গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে - ২

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: শনি, ২৩/০২/২০০৮ - ৩:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পিটার ওয়ার্ড রচিত "ইমপ্যাক্ট ফ্রম দ্য ডিপ" প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ
অনুবাদক: মুহাম্মদ
---------------------------------
আকস্মিক সংঘর্ষই একমাত্র সমাধান নয়

ক্রিটাশিয়াস-টার্শিয়ারি গণ বিলুপ্তি ঘটনাকে সংক্ষেপে কে/টি ঘটনা বলা হয়। কে/টি ঘটনায় বৃহদাকার বস্তুর যে সংঘর্ষের উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে একটি বড়সড়ো ভূমিকম্পের মাধ্যমে বড় একটি শহরের সমতল ভূমিতে পরিণত হওয়ার তুলনা করা যেতে পারে। হয়তো বিপর্যয়টি খুব আকস্মিক, বিধ্বংসী এবং স্বল্পায়ু, আর শেষ হয়ে যাওয়ার পরপরই নতুন করে শহর নির্মাণ শুরু হয় (হিরোশিমা ও নাগাসাকির সাথে তুলনা করতে পারেন)। কে/টি বিলুপ্তির কার্বন-সমাণু উপাত্ত এবং জীবাশ্ম রেকর্ড পরীক্ষা করে ধ্বংস ও পুনর্গঠনের এই চক্রের আলামত পাওয়া গেছে। অবশ্য জীবাশ্ম রেকর্ড পর্যালোচনা করতে বিজ্ঞানীদের খানিকটা বেশী কষ্ট হয়েছে। খুব ছোট ও সাংখ্যাগুরু জীবাশ্মগুলো জানান দেয় যে, কে/টি সীমানায় আকস্মিকভাবে তাদের মৃত্য ঘটেছিল। এ ধরণের জীবাশ্মের মধ্যে রয়েছে ক্যালকারিয়াস ও সিলিয়াস প্ল্যাংকটন এবং বিভিন্ন উদ্ভিদের স্পোর। কিন্তু সমসাময়িক জীবাশ্ম শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত বড়গুলো উল্টো কথা বলছে। জীবাশ্ম যতই বড় তাদের বিলুপ্তি ততই ক্রমান্বয়িক ও ধীর।

একসময় জীবাশ্মবিদরা বুঝতে পারেন, পরীক্ষিত অধিকাংশ মৃত্তিকা ও শিলার স্তরে বড় আকারের জীবাশ্ম নমুনার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। আর এ কারণেই বিলয়-পুনর্নিমাণের এই আপাত গড়নের সৃষ্টি হয়েছে। এই নমুনায়ন সংকটকে মোকাবেলা করে বিলুপ্তি পথের সন্ধান পেতে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জীবাশ্মবিদ চার্লস মার্শাল একটি নতুন পরিসাংখ্যিক প্রোটোকল তৈরী করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জীবাশ্মের ব্যপ্তিকে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নতুনভাবে পরীক্ষা করে। এর মাধ্যমে তিনি একটি প্রদত্ত সময়সীমার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির বিলুপ্তির সম্ভাব্যতা নির্ণয় করেন। এই প্রক্রিয়ায় সাফল্য আসে। বিরল জীবাশ্মগুলো হাতড়েও যে তথ্য পাওয়া যায়নি নতুন এই প্রোটোকল সেই তথ্যকেই বের করে আনে।

১৯৯৬ সালে আমি মার্শালের সাথে কাজ করা শুরু করি। উদ্দেশ্য ছিল কে/টি সীমানার স্ট্র্যাটিগ্রাফিক (একটি সাধারণ সময় স্কেলে কোন যুগের মৃত্তিকা নমুনা পরীক্ষা করার নাম) অংশের উপর মার্শালের প্রোটোকল প্রয়োগ করা। এর মাধ্যমে আমরা দেখাতে সক্ষম হই, ইউরোপের অ্যামোনাইট শ্রেণীর জলজ প্রাণী ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছে বলে যে ধারণাটি করা হচ্ছিল তা সঠিক নয়, বরং কে/টি সীমানায় আকস্মিক বিলুপ্তির সাথেই পরীক্ষণের ফলাফল বেশী সঙ্গতিপূর্ণ। উল্লেখ্য, অ্যামোনাইটরা হল বৃহদাকার জলজ প্রাণীদের মধ্য সবচেয়ে বিরল যার মধ্যে রয়েছে চেম্বার্ড নটিলাসের মত মলাস্কা পর্বের অন্যান্য প্রাণী। কিন্তু, এরপর আমি ও অন্যান্য গবেষকরা মিলে পূর্ববর্তী বিলুপ্তি ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে এই নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করি। এর ফলে সে সময়ে আকস্মিক বিলুপ্তির সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যায়। আমার গ্রুপ মৃত্তিকা স্তরে পার্মিয়ান ও ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিকে বিলুপ্ত জলজ ও স্থলজ সব প্রাণীর জীবাশ্ম নিয়ে পরীক্ষা চালায়। এতে দেখা যায়, বিলুপ্তি ঘটেছে ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়িকভাবে। অবশ্য বিলুপ্তির সময় সেই সীমানার আশেপাশেই রয়েছে।

বিলুপ্তির হার পরীক্ষার আরেকটি শক্তিশালী পদ্ধতি কার্বন সমাণুর রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করা। সেই পর্যবেক্ষণেও ধীর-বিলয়ের নিদর্শন মিলেছে। কার্বনের তিনটি সমাণু আছে যাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য নিউক্লিয়াসে নিষ্ক্রিয় নিউট্রনের পরিমাণ। এই তিনটির মধ্যে কার্বন-১৪ নামক সমাণুটির সাথে কমবেশী সবাই পরিচিত। কারণ, এই সমাণু দিয়ে জীবাশ্ম কঙ্কাল বা প্রাচীন পাললিক শিলার বয়স নির্ণয় করা হয়। কিন্তু গণ বিলুপ্তি ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা এর চেয়েও ভাল একটি পদ্ধতি পেয়েছি, আর তা হল কোন ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডে উপস্থিত কার্বন-১৩ এবং কার্বন-১২ সমাণু দুটির পরিমাণের অনুপাত। এই অনুপাতের মাধ্যমে বয়স তো নির্ণয় করা যায়ই, সেই সাথে ঐ সময় নির্দিষ্ট উদ্ভিদ প্রজাতির বিস্তৃতি কতটা ছিল তাও বের করা যায়।

এর কারণ, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া পরিবেশে কার্বন-১২ ও কার্বন-১৩ 'র অনুপাত পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রাখে। উদ্ভিদেরা পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে তা থেকে জৈব কার্বন ও শক্তি উৎপাদন করে। এর মাধ্যমেই বেঁচে থাকে তারা। সৌভাগ্য আমাদের, প্রাণীদের এতো কষ্ট করতে হয়না, উদ্ভিদের আবর্জনা খেয়েই বেঁচে থাকতে পারি আমরা। কিন্তু, আসল ব্যাপার হল, প্রাণীরা কার্বন ডাউ অক্সাইড শোষণ করতে গিয়ে পক্ষপাতিত্ব করে। তারা সেই কার্ডন ডাই অক্সাইডই শোষণ করে যার মধ্যে কার্বন-১২ আছে, অন্যগুলো সহজে নিতে চায়না- তা সে সমুদ্রে ভাসমান খুদেকায় প্ল্যাংকটনই হোক আর বিশাল বৃক্ষই হোক। সুতরাং, যখন পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিদ থাকে তখন পরিবেশে কার্বন-১৩ 'র পরিমাণ থাকে বেশী। আর উদ্ভিদের কারণেই কার্বন-১২ 'র পরিমাণ একেবারে কমে যায়। তাই কার্বন ১৩-১২ 'র অনুপাতও যায় বেড়ে।

গণ বিলুপ্তির আগে, সে সময় এবং বিলুপ্তির পরে এই দুটি সমাণুর পরিমাণ নির্ণয় করে তা থেকে অনুপাত বের করা হয়। আর এভাবেই গবেষকরা জলে ও ভূমিতে সে সময় কি পরিমাণ উদ্ভিদ ছিল তা বের করে ফেলতে পারেন। উপাত্ত সংগ্রহের পর গবেষকরা অনুভূমিক অক্ষে সময় আর উল্লম্ব অক্ষে কার্বন-১৩ 'র পরিমাণ বসিয়ে লেখ অংকন করেন। কে/টি সীমানার যে লেখচিত্রটি আমরা পেয়েছিলাম তাতে দেখা যায়, কার্বন-১৩ 'র পরিমাণ হঠাৎ করে একেবারে কমে গেছে এবং পরে আবার বেড়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, সে সময় সংঘর্ষের কারণে উদ্ভিদ প্রজাতির বিশাল অংশ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং পরে আবার ফিরে এসেছে। স্থলভাগের বড় বড় গাছ এবং জলভাগের ছোট ছোট প্ল্যাংকটন সবার জন্যই এটি সতত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

২০০৫ সালে আমরা পার্মিয়ান যুগের জন্য উপর্যুক্ত লেখটি আঁকি এবং অতি সম্প্রতি ট্রায়াসিক যুগের জন্যও সেটি আঁকা সম্ভব হয়েছে। এই দুটি লেখ কিন্তু আগেরটির থেকে একেবারে ভিন্ন কথা বলে। এগুলোতে দেখা যায়, সমাণুটির পরিমাণ ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ বছরের ব্যবধানে কখনও কমেছে এবং কখনও বেড়েছে। অর্থাৎ সে সময় জীবজগতের একটি অংশ কখনও বিলুপ্ত হয়েছে এবং কখনও আবার সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টির উদ্দেশ্যই যেন ছিল ধ্বংস হওয়া। এ ধরণের ধ্বংস-বিলয় গড়ন সৃষ্টির একটি কারণ হতে পারে, বারবার গ্রহাণু জাতীয় বহির্জাগতিক বস্তুর আঘাত। কিন্তু, খনিজ রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করে সে সময় কোন গ্রহাণু আঘাত করেছে বলে জানা যায় না।

অনেকে মিলে এই গুরুত্বপূর্ণ বিলুপ্তি ঘটনাগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন। অন্য কোন গবেষক দল এখন পর্যন্ত পার্মিয়ান সীমানার সময়ের কোন কার্বন বাকিবল (buckyball) অণুর সন্ধান পায়নি যাতে বহির্জাগতিক গ্যাস আটকা পড়ে আছে। সে সময়ের একটি আঘাতপ্রাপ্ত কোয়ার্জের সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু, অস্ট্রেলিয়ার নিকটবর্তী সমুদ্রতলে ও অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে প্রাপ্ত এই কোয়ার্জ খাদগুলো আসলেই সংঘর্ষ ক্র্যাটার নাকি নিছক প্রাকৃতিক খাদ তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ট্রায়াসিক যুগের শেষদিকের ইরিডিয়াম স্তরের যে সন্ধান পাওয়া গেছে তার পরিমাণ এতো কম যে মনে করা হচ্ছে, ছোট ছোট কয়েকটি গ্রহাণুর আঘাতে তেমনটি হয়েছিল। কিন্তু, সেগুলো মোটেই গণ বিলুপ্তির জন্য যথেষ্ট নয়। কে/টি সীমানার বিলুপ্তির মত বহির্জাগতিক বস্তুর সংঘর্ষ যদি পূর্বতন সেই বিলুপ্তিগুলো না ঘটিয়ে থাকে, তবে এর প্রকৃত কারণ কি? নতুন ধরণের এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, পৃথিবী নিজেই শত্রুতা করে তার অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে এবং হয়তো তা-ই সে করেছিল।

চলবে ...................

---------------------------------
সূত্র: সাইন্টিফিক অ্যামেরিকান; অক্টোবর ২০০৬
---------------------------------
মুহাম্মদ২০১৭


মন্তব্য

পরিবর্তনশীল এর ছবি

খুবই ইন্টারেস্টিং।
গত পর্বকে ছাড়িয়ে গেল।
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।