মার্চের দুইঃ স্কুল ভ্যান, শোকমোচনের অপর পাতা

অনীক আন্দালিব এর ছবি
লিখেছেন অনীক আন্দালিব [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০২/০৩/২০০৯ - ৫:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রতিদিন আমার যাত্রাপথের সময়টুকু আমি খুব অনুভব করি।

কিছুদিন আগেও ঝাঁ ঝাঁ রোদ ছিল না, বেশ মোলায়েম একটা বাতাস থাকতো, অনেক সময় আকাশ ঘন ধূসর হয়ে থাকতো আর সাথে একটা শীতল বাতাসও বইতো, আমার খুব ভাল লাগতো। এখন সেরকম নাই, শুষ্ক বাতাস ডাইনির মতো উড়ে বেড়ায়, সাথে চড়চড়ে রোদ! চামড়া পুড়িয়ে রোদের ঝাঁজ মাংশে গেঁথে যায় বলে আমি শিহরিত হই, যদিও এমন শিহরণে ক্রমশ মজে থাকা যায় না! নেশা ছুটে যাবার মত জেগেও উঠি।
তারপরে একটা সময়ে আমি হাঁটতে শুরু করি। আমার চলার পথে দুটো স্কুল পড়ে। সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুল শেষ হয়, একদম দশটা এগারোটার দিকেই। হয়তো তাদের কাছে দিনের ক্লান্তি তখনও ধরা দেয়নি, তাই রেলিং দেয়া ফুটপাতে তাদের ছোটাছুটি থামে না! আমার ভাল লাগতে থাকে, ধীরে ধীরে আমি ক্ষতহীন, শোকহীন হয়ে উঠতে থাকি।

এখানে সেই রোদে আমার কেবলই তাদের মতো হয়ে যেতে মন আঁকুপাঁকু করে। এখন জীবনের হিসেবগুলো বদলে গেছে, জটিল হয়ে গেছে সরল অঙ্ক। এখন আমাকেও কথা বলার আগে দু'বার ভাবতে হয়, যাকে বলছি, যে শুনছে সে কীভাবে নিতে পারে। আমার কথার ভিত্তিতে আমাকে সে যাচাই করবে যেহেতু আমাকে সে পুরোটা চেনেনা। এই জীবন এতো গতিময় হয়েছে আর আমরা গতির ঘূর্ণনে ক্রমশই অপরিচিত হয়ে উঠছি একে অপরের কাছে। এখন ক্ষণিকেই আমরা মিলিত হই, সহবাসেও সম্ভবত ক্ষণিক-পুলকই সার! আমরা বিজ্ঞাপন পছন্দ করি, রোজ রোজ ২০ মিনিটের ডেলি-সোপ চুষে চুষে খাই। খবরের মাঝেও বিরতি দেখি। তিন ঘন্টা মুভি এখন বিরক্তিকর একঘেয়েঁমি।
তাই আমার ওদের মতো হতে ইচ্ছা করে। ওরা নিশ্চয়ই এখনও দীর্ঘ দিন কাটায়! একটু এগুতেই দেখি দু'জনে মিলে একটা ফাঁকা স্কুলভ্যান ঠেলছেন। সামনের জন বালক, পেছনের জন বালিকা। ক্লাশ ওয়ান, কি টু। কী একাগ্রতায়, নিবিষ্ট আগ্রহে ঠেলা ঠেলি চলছে, কোথায় নেবেন তারা স্কুল ভ্যানটিকে? চালক নাই, এই ফাঁকে 'চল, ঐটা ঠেলি!' বলে হয়তো দু'জনে জুটে গেছেন। যূথবদ্ধ খেলায় হয়তো তারা মজা পাচ্ছেন না আজ। বালিকাটিও বেণি সরলদোলকের মত দুলিয়ে পিছু নিয়েছেন। আমার মনের ভেতর কোমল হয়ে গেল...

কিন্তু আর সকল চলমানতার সূত্রানুযায়ী, আমি একটু পরেই স্কুলভ্যান ঠেলক-ঠেলিকাদ্বয়ের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে এলাম। সামনের রেলক্রসিংয়ে আটকে আছি। ঘট ঘট করে দানবীয় ট্রেন যাচ্ছে। সাথে চারকোণা ফ্রেমে মুখেদের আটকে নিয়ে চলে যাচ্ছে দূরে। আমি দেখতেই ভাবি, অনেকদিন ট্রেনে চড়ি না! কতদিন? বুঝতে পারলাম যে আমিই হয়তো ট্রেনের কাছ থেকে দূরে সরে গেছি। ও তো আগের মতোই একই রেলের ওপর দিয়ে দিন রাত দৌড়ে চলছে। আমিই খালি তার চলপথের আড়াআড়ি যেতে চাই, সমান্তরালে নয়!

একটা পর্যায়ে গুলশান চলে আসে। আমার কাছে গুলশানের ফুটপাত খুবই উদ্ভিন্ন যৌবনা মনে হয়। আমি তখন ধীরে ধীরে রেলিং দেয়া সেই শিশুসমারোহী ফুটপাত ভুলে যেতে থাকি। কিংবা হয়তো তারা আমার সাথেই চলে এসেছে, শার্টে, জামায়, হাতায় অণু-পরমাণু হয়ে মিশে মিশে? কেননা অফিসে বসেও আমি ভুলি না। ক্লাশ নিতে নিতেও আমি ভুলি না। সহকর্মীর সাথে লাঞ্চ করতে করতেও ভুলি না। আমার করোটির মাঝে স্কুলভ্যানের চাকার মন্থর ঘূর্ণন জমে পাথর হয়ে থাকে!

***
২/৩/৯
=====
- অনীক আন্দালিব


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমিই খালি তার চলপথের আড়াআড়ি যেতে চাই, সমান্তরালে নয়!

ভাল লাগলো। চলুক আরো লেখালেখি।

অতিথি লেখক এর ছবি

হুমম

চলুক গাড়ী, যাত্রাবাড়ি।

লেখা আসছে না, অনেকদিন পর লিখলাম। মনে হচ্ছিল কলমে (পড়, আঙুলের ডগায়) সিডেটিভ দিয়ে কেউ ঘুম পাড়িয়ে দিছে। ঝাড়া দিয়ে দিয়ে জাগানো লাগে!

===
- অনীক আন্দালিব

নিবিড় এর ছবি

হুম...... ভাল লাগল চলুক
*********************************************************
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, নিবিড়।

স্নিগ্ধা এর ছবি

চমৎকার লাগলো! খুব, খুব গতিময় লেখার ভঙ্গি!

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ স্নিগ্ধা। রিকশা আর পায়ে হাঁটার গতি, আজকালকার দিনে খুবই শ্লথ। হাসি

নামহারা এর ছবি

এই জীবন এতো গতিময় হয়েছে আর আমরা গতির ঘূর্ণনে ক্রমশই অপরিচিত হয়ে উঠছি একে অপরের কাছে। এখন ক্ষণিকেই আমরা মিলিত হই, সহবাসেও সম্ভবত ক্ষণিক-পুলকই সার!

চলুক
আমিও কিন্তু আর সকল চলমানতার সূত্রানুযায়ী চলতেই থাকি। শুধু
করোটির মাঝে কিছু মন্থর পাথর ঠোকাঠুকি করে

লেখাটি মনে দাগ কাটবার মতন হয়েছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আরে, আপনি তো পুরোই আমার কথাকে নিয়ে বলে ফেললেন!

মনের দাগটা যেন এমন ক্ষণস্থায়ী না হয় সেটাই কামনা। ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্যে।

জিজ্ঞাসু এর ছবি

চলুক

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

চমৎকার হয়েছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ পান্থ রহমান।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনার লেখা তো অনেক সুন্দর!!!
পড়তে আরাম লাগে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ নজরুল। আমার লেখার সৌন্দর্য চোখে পড়লো, আমারো দারুণ ভালো লাগলো!

আরাম দিতে পেরে মজা লাগছে।

===
অনীক আন্দালিব

কনফুসিয়াস এর ছবি

চমৎকার লাগলো, সবসময়ের মতোই।
অনীককে সচলায়তনে স্বাগতম।
-----------------------------------
আমার ইচ্ছে হলো বাজাতে গীটার, মন আমার, মন আমার, মন আমার-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার লাগলো, সবসময়ের মতোই।

তারমানে আপনি পুরোনো পাঠক? সামহোয়ার, নাকি সিসিবি? চিনছি না তো ভাই! ইয়ে, মানে...

===
অনীক আন্দালিব

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগলো।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্যে ধন্যবাদ শিমুল।

===
অনীক আন্দালিব

সবজান্তা এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

ওক্কে! দেঁতো হাসি

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দারুন! চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ অতন্দ্র প্রহরী! হাসি

===
অনীক আন্দালিব

রানা মেহের এর ছবি

খুব ভালো লগলো আপনার লেখা পড়ে।
ধুপধাপ লিখতে থাকুন হাসি
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক এর ছবি

হাহা! ধুপ ধাপ করে লেখা শুরু করলে তো সমস্যা! মাঝখান থেকে আমাকে ব্যথা পেতে হবে বিস্তর, আমি নাজুক মানুষ। ইয়ে, মানে...
আপনি লেখাটি পড়েছেন বলে খুশি হলাম! হাসি
===
অনীক আন্দালিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।