গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে - ৩

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: সোম, ২৫/০২/২০০৮ - ১০:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পিটার ডি ওয়ার্ড রচিত "ইমপ্যাক্ট ফ্রম দ্য ডিপ" প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ
অনুবাদঃ মুহাম্মদ
------------------------------

ভয়ংকর গ্রিনহাউজ

প্রায় অর্ধযুগ আগে ভূতাত্ত্বিকদের কয়েকটি দল জৈব রসায়নবিদদের সাথে মিলে পৃথিবীর ইতিহাসের সংকটময় মূহুর্তগুলোতে এর পরিবেশের অবস্থা অধ্যয়ন শুরু করেছিল। তাদের মূল কাজ ছিল প্রাচীন শিলাস্তর থেকে জৈব অবশেষ নিষ্কাশন করা। নিষ্কাশিত অবশেষে জৈব নির্দেশক নামে পরিচিত রাসায়নিক জীবাশ্ম সন্ধান করা হতো। কিছু জীব বেশ শক্তিশালী জৈব অণু অবশেষ হিসেবে রেখে যায় যে অণুগুলো নিজেদের ক্ষয় থেকে রক্ষা পেয়ে বিভিন্ন পাললিক শিলার অভ্যন্তরে বেঁচে থাকে। অনেক আগে বিলুপ্ত যে জীবগুলো কোন দৃঢ় কঙ্কালরূপী অবশেষ রেখে যায় না তাদের জীবনধারণের প্রমাণ হিসেবে এই জৈব নির্দেশকগুলো বেশ কার্যকর। যেমন, বিভিন্ন প্রকার অণুজীব এমন কিছু অবশেষ প্রমাণ হিসেবে রেখে গেছে যা থেকে বোঝা যায় তাদের কোষ ঝিল্লীতে লিপিড ছিল। অবশেষ হিসেবে রক্ষিত অণুগুলো থেকে এসব তথ্য বের করে আনা সম্ভব হয়েছে নতুন ধরণের এক ভর বর্ণালিবীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে ভর অনুযায়ী অণুগুলোকে পৃথক করা হয়।

প্রথম দিকে যে জৈব নির্দেশকগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল সেগুলো এমন সব শিলা থেকে নিষ্কাশিত যাদের বয়স পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভবের সময়ের চেয়েও বেশী। এ কাজ করা হয়েছিল ঠিক কিভাবে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে তা উদ্‌ঘাটন করার জন্য। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বিজ্ঞানীরা গণ বিলুপ্তি সীমানার সময়কার শিলাস্তরের জৈব নির্দেশকগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন। এই পরীক্ষা করতে গিয়ে বিস্ময়কর এক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কে/টি সীমানা ছাড়া অন্য সকল সময়ের ক্ষেত্রেই এই তথ্যের সত্যতা মিলেছে। তথ্যটি হল, পৃথিবীর মহাসাগরগুলোতে সঞ্চিত অক্সিজেনের পরিমাণ একাধিকবার একেবারে কমে গিয়েছিল। আর বিভিন্ন সময়ে উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্তির ঠিক আগে আগেই এই কমে যাওয়ার ঘটনাগুলো ঘটেছিল। এই ঘটনাগুলো "অ্যানোক্সিয়া" নামে পরিচিত।

শিলাস্তর থেকে প্রাপ্ত জৈব নির্দেশকের মধ্যে বিপুল পরিমাণে সালোকসংশ্লেষী সবুজ সালফার ব্যাক্টেরিয়ার অবশেষ পাওয়া গেছে। এ ধরণের আরেকটি অণুজীব হচ্ছে সালোকসংশ্লেষী রক্তবর্ণ সালফার ব্যাক্টেরিয়া। এই অণুজীবগুলো নিশ্চল হ্রদের তলদেশ বা মৃত সাগরের মত স্বল্প অক্সিজেন বিশিষ্ট পরিবেশে বসবাস করে এবং এরা বেশ অনিষ্টকর জীব। নিজেদের প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদনের জন্য তারা হাইড্রোজেন সালফাইডকে জারিত করে সালফার তৈরী করে, অথচ এই হাইড্রোজেন সালফাইড অন্য যেকোন জীবের জন্য এক প্রকার বিষ। দেখা যাচ্ছে এই অণুজীবগুলো অক্সিজেন ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। গণ বিলুপ্তি সীমানায় তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণ এ থেকেই বোঝা যায়। এবং এই সংখ্যাধিক্যের মাধ্যমে গণ বিলুপ্তির কারণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্তও উন্মোচিত হয়।

বিজ্ঞানীরা অনেক দিন থেকেই জানতেন, স্বাভাবিকের তুলনায় গণ বিলুপ্তি সীমানার সময়ে পরিবেশে অক্সিজেনের পরিমাণ কম ছিল। কিন্তু এর সুস্পষ্ট কোন কারণ তারা বের করতে পারেন নি। সংঘর্ষের বিপরীতে এক্ষেত্রে যে তত্ত্বটি প্রচলিত ছিল তা হল: গণ বিলুপ্তির সময়ে যে বিপুল পরিমাণ অগ্ন্যুৎপাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে তার কারণে পরিবেশে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এই বর্ধনের কারণে সৃষ্ট গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ায় অক্সিজেন স্বল্পতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু পার্মিয়ান যুগের শেষ দিকের গণ বিলুপ্তির সময়ে জলজ জীবকূলের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পেছনে এই অগ্ন্যুৎপাতকে দায়ী করা যায় নি, কারণ এর জন্য শুধু অগ্ন্যুৎপাত যথেষ্ট নয়। উপরন্তু, উদ্ভিদকূলের বিলুপ্তি কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাওয়ার কারণে হতে পারে না, কারণ তারা তো এই গ্যাসের উপরই নির্ভরশীল। আর উত্তাপের ব্যাপারে বলতে হয়, সে সময়কার উদ্ভিদগুলোর পক্ষে সে উত্তাপ সইয়ে নেয়া অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু, ট্রায়িসিক ও পার্মিয়ান যুগের শেষ দিককার মহাসাগরীয় পাললিক শিলা থেকে প্রাপ্ত জৈব নির্দেশক পরীক্ষার মাধ্যমে রাসায়নিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, সে সময় মহাসাগর জুড়ে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্রহণকারী ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল। এখানে মনে রাখা দরকার, এই অণুজীবগুলো অক্সিজেন-মুক্ত পরিবেশেই কেবল বেঁচে থাকতে পারে এবং সেই সাথে তাদের প্রয়োজন পড়ে সূর্যালোকের। এই পরিপ্রেক্ষিতে অগভীর জলভূমির নিম্নস্থিত মৃত্তিকা স্তরে এই জৈব নির্দেশকগুলো পাওয়ার অর্থ হচ্ছে, পার্মিয়ান যুগের শেষ দিকে সাগরের অভ্যন্তরের জলভাগই কেবল নয়, সমুদ্রতলেও তখন অক্সিজেন ছিল না। তার বদলে ছিল প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন সালফাইড।

বর্তমান যুগে সমুদ্রের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পুরো অংশেই অক্সিজেনের ঘনত্ব সমান। কারণ বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত হয় এবং পরিচলনের মাধ্যমে গভীরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন, মৃত সাগরের জলে কোন অক্সিজেন নেই। এ ধরণের অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে তাই এখনও কিছু অক্সিজেন বিদ্বেষী জীব বসবাস করতে পারে। এ পরিবেশের অবায়বীয় জীবগুলো যে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরী করে তাও সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যায়। এই জীবগুলো সাধারণত গভীর সমুদ্রে বসবাস করে। সেখান থেকে তৈরী হওয়া হাইড্রোজেন সালফাইডের পরিমাণ যখন অনেক বেড়ে যায় তখন তা উপরের দিকে ব্যাপীত হতে শুরু করে এবং নিচের দিকে ব্যাপীত হতে থাকা অক্সিজেনের মুখোমুখী হয়। যতক্ষণ এ দুয়ের মধ্যে সাম্যাবস্থা বজায় থাকে ততক্ষণ হাইড্রোজেন সালফাইড (গভীর জলে) এবং অক্সিজেন পূর্ণ (পৃষ্ঠতলীয় জলে) জলভাগ একে অপর থেকে পৃথক অবস্থায় থাকে। আর এ দুয়ের ছেদকতলে একটি নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয় যার নাম কেমোক্লাইন। সাধারণত সকল সবুজ ও রক্তবর্ণ সালফার ব্যাক্টেরিয়া এই কেমোক্লাইনে বাস করে। এর ফলে তারা একইসাথে হাইড্রোজেন সালফাইড এবং সূর্যের আলো পায়।

অধুনা পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ভূবিজ্ঞানী লি আর কাম্প এবং মাইকেল এ আর্থার হিসাব করে দেখেছেন, কোন কারণে সমুদ্রজলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে গভীর জলের অবায়বীয় এই অণুজীবগুলো বিশেষ সুবিধা পায়। এর ফলে তারা আরও অধিক পরিমাণে হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরী করে। এভাবে হাইড্রোজেন সালফাইড বাড়তে বাড়তে একসময় অক্সিজেনপূর্ণ জলভাগের সাথে বিরাজমান সাম্যাবস্থা ভেঙে যায় এবং তাদের মধ্যবর্তী কেমোক্লাইনের আর কোন অস্তিত্ব থাকে না। তখনই গভীরস্থিত হাইড্রোজেন সালফাইডপূর্ণ জল একেবারে পৃষ্ঠতলে উঠে আসে। এর ফলে ভয়ংকর এক অবস্থার সৃষ্টি হয়। সমুদ্রতল থেকে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে।

এই বিজ্ঞানীদ্বয় তাদের গবেষণা থেকে অনুমান করেছেন, পার্মিয়ান যুগের শেষ দিকে এমনই একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অর্থাৎ বিশাল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উৎক্ষিপ্ত বিষাক্ত গ্যাসের কারণে স্থলভাগের প্রায় সকল উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এই বিনাশী গ্যাসকেই একমাত্র ঘাতক বলা ঠিক হবে না। ইউনিভার্সিটি অফ অ্যারিজোনার বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার পাভলভকৃত নকশা অনুসারে, বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস একাধারে গ্রহের ওজোন স্তরকেও নষ্ট করে দিয়েছিল, যে ওজোন স্তর গ্রহস্থিত জীবকূলকে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচায়। গ্রিনল্যান্ডে প্রাপ্ত জীবাশ্ম বীজাণু থেকে জানা গেছে, পার্মিয়ান যুগের শেষ দিকে ওজোন স্তরের এমন ক্ষতি আসলেই হয়েছিল। এই বীজাণুগুলোতে এমন সব বিকৃতির নিদর্শন পাওয়া গেছে যা অতিবেগুনি রশ্মির অত্যধিক প্রভাবের কারণেই কেবল হতে পারে। বর্তমানে আমরা আরও দেখতে পাই, ওজোন স্তরের যেখানে ছিদ্র হয়েছে তার নিচে পৃথিবীর অংশটিতে জীবকূল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন, অ্যান্টার্কটিকার উপরে এমন ছিদ্র থাকার কারণে, সেখানকার ফাইটোপ্ল্যাংকটনের বায়োমাস দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। এবং এদের ধ্বংসের কারণে যদি খাদ্য শিকল ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে, তাহলে আর বেশিদিন নয়; অচিরেই হয়তো ভূভাগের অন্য সব জীব বিলুপ্তীর সম্মুখীন হবে।

---------------------------------
পূর্ববর্তী কিস্তিসমূহ:

* গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে
* গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে - ২

---------------------------------
সূত্রঃ সাইন্টফিক অ্যামেরিকান, অক্টোবর ২০০৬
---------------------------------

মুহাম্মদ২০১৭


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।