বিচ্ছেদের অপেক্ষা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৪/০২/২০০৮ - ৮:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক

কিছুক্ষন আগে অপু বাদে অন্যরা সবাই হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছে। তাদের মা লুৎফার অপারেশনটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হবে আরো কয়েকদিন। তিনি বাসায় ফিরে না আসা পর্যন্ত অপুর রাতে হাসপাতালে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সব ভাই-বোনেরা মিলে। সে ছাড়া আর কারো পক্ষে রাতে থাকা সম্ভব নয়। বাকী তিন ভাই-বোনেরা সবাই নিজ নিজ চাকরি, সংসার, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত। সে সবার ছোট এবং এখনো ছাত্র। কয়েক দিন কলেজ কামাই হ'লে ক্ষতি নেই।

বসার ঘরে বাবা ফরিদউদ্দনকে ঘিরে এটা ওটা নিয়ে কথাবার্তা বলছে সবার বড় তৌফিক এবং ভাই-বোনদের মধ্যে তৃতীয় সুমা আর তার স্বামী আজিজ। স্বামীসহ সুমা থাকছে আজ রাতটা এ বাসায়। তাদের ছেলেটিকে রেখে এসেছে ওর দাদীর কাছে। মেঝ ভাই রাজু আর তার স্ত্রী ছুটির অভাবে চিটাগং থেকে আসতে পারছেনা শুক্রুবারের আগে। বিচ্ছিন্ন কথাবার্তার এক পর্যায়ে সুমা ফরিদউদ্দনকে বলে, 'বাবা, ক্ষিদে পেয়েছে? ভাবীকে খাবার দিতে বলবো টেবিলে?'

ফরিদউদ্দন বলেন, 'খেতে ইচ্ছে করছে না রে মা।'

তৌফিক বলে, 'আমাদের সবারই খারাপ লাগছে বাবা, তাই বলেতো খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়া যায় না। এতসব ঝামেলার মধ্যে দুপুরে হাসপাতালে কী খেয়েছো খেয়াল করতে পারিনি। সুমা তোর ভাবীকে খাবার গরম ক'রে টেবিলে দিতে বল।'

তৌফিকের স্ত্রী তাদের ছোট ছেলে মেয়ে দু'টিকে কিছু মুখে গুঁজে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে আগেই রান্নাঘুরে ঢুকে গেছে খাবারের আয়োজন করতে। সুমা 'আচ্ছা' বলে রান্নাঘরে চলে যায় ভাবীকে সাহায্য করতে।

ফরিদউদ্দিন বলেন, 'আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, গোসল করে নিই খাবার আগে?' ঠিক প্রশ্ন নয়, তাই কারো উত্তরের অপেক্ষা না ক'রে তিনি উঠে বাথরুমের দিকে চলে যান। ছেলেমেয়েরা কেউ তাঁকে হুকুম করে না, তিনিও কারো অনুমতি প্রার্থনা করেন না। তারপরেও রিটায়ার করার পর থেকে নিজের অজান্তে ছেলে-মেয়েদের মন যুগিয়ে চলার চেষ্টা করেন সবসময়। নিজের সঞ্চয় বলতে তেমন কিছু কখনো ছিলো না। সারাজীবন একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে সৎভাবে কাজ ক'রে যেটুকু সঞ্চয় সম্ভব সেটুকুই ছিলো। তারও সবটা গেছে ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে, বিয়ে দিতে। এই বয়সে তাঁর আর তাঁর স্ত্রীর দেখাশোনা, চিকিৎসা এবং সেই অর্থে তাঁদের ভাগ্য পুরোপুরি নির্ভর করে ছেলে-মেয়েদের হাতে।

তিনি বাথরুমে ঢুকেছেন নিশ্চিত হওয়ার পর আজিজ জিঞ্জেস করে, 'ভাইয়া, মা কতদিন ভালো থাকবে ব'লে মনে করেন? অপারেশনে অনেক খরচ হয়ে গেলো।' এমন মন্তব্য আজিজ করতে পারে। এই অপারেশনের বিপুল খরচের একটি অংশ এসেছে তার কাছ থেকে।

তৌফিক বলে, 'ডাক্তারদের কথা অনুযায়ী নিয়মিত কেমোথেরাপী চালিয়ে যেতে পারলে বেশ কিছুদিন ভালো থাকার কথা।'

আজিজ বলে, 'ভালো থাকা মানে তো ক্যান্সারের রুগীর ভালো থাকা। ব্রেস্ট ক্যান্সার একবার হ'লে আবার ফিরে আসে। ফুসফুস, লিভার এরকম শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়ায়।'

তৌফিক বলে, 'ডাক্তার বলেছেন সবগুলো কেমো ঠিকমত দেয়া হ'লে সে ঝুঁকি অনেক কমে যায়।'

এই সময় সুমা রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে আলোচনায় যোগ দেয়, বলে, 'সে তো ডাক্তারের কথা। মানুষের হায়াৎ-মৃত্যু আল্লার হাতে। হায়াৎ না থাকলে সবগুলো কেমো দেয়ার পরও ক্যান্সার ছড়াবে, আর হায়াৎ থাকলে একটি কেমো না দিলেও ছড়াবে না।'

তৌফিক চুপ ক'রে থাকে। আজিজ বলে, 'এক একটি কেমোথেরাপীর খরচও কিন্তু অনেক।'

সুমা আবার বলে, 'সবগুলো কেমো কি দেয়া হবে ভাইয়া?'

তৌফিক বলে, 'রাজুর সাথে আলোচনা না ক'রে তা ঠিক করে বলা সম্ভব নয়।'

সুমা বলে, 'মেঝ ভাইয়ার আর্থিক অবস্থাওতো খুব একটা ভালো নয়। ওদের ছেলেটির সবসময় অসুখ বিসুখ লেগে আছে। বড় ধরণের কোনো সমস্যা আছে মনে হয়। মাত্র তিন বছর বয়স ছেলেটার, বেচারা।'

কিছুক্ষন চুপ ক'রে থাকে সবাই। তারপর আজিজ একটু অপ্রসংগিকভাবে বলে, 'আমার জমানো টাকা যা কিছু ছিলো তা খাটিয়েছিলাম এক বন্ধুর ব্যবসায়। সে বন্ধু তার ব্যবসায় বড় ধরণের মার খেয়েছে। লাভ দুরে থাক, আমার আসলই ফিরিয়ে দিতে পারছে না। চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারি না।'

তৌফিক কিছু বলে না। বুঝতে পারে আজিজ আর সাহায্য করবে না সে কথা বোঝাতে চেষ্টা করছে। জামাই হয়েও সে যে অপারেশনের খরচে সাহায্য করেছে সেই বেশী। তার কাছে আর সাহায্য চাওয়া সম্ভব নয় তা সে ভালো ক'রে বোঝে। রাজুর পক্ষেও খুব একটা সাহায্য করা সম্ভব হবে না ব'লেই মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ঘুরে ফিরে তার উপর এসে পড়বে সবকিছু। তৌফিক বলে, 'বাবা-মা'র থাকা-খাওয়া-চিকিৎসা, অপুর পড়ালেখা এসব খরচ আমি একা সামলাই বেশীর ভাগ সময়। রাজু একমাস কিছু দেয় তো তিনমাস দিতে পারে না। এভাবে আমি আর কতদিন পারবো জানি না। ও আসুক, তারপর ওর সাথে আলোচনা ক'রে পরবর্তি চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমাদের সামর্থ্যে যতটুকু কুলোয় ততটুকু আমরা নিশ্চয় করবো। একটি বা দু'টি কেমো কষ্ট ক'রে ধারকর্য ক'রে দেয়া সম্ভব হতে পারে হয়তো।'

আজিজ বলে, 'সেক্ষেত্রে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে জেনে নিতে হবে একটি বা দু'টি কেমোতে আদৌ কোনো লাভ হবে কিনা। তাছাড়া কেমোর সাইড এফেক্ট মারাত্মক। হয়তো দেখা যাবে ভালোর চেয়ে খারাপই বেশী হয়ে যাবে।'

নিরবতা নেমে আসে আবার। মনে মনে সবাই বুঝতে পারে সফল অপারেশনের পরও তেমন কোনো লাভ হয়নি বা হবে না যদি পরবর্তি চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া না যায়। সবার সীমিত আয়ে নিজ নিজ সংসার চালিয়ে আর কতটুকু করা যাবে তা অনিশ্চত। । আজিজ বলে, 'মা টিউমারের কথা জেনেও কাউকে কিছু না ব'লে এতদিন লুকিয়ে রেখে ভয়ংকর ভুল করেছেন। প্রাইমারী স্টেজে যদি জানাতেন তাহলে চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে যেতো। লুকিয়ে রেখে সবাইকে বিপদে ফেলেছেন। তিনি সাথে সাথে কাউকে বলেননি কেনো?'

উত্তর না দিয়ে একটু বিরক্তি নিয়ে তৌফিক অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। এ প্রশ্ন অনেকে অনেকবার লুৎফাকে করেছে। সন্তোষজনক কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তিনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিলেন টিউমারটি কী। লুকিয়ে রাখার কারণ কি স্তনের টিউমার তার লজ্জা না কি সন্তানদের উপর চিকিৎসার দায়ভার চাপিয়ে দেবার লজ্জা? সে জানে না। সুমা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কিছুক্ষন কেঁদে একটু হালকা হয়ে আঁচলে চোখ মুছে বলে, 'মা'র জন্যে মিলাদ পড়িয়ে দোয়া করার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?'

এই সময় ফরিদউদ্দিন গোসল সেরে ফিরে আসেন। তাঁকে দেখে সবাই চুপ ক'রে যায়। মা'র ভবিষ্যত চিকিৎসার অনিশ্চয়তা নিয়ে বাবার সামনে আলোচনা করতে চায় না তারা। এ বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে সবাই মিলে রাতের খাবার সেরে নেয়। তারপর কিছুক্ষন ঘর সংসার, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা, এটা ওটা ইত্যাদি পারিবারিক বিষয় নিয়ে আলোচনা ক'রে যার যার ঘরে ঘুমোতে চলে যায়।

---
দুই

নিজের ঘরে অন্ধকারে শুয়ে আছেন ফরিদউদ্দিন। ঘুমোতে পারছেন না। বিছানার শুন্য জায়গাটিতে একবার হাত বোলালেন। শুন্য বালিশটি নেড়ে চেড়ে ঠিক করলেন। বিয়ের পর থেকে প্রাত্যহিক পারিবারিক জীবনের দুশ্চিন্তা বা অন্য কোনো কারণে কখনো ঘুম না এলে, বিছানায় ছটফট করলে লুৎফা আলতো ক'রে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন। সেইসব ঘুম না আসা রাতগুলোয় তিনি পাশ ফিরে শুয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন লুৎফার হাতের ছোঁয়ার জন্যে। নিজ থেকে কখনো চাইতেন না। লুৎফা যদি আগেই ঘুমিয়ে না পড়তেন, যদি টের পেতেন যে তিনি ঘুমোতে পারছেন না, তাহলে নিজেই পাশ ফিরে হাত রাখতেন তাঁর পিঠে, বলতেন, 'শান্ত হয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করো, আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।' সেই হাতের স্পর্শ পাওয়া মাত্র কোনো এক আজানা কারণে তাঁর অস্থিরতা কমে যেতো, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসতো। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে দেরী হতো না। আগের মত ঘন ঘন না হলেও এই বয়সেও লুৎফা মাঝে মাঝে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে তাঁকে ঘুমোতে সাহায্য করেন।

ফরিদউদ্দিন একটি দীর্ঘস্বাস ফেলে দেয়ালের দিকে পাশ ফেরেন। কেউ কিছু না বললেও তিনি স্ত্রীর ভবিষ্যত অনুমান করতে পারেন। নিজ থেকে কাউকে কিছু জিঞ্জেস করেননি তিনি। তাঁর তেমন কিছু জিঞ্জেস করার নেই, তেমন কিছু বলার নেই, তেমন কিছু করার নেই। ছেলে-মেয়েরা, তাদের স্বামী-স্ত্রীরা, নাতি-নাতনিরা সবসময় আশেপাশে থাকলেও ক'দিন ধরে বুঝতে পারছেন একা হয়ে যাবার সময় হয়ে আসছে। দীর্ঘদিনের জীবন-সংগিনীর সাথে, সুসময়ের এবং দুঃসময়ের এতদিনের সাথীর সাথে বিচ্ছেদের সময় হয়ে আসছে। ভীতিকর একটি অনুভূতি হয়। তিনি হাঁটু ভাঁজ ক'রে গুটিশুটি মেরে শিশুর মত শুয়ে থাকেন। চোখ বন্ধ ক'রে থাকেন। অনেক আপন, অনেক চেনা, অনেক ভালো লাগা স্পর্শটি হারিয়ে যাবে উপলব্ধি ক'রে খুব অসহায় বোধ করেন।

--------------------------------------
শামীম হক


মন্তব্য

বিপ্লব রহমান এর ছবি

ভালো লাগলো। তবে গল্পটি বোধয় হঠাৎ শেষ করা হয়েছে। লুৎফার চরিত্রটি তাকে কেন্দ্র করে আরেকটু বিস্তৃতি পেলে আরো ভালো হতো।

নিয়মিত লিখবার অনুরোধ @ শামীম হক। হাসি


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।