গ্রহণ করে নি। বর্তমান সময়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেই পাশকৃত শিক্ষানীতি অনুসরণে চলছে কিনা, বা সেটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে কিনা, সে সম্পর্কিত তথ্যও জানা নেই।

শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণয়নের ইতিহাস আমাদের বেশ উজ্জ্বল। শিক্ষানীতি হিসেবে রিপোর্টগুলো গৃহীত হোক বা না হোক, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি কমিশন বা কমিশনের আদলে কমিটি বা টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছে এবং সেগুলোর প্রতিটি একটি করে রিপোর্ট প্রদান করেছে। ব্রিটিশ-ভারতে ১৭৯২ সালে সর্বপ্রথম চার্লস গ্রান্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। প্রায় দুশ বছরের শাসনামলে ব্রিটিশরা মোট নয়টি কমিশন রিপোর্ট প্রদান করে। যেমন-

১. ১৭৯২: চার্লস গ্রান্ট শিক্ষা কমিশন
২. ১৮১৩: কোম্পানি সনদ
৩. ১৮৩৫: লর্ড ম্যাকলে কমিটি
৪. ১৮৩৮: উইলিয়াম অ্যাডামস কমিটি
৫. ১৮৫৪: উডস এডুকেশন ডেসপাচ
৬. ১৮৮২: ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার শিক্ষা কমিশন
৭. ১৯১৯: এম ই স্যাডলার শিক্ষা কমিশন
৮. ১৯৩৪: সা প্রু শিক্ষা কমিশন
৯. ১৯৪৪: জন সার্জেন্ট শিক্ষা কমিশন

পাকিস্তান শাসনামলে মোট পাঁচটি এবং বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোট নয়টি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তান আমলের শিক্ষা কমিশনগুলো হচ্ছে-

১. ১৯৪৯: পূর্ববঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি (সভাপতি: মাওলানা আকরম খাঁ)
২. ১৯৫৭: শিক্ষাসংক্রান্ত সংস্কার কমিশন (সভাপতি: আতাউর রহমান খান)
৩. ১৯৫৯: জাতীয় শিক্ষা কমিশন (সভাপতি: এস এম শরীফ)
৪. ১৯৬৪: শিক্ষার্থীদের সমস্যা ও কল্যাণবিষয়ক কমিশন (সভাপতি: বিচারপতি হামুদুর রহমান)
৫. ১৯৬৯: নতুন শিক্ষানীতির জন্য প্রস্তাবনা (সভাপতি: এয়ার মার্শাল নূর খাঁ)

বাংলাদেশ আমলে গঠিত শিক্ষা কমিশনগুলো হচ্ছে-

১. ১৯৭৪: বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন (সভাপতি: কুদরাত-এ-খুদা)
২. ১৯৭৯: অন্তবর্তীকালীন শিক্ষানীতি: জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা পরিষদের সুপারিশ (সভাপতি: কাজী জাফর আহমদ/আব্দুল বাতেন)
৩. ১৯৮৩: শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থাপনা কমিশন (সভাপতি: আব্দুল মজিদ খান)
৪. ১৯৮৬: বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন (সভাপতি: মফিজউদ্দিন আহমেদ)
৫. ১৯৯৩: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক টাস্ক ফোর্স (সভাপতি: আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন)
৬. ১৯৯৭: জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি (সভাপতি: মোহাম্মদ শামসুল হক)
৭. ২০০০: জাতীয় শিক্ষা কমিটি
৮. ২০০২: শিক্ষা সংস্কার বিশেষজ্ঞ কমিটি (সভাপতি: মুহম্মদ আব্দুল বারী)
৯. ২০০৩: জাতীয় শিক্ষা কমিশন (সভাপতি: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা)

দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশামলে গড়ে প্রতি ২১ বছরে একটি, পাকিস্তান আমলে প্রতি পাঁচ বছরে এবং বাংলাদেশ আমলে এখন পর্যন্ত গড়ে প্রতি চার বছরে একটি করে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা কমিশন গঠন ও তাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত রিপোর্ট পাওয়ার সংস্কৃতি আমাদের থাকলেও সেগুলো আনুষ্ঠানিক আলোচনার মধ্য দিয়ে শিক্ষানীতি হিসেবে গ্রহণ করার সংস্কৃতি আমাদের গড়ে ওঠে নি। তাছাড়া পূর্ববর্তী রিপোর্টকে পর্যালোচনা না করে বা সেগুলো গ্রহণ না করে কয়েক বছর পরপর শিক্ষা কমিশন গঠন করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অস্থিরতা এবং বিরুদ্ধ মত মেনে না নেওয়ার মানসিকতাকেই প্রকাশ করে।

এক সরকারের আমলে প্রণীত রিপোর্ট অন্য সরকার গুরুত্ব দেয় নি কখনোই। শিক্ষানীতিতে যেহেতু রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ছাপ থাকে এবং সরকার বদলের সাথে সাথে বেশ কিছু লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মকৌশল বদলে যায়, সেহেতু শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রণীত রিপোর্টগুলোকে পরবর্তী সময়ে মূল্যায়িত হতে দেখা যায় নি। এমনকি পূর্ববর্তী কমিশন রিপোর্ট পরবর্তী সরকার কী কারণে গ্রহণ করলো না, সে সম্পর্কিত কারণও খুঁজে পাওয়া যায় না। সরকার পূর্ববর্তী রিপোর্ট মূল্যায়ন বা সেটিকে ভিত্তি ধরে কাজ করার চেয়ে নতুন কমিশন তৈরিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আবার শিক্ষা কমিশন প্রণীত রিপোর্টগুলোও বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছে। অনেক রিপোর্ট প্রকাশের পর আন্দোলনও হয়েছে। রিপোর্টগুলো কখনও কখনও মানুষের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারে নি। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি কমিশন রিপোর্টে যে ধরনের পরিকল্পনার ছাপ থাকার কথা, তা পাওয়া যায় নি অনেকক্ষেত্রেই। এমনকি একজন প্রেসিডেন্টের ঘোষণাকে বাস্তবায়িত করার জন্য কোনো সম্ভাবনা যাচাই না করেই দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে সরকারি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে। ফলে সব মিলিয়েই কমিশন রিপোর্টগুলো গৃহীত হয় নি। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য- শিক্ষা বিষয়ে তাত্ত্বিক (অ্যাকাডেমিক) জ্ঞান আছে বা শিক্ষাতত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন, এমন মানুষরা শিক্ষা কমিশনে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পান তুলনামূলকভাবে কম। শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ এক নন- এই বিষয়টিও মনে রাখা দরকার।

ফলে আমাদের দেশের মতো বড় একটি শিক্ষাব্যবস্থা চলছে পূর্ণাঙ্গ কোনো শিক্ষানীতি ছাড়াই। বর্তমানে শিক্ষাসম্পর্কিত যে আদেশ-নির্দেশগুলো আসে, সেগুলোতে যতোটুকু পরিকল্পনার ছাপ থাকে; তার চেয়ে সেখানে শিক্ষাসম্পর্কিত তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধানটাই গুরুত্ব পায় বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্ত অন্য সিদ্ধান্তের পরিপূরক না হয়ে বিপরীত ভূমিকাও পালন করে। শিক্ষানীতি না থাকায় শিক্ষাকার্যক্রমগুলো একপ্রকার দিকনির্দেশনাহীন অবস্থায়ও ভুগছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণ এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এভাবে চলতে পারে না। কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চললে সেখান থেকে কার্যকর কোনো আউটপুটের আশা না করাই ভালো।

আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের কথা বলেছে। তারা এখন সরকারি দলে। আশা করা যায়, সরকার কিছুদিনের মধ্যে এ সম্পর্কিত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যেহেতু ইশতেহারে ‘নতুন শিক্ষানীতি’ প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, সুতরাং ধরে নেয়া যায় সরকার নতুন আরেকটি কমিশন গঠন করে এ কাজটি করবে। সেক্ষেত্রে সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে খুব তাড়াতাড়িই যেনো কমিশন গঠনের কাজটি করা হয় এবং পূর্ববর্তী শিক্ষা কমিশন রিপোর্টগুলোকে যথাযথভাবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়। পূর্বের কমিশন রিপোর্টগুলোর সবকিছু বাদ দিতে হবে বা সবকিছু গ্রহণ করতে হবে- এমন মানসিকতা থাকলে সেটি দূর করেই কাজ করতে হবে। কারণ প্রতিটি রিপোর্টেরই কিছু সবল ও কিছু দুর্বল দিক রয়েছে। তবে কমিশনকে এ সম্পর্কিত কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়াটাও জরুরি। খুব স্বল্প সময়ে তাড়াহুড়া না করে, কোনো ধরনের দলীয় এবং সরকারি প্রভাবমুক্ত থেকে কমিশন যেনো কাজ করতে পারে, সেটিও নিশ্চিত করা দরকার। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, কমিশন রিপোর্টগুলোতে যে সব সুপারিশ থাকে সেগুলোর কীভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে বা আদৌ সম্ভব হবে কিনা, সে সম্পর্কিত তথ্যের একটি ফাঁক থেকে যায়। অন্যদিকে আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোন সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা উচিত, তা নিয়েও একাধিক কমিশনের সুপারিশের মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে। প্রাথমিক শিক্ষার কথাই ধরা যায়। কোনো কমিশন মনে করেছে যে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ হওয়া উচিত অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত, আবার কারো কারো মতে বর্তমানে যেভাবে চলছে সেভাবে থাকাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু কমিশনগুলো কীসের ভিত্তিতে তাদের সুপারিশগুলো করছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠে নি। এ সম্পর্কিত কোনো গবেষণাও চোখে পড়ে নি। আগের কমিশনগুলো কতোটুকু গবেষণাভিত্তিক কাজ করেছে, সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না। শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট তৈরিতে সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ করে জনগণের মতামত জানা বা নির্দিষ্ট কোনো বিষয় সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা জরুরি; কিন্তু গবেষণা করে শিক্ষার কোন স্তরে কী ধরনের কর্মকৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন বা কোথায় কী চাহিদা রয়েছে, সেটি নিরূপণ করাটাও দরকার। গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই দিকটি উপেক্ষিত থেকেছে সবসময়ই। তাছাড়া বড় বড় সুপারিশগুলোর অর্থায়ন কীভাবে হবে, সে সম্পর্কেও রিপোর্টে স্পষ্ট বক্তব্য থাকা আবশ্যক। শুধু সুপারিশ করে সব দায়িত্ব সরকারের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। সীমিত সম্পদ, সময় এবং চাহিদা- তিনটির সমন্বয়েই যেনো সুপারিশ প্রণীত হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা খুব দরকার।

বাংলাদেশ আমলে যে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টগুলো প্রণীত হয়েছে, সেগুলো পড়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি কমিশনেই একটি বিষয় বেশ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। সেটি হলো- রাষ্ট্রীয় মূলনীতির আলোকে কমিশন কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করে সেগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করে। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা-সম্পদ-ভবিষ্যৎ চাহিদা ইত্যাদির নিরিখে নিকট ও দূর অতীতে কোন সেক্টরে কী পরিমাণ জনসম্পদের প্রয়োজন হবে- সে সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা রিপোর্টগুলোতে পাওয়া যায় না। ফলে কর্মক্ষেত্রের অনেক সেক্টরে যেমন জনসম্পদের প্রবল অভাব রয়েছে, তেমনি অনেকক্ষেত্রে শিক্ষিত জনসম্পদ বোঝা হয়ে দাড়াচ্ছে। বিষয়টির ওপর পরিকল্পিত দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।

একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি প্রণীত হলেই যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সব অব্যবস্থাপনা ও সীমাবদ্ধতা দূর হয়ে রাতারাতি তা সবল হয়ে উঠবে, তা নয়। কিন্তু শিক্ষাকে আমরা কোন পথে এগিয়ে নিতে চাই, অদূর ভবিষ্যতে কোন সেক্টরে কী পরিমাণ জনসম্পদ তৈরি করতে চাই এবং কোন সুনির্দিষ্ট পথ ধরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে চাই, সে বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা-বুঝার জন্য এবং সে আলোকে নিজেদের তৈরি করার জন্য শিক্ষানীতি থাকা জরুরি। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে কোনো পূর্ণাঙ্গ নীতি না থাকলে এগিয়ে যাওয়ার বদলে পথভ্রষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি থাকা তাই খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

পাঠক্রম (সিলেবাস) আর নীতি (পলিসি) -র মাঝের ফারাক বুঝি না আমরা, এটাই সব ঝামেলার কারণ।

প্রাইমারি স্কুলিং ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত হবে, নাকি ৮ম, এটা নীতির প্রশ্ন। একটি মাধ্যম থাকবে, নাকি তিনটি, এটা নীতির প্রশ্ন।

পক্ষান্তরে, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ৫ লাইনে লেখা হবে, নাকি ৫টি বইয়ে, সেটি পাঠক্রমের ব্যাপার। যে-দেশে সেলিব্রিটি নকলবাজও শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হয়, সে-দেশে এর চেয়ে উন্নত কিছু আশা করাও দুষ্কর আসলে।

গৌতম এর ছবি

আপনার সাথে দ্বিমতের খুব একটা অবকাশ নেই। তবে একটু সংশোধনী দিচ্ছি- সিলেবাসকে পাঠ্সূচি আর কারিকুলামকে পাঠক্রম বা শিক্ষাক্রম বলা হয়। নীতি > শিক্ষাক্রম > পাঠসূচি- বিষয়গুলোকে এভাবে সাজানো যায়।

শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে এখন নূরুল ইসলাম নাহিদ আছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করি।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সংশোধনের জন্য ধন্যবাদ। বেশিদিন বাইরে থাকার কুফল। অনেক পরিভাষাই মূল ভাষার দাপটে হারিয়ে গেছে। হাসি

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি থাকা তাই খুব জরুরি

একমত ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

গৌতম এর ছবি

ধন্যবাদ, মানিক ভাই।

মুজিব মেহদীর কবিতার এই লাইনগুলো আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

হাসান মোরশেদ এর ছবি

১. ১৯৭২: চার্লস গ্রান্ট শিক্ষা কমিশন

সম্ভবতঃ ১৭৯২ হবে ।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

গৌতম এর ছবি

ধন্যবাদ মোরশেদ ভাই। সংশোধন করা হলো।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি

পোস্টটা বেশ তথ্যবহুল ও চিন্তা-উদ্রেককারী।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতির আলোকে কমিশন কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করে সেগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করে।

যদ্দুর বুঝি, শিক্ষা ব্যবস্থার ঐতিহাসিক লক্ষ্য হল রাষ্ট্রদর্শনের বিস্তার। শিক্ষানীতির এই যে বার বার পরিবর্তন, এটা আমাদের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে যে এখনো অনেক বিতর্ক এবং প্রবল দ্বন্দ্ব আছে, সেটারই বহিপ্রকাশ। ওটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত এটা ফেলে ওটা, এরকম চলতেই থাকবে। আর, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই নবীন বয়সে এইটাই বোধ হয় স্বাভাবিক।

কিন্তু দেশের জনসংখ্যা-সম্পদ-ভবিষ্যৎ চাহিদা ইত্যাদির নিরিখে নিকট ও দূর অতীতে কোন সেক্টরে কী পরিমাণ জনসম্পদের প্রয়োজন হবে- সে সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা রিপোর্টগুলোতে পাওয়া যায় না।

শিক্ষা বৃত্তিমূলক হবে না জ্ঞান বিকাশের সহায়ক হবে, নাকি দুটার সংমিশ্রন হবে, এটা নিয়ে আগে অনেক বিতর্ক হয়েছে শুনেছি, কৈশোরে এ নিয়ে পাঠ্যবইয়ে রচনাও পড়েছি। এটা অবশ্যই নীতির একটা বিষয়। আজকাল বাংলাদেশ বৈশ্বিক পুজির উপনিবেশ হওয়াতে বৃত্তিমুলকতার দাপট বাড়ছে।

আপনি যে প্রশ্নটা রেখেছেন, তা মূলত কোন বৃত্তিকে প্রাধান্য দেয়া হবে সেটা নিয়ে। এখানে বৃত্তিমূলকতাকে স্বীকার্য ধরে নেয়ার প্রবণতা আছে। বৃত্তির প্রাধান্যের অনুক্রম আমার বিবেচনায় রাষ্ট্রের শিক্ষাদর্শনের আওতায় পড়ে না। ইশতিয়াক ও বোধ হয় এ ব্যপারটা নিয়েই আপত্তি করছিলেন। তবে এ ব্যপারটা আলোচনার দাবীদার।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ন বিষয় হল শিক্ষানীতিতে গণতন্ত্রের প্রয়োগ। এর জন্য শিক্ষানীতিরই বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। মানে ঢাকার স্কুলে পাঠ্যসূচী কি হবে, ভর্তি প্রক্রিয়া কি হবে, ক'ধরণের স্কুল থাকবে, সেটা ঢাকার লোক ঠিক করবে, চট্টগ্রাম বা সিলেট বা রাজশাহীরটা ঠিক করবে স্ব স্ব অঞ্চলের লোক। তবে, আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো যদ্দিন প্রবলভাবে এককেন্দ্রিক, তদ্দিন তা হবে বলে মনে হয় না।

শিক্ষা ব্যবস্থা সাজানোর জন্য যেমন রাষ্ট্রদর্শনকে যেমন গুরুত্ব দিতে হয়, তেমনি ঐতিহাসিক বাস্তবতাকেও অস্বীকার করা যায় না। দেখা যাক নতুন সরকার কি করে।

গৌতম এর ছবি

১.

আমাদের রাষ্ট্রদর্শন কাগজে-কলমে প্রথমদিকে কিছুটা বদলালেও নেতৃত্বের মানসিকতায় খুব একটা পরিবর্তন আসে নি। যে কারণে ১৯৭৪-এর ড. খুদা কমিশনের পর গঠিত শিক্ষা কমিশনগুলোর রিপোর্ট মূলত একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছে। ফলে আমাদের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে যে প্রবল দ্বন্দ্ব ও বিতর্কের কথা বলেছেন, সেটার সাথে ঠিক একমত হতে পারলাম না। এই বিতর্ক হচ্ছে মূলত ডান ও বামপন্থার মানুষদের মধ্যে। কিন্তু এটার সাথে রিপোর্ট তৈরির সরাসরি সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।

২.

বৈশ্বিক পুঁজির উপনিবেশ হওয়াতে বৃত্তিমূলক শিক্ষার দাপট বাড়লেও এখানে আমি দুটোর সংমিশ্রণের কথাই বুঝাতে চেয়েছি। আজকের দিনে শিক্ষাকে শুধু জ্ঞান বিকাশের সহায়ক দেখলেই চলবে না, কিছু একটা করে খাবার মতো রসদ জোগান দিতে হবে- দুটোর সংমিশ্রন না হলে সেটা ভেঙে পড়তে বাধ্য বলে আমার মনে হয়। আমাদের দেশের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে দুটোর কোনোটিরই প্রাধান্য চোখে পড়ে না, বরং দুটোরই অসম্পূর্ণ দিক প্রকটভাবে চোখে লাগে।

৩.

ইশতিয়াকের সাথে তো আমিও একমত। তবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া হবে কিনা, এটা রাষ্ট্রের শিক্ষাদর্শনের আওতায়ই পড়ে বলে আমি যতদূর জানি। আর বিকেন্দ্রীকরণ তো অবশ্যই দরকার, কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণ হবে প্রয়োগে, নীতিনির্ধারণীতে নয়।

৪.

আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি

আপনার বিশ্লেষণ ভাল লাগল। মোটামুটি একমত।
আপনার হাতে যদি শিক্ষানীতিগুলোর, বা অন্ততঃ খুদা কমিশনের রিপোর্ট টি থাকে, তাহলে চলুন নীতি-ক্রম-সূচীর পার্থক্য বাদ দিয়ে বিষয় ভিত্তিক একটু কথা বলি।

আমার জানার ইচ্ছে থেকে কতগুলো প্রশ্ন করি, আপনি ওগুলো নিয়ে আলোচনা করলে ভাল হয়। প্রশ্নগুলোর ব্যপারে খুদা থেকে মিঞা পর্যন্ত কি অদল বদল হয়েছে, সেগুলো বলুন।

১) একমুখী-দ্বিমুখী-ত্রিমুখী শিক্ষা
ক) মাদ্রাসা শিক্ষা
খ) বেসরকারী এবং বানিজ্যিক শিক্ষা
গ) ইংরেজি মাধ্যমের উপস্থিতি

২) শিক্ষার স্তরবিন্যাস কি হবে? বাধ্যতামূলক শিক্ষা কোন স্তর পর্যন্ত হবে?

৩) বৃত্তিমূলক বনাম জ্ঞান বিকাশের সহায়ক -
আমার মতে পূর্ণবয়সপ্রাপ্তির আগ পর্যন্ত শিক্ষায় (১০ম বা মতান্তরে ১২শ শ্রেনী পর্যন্ত) বৃত্তিমূলকতা মোটামুটি অনুপস্থিত থাকা উচিত। তবে এক্ষেত্রে শিশুশ্রমিকদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত করার বাস্তবতা ভাবতে হবে। এর পরবর্তী পর্যায়ের শিক্ষাকে বৃত্তিমূলক এবং চিন্তা/গবেষনা ধর্মী এরকম ভাগ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যেহেতু চিন্তা ধর্মী শিক্ষায় শিক্ষিতরা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণধর্মী কাজে যোগ দেয়ার সুযোগ বেশী পায়, সেক্ষেত্রে কিভাবে দু্ই ধারার শিক্ষায় প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ বা উত্সাহ প্রদান করা হবে সেটা বিবেচনার বিষয়।
এসব ব্যপারে কমিশুনগুলো কি বলে এবং আপনার মত কি? ছাত্র সংগঠন গুলোতে এব্যপারে কোন নীতিমালা থাকলে সেগুলোও বলুন।

৪) বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে কোন বৃত্তিকে প্রাধান্য দেয়া এবং কোন বৃত্তিকে ক্রমে নিরুতসাহিত করা হবে?

৫) গণতন্ত্র ও বিকেন্দ্রীকরণ প্রশ্নে নীতি কি?

গৌতম এর ছবি

আমার কাছে সবগুলো শিক্ষা কমিশন রিপোর্টই আছে। সুতরাং কথা বলা যাবে। তবে প্রশ্নগুলোর উত্তর সংক্ষেপে দিতে আমি অপারগ। যে কারণে ভাবছি প্রতিটি বিষয়কে ধরে আলাদা আলাদা পোস্ট দিবো।

তবে কমিশন রিপোর্টগুলোতে কিন্তু অনেক বিষয় সম্পর্কেই কিছু বলা নেই। গণতন্ত্র ও বিকেন্দ্রীকরণ তার একটি। সুতরাং এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অন্য সূত্র ধরে আলোচনা করতে হবে।

আপনার দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।