লোকটির কোন রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১০/০৩/২০০৯ - ১১:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লোকটির কোন রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না
শামীম রুনা
.................................................................................................................

আনিস দুপুরে নিরুর সেলফোনে মেসেজ পাঠায়, “ashchi”। ম্যাসেজটি দেখে নিরু ওর দৈনিক দুপুরের রুটিন ওয়ার্কে তাড়া হুড়া আনে। কাজের মহিলাকে তাড়াতাড়ি টেবিল রেডী করার জন্য বলে। নিজে বাচ্চাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে দ্রুত দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করতে চায়। কেননা আনিস সব সময় চায় নিরু ফিটফাট হয়ে ওর সাথে বসে খাবে। ফিটফাট বলতে যা বুঝায়, নিরুর পে তা আজকাল অসাধ্য হয়ে পড়েছে তিন বছরের দুই সন্তানকে নিয়ে। অন্যরা যে যাই বলুক না কেন, ”হাউ সুইট টুইন বেবী!” কিন্তু যমজ সন্তানের মা মাত্রই জানে কি কষ্টকর ওদের দুরন্তপনা সামলানো। তাও আবার দুই বছরের পর থেকে বাচ্চাগুলো হাঁড় কাঁপানো বিচ্ছুতে পরিণত হতে থাকে।
যাহোক, বাচ্চাদের খাইয়ে ভাত ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিরু তবে নিজেকে কিছুটা বিনস্ত্য করার সুযোগ পায়। আনিস আর নিরুর পরিবার সবদিক থেকে একটি আদর্শ সুখী পরিবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকে দু’জনের পরিচয় এবং সেশন জটে তালগোল পাঁকাতে পাঁকাতে নিজেদের সম্পর্কটাও ভাল করে পাঁকিয়ে নেয়। এরপর পাশ করে বেরিয়ে চাকরী নিয়ে দু’জন দেশের দু’প্রান্তে ছিটকে পড়লেও নিজেদের একত্রিত করবার তাড়নায় নিরু এনজিও’র চাকরী ছেড়ে আনিসের সংসারের গন্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ করতে কুন্ঠিত হয়নি। তারপরও, আনিসের একার আয় বা সম্পদ বর্তমানের বাজার মূল্যে খুব একটা কম নয় বৈ কি! বিদেশী বাণিজ্যিক সংস্থায় ভাল বেতনের চাকুরী, বাবার রেখে যাওয়া জমি বিক্রির টাকায় ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত এলাকায় তিন বেড, ড্রইং-ডাইনিং-এর ফ্যাট, কোম্পানী থেকে দেওয়া গাড়ী, সুন্দরী স্ত্রী, দু’টি টুকটুকে ফুটফুটে যমজ বাচ্চা তাও আবার একটি ছেলে একটি মেয়ে। ওরা প্রতি বছর না হোক, দু’বছরে একবার পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ভিজিট করে। ধর্মীয় বা সামাজিক কিংবা সরকারী বন্ধতে বন্ধু বান্ধবদের সাথে আনন্দে হৈ-হুল্লোড়ে মিলিত হয়, মধ্যরাত পর্যন্ত হট ড্রিংকসের সাথে রাজনৈতিক আলাপ বা শিল্প সাহিত্য সিনেমা কিংবা ইন্টারনেটে বর্তমান পরিস্থিতি নিদেন পে এঞ্জেলিনা জোলী নাকি জেনিফার লোফেজ কার ফিগার বেশী এক্ট্রাকটিভ অথবা এডাল্ট জোকস্ বলে ঘরে ফিরে আগামী কালকের অফিসের প্রস্তুতির জন্য ঘুমিয়ে পড়ে। অফিসের ধরাবাধা ডিউটি শেষে ঘরে ফিরে স্ত্রীর সাথে চা পান করে বাচ্চাদের সাথে কিছু সময় হুটপুটি কিংবা গাড়ী নিয়ে সো কলড নং ড্রাইভের নামে আশুলিয়া অথবা গাজীপুর নয়তবা আশুলিয়া সাভার গাবতলী হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন - এ সুখী জীবন নয় তো কি? আনিস নিরু এই দেশে বা বর্তমান পরিস্থিতিতে এর চে’ সুখ আর কি বা পেতে পারে। চারপাশের পরিবেশ যতই উত্তপ্ত হোক না কেন, ওদের জীবনে তা ঘড়ির কাঁটার মত করে প্রতিদিন সুখগুলো আসছে যাচ্ছে, যাচ্ছে আসছে। ওদের বর্তমান টেনশন বাচ্চাগুলোকে ভাল কোন স্কুলে এডমিড করা। নিরু মাঝে মাঝে হতাশা বিলাসে ভোগে, ”আমার তো ডাবল ডোজ। এক সাথে দু’জনের এডমিশন ফি, দু’জনের বেতন আর অন্যান্য খরচ! ভাবুন তো, যেখানে আপনাদের লাগবে একজনের আমার তো সেখানে দু’জনের। কিভাবে যে সামলাব”
আনিস হাসে, কেননা বাচ্চাদের জন্য ওর সঞ্চয় খুব একটা খারাপ না।
নিরুও নিজের চমৎকার ভদ্রলোক স্বামী, ছিমছাম সুন্দর সাজানো-গোছানো ফ্যাট আর দু’টি সন্তানের জন্য নিজেকে ভাগ্যবতী নারী ভাবে। তার উপর আমার শশুড়-শাশুড়ীর জামেলা নেই। শশুড় মারা গেছে ওর বিয়ের আগে। শাশুড়ী বড় ছেলের কাছে কানাডাতেই থকে। দেশে একদম আসে না। আর আনিসরা তো মাত্র দু’ভাই-বড় ভাই কানাডাই স্যাটেলড। নিরুর শশুড় বাড়ীর কারো জন্য কিছু করতে টরতে হয় না। নিজের সংসারে নিজেই একচ্ছত্র রাণী। বরং নিজের পরে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যাওয়া-আসা হরদম চলছে। আর আনিসও সবাইকে খুব আপন করে নিয়েছে। বাচ্চা দু'টোও মাশাল্লা! যে দেখে সেই একবার চিবুক ছুঁয়ে কিংবা গাল টিপে নতুবা ভেংচি দিয়ে যায়।
যা বলছিলাম, এই সুখী আনিস-নিরুর পরিবারের গল্প, ওরা দৈনিক রুটিন অনুযায়ী টিভি দেখে - বাংলা হিন্দী কিংবা এইচবিও’র কোন সুপার হিট মুভি। তবে টিভি ওয়াচের রুটিনের মধ্যে একবার বাংলা কোন চ্যানেলে খবরটাও দেখে নেয়। ইদানিং পত্রিকা থেকে এই মাধ্যমটাই বেশী প্রচলিত। তাইতো সবাই তিরিশ মিনিটের খবরের মাঝে পনের মিনিটের বিজ্ঞাপন দেখে হাসি হাসি মুখে, ব্যাপারটা হিন্দী মুভির মত আর কি! বিরক্তিকর খবর মাঝে মাঝে আইটেম সং-এর মতন করে বিজ্ঞাপনের নাচানাচি। মন্দ না! লিভিং রুমে আয়েশ করে টিভি দেখতে দেখতে আনিস বাসে বোমা বিস্ফোরণের খবর দেখে। বাগদাদের রাস্তায় বোরকা পরিহিত মহিলাদের ছুটোছুটি, শিশুর আর্ত চিৎকারের চলমান ছবি দেখে নীরুর কন্ঠে আফসোসের সুর হাহা করে উঠে। নিজের অজান্তেই সন্তানদের বুকের কাছে টানে আর নিজেও আনিসের বুকে মাথা হেলিয়ে দিতে দিতে ভাবে - এই তো আমরা নিরাপদ!
টিভিতে কোন এক স্থানে বোমা বিস্ফোরণে খণ্ড বিখণ্ড নিরীহ মুনষের ছবি দেখায়, যারা বাঁচে তাদের আর্তচিৎকার দেখায়, গুমরে কাঁদার ছবি দেখায়, দেখায় ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষের অসহায় মুখ - একের পর এক কিপ, বর্ণনা, হাহাকার, অসহায়ত্ব,

মানুষের বর্বরতা পশুত্বের উদাহরণ - আনিস টিভি থেকে চোখ না সরিয়ে উচ্চ কন্ঠে নিরুকে ডাকে - দু’জন এক সাতে টিভির সামনে টুকরো টুকরো কথাবার্তা বলতে বলতে বর্তমান দেশের পরিস্থিতি আলাপ করে। আনিস বলে, ’এই দেশে আর থাকব না। চেষ্টা করছি অন্য কোন উন্নত দেশে চলে যাব’।
'কোথায়’?
’কানাডা, আমেরিকা-’।
'সে সব দেশ কি সন্ত্রাস মুক্ত’?
’তারপরও-। এই দেশে কি আর বাস করা যায়’!
’তারপরও, এই দেশেই থাকতে হবে। এই সব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদেরকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে কোন দেশেই পালিয়ে তুমি সন্ত্রাস থেকে বাঁচতে পারবে না’।
ওদের মধ্যে এরকম উদ্দীপনা মূলক কথাবার্তা জমে উঠে। যেমন এরকম অনেক কথাই আমরা ঘরে, অফিসে, ক্যাফের চায়ের আড্ডায়, চলমান বাস-ট্রেনে এমন কি গলির মোড়ে মোড়ে শুনতে পাই। আবার ভুলে যাই। তেমনি আনিস আর নিরুও কিছুণের মধ্যে সব কিছু বিস্মৃত হয়। এরপর তাইতো ওরা বাচ্চাদের খাওয়ায়, নিজেরা খায়, বাচ্চাদের ঘুম পাড়ায় তারপর দুজন সন্তর্পণে মিলিত হয় এবং তৃপ্ত ও অবষন্ন দেহগুলো একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। পরের দিন যথা সময়ে আনিস অফিসে যায়, নিরু পাশের ফ্যাটের মহিলার সাথে আমির খানের নতুন বিয়ে, শাহরুখ খান গৌরীকে কতটা ভালবাসে, টম ক্রুজের প্রথমে পিতা তারপর বিয়ে এই ঘোষণা Ñ এ সব প্রসঙ্গে অনেক সময় পার করে দেয়। এখন অবশ্য নিরু আনিসের জন্য অপো করতে করতে অন্য কিছু ভাবছিল আবার ভাবছিলও না। সে ক্রমাগত বিভিন্ন টুকটাক ভাবনা পরিভ্রমণ করছিল। এক সময় দু'চোখে তন্দ্রার মত এসে যায়। আনিস এসে ওকে ঘুম থেকে টেনে তোলে, ’কি ব্যাপার অসময়ে ঘুম’?
'তোমার জন্য ওয়েট করতে করতে কখন যেন দু'চোখ লেগে এসেছে। কখন ম্যাসেজ পাঠিয়েছ - আসছি, আর এলে মাত্র’।
’তুমি খেয়ে নিয়েছ’?
'তোমার আসার কথা থাকলে আমি বুঝি কখনো আগে খাই’!
'খেয়ে নাও না তুমি। আমার আসতে আরো দেরী হবে’। আনিস মুখ টিপে হাসে।
’মানে, তুমি এসেছ না’! নিরু বিস্মত হয়।
’আমি তো তোমাকে ফুলগুলো দিতে এসেছি মাত্র’। আনিস নিরুর হাতে এক গুচ্ছ সাদা ফুল ধরিয়ে দেয়। আনিসকে নিরুর কেমন রহস্যময় মনে হয়। এখনো আনিসের ঠোঁটে মিটমিটে হাসি, নিরুর সে হাসি অবাক করা সুন্দর লাগে। নিরুর অবাক দৃষ্টির সামনে দিয়ে আনিস ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। না, কেমন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়!
নিরু ধড়ফড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠে। কিছু সময় ও গুম হয়ে একটু আগে দেখা স্বপ্নের কথা ভাবে, সুন্দর আর বিভ্রান্ত কর। বিন্দু বিন্দু ঘামে ওর কপাল চিবুক গলা স্যাতস্যাতে। ও ঘড়ির দিকে তাকায়-এযে বিকেল এসে থেমেছে। নিরু সেল ফোন উঠিয়ে আনিসের সেলফোনে কল করে। কম্পিউটার যান্ত্রিক কন্ঠে লাইন দিতে না পারার অপারগতা প্রকাশ করে। বারবার আনিসের দু’টি সেল ফোন নাম্বার কোনটিতে নিরু সংযোগ পায় না, হয়ত এমূহুর্তে আনিস কোন বদ্ধ রুমে যেখানে নেটওয়ার্ক সমস্যা হয়-নিজেকে প্রবোদ দেয় নিরু।
এ-সময় আনিস কোথায়? ওর মত ভদ্র মার্জিত বৌ পাগল (স্ত্রৈনও বলা যায়) মানুষটি কোথায়! আনিসকে ঘিরে খুব কাছাকাছি নয়, নিরাপদ দুরুত্ব রেখে গোল হয়ে জমাট বেঁধে আছে মানুষের বৃত্ত। ধীরে ধীরে সে বৃত্ত ঘন হয়ে উঠছে। বৃত্তের মানুষ গুলো চিৎকার করছে। আর্তনাদ করছে। হাহাকার করছে। করছে আফসোস। এক সাথে অনেকেই কথা বলছে। কেউ শুনেছে কারো কথা, অনেকেই শুনছে না কিছুই। কম-বেশী কথা বলছে সবাই। পুলিশের গাড়ীর সাইরেনের শব্দ, হুইসেলের শব্দ, বাজখাঁই গলায় ধমকের শব্দ, এম্বুলেন্সের সাইরেন এসব কিছুতে কিছুই যেন এখন আর আসে না আনিসের। নির্বিকার, নির্বাক ও। দুমড়ে-মুচড়ে বিভৎস ভঙ্গিতে বসে আছে গাড়ীর ড্রাইভিং সিটে-। ওর পরনের জামা কাপড় শতছিন্ন হয়ে অগ্নিদগ্ধ শরীরের কালো চামড়া বা ঝলসানো দগদগে লাল হাড়-মাংস দেখা যাচ্ছে। গাড়ীর বিভিন্ন পার্টস পোঁড়া গন্ধের সাথে মাংস পোড়া উৎকট গন্ধে উপস্থিত মানুষগুলো আর একবার অনিরাপত্তার আশংকায় ভীত হয়ে উঠে। একে অন্যের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়, কে এমন পাশবিক কাণ্ডটি ঘটালো? আশ্চর্যজনকভাবে তখনো আনিসের চোখ দু’টি অত আছে চুলহীন দগদগে লাল খুলী পেরিয়ে Ñ নীচে কপালের সে চোখের দৃষ্টিতে বিস্ময়! না না বিস্ময় নয় - হতাশা! ক্রোধ। আতংক! আসলে সে চোখের দিকে তাকিয়ে সবাই নিজের মনের অভিব্যকিই খুঁজে পেলো। এই নগ্ন দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সমবেত মানুষগুলো আর একবার নিজেদের ভেতর কম্পন অনুভব করলো। পুলিশ এসে মানুষের বৃত্ত পাতলা করে দেয়। দমকল এসে আগুন নেভাতে লাগল। তারপর আনিসের পোঁড়া কংকাল সার লাশ তুলে নেওয়া হলো সরকারী হাসপাতালের এম্বুলেন্সে।
ব্যাপারটা জটিল কিছু ছিল না। আনিসের অফিস থেকে বাসস্থানে চলাচলের পথে পড়ে এমন একটি স্থানে মহা-সমাবেশ চলছিল। ব্যাপক আয়োজন। পোষ্টার, পেস্টুন মাইকিং-হাজার হাজার মানুষের হল্লা। দলে দলে মানুষ যোগ দিয়ে মহা সমাবেশকে সফল করে তুলেছে। নাকি গরীব জনগণ বাড়তি দু’টাকার প্রলোভনে সমাবেশ সফল করে তুলেছে। মহা-সমাবেশের ডাকে সাড়া দিয়ে-তো আর অফিসেগুলো বন্ধ থাকে না। প্রতিদিনের মত সে দিনও আনিস অফিসে যায়। লাঞ্চ আওয়ারে ও হিসাব করে দেখলো, অফিসে একটি মিটিং আছে। সেটি এটেন্ড করে আজ ডুবে মারলে অফিসিয়াল কোন সমস্যা হবে না। বরং নিরুকে নিয়ে সংসারিক কিছু শপিং সেরে ফেলে সাপ্তাহিক ছুটির দিন “ছুটি ছুটি” আমেজে কাটানো যাবে। তাই অফিস শেষে আনিস নিজ বাসার দিকেই গাড়ীর হুইল ধরে। ও যখন সমাবেশ স্থল অতিক্রম করছিল ঠিক তখুনি সভাস্থলে বোমা বিস্ফোনের শব্দ উঠে এক দুই করে আরো কয়েকটি। জমায়েত মানুষগুলো থোকা ছেঁড়া লিচুর মত চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। গাড়িয়ে পড়লো। সভাস্থল থেকে বেশ দূরেই ছিল আনিসের গাড়ী, সাথে আরো অনেক চলমান গাড়ী, রিক্সা, ভ্যান পায়ে চলা পথচারী Ñ সমাবেশের পলায়নরত মানুষের ঢেউ এসে সে সবের গতি আটকে দেয়। ধবমান মানুষ গতিশীল যান থামিয়ে ছুটতে থাকে উর্ধ্ব-শ্বাসে। অন্যদের মত আনিসও চাচ্ছিল এখান থেকে কেটে পড়তে। কিন্তু ও তখন জ্যামের গ্যাড়াকলে আটকে গেছে। সবাই হর্ণ দিচ্ছে, সবাই যেতে চায়, পালাতে চায়-কিন্তু পারে না। হঠাৎ হঠাৎ করেই, কোত্থেকে, উইন্ডো গলে ঠিক আনিসের দু’পায়ের মাঝে এক্সেলেটরের পাশে পড়ে বস্তুটি (পরে জানা গিয়েছিল গ্রেনেড) আনিস কি দেখেছিল কে ছুড়েছিল ওটি? আনিস কি চিনেছিল বস্তুটি-কি? তবে সেকেন্ডে শেষ হয়ে যায় একজন মানুষের সাধের এক জন্ম।! একটি জীবন! মৃত্যুর আগে আনিস কি বুঝতে পেরেছিল, ও মরে যাচ্ছে। ও কি মৃত্যুকে দেখে আঁতকে উঠেছিল নাকি নিজের একান্ত প্রিয়জনদের সাথে বিচ্ছেদের বেদনায় বেদনাতুর হয়ে গিয়েছিল। ওর দৃষ্টি কি মাথার উপর ঝুলে থাকা সাইন বোর্ডের হাস্যময়ী রমনীর দিকে আটকে গিয়েছিল নাকি সে দৃষ্টি ছুটে গিয়েছিল শৈশবে ধরতে না পারা রঙিন প্রজাপতির পাখ্নার পিছু পিছু! এসব কিছুই আমরা জানি না। জানতে পারিনা। শুধু দেখি আমাদের অস্থিতিশীল দেশের রাস্তায় অতি সাধারণ কিছু মানুষের লাশ পড়ে থাকতে। যে লাশ গুলো পেছনে রেখে যায় কিছু ভালবাসার মানুষকে। যারা তার জন্য দীর্ঘদিন ডুকরে ডুকরে কাঁদে। আনিসের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যায় এক, দুই-তিন করে আরও তিনটি জীবনের স্বাভাবিকত। হত্যাকারী কি কখনো জানবে সে একটি নয় চারটি জীবনের বেঁচে থাকার স্বপ্ন কেড়ে নিতে সফল হয়েছিল। একটি সুখী পরিবার শেষ করে দিয়েছিলো সে। একটি সুখী পরিবারের কাহিনী এভাবে এখানেই শেষ হয়ে যায়।
অন্য রকম একটি গল্প শুরু হয় হাসপাতালে, মর্গের সামনে। দু’দলের নেতা কর্মীদের মাঝে তখন দারুণ তর্ক বিতর্ক ইট-পাটকেলের মত ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে যায়। দু’দলের দাবী, নিহত ব্যক্তি ওদের পার্টির সক্রিয়-সদস্য। অন্য দলের মরণজ্ঞাতি আক্রমনে ওদের কর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। পত্রিকার সাংবাদিক, ইলেক্ট্রনিকস্ মিডিয়ার সাংবাদিক সকলেই একবার এ পার্টির জ্বালাময়ী বক্তব্য শুনে তো পরমুহুর্তে অন্য-পার্টির গায়ে ফোসকা পড়া বক্তব্য রেকর্ড করে নেয়।
দু’দলের দাবী, ওদের কর্মীর লাশ, নিহত ভাইয়ের লাশ না নিয়ে ওরা ফিরবে না। ওরা শহীদের মর্যাদায় নিহত জনকে সমাহিত করবে। তাঁর এই আত্মত্যাগের কাহিনী স্বর্ণারে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করবে! যারা এই হত্যা কাণ্ডের জন্য দায়ী সে অপর পরে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দু’পরে দাবী। তা না হলে “জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে” (আরো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি!) উত্তপ্ত মস্তিস্কের মানুষগুলো, কেউই ভাবে না, নিহত জন কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো স্বামী কারো পিতা তার জন্য হয়ত কেউ কেউ অপো করে আছে। তার অবস্থা জানা ওদের অধিকার। কিন্তু সে সব কথা করোরই মনে পড়ে না। তখন সকলের মধ্যে শুধু এক অশুভ একগুয়ে জিদ। ওরা কেউ জানতে চায় না নিহত ব্যক্তিটিকে? ওরা শুধু নিজেদের অন্যায্য দাবী প্রতিষ্ঠা করে আন্দোলনকে ঘোলাটে করে তুলতে চায়।
তখন মর্গের কঠিন মেঝেতে অবহেলায় পড়ে থাকা আনিসের মৃত দেহ চিৎ হয়ে স্তব্ধ দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিক তাকিয়ে। সন্ধ্যা পেরিয়ে শহরের বুকে রাত নেমে এসেছে অনেক আগে। আনিসের অপোয় নিরু এখন বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। ঘর-বারান্দা, বারান্দা ঘর অসহিষ্ণু পায়ে পায়চারী করছে ও। মাঝে মাঝেই হাতের সেল ফোনের বোতাম টিপে আনিসের নাম্বারে পেতে চাইছে। এর মাঝে অসংখ্যবার চেষ্টা করেছে, এক ঘেয়ে নারী কন্ঠে কম্পিউটার মা চেয়ে যাচ্ছে বারবার। নিরুর মনে অশুভ কিছু ভাবনা মাঝে মাঝে উকিঁ দিলেও মাথা থেকে সে সব চিন্তা ও জোর করে তাড়িয়ে দেয়। নিরু এখন ছ’তলা ফ্যাটের বারান্দায় ঝুঁকে নীচের রাস্তায় আনিসের গাড়ী খুঁজছে। লিভিং রুমের অন করা টিভিতে রাত নয়টার খবরে মহা-সমাবেশের স্থলে বোমা বিস্ফোরণের সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হচ্ছে। সে খবর নিরুর কানে পৌঁছায় না, কেননা আমরা সবাই জেনে নিয়েছি, এসব দুর্ঘটনা অন্যদের জীবনে ঘটে-আমাদের, নিজেদের নয়।


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

সে খবর নিরুর কানে পৌঁছায় না, কেননা আমরা সবাই জেনে নিয়েছি, এসব দুর্ঘটনা অন্যদের জীবনে ঘটে-আমাদের, নিজেদের নয়।
ভীষন রকম সত্যি কথা। আমরা যতো সমব্যথীই হই না কেন, যার যায়, তার মতো করে অনুভব করতে পারি না কখনোই।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

দময়ন্তী এর ছবি

কিরকম অসহায় লাগতে থাকে ........................
------------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

ছুয়ে যাওয়ার মত লেখা..........

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

শেষের বাক্যটিতে কিছুক্ষণ আটকে থাকতাম।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ লাগলো পড়ে... দারুণ...

শেষ বাক্যটা একেবারে যা তা...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

শেষ লাইন টা সত্যি এই যে পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়ে সবাই শোকাহত হয়েছিলাম আবারকত দ্রুত ফিরে এসেছি দৈনন্দিন জীবনে। ঐ যে ..

এসব দুর্ঘটনা অন্যদের জীবনে ঘটে-আমাদের, নিজেদের নয়। মন খারাপ হলো কিছু সময়ের জন্য।
মেঘের পরে

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

বেড়ে লিখছেন হে।

---------------------------------------------------------

আমরা যারা শিখিনি চাষবাস,ফসলের গীত
গুলালিতে পাখি হত্যা

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।