পূজারী ও দেবী

স্পর্শ এর ছবি
লিখেছেন স্পর্শ (তারিখ: শনি, ১২/০৪/২০০৮ - ৯:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কঁদা বালির মধ্যে যখন পা ফসকে পড়ে গেলাম, ঠিক তখনই অস্বাভাবিক একটা রিফ্লেক্স হল! অন্য সময় হলে ভাবতাম ‘হায় হায়, আমার এত সাধের ক্যামেরাটা বুঝি গেল’ অথবা তাড়াতাড়ি আশে পাশে চোখ বুলিয়ে নিতাম ‘কেউ দেখে ফেলল নাতো? স্পেশালী মেয়েরা!’ তবে গতকাল সে সবের কিছুই হলনা। শুধু এক অদ্ভুত ভাললাগায় ভরে গেল মনটা।

ছিলাম মেঘনার চরে। সামনে মেঘনা, মেঘনার ওই পাড়ে অস্তগামী সূর্য। আর এই পাড়ে আমি। দৈব কারণে এখন এক হাটু কাদা বালিতে হাটু গেড়ে আধবসা-আধদাঁড়ানো হয়ে আছি। একটা ঘোরের মধ্যে যেন। আমি যে কি ভয়ানক ভাগ্যবান সেটা বুঝতে পেরে হতবিহ্‌বল। একটা আটপৌরে জানা কথা ছড়িয়ে যাচ্ছে অনুভুতির প্রতিটি তন্তুতে।

এটা আমার দেশ!!!

একটু আগে ছিলাম পানাম নগরে। তার আগে সোঁনারগায়ের একটা দরিদ্র, অরক্ষিত মিউজিয়ামে(!!!)। সব কিছু ভাঙাচোরা। দেখার মত কিছুই নেই। থাকলেও অযত্নে আর অবহেলায় তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। দেখি এক ফ্রেঞ্চ মহিলা ট্যুরিস্ট। আমাদের পরেই ঢুকলো একই প্রদর্শন কক্ষে, সাথে গাইড। আর সাথে সাথেই পুরো সোনারগায়ে কারেন্ট চলে গেল। সাদা ভিনদেশী বিজাতীয় ভাষায় খিস্তি করল মনে হয়। যেখানে আমি মফস্বলের পোলাই ‘বক...’ আর ‘বান...’ প্রিফিক্স ওয়ালা কিছুমিছু আওড়িয়ে ফেলেলাম বেশ জোরেই। সেখানে ঐ ল্যুভরের দেশের বেটিতো দুচারটা ‘ফ্রেঞ্চ গালি’ দেবেই (আটলিস্ট ‘ফ্রেঞ্চ কিস্’‌তো আর দেবেনা)। আমার অবস্থা হয়েছে ভূমিহীন কৃষক মজিদ মিয়ার মত। খাঁ সাহেবের মেয়ে এসে যার বাড়িতে বসবার চেয়ার চেয়ে বসেছে! চেয়ার কোথায় পাব?

খানিকটা লজ্জা পেলাম। যেনতেন ‘খানিকটা’ না, বেশ ‘খানিকটা’! এত দূর এসে আমার নিজেরই মনে হচ্ছিল ‘শালা পুরা টাকাটাই জলে গেল’ সাথে গেল ‘সময়’। সেখানে এই ট্যুরিস্ট না জানি কোন গৌরবময় ইতিহাস শুনে এখানে এসেছে!

গরিব দেশ আমার, নিজেরইতো দেশ। তার পরও প্রচন্ড লজ্জা আর কিছুটা অভিমান নিয়ে পাশের এক কুঠুরীতে চলে যাই। আসলে মুখ লুকাই।

এর পর আর কিছুই জমে না। বন্ধুরা হৈচৈ করে। ক্যামেরার জুমলেন্স দিয়ে পাখি এবং পক্ষী সবই দেখে। তাও জমেনা কিছুতেই। কয়েকটা ভাঙা দেয়ালের ছবি তোলার চেষ্টা করি। কি ভয়ানক কান্ড! পুরাতন ভাঙা দেয়ালের গ্লামারটাও নষ্ট করে ফেলেছে কারা যেন। সংস্কার করতে গিয়ে এখানে সেখানে সেই লাল সুড়কির দালানে সাদা সিমেন্ট দিয়ে!!

মনে হয় একমাত্র নিজের দেশের সাথেই এরকম দ্বৈত সম্পর্ক থাকাসম্ভব কারো। একাধারে সে কখনো প্রেয়সী কখনো মাতা। আজকে কি লজ্জাটাই না দিল, ভিনদেশী গৌরির সামনে। চাপা ক্ষোভটা বাড়তেই থাকে। এসব দেখে কোথাও কেউ মুচকি হাসে বুঝি...

এর পর রাস্তার ধারে এক ইটালিয়ান হোটেলে (ইট এর উপর বসে খেতে হয়!) খাওয়া দাওয়া সেরে গেলাম মেঘনায়। সংক্ষিপ্ত নৌকা ভ্রমনের পর মেঘনার চরে এসে যখন পা হড়কে পড়ি, তখনই প্রেয়সী অথবা মাতার আরেক রূপ দেখি। এ যে দেবী!!! এবং সে একান্তই আমার। দূঃখ হয় ঐ ভিনদেশীর জন্য। আচ্ছা ওদের দেশটা কি এরকম? মনে হয় না। হতেই পারেনা। অসম্ভব। বেচারী এতদুর আসলো, দেখে যেতে পারলোনা কিছুই। আমার দেবী আমারই থাকলো মাঝখান থেকে কোন এক বিদেশী এসে লজ্জা দিয়ে গেল কিছু।

মৃদু একটা ঢেউ এসে হাটু ভিজিয়ে দেয়। আমার দেশের পানি! একটা চিল আলতো ভাবে ডানা মেলে উড়তে থাকে মাথার উপরে। আমার দেশের চিল! তিনটা বক, ফাইটার বিমানের মত অ্যারো ফর্মেশনে গার্ড অফ অনার দিয়ে যায় বিদায়ী সূর্যকে। আমার দেশের বক! আহ সবই আমার দেশের!! আমার...

কাদাবালির খানিকটা মুঠো চেপে ধরে হঠাৎ একটা অনুভুতি হয়। শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতার। নিজের বাবার প্রতি। আর তার সঙ্গীদের প্রতি। উনিশ বছর বয়স। আমার চেয়ে কত কম!! সে বয়সেই সে রাইফেল কাঁধে এইসব জলা ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে কি প্রচন্ড দৃড় পায়েই না হেটে গিয়েছে! সেই পায়ের ছাপ ছিল বলেই আজ আমি রাইফেলের বদলে ক্যামেরা কাধে করে একমুঠো বালি আঁকড়ে ‘আমার দেশ’ ‘আমার দেশ’ বলে নাকের পানি চোখের পানি এক করতে পারছি।

আচ্ছা ঐ বয়সে আমি কি করছিলাম? সদ্য গ্রাম থেকে এসে, কলাবাগানের এক ঘুপচি মেসে বুয়েট ভর্তিকোচিং করছিলাম বোধ হয়। এর বেশি আর কিই বা করার সুযোগ ছিল। আসলেই কি সুযোগ ছিল না? ভয়ানক ঈর্ষা হয় বাবাকে!

হলের এক বড় ভাই বলতেন। তার জীবন বৃথা হয়ে যাবে অস্ট্রিয়া, নিউজিলান্ড আর সুইজারল্যান্ডের ল্যান্ডস্কেপ নিজ চোখে না দেখলে!! হয়তো সেসবও সুন্দর। কিন্তু সেখানে কি একমুঠো মাটি এভাবে হাতের মধ্যে নিয়ে প্রচন্ড আত্মতৃপ্তিতে বলা যায়। ‘আমার...’

বুঝে যাই ‘কসমোপলিটান’ হওয়া হবেনা আমার। এই সাইবার স্পেসের যুগে পুরো বিশ্বটা যখন হাতের মুঠোয়, তখনো আমি থেকে যাই এক ক্ষুদ্রমনা উগ্র দেশপ্রেমিক। অথবা একজন ধর্মান্ধ পূজারী! মেঘনা জলে হাটু গেড়ে যে প্রণাম করে তার দেবীকে...

পুনশ্চঃ- যারা মেঘনাকে মিস করছেন, আর মিস করছেন আমার দেবীকে। তাদের জন্য আমার কাঁচা হাতে তোলা গত সন্ধ্যার দুটি ছবিঃ
১.
... and struggle

২.
ফিরে দেখা

ইশ্‌শ কদিন পরে আমাকেও হয়ত ছেড়ে যেতে হবে এসব। হায়রে উচ্চশিক্ষা! মারাই যাব বোধ হয়।

পুনশ্চঃ- ঝানু লেখক নই আমি। নিতান্তই আনাড়ি। কম্যুনিটি ব্লগিং এর অভিজ্ঞতাও নেই। লিখি ভুল বানানে, কখনো ক্লাসে পিছনে বসে ক্লাস নোটের বদলে, কখনো সদ্য জয়েন করা অফিসে প্রোগ্রামিংএর নামে মাইডকুমেন্ট ফোল্ডার ভরে। লিখি, লিখতে ভালবাসি তাই। ইদানিং সাহসে ভর করে সচলায়তনে পাঠিয়ে দিচ্চি কিছু লেখা। লেখা ছাপা হচ্ছেনা। অতিথি লেখক হিসেবেও না! বুঝতে পারছিনা, ‘আমার লেখা’ বাতিল হয়ে যাচ্ছে (সম্ভবনা প্রচুর) নাকি ‘আমি নিজে’(হতে পারে কি?) ?

আমার ই-মেই আড্রেস প্রতিটি লেখার শেষেই আছে। শ্রদ্ধেয় মডারেটর কি একটু কষ্ট করে দুলাইন বা একলাইনের একটা মেইলে জানাবেন? ব্লাঙ্ক মেইল হলেও চলবে। তাহলে কাঁচা হাতের লেখাগুলো রেখে দিতাম ডায়েরী পাতাতেই। অহেতুক এই টাইপ করার হ্যাপা।
একটু জানান... অনুগ্রহ করে।
বিদায়।


মন্তব্য

স্বপ্নাহত এর ছবি

এই দুটো ছবি কি সত্যিই আপনার তোলা??
ওফফফ... অদ্ভূত সুন্দর!!

লেখা ভাল্লাগসে...

---------------------------

থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যা ভাই আমারই তোলা। আপনার ভাল লেগেছে শুনে ভাল লাগলো।
আসল যায়গাটা আরো সুন্দর!! আমার ক্যামেরায় সেটা ধারণ করা সম্ভব না। ঘুরে আসুন মেঘনায় এক দিন।

লেখাটা ছেপেছে দেখি!!

স্পর্শ

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

এটাই তাহলে সচলে আসা স্পর্শ'র প্রথম লেখা!!!
Morning showed the day...

স্পর্শ এর ছবি

হা হা হা!
খুজে বের করেফেলেছেন দেখছি !!! কমেন্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ। হাসি
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
এক্কা... দোক্কা... তেক্কা...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

হায়! হায়! এই লেখা মিস করছিলাম। আমার আবেগ কম, তাই কম করে ঢালি। এখানে মনে হয় সবটাই দিয়ে দিই। এই অকপট ভালবাসার জন্য। আপনার স্ট্রাকচার অব ফিলিংটা ভাল লেগেছে বেশি। আর ছবি দুটা মাশাল্লা! আমার ডেস্কটপে ঝুলাই?
অভিনন্দন স্পর্শ।


মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

স্পর্শ এর ছবি

অবশ্যই ঝুলান! হাসি
সুন্দর একটা কমেন্টের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
এক্কা... দোক্কা... তেক্কা...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

সত্যি বাংলাদেশ যে কী অসম্ভব রকমের সুন্দর! এত সৌন্দর্য্য আমার দেখা আর কোথাও পাই নাই তা বলতে পারি। আর তোমার কি গর্ব স্পর্শ, তোমার বাবা এই সৌন্দর্য্য যাতে আমরা উপভোগ করতে পারি তার জন্যে অনন্য অবদান রেখেছেন সেই কত ছোট বয়সে। শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে। আর ছবি দুটি অসাধারণ লাগল।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।