সার্ক হাঁটছে ডেডহর্সের চামড়া গায়ে: শিক্ষাসম্মেলনের পর অনুভূতি

গৌতম এর ছবি
লিখেছেন গৌতম (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/১২/২০০৯ - ১০:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভারত যে সার্ককে এখন আর পাত্তা দেয় না- সেটা মোটামুটি বুঝা যায় গত কয়েক বছরের সার্কের খেলাধুলার দিকে তাকালেই। সার্কের শীর্ষ প্রতিযোগিতাগুলোতে ভারত আস্তে আস্তে দ্বিতীয় সারির দল পাঠাতে শুরু করেছে। সদ্যসমাপ্ত সাফ ফুটবল গেমসে ভারত জাতীয় দল পাঠায় নি; পাঠিয়েছে অনূর্ধ্ব ২৩ দল এবং এই দল ট্রফিও জয় করে নিয়ে গেছে। অনূর্ধ্ব ২৩ পাঠালে যদি সার্কের অপরাপর দেশগুলোর জাতীয় দলকে হারিয়ে ট্রফি জয় করা যায়, তাহলে খামাকা জাতীয় দল পাঠানো কেন? তারচেয়ে বরং ওরা অন্য কোনো দেশে গিয়ে প্র্যাকটিস করুক! আখেরে সেটাই দেশের জন্য লাভবান হবে! তাই শুধু ফুটবলে নয়, অন্যান্য স্পোর্টস ইভেন্টেও শীর্ষ খেলোয়াড়দের বাদ দিয়ে ভারত নতুন, সম্ভাবনাময় ও উঠতি প্রতিভাদের লড়াই করতে পাঠাচ্ছে অন্য দেশের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের সাথে প্রতিযোগিতা করতে।

ব্যাপারটা হয়তো দোষের কিছু নয় এবং কোন দেশ কাকে পাঠাবে সেটা ওই দেশের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এটা যদি সার্কের মন্ত্রীপর্যায়ের সম্মেলেনের মতো ঘটনায় ঘটে, তাহলে বোধহয় মেনে নেয়া যায় না।

সম্প্রতি বাংলাদেশে সার্কভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষামন্ত্রীদের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে যা যা ঘোষণা দেয়া হয়েছিল সেগুলো পর্যালোচনার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষাকে নতুন করে দেখা এই সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। এতে ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের শিক্ষামন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন না, কোনো কোনো দেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব দিয়ে কাজ সেরেছে। কোনো কোনো দেশ তো আরও সরেস- বাংলাদেশের তাদের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকেই সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। খরচ কমল। একমাত্র মালদ্বীপ থেকে শিক্ষামন্ত্রী এসেছেন (তাও নাকি সাফ ফুটবলের ফাইনাল দেখা মূল উপলক্ষ) এবং নেপালের শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন।

তার মানে দেখা যাচ্ছে, শুধু ভারত নয়, অন্য দেশগুলোও আস্তে আস্তে সার্ককে অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলনে মন্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকে যে পাঠানো উচিত না- সেটা স্বীকার করে নিয়েও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সম্মেলন থেকে যে সমস্ত কারণ দেখানো হয়েছে, সেগুলো হাস্যকর ছাড়া আর কিছু না। যে কথাটা সরাসরি বলা অস্বস্তিকর, অর্থাৎ সার্কের সম্মেলনে আসাটা যে সময় আর টাকা খরচ করা ছাড়া আর কিছু না, সেটা আকারে-ইঙ্গিতে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল সবাই।

২.
গত সম্মেলনে সার্কভুক্ত দেশগুলো জিডিপির অন্তত চার শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দের অঙ্গীকার করেছিল। হিসেব শেষে দেখা যায়, ভুটান ও মালদ্বীপ সাত শতাংশ, নেপাল চার শতাংশ, ভারত প্রায় চার শতাংশ, শ্রীলংকা তিন ও বাংলাদেশ মাত্র দুই শতাংশ বরাদ্দ দিচ্ছে। ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকা তিনটি দেশই আগামী কয়েকবছরের মধ্যে এই বরাদ্দ সাত শতাংশের উপরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে বছর দুয়েক আগেই এবং প্রতি বছর একটু একটু করে বাড়ানোর মাধ্যমে সেটা তারা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এ বছর সম্মেলন থেকে অঙ্গীকার করা হয়েছে জিডিপিতে ছয় শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার। অধিকাংশ দেশ ছয়ের কোটা যেখানে ইতোমধ্যে পেরুতে যাচ্ছে, সেখানে আবার ছয় শতাংশের অঙ্গীকার কেন? কারণটা বাংলাদেশ। শিক্ষাখাতে জিডিপির বরাদ্দের পরিমাণ দুই থেকে ছয়ে বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বাংলাদেশের নেতৃত্বের নেই। বাংলাদেশ ছাড়া বাকি দেশগুলো সার্কের সিদ্ধান্ত ছাড়াই আগে থেকেই যে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে, সেটির জন্য বাংলাদেশ সার্কের আশায় বসে ছিল। শিক্ষামন্ত্রী যতো চিল্লাচিল্লি করুন না কেন, আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে চাপ না আসলে বাংলাদেশ কখনোই এ বরাদ্দ বাড়াবে না- অন্তত নিকট অতীতে এরকম উদাহরণ দেখা যায় নি। সে হিসেবে এই সম্মেলনকে বাংলাদেশ ব্যবহার করেছে জিডিপি বরাদ্দ বাড়ানোর একটি অজুহাত হিসেবে। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের সার্কের ওপর এরকম নির্ভরশীলতা কি দেখা গেছে অতীতে?

৩.
একটা আঞ্চলিক পর্যায়ের সম্মেলনে কী নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত? বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে নাকি দেশীর পরিমণ্ডল নিয়ে? সম্মেলনের প্রথম দিন প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিলেন, তাতে বাংলাদেশের শিক্ষার অবস্থা ও কিছু প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু উঠে আসে নি। সম্মেলনে যে আলোচনা হলো বা সিদ্ধান্ত হলো, সেগুলো মূলত এমডিজি, ডাকার বা জমতিয়েন কনফারেন্সের বুলিগুলো ছাড়া আর কিছুই নয়। একটি নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা বা উপর্যুক্ত কনফারেন্সগুলোর অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার জন্য তো সার্কের জন্ম হয় নি। আঞ্চলিক পর্যায়ের সম্মেলনে যদি এ অঞ্চলের নানা সমস্যা ও সমাধানের উপায়গুলো উঠে না আসে, চিন্তাচেতনায় অঞ্চল যদি মুখ্য না হয় তাহলে এ ধরনের সম্মেলন করে লাভ কী?

৪.
সার্ককে পাশ কাটিয়ে সব দেশ নিজের মতো করে সার্ক স্ট্যান্ডার্ডের উপরে উঠার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সার্ক এখন তাদের কাছে ফ্যাশন ছাড়া আর কিছুই না। একমাত্র বাংলাদেশই বোধহয় সার্ক নামক ডেডহর্সটাকে যত্ন করে গোসল করায়, নিয়মিত।

(ডিসক্লেইমার: সম্মেলনের নানা অবস্থা দেখে মাথা গরম। রাগের বশে লেখা এটা। কোনো পদেরই হয় নাই। কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।)


মন্তব্য

নাশতারান এর ছবি

লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। নিজেদের অচলাবস্থা দেখে খারাপ লাগে। কী বলব বুঝে উঠতে পারিনা।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

গৌতম এর ছবি

আমিও বুঝে উঠতে পারি না কী বলা উচিত।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

অম্লান অভি এর ছবি

বিজয় দিনের প্রথম পাঠ হলো ব্যর্থতার কিন্তু সচেতনারও তাই ধন্যবাদ।

মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....

গৌতম এর ছবি

সচেতনভাবে ব্যর্থতার পাঠ দিতে চাই নি, রাগ আর ক্রোধ জন্ম দিয়েছে এই লেখার। আর কোনো বিজয় দিবসে যেন এরকম রাগ-ক্রোধের জন্ম না হয়, সেই আশায় রয়েছি।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

তৌফিক হাসান [অতিথি] এর ছবি

খুব সুন্দর এই লেখাটার জন্য লেখককে ধন্যবাদ...

গৌতম এর ছবি

পড়ার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

......................................................................
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

গৌতম এর ছবি

.............................................

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শরতশিশির [অতিথি] এর ছবি

ভাল লাগলো। রাগের অকপট স্বীকারোক্তি না থাকলেও আপনার উষ্মার কারণ ঠিক আছে। সার্ক আসলেই এখন নামস্বর্বস্ব সংস্থা শুধু, ন্যাটো-রই যে হাল এখন। 'শিক্ষা' নিয়ে আগ্রহ আছে, সে পেশাতেও নিযুক্ত আছি। আপনার সাথে বিস্তারিত আলাপ করার সুযোগ খুঁজছি, সামনে ছুটি পেলেই হবে বলে আশা রাখছি, বিশেষ করে সম্ভাব্য জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে। শুভেচ্ছা রইলো।

গৌতম এর ছবি

অবশ্যই। খুব ভালো হয় প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি নিয়ে আপনার ভাবনাটা যদি লিখে ফেলেন। আর আমার ইমেইল দেওয়া আছে প্রোফাইলে। ইমেইল করলে খুশি হবো।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

স্পার্টাকাস এর ছবি

মাথা গরম হওয়ার মতই ব্যাপার।

জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

গৌতম এর ছবি

মাথা ঠাণ্ডা রেখে লেখা উচিত ছিলো। পারি নি। মন খারাপ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১.
ভারতের কাছে তো বটেই অন্যদের কাছেও সার্ক অনেক আগেই বাতিলের খাতায় চলে গেছে। নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে কেউ এটা ছাড়ছেনা। আজকে ভুটান আসিয়ানে, পাকিস্তান-আফগানিস্তান জিসিসি বা মধ্যপ্রাচ্যের এই জাতীয় কোন সংস্থায় ঢোকার সুযোগ পাক দেখবেন তখন প্রথম চান্সেই তারা সার্ককে ঝেড়ে ফেলবে।

২.
শিক্ষাখাতে ফাকিস্তান তার জিডিপির কতভাগ বরাদ্দ করেছে?

৩.
যে কোন পর্যায়ের সম্মেলনে দেখবেন ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চারা সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্যের সাথে সঙ্গতিবিহীন বক্তব্য দিয়ে যায়। আর যেখানে খোদ মূল সংস্থাটিই ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা হয় সেখানে সবাই যে দ্বায়িত্বহীন বক্তব্য দেবে এ আর নতুন কী?

৪.
বাংলাদেশ যে কিসের আশায় এই রাঙামুলোটাকে এত গুরুত্ব দেয় তা-ই বুঝিনা।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

গৌতম এর ছবি

১. সহমত।

২. ফাক-ইস্তানও তিনভাগের বেশি (সম্ভবত ৩.২) বরাদ্দ করেছে।

৩. হা হা হা। হাসি

৪. সার্ক ধারণার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বাংলাদেশ বরাবরই গর্ব করে। সার্ক যদি কার্যকর কিছু একটা হতো, তাহলে হয়তো এই গর্বের একটা মানে দাড়াতো। সম্ভবত এ কারণে বাংলাদেশ সার্ককে ছাড়তে চায় না। অন্যদের তো আর এই আবেগ নেই!

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

সাফি এর ছবি

মিলিটারির মতন খাদক বর্তমান থাকতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সর্বনিম্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক। যেখানে শিক্ষাখাতে বরাদ্দই হওয়া উচিত ছিল সর্বোচ্চ

গৌতম এর ছবি

শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ব্যাপারে ইউনেস্কোর একটা গাইডলাইন আছে- সেটা হলো জাতীয় বাজেটের আট শতাংশ। সরকার সেটাকে যুক্তিযুক্ত মনে করে। যুক্তিযুক্ত মনে করার পরও সেটাকে বাস্তবায়ন না করাটা, বিশেষ করে না করার চেষ্টা করাটা দুঃখজনকই বটে।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।