এই আত্মতৃপ্তি কি আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে না?

গৌতম এর ছবি
লিখেছেন গৌতম (তারিখ: রবি, ২৩/১২/২০০৭ - ৩:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঈদ আসলেই আমরা যে যেভাবে পারি, ছুটি বাড়িপানে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যবিত্ত-নাগরিক জীবনে এই ধারায় কিছুটা ব্যতিক্রম অবশ্য দেখা যায়। বাড়ির বদলে তারা ছুটেন কক্সবাজারে, কুয়াকাটায়। এই ইতিবাচক দিকটি অবশ্য এখনো সীমিত আকারে সামর্থবানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এর বাইরে আমরা সবাই মনের মধ্যে ধারণা পুষে বসে আছি- ঈদ আসছে। বাড়ি যেতে হবে। লাইন লাগাও। বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কর। হুড়োহুড়ি করে উঠ। পথে অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। দ্বিগুণেরও বেশি সময় লাগবে। ... আবার লাইন লাগাও। বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কর। হুড়োহুড়ি করে উঠ। পথে অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। দ্বিগুণেরও বেশি সময় লাগবে।...

মোটামুটি চিত্রটা একই রকম। বছরের পর বছর দুই ঈদে এই রকম করে আসছি আমরা। নাগরিক মানুষ অবশ্য এমনিতে ছুটিছাটা পায় কম। বাড়ির মানুষের সাথে, আত্মীয়স্বজন-পড়শির সাথে দেখাশুনা হওয়ার এটি একটি মোক্ষম সময়। তাই এ সময়ে বাড়িপানে ছোটাটা প্রয়োজনীয় তো বটেই, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করে।

কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়, এই কাজটি করতে গিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত যেমন নানা রকমের বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছি, তেমনি বিড়ম্বনায় ফেলছি হাজারো মানুষকে। যাদের কোনো উপায় নেই- যেমন শ্রমিক, ঈদ ছাড়া যাদের ছুটিছাটা নেই- এই ধরনের উপায়হীন চাকুরিজীবি বা শ্রমজীবি মানুষ ছাড়া সত্যিকার অর্থে অন্যদের কি ঈদেই বাড়ি যেতে হবে? আমরা যদি সবাই একযোগে বাড়ি না গিয়ে কোথাও বেড়াতে যাই, কিংবা ঢাকা শহরে থাকি, তাহলে কি সময়টা খুব খারাপ কাটবে?

আমাদের অনেকেরই সামর্থ্য আছে বাড়ি না গিয়ে বরং বাড়ি থেকে সবাইকে ঢাকায় নিয়ে এসে ঈদ করা। এতেও কিন্তু সবার একসাথেই ঈদ করা হয়। এই ধরনের পরিবারের সংখ্যাটা হয়তো কম হবে, কিন্তু এর একটি প্রভাব পড়বে অন্যদের ওপরও। কক্সবাজার, কুয়াকাটা ইত্যাদি ছাড়াও আমাদের বেড়ানোর অনেক জায়গা আছে। সেগুলোতেও যেতে পারি। এতে পর্যটন শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে।

প্রতি বছরই দুই ঈদের সময় সংবাদপত্রের পাতায় যে বিষয়টি বড় করে আসে- সবজায়গায় ভিড়। তিলধারণের জায়গা নেই। এবং এতে অবধারিতভাবেই সব দোষ গিয়ে পড়ে পরিবহন সংস্থাগুলোর ওপর। টিকিট পাওয়া যায় না, গাদাগাদি করে যেতে হয়, অশেষ ভোগান্তি, ভাড়া বেশি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কেউ কি ভেবেছি সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লে যতো উন্নত দেশই হোক না কেন, পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। গণপরিবহন ব্যবস্থায় নিউ ইয়র্কের সুনাম আছে। আজ যদি নিউ ইয়র্কের সব মানুষ শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, তখন নিউ ইয়র্কের সব বাস-ট্রেন-বিমান সংস্থা কি এতোগুলো মানুষকে সেবা দিতে সক্ষম হবে? আমরা কিন্তু এই দিকটি নিয়ে মোটেই বিবেচনা করি না। দোষ চাপাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি কেন বেশি বেশি ট্রেন নেই, বাস নেই। কেন নিরাপত্তা নেই।

আরো ভয়ংকর লাগে মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখলে। কী আশ্চর্যজনকভাবেই মানুষ বলে- বাড়ি গিয়ে যখন প্রিয়জনের মুখ দেখি তখন সব কষ্ট ভুলে যাই। কী ভয়ংকর কথা! যাত্রার শুরুতে কি মনে থাকে না যে বাড়ি গিয়ে প্রিয় মানুষের মুখ দেখবো তখন সব কষ্ট ভুলে থাকবো? তাহলে তো খামোকা পরিবহন সংস্থাগুলোকে দোষ দেওয়ার দরকার নেই। মানুষ কষ্ট পায়; এবং পরবর্তীতে যাতে সেই কষ্ট না পেতে হয় সে চেষ্টা করে। কিন্তু কয়েকটি মুখ দেখে যদি যাত্রাপথের কষ্ট কেউ ভুলে যায়, তাহলে কি কেউ সেই কষ্ট নিবারণের চেষ্টা করবে। কী দরকার পরিবহন ব্যবস্থাকে ভালো করার, উন্নত করার?

আমি জানি না, এই আত্মতৃপ্তি আমাদের দুর্ভোগের কারণ কি-না।

গৌতম


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

খুবই ভুল দৃষ্টিভঙ্গী। পৃথিবীর সব দেশেই সব মানুষই ছুটিতে পরিবারের সাথে সময় কাটাতে চায়। এবারের ক্রীসমাসে আমেরিকার বাসীর দুর্ভোগের খবর দেখুন

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি ভালো লিখতে পারি না, কেবল মনের ভাবটুকু প্রকাশ করতে চেষ্টা করি। ফলে অন্য ব্লগাররা যেভাবে সুন্দর করে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে, আমার দ্বারা সেটি সম্ভব হয় না। তবে চেষ্টা করি, আমি কী বলতে চাই সেটি যেনো বুঝা যায়।

দুটি মন্তব্য পড়ার পর লেখাটি আমি আবার পড়লাম। এস এম মাহবুব মুর্শেদ বলেছেন, 'খুবই ভুল দৃষ্টিভঙ্গী। পৃথিবীর সব দেশেই সব মানুষই ছুটিতে পরিবারের সাথে সময় কাটাতে চায়।' - আমি ঠিক বুঝতে পারি নি, কোন দৃষ্টিভঙ্গিটি ভুল। মানুষ ছুটিতে পরিবারের সাথে সময় কাটাতে চায়- এ ব্যাপারে তো আমি কোনো বিরুদ্ধ মন্তব্য করিনি! আমি বরং লিখেছি- 'নাগরিক মানুষ অবশ্য এমনিতে ছুটিছাটা পায় কম। বাড়ির মানুষের সাথে, আত্মীয়স্বজন-পড়শির সাথে দেখাশুনা হওয়ার এটি একটি মোক্ষম সময়। তাই এ সময়ে বাড়িপানে ছোটাটা প্রয়োজনীয় তো বটেই, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করে।'

আমার মনে হয় আমি আমার কথাটি আরেকটু পরিষ্কার করতে পারি এভাবে-
১. ঈদ বা অন্য কোনো ছুটিতে আমরা সবাই ছুটি গ্রামের দিকে। কিন্তু যদি উল্টোটা করা যায়, অর্থাৎ গ্রাম থেকে পরিজনদের নগরের দিকে আনা যায়, তাহলে যাতায়াতটা আর একপাক্ষিক করা থাকে না, একটু ভিন্নমাত্রা পায়। তাতে পরিজনদের সাথে থাকা হলো, আবার পরিজনরাও ভিন্ন পরিবেশে ছুটি উপভোগ করতে পারলো। আর কেউ বাড়ি যেতে চাইলে যেতেই পারে, তবে সেটি সবাই ঈদে না গিয়ে অন্য ছুটিগুলোতেও যেতে পারে।
২. এতে পরিবহনের ওপর চাপ পড়ে। আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা এমনিতেই নাজুক। সবাই মিলে গণহারে যাতায়াত শুরু করলে তা ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। সেটা যে দেশেরই হোক না কেন।
৩. এমনিতে আমাদের বেড়ানোর অভ্যাস কম। ছুটিগুলোতে কোথাও বেড়াতে গেলে দেশীয় পর্যটন শিল্প কিছুটা গতি পায়।
৪. শেষ বিষয়টি ছিলো, এই দুর্ভোগ স্বীকার করে বাড়ি যাওয়া এবং আসার পর এ ব্যাপারে মানুষের নিষ্পৃহতা। একটি সুখ পাওয়ার সাথে সাথেই যদি ঠিক আগ মুহূর্তের দুঃখ ভুলে যাই (এবং যে দুঃখ আগামীতে আবার নিশ্চিত আসছে জানি) তাহলে কি সেই দুর্ভোগকে অতিক্রম করা সম্ভব? দুর্ভোগটিকে ধারণ করে এ ব্যাপারে কিছু করলেই না সে দুর্ভোগকে ভোগে পরিণত করা যায়!

ধন্যবাদ এস এম মাহবুব মুর্শেদ এবং অরূপ। এটুকু বলা যায়, সংস্কৃতিকে যেমন ভালো সংস্কৃতি বা খারাপ সংস্কৃতি বলে ক্লাসিফায়েড করা যায় না, বলা যায় ভিন্ন বা ভিন্নতর সংস্কৃতি; তেমনিভাবে কোনো দৃষ্টিভঙ্গিকে আসলে ভুল বা শুদ্ধ বলার চাইতে সেই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত বা দ্বিমত পোষণ করাটাই বোধহয় যুক্তিযুক্ত।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আরে ভাই, আপনি আপনার বক্তব্য দিয়েছেন, আপনি যা মনে করেছেন তা লিখেছেন। তাতে কারোই অসুবিধা নাই। অন্যেরা তাদের মন্তব্য করেছে। সবাইকে ধন্যবাদ।

আপনার ধারনাটা খারাপ না। তবে সবাইকে ঢাকায় নিয়ে এলে ঢাকা ডেবে যাবে যে! (মজা করলাম)

আর একটু যোগ করি-- ইদানিং গরু জবাই করা নিয়ে যেসব শোরগোল উঠছে তাতে আপনার লেখা পড়ে অনেকেই হয়তো শোরগোল তুলবে ঈদ করারই দরকার নাই। এত ঝক্কি, ঝামেলা, এত জাতীয় অপচয়, এত প্রাণহানি-- কী দরকার সামান্য ধর্মীয় আচার পালনের। হা হা .....

অতিথি লেখক এর ছবি

... তবে কবি নজরুল লিখেছিলেন... 'বনের পশুরে নয়, মনের পশুরে কর জবাই'

গৌতম এর ছবি

আবার ঈদ আসছে, আবার বাড়িতে যেতে হবে। ভয়েই বুক কাঁপছে।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

আমি নিজে যদিও অতটা সামাজিক মানুষ নই, ঈদ আমাকে সেভাবে টানে না। গত দুই বছর ঈদের দিন ল্যাবে বসে সিমুলেটরে কাজ করাই ভালো মনে করেছি, তবে তার পরও কেন যেন মনে হয় ঈদ বা ক্রিস্টমাস বিশ্ব ব্যাপি সবাইকে ঘরে ফেরার ডাক দেয়।

ফোর ক্রিস্টমাস বলে একটা ছবি দেখেছিলাম কিছুদিন আগে। সেখানে দেখায় নায়ক-নায়িকা প্রতি ক্রিস্টমাসে ছুটি কাটাতে চলে যায় কোন না কোন জায়গায়। কিন্তু একবার তারা আর যেতে পারেনি ফ্লাইট ক্যানসেল হয়ে যাওয়ায়। তখন তারা বাধ্য হয় পরিবারের সাথে ক্রিস্টমাস করতে। সেই সময় তারা অবিষ্কার করে পরিবারের বন্ধনটাকে। যদিও আমার টাইপ মুভি না, তবে মন্দ ছিল না।

তবে আপনার একটা আইডিয়া আমার কাছে ভালো লেগেছে খুব। বাড়ি না গিয়ে বাড়ির মানুষদের ঢাকায় নিয়ে এনে ঈদ করা যেতে পারে। এটা সবার জন্যই নুতনত্ব বয়ে আনবে। যাদের পরিবার দেশের বাড়ি থাকে তারা এটা করলে বেশ ভালো লাগবে হয়তো তাদের।

শুভেচ্ছা রইলো।

রাগিব এর ছবি

ক্রিসমাস ও থ্যাংকসগিভিং এর সময়ে আমেরিকাতেও একই দশা হয়। বিশেষত এয়ারপোর্টে মারামারি করার মতো ভীড়।

পরিবারের কাছে যাওয়ার এই মানবীয় আকাংক্ষাকে আসলে ঠেকানো যাবে না।

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | কুহুকুহু

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।