বাংলাদেশ না পূর্ব পাকিস্তান?

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৭/০৫/২০০৮ - ৩:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যুদ্ধ যখন আসে তখন কিন্তু যুদ্ধ থেকে বাঁচার কৌশল হিসেবে মানুষ অনেক ধরণের পন্থা অবলম্বন করে। যুদ্ধটা কখনোই এক তরফা হয় না। দু পক্ষেরই কম বেশি ভূমিকা থাকে। আমাদের উপর যখন পশ্চিম পকিস্তানিরা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তখনো কিন্তু তা আমাদের কারো কাম্য ছিলো না। আর পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচারের মাত্রাও অতটা ভয়বহ আকার ধারণ করতো না, যদি না আমাদের দেশের কতিপয় নষ্ট রক্তের উত্তরসূরী তাদের সহযোগীতা না করতো। পাকিস্তানিরা যতটুকু ক্ষতি না করেছে তার চাইতে শতগুণ ক্ষতি করেছে আমাদের দেশীয় শত্রুরা। তারাই পাকিস্তানিদের পথ দেখিয়েছে। চিনিয়েছে। উসকে দিয়েছে। প্রলুব্ধ করেছে।

ড. খুরশিদ আলম-এর সম্পাদিত ও সংকলিত বাংলা বানান অভিধানে রাজাকার অর্থ লেখা আছে স্বেচ্ছাসেবক। কিন্তু সেটা তো পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষের অর্থ। যদি অভিধানটি বাংলাভাষা-ভাষীদের জন্য হয়, তাহলে আমরা রাজাকার বলতে কাদের বুঝি? আর আমরা দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীরা রাজাকার বলতে যা বুঝি তার অর্থই অভিধানে প্রয়োগ করা উচিত ছিলো। রাজাকার শব্দটির অর্থ যতই স্বেচ্ছাসেবক হউক না কেন আমরা কখনোই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিজেকে রাজাকার বলে পরিচয় দেবো না। বন্যার সময়, প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় আমরা অনেকেই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করি। কিন্তু নিজেদের সেই অর্থে রাজাকার বলে পরিচয় দেই না। অভিধানটির প্রণেতা যদিও রাজাকার শব্দের অর্থটি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু কোথাও উল্লেখ করেন নি যে, আলবদর বানানটি আল-বদর হবে না আলবদর হবে। তেমনি আল-শামস না আলশামস। কাজেই রাজাকার শব্দটির ব্যবহার হলে বাকি দুটো শব্দেরও ব্যবহার দেখানো উচিত ছিলো। এগুলোর অর্থ বাংলাশের দেশ প্রেমিক বাঙালীদের কাছে ভিন্ন। এই তিনটি শব্দই একাত্তরে আমরা শিখেছি। এর আগে বাংলা ভাষায় এগুলোর ব্যবহার ছিলো না। শব্দ তিনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ ঊনিশ শো একাত্তরে বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত জাতিটির সহযোগীদের পরিচিতি হিসেবে ব্যবহার করে আসছি। কাজেই রাজাকার, আলবদর, আলশামস হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বণকারী, যারা বাংলাদেশের নিরীহ মানুষদের উপর নির্বিচারে লুটপাট-হত্যা-খুন-ধর্ষণ চালিয়ে নিজেদের বীরত্ব প্রকাশ করেছে। যেমন ইরাকে যারা আমেরিকান সৈন্যদের সাহায্য করছে, ইরাকের ইতিহাসে তারাও একদিন আমেরিকার রাজাকার হিসেবে পরিচিতি পাবে। এখন স্বাধীনতার ৩৬বছর পরও যদি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী প্রত্যাখান কি খুবই ন্যায়সংগত হবে?

বুঝলাম বঙ্গবন্ধু তাদের ক্ষমা করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তাই বলে কি আমরা তাদের বিচার করতে পারবো না? বঙ্গবন্ধু তো অনেক কিছুই করেছিলেন। তিনি বাকশাল, রক্ষীবাহিনী, একনায়কতন্ত্র গঠণ করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো তো এখন নেই। বাকশালকে কারা নিষিদ্ধ করলো? কারা নিষিদ্ধ করলো রক্ষীবাহিনী? কারা হত্যা করলো বঙ্গবন্ধুকে? তাহলে কেন তারা কাজটি করছে না? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেন হবে না? বঙ্গবন্ধুর জন্য যদি আমাদের মমতা না থাকে তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য কেন এত দরদ? কী সেই স্বার্থ? কাদের স্বার্থ? কেনই বা তাদের বাঁচাতে আমরা উঠে পড়ে লাগি?

একবার কি ভাবনা হয় না যে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যদি আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত হতেন তাহলে কি পাকিস্তানিরা তাঁদের ক্ষমা করে দিতো? আমরা এখন যেমন রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের পশ্চাৎদেশে মূল্যবান ঘি মাখাচ্ছি, তাদের ওটা মুখে পুরে নীরব থাকছি, তারা কি সেটা করতো? কক্ষনো না! দেশদ্রোহী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরেধরে পাইকারি হারে বৃটিশদের মত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারতো! শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, আত্মীয়দেরও ফাঁসিতে ঝোলাতো। এমনকি তাঁদের নাম মুখে আনলেও সাজা পেতে হতো। এখনও জার্মানিতে যেমন হিটলারের পক্ষে কিছু বললে বা কৌতুক করলেও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। যেমন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিলো বঙ্গবন্ধুর রক্তের চিহ্নও যেন বাংলাদেশে না থাকে। কিন্তু হাসিনা রেহানা বেঁচে গেলেও বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরীর পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ আমরা লজ্জা পাই না আমাদের মন্ত্রীসভায় রাজাকার অধিষ্ঠিত করতে। রাজাকারের আহূত মিটিঙে সভাপতিত্ব করতে, যোগ দিতে। রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ভুমিকা নিয়ে কটাক্ষ করে, আমরা তা শুনে নির্লজ্জের মত দাঁত বের করে হাসি। হাততালি দেই।

কিছুদিন আগেও মুসলিম জঙ্গীগ্রুপটি যেভাবে তাদের কার্যক্রম আরম্ভ করেছিলো, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিলো না। তারা আসলে ইসলামবহির্ভূত গোষ্ঠি। রাজাকারদের তৈরী পেটোয়া বাহিনী। পাকিস্তান মুসলিম লিগের প্রেতাত্মা। ইসলামধর্মের ছায়াতলে তারা তাদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের অসদুদ্দেশ্যে লিপ্ত ছিলো। লিপ্ত ছিলো একাত্তরে বুদ্ধিজিবী হত্যার অসম্পূর্ণ কালো তালিকার কাজ সম্পন্ন করার কাজে। কাজ শুরুও করে দিয়েছিলো। ফলে, সাংবাদিক, অধ্যাপকদের খুনের ঘটনা অনেক ঘটেছে এদেশে। তবুও সান্ত্বনা যে, দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকারের বোধোদয় হয়েছিলো। কিন্তু কতিপয় সন্ত্রাসীর মৃত্যুহলেই সন্ত্রাস নির্মূল হয় না। যারা সন্ত্রাস প্রসব করে তাদের মূলোৎপাটন না হলে আবার সেই একই চিত্র দেখা যাবে। গল্পের ইয়াযুয-মাযুযের মত রাতভর দেয়াল চেটে পাতলা করেও প্রত্যূষে দেখা যায় দেয়াল পূর্ববৎ হয়ে আছে।

মধ্যপ্রাচ্যে এসেছি ২৩মাস অতিক্রান্ত হতে চললো। আমাদের পাকিস্তানি সহকর্মীদের প্রশ্ন করি যে, বাংলাদেশ যে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে গেল এ সম্পর্কে তাদের স্কুল কলেজের পাঠ্য বইতে কি বলা আছে? তারা জানায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের কতিপয় বদমাশের কারণে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে গেছে। একাত্তরের গণহত্যা সম্পর্কে কিছু জানে না ওরা। পাকিস্তানের কাছে এই যদি হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, তাহলে কী বুঝে আমরা এখনো রাজাকার তোষণে লিপ্ত? এই যে বাংলাদেশের এত দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজিবী, নেতা-মন্ত্রী, রাজনিতীবিদ কী করলেন তারা? কী বা করছেন? একা জাহানারা ইমামকে কেন গলা ফাটিয়ে রাজপথে চিৎকার করতে হয়? তাহলে কি বাংলাদেশের প্রকৃত রাজাকার জাহানারা ইমাম আর তাঁর সহযোগীরা? এই স্বাধীন দেশে যদি যুদ্ধাপরাধীরা বুক ফুলিয়ে চলতে পারে, মুক্তিযোদ্ধাদের মাথা নিচু করে চলতে হয়, তাহলে কী প্রয়োজন সার্বভৌমত্বের? আবার পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে গিয়ে বাংলাদেশের নাম পূর্ব পাকিস্তান রাখলে কী এমন ক্ষতি? কোনো প্রয়োজনই নেই বাংলাদেশের আলাদা মানচিত্রের, আলাদা পতাকার। সেই চাঁদতারা খচিত সাদা আর সবুজ পতাকাই ফের উড়–ক আমাদের সচিবালয়ে, হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টে। পুরো বাংলাদেশে (পূর্ব-পাকিস্তানে?) পুরোনো অহংকারে!

তা ছাড়া সংসদে বসে বসে আমাদের মহান নেতা-মন্ত্রীরা এই আইন সেই আইন পাশ করছেন কার স্বার্থে? তারা সংসদে বসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাওয়ার দাবীকেও অন্যায্য বলে আইন পাশ করেছিলো। তাহলে বঙ্গবন্ধু যাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, আবার কেন সংসদে আইন পাশ করা হলো না যে, তাদের বিচার হোক? অন্তত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী গ্রুপটির সমর্থক কিংবা বঙ্গবন্ধুর বিরোধীপক্ষাবলম্বণকারী হিসেবেও তো যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার বিরুদ্ধে আইন পাশ করা যেত।
তবে যাই হোক, এখনও সময় চলে যায়নি। এখনও আমরা আমাদের আইন সংশোধন করে নিতে পারি। যদি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হয়, তাহলে এই পরাজিত শক্তিটির মূলোৎপাটন করতেই হবে। নয়তো আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস, আমাদের অর্জিত পতাকা, আমাদের মানচিত্র একদিন পুনরায় আরো বড় সংকটের মুখে পড়তে বাধ্য হবে। তদুপরি আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমাদের বাংলাদেশকেই টিকিয়ে রাখবো না কি বার্লিনের মত পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মধ্যকার বিভেদের দেয়াল তুলে দিয়ে ভুলে যাবো ‘৫২, ‘৬৯, আর ‘৭১এর সেই ইতিহাস?

যুদ্ধাপরাধীদের নামে মামলা দেওয়া আরম্ভ হয়েছে। দেরিতে হলেও এটা একটি শুভ লক্ষন। কিন্তু আমাদেরই স্বার্থপরতার কারণে যদি তারা ফের মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের সম্মানিত ব্যক্তিটির আসনে আসীন হয়, তাহলে ব্যাপারটা হবে খুবই লজ্জার। নিজের মুখ ঢেকে পশ্চাৎদেশ উম্মুক্ত করে রাখার মতই।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

কারা নিষিদ্ধ করলো রক্ষীবাহিনী?

সম্ভবত রক্কিবাহিনী নিষিদ্ধ করা হয়নি । এক পর্যায়ে তাকে পুরোদস্তুর সামরিকবাহিনীর সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় ।

-এনকিদু

অতিথি লেখক এর ছবি

হয়তো বা। কিন্তু তাদের কর্মকান্ড এখনও বিতর্কিত। মানুষ তাদের কর্মকান্ডকে ভুলকরেও অভিনন্দন জানাতে পারে নি। ধন্যবাদ
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

অতিথি লেখক এর ছবি

আপাতত, বাঙলার জন্য বাংলা একাডেমি অভিধানগুলোই প্রমিত। অন্য অভিধান কখনও পড়িনি। অন্যগুলো এড়িয়ে চলাই ভাল হবে মনে হচ্ছে। আর মামলা দিয়ে কিছু হবে না। নতুন আইন করে সরকারি উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। না হলে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলার মত এটাও ভেস্তে যাবে। আর তারা ফুলের মালা পড়ে নগরীর রাস্তা প্রদক্ষিণ করবে।

জিজ্ঞাসু

অতিথি লেখক এর ছবি

সমস্যা সেখানেও। আইন যারা বানায়, নিজেরাই নিজেদের আইন মানে না। খুবই খারাপ লক্ষণ!
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

এসব ভাবনা সবসময়েই প্রাসঙ্গিক। লেখা ভাল লাগল।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।