তোমার জন্মদিনে

s-s এর ছবি
লিখেছেন s-s (তারিখ: শনি, ০৮/১২/২০০৭ - ৮:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্বাধীনতা মানে ক্লাস সেভেনের বাংলা বইয়ের পাতা বলেছিলো আমাকে:পচা আমটা রেখে ভালো আমটা ওকে দাও
তুমি কিন্তু আম্মা, আমার গোল্ডফিশ ক্যাটফিশ অ্যাঞ্জেল অথবা গাপ্পি মাছের অ্যাকুয়ারিয়ামকেও
মানতে পারোনি -
অতঃপর ছোট্ট কাঁচের বোলেই ওদের বসবাস।।

দুই ঝুঁটি ,রঙবেরঙা রিবন আর মোজা,তাও রঙমেলানো
সাদার মধ্যে লাল পোলকা ডট ফ্রক, তোমার সেলাই মেশিনেই বোনা
বিলেত থেকে তুমি এলেনা, কিন্তু তোমার চিঠিতে বলা ল---ম্বা কবিতা আর জাম্বো প্রাইজ
খুব মোলায়েম সুগন্ধী ছিলো সেইফওয়ে আর কে-মার্ট এর -------
কিন্তু আম্মা, তুমি কই তাতে?
মুরগীর মাংসের ঝোল আর আলু দিয়ে গরম গরম ভাত
মাখন গলে যেতো তোমার ছোট্ট আঙুলের ডগায়
মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট এর গলানো চীজ এনচিলাডার ওপর
ওই আঙুলগুলোকেই খুঁজছি আমি।।

খুব ভয় পেতাম ঐ কালো ফ্রেমের চশমাটাকে
আড়ালে আবডালে দুষ্টুমি করতে শিখেছি তখন -
নাম দিলাম:শিয়াল চশমা।
অথচ তার চেয়েও অনেক ফ্যাশনদুরস্ত চশমার ফাঁক দিয়ে তার বহুকাল পরে
একদিন তুমি আমাকে বললে
কোেত্থকে এত নোংরা ক্লেদ জোগাড় করি-
কেমন কেমন করে যেন, তোমার গোলাপী নেটের শাড়ি,সেই ষাট দশকের সুগন্ধ
সেই আলমারির অন্ধকার নিষিদ্ধ কোণায় থাকা বড়মামার বন্ধ হয়ে যাওয়া লুকনো হাতঘড়ি
আর তোমার ছোট্ট ওই আঙুলসমান প্লাস্টিকের পুতুলটা
যেটা আমি চেয়েও মার খেয়েছি বহুদিন
সবকিছু থেকে আদরটা হারিয়ে গেলো-
যৌনগন্ধী সিনেমা,হোমোসেক্সুয়াল স্টকার,বিবাহিত মধ্যবয়স্ক পুরুষের প্রেম, আত্মহত্যার চেষ্টা,ঘেন্না,হিংসা,ঈর্ষা---------
পরস্পরকে নখ-দাঁত দিয়ে চিরে ফেলা
কেবলই আঁচড়ে কামড়ে দেয়া
ক্রমশঃ দুই নারী হয়ে ওঠা।
আর লুকিয়ে ডায়েরী পড়ে -
দু'জনেরই অকস্মাৎ বীভৎস বিস্ময়ে
স্তব্ধ হয়ে থাকা।।
আমার সরল প্রশ্ন ছিলো নিজের প্রেমিককে কেউ আঙ্কেল ডাকে কি করে?

তার চেয়ে কি এই ভালো,আম্মা?
দূরদ্বীপবাসিনীর মতো অচেনা শহরে
একদম একলা অচেনা একজন হয়ে থাকা?
সেগুনবাগানের ওই ব্রিটিশ আমলের বাড়ীটা
জামরুল গাছের কোঁচড়ে লুকিয়ে থাকা
(হোমওয়ার্ক করিনি যে,স্কেলের বাড়ির ভয়!)
কিম্বা হাসপাতালে ইঞ্জেকশনের ভয়ে হাত আঁকড়ে ধরা সাদা নার্সটাকে
আচম্বিতেই "আম্মা" বলে ডেকে ওঠা?
উপশহরের এই ছায়াঢাকা সবুজ বাড়ীটাতেও
জ্বরতপ্ত কপালে কেউ জলপটি দিলোনা
সরবতের মিহি চিনির দানা আর গন্ধরাজ লেবুর নির্যাসে
তোমার টুং টাং চামচ নাড়ার শব্দ,আম্মা - মগজে গেঁথে গেছে
কোন প্রেম,কাম,মদ,মাৎসর্য,কোন হাত,কোন ছোঁওয়া
ওরকম হয়না কেন?
অ্যামবিলিকাল কর্ড- তুমিই শিখিয়েছিলে
খাওয়াতো আমাকে,বাঁচিয়ে রাখতো তোমার পেটের ভেতর
কি করে বদলে গেলো সব!
কত্তদিন হলো তুমি বলোনা - "আমার পরীক্ষার খাতার মার্কশীটে নম্বরটা যোগ কর্"
হাতের কড়া গুনে সুরে সুরে শেখাওনা-
"তিরিশ দিনেতে হয় মাস সেপ্টেম্বর"।।

এক সময় সবচাইতে বড় সবচাইতে সুন্দর কেকটা,আম্মা,আমার বাঁধাধরাই ছিলো একমাত্র বাচ্চা হিসেবে
ক্রমে সেটা দাঁড়ালো বন্ধুদের নিয়ে রেস্টুরেন্টের কাঁটাচামচ নাড়া
আর এখন??
অন্ধকার ঘরে হাজারটা সুগন্ধী মোম জ্বালিয়ে বসে থাকি-হঠাৎ একটা "লক্ষী সোনা আমার যে মা দু'গাল জুড়ে হাজার চুমা" শোনার আশায়-
তোমার দরজায় সেঁটে দেওয়া সেই ব্যানার- কত্ত কাঠখড় পুড়িয়ে বানানো আমার আর ভাইয়ার
কেবলই ঝাপসা করে দেয় চোখ -----
নির্লিপ্ততায় নয়- এই ভেবে যে কত-
কতখানি নির্মোহ হয়ে গেছ তুমি।
দু'জনে দু'জনার ছিলাম কখনো ভীষণ তীব্রভাবে।।

আকাশের তারায় তোমাকে খুঁজে পাবো না জানি
আরো ভয় পাই ভাবলে, ফোনের উল্টোদিকেও হয়তো নয় -
সেই গম্ভীর আবেগহীন নিঃশ্ছিদ্র বিমগ্নতার আগেই
আম্মা, তোমাকে ভীষণ আবেগে জড়িয়ে ধরে তোমার বুকে মুখ গুঁজে
সমস্ত গ্লানি ঘেন্না ঈর্ষা নিয়েও নিমজ্জমান আমি বলতে চাই:
তোমাকে যে হারাতে চাই না কিছুতেই,
কি ভাবে বললে গভীর হবে সে বলা???

ss ০৭ ডিসেম্বর,২০০৭, রাত ১টা ২০ মি:


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সূবর্ণা সেজুতি (তাই তো?) , অতিথি লেখক বলে আপনাকে ব্যক্তিগত ইমেইল পাঠাতে পারছি না নাহলে হয়তো আর একটু বিষদ ভাবে বোঝাতে পারতাম আপনার কবিতাটা আমাকে কোথায় স্পর্শ করেছে। এ বছর আমার মা কে হারিয়েছি। আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং আপন দুজনের একজন। এখন খুব মনে হয় কিছু কথা যদি সময় থাকতে বলতাম............

স্নিগ্ধা

ss এর ছবি

আমাদের কথাগুলো সময়ে বলা হয়ে ওঠেনা বলেই আমরা কবিতা লিখি, অক্ষমের আস্ফালনের মতো,নির্বীর্যের শৌর্য প্রদর্শনের মতো,বন্ধ্যপুরুষের ভূমি কর্ষণের মতো করে নিজের সন্তানহীনতার গ্লানি ঢাকি। আমার সহানুভূতি বলবো না,বরং বলি সংবেদনশীল ঐকমত্য রয়েছে আপনার হারানোর প্রতি। মধ্যবিত্তের এই এক প্যারাডক্স স্নিগ্ধা, মা বিষয়ক জটিলতা থেকে কিছুতেই মুক্তি নেই যে আমাদের। এটাও ভুলে যাই আমার মা হওয়ার বাইরেও ওই মানুষটার সমাজে,কর্মে,বাইরের জীবনটায় অন্য অনেক কিছু থাকে,ছিলো যা কেবলমাত্র তার শরীরে ন'মাস থাকার কারণেই আমার মৌরসীপাট্টা বলে ধরে নেই। সেটা আমার নয় মোটেও,সারা জীবন যায় শুধরোতে মা শুধু আমার সারা জীবনের উদগ্র প্রয়োজন,মানবিক সমস্যা মেটানোর আর মাঝে মাঝে পেটে গিয়ে মুখ লুকোনোর জায়গাই নন,অনেক সফল অ্যাকমপ্লিশড পূর্ণ একটা মানুষ মাঝে মাঝে চমকে উঠে নিজের সাথেই বোঝাপড়া, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে, অস্তিত্বের অংশকে না বোঝার, না জানার, অপ্রকাশের অক্ষমতার নামই সন্তান। আমরা, ছানাপোনারা। বোঝাতে পারলাম?
আপনাকে সিক পাপিস এর পক্ষ থেকে free hugs. হাসি

আরণ্যক সৌরভ এর ছবি

প্রায় দেড় বছর পর সম্পূর্ণ হঠাৎ গত সপ্তায় দেশে ফিরে মা'কে দেখে কান্নায় বুক ফেটে আসলো। শরীর ভেঙে গেছে অনেক, বয়েসের ছাপ পড়েছে অদ্ভূত।

কান্নাটা চাপা দিলাম অনেক কষ্টে।
আমি কাঁদলে মা'ও যে কাঁদবে। আমাদের বাড়িতে এখন কাঁদা নিষেধ।

আপনার কবিতাটা পড়ে সেই অনুভূতিটা রিনরিন করছে মন জুড়ে। মা'য়েদের কষ্টগুলো ঈশ্বরকে কাঁদায় না? মায়েদের ভালোবাসাগুলোর কাছে স্বর্গকে তো আমার খুব নস্যি মনে হয় । খুব নস্যি।

কবিতাটা অসাধারণ লাগলো। বড্ড।

ss এর ছবি

সুপ্রিয় সৌরভ: মা ভীষণ জটিল এক সম্পর্কের নাম। প্রেম, ভালোবাসা, শাসন, ঈর্ষা, ঘৃণা, তুমুল আবেগ, অসম্ভব ভালোলাগা, আশ্রয়, কখনো সখনো চাপা inferiority complex ও বোধ করি,তাই আমি কখনোই চাইতাম না মা'র চুল পাকুক, মুখে বয়সের ছাপ পড়ুক। চল্লিশ পেরুলেই চালশের ধারে কাছেও যেন না যায় মা, চিরযৌবনা, চির সুন্দর, চির তীক্ষ্ণধী শব্দসন্ধান আর ক্রসওয়ার্ড পাজ্ ল করা, তুমুল দাবাড়ু, চশমার আড়ালে অপূর্ব দু'টো চোখ- এই ছিলো আমার মানসপটে। কিন্তু জানবেন,মায়েদের কষ্টে ঈশ্বর নামক ব্যক্তিটির বিশেষ কিছু যায় আসে না। আমাদের, যাদের যায়, কিম্বা আসে, তারাই অন্ধ, বাক্ হীন মূঢ়ের ভূমিকায়, বেচারা ঈশ্বরকে টানি কেন-----
কৃতজ্ঞতা আর সংবেদনশীল ভালোবাসা রইলো।

সৌরভ এর ছবি

ঈশ্বর মরে গেছে - মনে হয় মাঝে মাঝে।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বেঁচে থাকার জন্য প্রতি মুহুর্তে ঋনী হই বাতাসের কাছে অথচ আলাদা করে একবার,কোন একবারো তার প্রতি কৃতজ্ঞ হলাম না । চাঁদকে ভালোবাসলাম,ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম । বাতাসকে কখনোই আলাদা করে ভাবলামই না ।
মা তো ঠিক সেরকমই ।

খুব, খুব ছুঁয়ে গেলো আপনার লেখা ।
সামান্য পাঠকের অভিবাদন গ্রহন করুন ।
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ss এর ছবি

সুজনেষু:অসংখ্য ধন্যবাদ দেবার প্রয়োজন আছে কি? বিশেষতঃ বাতাসের কাছে আজন্ম ঋণ, নিঃশ্বাসেই তো বেঁচে আছি আপনি,আমি সবাই , তাই না।। হাসি?মা'কে মানুষ হিসেবে ভালোবাসতে শেখার চর্চা করি চলুন। অক্সিজেনহীন ঘরের ভয় মনে ঢোকার আগেই,বিনম্র শ্রদ্ধায় আপনার শব্দাবলী গ্রহণ করলাম। পূর্ণতায়,সানন্দে। শুভাশীষ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।