অভিনেত্রী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০৩/২০০৯ - ১১:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অভিনেত্রী
শামীম রুনা
.........................................................................................................................................
কাঁচা সোনা রঙ রোদ আজ যেন উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করেছে নগরীতে ।তাই তো সবার মাঝে উৎসব উৎসব ভাব। হবে নাই বা কেন ;শ্রাবনের টানা বর্ষনের পর জলাবদ্ধ শহুরে মানুষগুলো একটি কড়কড়ে টাটকা সূর্যের জন্য যখন উন্মুখ হয়ে উঠেছিল তখনই আজকের এই ঝকঝকে দিনের আগমন। একটি আনন্দময় গানের কলি গুনগুন করতে করতে আমি বাচ্চাদের স্কুল গেইটের সামনে রিক্সা থেকে নেমে পড়ি।রিক্সা বিদায় করে হাতঘড়িতে চোখ রাখি,আজ একটু আগেই চলে এসেছি, ছুটি হতে এখনো পাক্কা পঁচিশ মিনিট দেরী আছে ।আড্ডার লোভে এদিক-ওদিক তাকাতে চোখে পড়ে ,অভিভাব-কদের জন্য নির্ধারিত স্থানে নীরাআপাসহ অনেকে ধুম্ আড্ডা দিচ্ছে । আমিও গুটিগুটি পায়ে সেপ্রান্তে হাঁটা ধরি,যতই মেয়েদের গল্পের দুর্নাম দুর্মুখেরা করুক না , ওরা যে শুধু পরনিন্দা বা পরচর্চা করে-- তা ঠিক নয় , মেয়েরা আসলে সব বিষয়ে গল্প করতে পারে। ওরা কেবল মাত্র কারো কর্মে নিজেদের গল্প থামিয়ে না রেখে ঐ ব্যক্তির পারিবারিক অবস্থা, কার সাথে কি সম্পর্ক,কি খাবার খেতে পছন্দ করে, চুলে কি জেল মাখে সর্ব বিষয়ে অর্থাৎ বিস্তারিত আলাপ করে। আর এটাতেই দুর্মুখদের যত আপত্তি। তা থাকুক দুমুর্খেরা ওদের আপত্তি নিয়ে আর আমরা আড্ডা নিয়ে থাকি ।
‘দেখেছেন কি সুন্দর রোদ!সোনার মত উজ্জল!’ একটু আগে রিক্সায় ভাবতে ভাবতে আসা কথাগুলো বললাম।
‘হুঁ, অনেক দিন পর একটি ঝকমকে দিন দেখে ভালই লাগছে ।’ নীরা আপা আমার মনের কথারই পুনার্বৃত্তি করে । ‘সোনা রোদ হলেও গয়না কিন্তু বানানো যাবে না ।’ নিপা ভাবী হাসতে হাসতে বলে ।
‘গয়না বানানো না যাক্, এই সোনা রোদ গায়ে তো মাখা যাবে ।’ আমি আজকের রৌদ্রজ্জ্বল দিনের প্রেমে মজে বলি। ‘এত সোনা সোনা করো না, সোনার যা দাম ,পরে সোনা রোদ গায়ে মাখার জন্যও হয়ত ট্যাক্স দিতে হবে।’ নীরা আপার কথায় আমরা মাথা দোলাই এবং পরনে হেসে উঠি উচ্চস্বরে। গল্পের মাঝে নীরা আপা তার কালারড্ চুলে আল্তো হাত বুলায় , আমি দেখি তার মেনিকিউর করা বাঁ হাতের অনামিকার আংটি রোদের আলোয় দ্যুতি ছড়িয়ে ঝকমকিয়ে হাসছে ।খুব দামী হবে নিশ্চয়-মনে মনে ভাবি । কি পাথরের আংটি জানতে ইচ্ছে হলেও নাগরিক সভ্যতার কারনে নিজেকে মূর্খ প্রমাণিত করতে চাই না বলে কিছু জি¹েস করি না । উর্মি ওসব কিছুর ধার ধারে না ,সে জানতে চায় ,‘ নীরা আপা আপনার হাতের আংটিটা তো খুব সুন্দর !বাহির থেকে আনা তাই না , কোথা থেকে আনিয়েছেন? ’
‘ আংটিটা সু›্দর না ? আমি আর কই আনালাম ,ও ’ ই তো কয়েক মাস আগে ও যখন দুবাই গেল তখন নিয়ে এলো ।হোয়াইট গোল্ডআর ডায়মন্ড ।এত টাকা দিয়ে আমার জন্য যখন এই আংটি আনলো আমি তখন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম।মাঝে মাঝে কি সব পাগলামো যে ও করে না। ভালও অবশ্য লেগেছে ।’ গভীর ভালবাসায় আংটির দিকে তাকিয়ে নীরা আপা স্বাগোক্তিই করে যেন বা।
‘ কপাল বটে আপনার ,হিংসা করবার মত ।’নিপা ভাবী দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে ,‘ আপনার বরের যেমন পছন্দ আছে তেমনি তিনি রোমান্টিকও তাই না? আমার বরের মধ্যে ঐসব গুনের কিছুই নাই ।বিয়ের পরপর একবার রাগ ভাঙানোর জন্য একটা শাড়ী এনেছিল দেখে তো আমি টাসকি মেরে গেলাম ,টাকা দিয়েও যে কেউ এমন জিনিষ কিনে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না । আমার জন্য কোন কিছু কেনা ওর ঐ প্রথম ঐ শেষ ।’ নিপা ভাবীর কথায় আমরা সবাই হেসে ফেলি এবং আড়চোখে আর একবার নীরা আপার দু্যুতি ছড়ানো আংটিটা দেখে নেই ।
‘ আমার জন্য কেনাকাটা যাই করি সব আমার পছন্দেই করি, পেমেন্ট করবার জন্য শুধু ওকে সাথে নিয়ে মার্কেটে যাই ।’ ঊর্মি বলে । আমি ঊর্মির দিকে ফিরি , ‘ যাই বলেন , শুধু পেমেন্ট করবার জন্য বরকে যখন নিয়ে যাই তখন আমার খুব লজ্জা করে । নিজেকে অথর্ব মনে হয় ,একজন দিচ্ছে আর আমি কেবল হাত পেতে তা নিচ্ছি । আমি ব্যাপারটা মন থেকে একসেপ্ট করতে পারি না ।’
‘ বা রে, ব্যাপারটা ওভাবে দেখবেন কেন , আপনি আপনার হাজব্যান্ডের ঘর-দোর সামলাচ্চেন ,বাচ্চা-কাচ্চা দেখছেন তার একটা দাম আছে না! তাছাড়া আপনার ভরন-পোষন যাবতীয় দায়-দায়িত্বও তো আপনার হাজব্যান্ডের ,সে পারপাজে আপনারও তো কিছু প্রাপ্য ।’ উর্মি হাতপা ছুঁড়ে আমাকে বুঝায় ।
‘ আগে যাও বা ভাল বলেছিলেন এখন তো আরো খারাপ বললেন, আমি সংসার সামলানো এবং বাচ্চাদের দেখা-শোনার জন্য আমার বরের কাছ থেকে পেমেন্ট নেব ! সংসারটা কি আমার না ? তাহলে সংসারে আমার ভূমিকা কি ? আমি কি সংসারের কেউ না ? সিম্পলি এ সারভেন্ট ?’উর্মির কথায় আমি অবাক হই ,আজকের যুগেও শিতি কোন মহিলাকে এরকম কথা বলতে শুনে ।
‘ আপনি কিছুই জানেন না, অনেকে তো হাজব্যান্ডের সাথে শোয়ার জন্যও টাকা নেয় ।’উর্মি আমাকে বিস্মিত করে বলে । আমি ওর কথায় খুব অসহায় বোধ করি, মেয়েরা নিজেরাই যদি নিজেদেরকে এত নীচে নামায় তবে কার সাধ্য তাদের টেনে তোলে !
‘ তবে সে হাজব্যান্ড টাকা দিয়ে রোজ রোজ এক পাত্রে না খেয়ে চেইন্জ করে করে খেলে পারে । আলাদা টেষ্ট পাবে ।’ আমি রাগ চেপে বলি । নীরা আপা আমার হাত চেপে ধরে মৃদু হেসে চাপা কন্ঠে বলে ,‘ খেপেছ কেন ? সবাই কি আর
সংসারটাকে ঠিকঠাক বুঝতে পারে ? নাকি সে বুঝ সবার আছে ? বুঝতে দাও যার যা বুঝ-তরমুজ । ’ নীরা আপার কথায় আমিও হেসে ফেলি ।
‘ তোমার বোন একজনের না কি একটা অপারেশন হলো ----?’ নীরা আপা জানতে চায় ।
‘ মেজ বোনের । ইউটেরাসে টিউমার । ’
‘ এখন কেমন আছে ?’
‘ ভালো ।বাচ্চাদের বড় বোনের বাসায় রেখে মেজবোনের ডিউটি দিতে আমাকে আবার কিনিকে ছুটতে হবে ।’
‘ বেশী ভাই-বোন হলে এই ভাল , বিপদে-আপদে বেশ কাজ দেয় । আমাদের বাচ্চাদের যে কি হবে ! তোমার তো আবার দুইটা মেয়ে , দেখো ,বড় হলে দু’বোনের খুব মিল হবে ।একে অপরের কাজে আসবে। আমার তো আবার এক ছেলে-সঙ্গী-সাথী কেউ নেই ।’
‘ ছেলের জন্য সঙ্গী-সাথীর ব্যবস্থা করে নিলে পারেন । আর একটা বাচ্চা নিয়ে নেন না ক্যান ?’ আমি বলি ।
‘ নারে । আমার বর চায় না । বলে, বাচ্চা নিলে তুমি যেরকম অসুস্থ হয়ে পড় আমার ভাল লাগে না । তার চেয়ে আর বাচ্চা না নেওয়াই ভাল । আমাদের তো একটা আছে , একটাই উত্তম ।’ নীরা আপা মৃদু হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে বলে ,তার কাজলে আঁকা বড় বড় চোখ জোড়ায় আনন্দ যেন চিকচিক করে উঠে,সে আনন্দময় মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনও সুখে ভরে যায়।
আমাদের শৈশব-কৈশর মনে করিয়ে দিয়ে এসময় ছুটির ঘন্টা বেজে উঠে । আমরা বাচ্চাদের মায়েরা নড়েচড়ে উঠি , হাত বুলিয়ে নেই চুলে-মুখে , শাড়ীর আঁচল বা ওড়না টেনেটুনে ঠিকঠাক করে আড্ডা ভেঙ্গে উঠে দাড়াই । বাচ্চা নেবার জন্য মেইন গেইটের সামনে দাড়ালে আমার বাচ্চাদের আগে নীরা আপার ছেলে মুগ্ধ বেরিয়ে আসে । বয়স ছয় কি সাত ,মায়ের সবটুকু সৌন্দর্য্য নিয়ে ওর যেন জন্ম । মায়ের মতই বড় আর মায়াময় এক জোড়া চোখÑতবে কেমন যেন বিষন্ন । কখনো ছোট ছেলেটি আমার সাথে দৃষ্টি এক করতে চায় না ,শিশুসুলভ লজ্জায় দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয় ,তারপরও টুকটাক যেটুকু দৃষ্টি বিনিময় হয় তাতে ছেলেটির চোখের বিষন্নতা দেখে আমি নিজের অজান্তেই হোঁচট খাই ! একটি বাচ্চা ছেলের দৃষ্টি এত কাতর আর এত বিষন্ন হয় কি করে আমি ভেবে পাই না ! যেন জীবনের অনেক কঠিন আর কুটিল বাস্তবতা সে দেখে নিয়েছে । ছেলেটি অন্য বাচ্চাদের থেকে আলাদা ,মাত্রাতিরিক্ত ধীর স্থির এবং শান্ত । নিজের উপস্থিতি জানাতে যেন সে কুন্ঠিত । ছেলেটি স্কুল থেকে বেরিয়ে এলে আমি ওর চুলে হাত বুলিয়ে নীরা আপাকে বলি ,‘ ভারী লী ছেলে আপনার নীরা আপা । কার মত হয়েছে ,ওর বাবার মত নাকি ?’ নীরা আপা আমার কথা শুনেছে কিনা বুঝতে পারি না , ছেলের হাত ধরে ব্যস্ত হয়ে দ্রুত চলে যায় । আমিও তার দ্রুত চলে যাওয়া ল্য করি না বরং আমার মেয়ে দুটি বেরিয়ে এলে ওদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই ।
আমরা ক’জন মা সপ্তাহের পাঁচদিন বাচ্চাদের স্কুলের সামনে অভিভাবকদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসে আড্ডা দেই , গল্প করি । আমরা শুধু শাড়ী গয়না নিয়েই গল্প করি না , আমাদের গল্পে দ্রব্যের উর্ধধগতি , দেশের বর্তমান পরিস্থিতি , হাসিনা-খালেদার রাজনীতির শেষ কোথায় ,এটিএনের নতুন ডেইলি সোপ “ ডলস হাউস ” থেকে শুরু করে এমনকি আব্বাস কিয়ারুস্তমী’র ছবি পর্যন্ত স্থান পায় । শুধুমাত্র নিজ নিজ পরিবারের সামন্য মলিন দিকটিও গল্প থেকে সবাই দূরে সরিয়ে রাখি যতœ করে ।যেন আমরা মুখোস পরা একদল সঙÑ সুখের সাগরের বেলাভূমিতে রৌদ্যস্নান করছি আর মাঝে মাঝে কচিঁ ডাবের মিঠে পানিতে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছি । ধোপÑদুরস্ত এক দল সুখী মানুষ । এভাবে নিয়মিতভাবে স্কুলকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমাদের সবার দেখা হতে থাকে । নীরা আপার সাথেও । তেমনি একদিন , যারা সব সময় নিয়মিত আড্ডায় থাকে তারা হয়ত মার্কেট বা অন্য কোথাও গিয়েছে ,আমি আর নীরাআপা বসে গল্প করছি ,হঠাৎ নীরা আপা নীচুস্বরে বলে ,‘ মেয়েদের নিজের জন্য একটা কাজ করা ভাল । পরগাছার মত অন্যের উপর সম্পূর্ন নির্ভরশীল হয়ে পড়া ঠিক না ।নিজেকে ব্যক্তিত্বহীন লাগে ।’
বরের সাথে কি মান-অভিমান চলছে নীরা আপার ,আমি ভাবি ।
‘ হুঁ, আমরা একেবারে ডমিষ্টিক এনিমেল হয়ে গেছি । আপনি কিছু একটা করলেও তো পারেন । আপনার ছেলেও তো বড় হয়ে গেছে বেশ, আমার গুলোর মত সময় দিতে হয় না ।’ আমি বলি ।
‘ভাবছি । আচ্ছা তোমাদের তো অনেক জানা-শোনা আছে আমার জন্য একটা চাকরী জোগাড় করে দিতে পার না ।’খুবই নীচুস্বরে নীরা আপা বলে ।
‘ নীরা আপা আপনি হলেন সুনীলের নায়িকা রানী ,আর আপনার বরের ঘরনী ,আপনি করবেন চাকরী ! বরের সাথে রাগ হয়েছে নাকি ?’ নীরা আপা’র “ নীরা ”নামটা নিয়ে পরিচয়ের প্রথম থেকে তাকে আমি এ কথা বলে আসছি । এখনো তাই দুষ্টুমী করি ।
‘ রানী ! চাইলে কি আর কেউ নাম উল্টে নীরা থেকে রানী হতে পারে ! রানী হতে কপাল লাগে ।’ কথা বলতে বলতে নীরা আপার চোখ জোড়া বিষন্ন হয়ে উঠে এই প্রথমবার ,Ñযেমন বিষন্নতা তার ছেলের চোখে আমি দেখি । তার কপালের বড় কাল টিপ ঘিরে মেঘের ছায়া । আমি ভিতরে ভিতরে অস্থিরতা বোধ করি ,বুঝে উঠতে পারি না কিছু জানতে চাওয়া ঠিক হবে কিনা। ভয় হয় ,আমার প্রশ্নে যদি নীরাআপার প্রাইভেসি নষ্ট হয় । আমার দোদুল্যমান মানসিকতার মাঝে নীরাআপা চমৎকার নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবার হাসি-খুশী হয়ে উঠেন।
‘ এই লাষ্ট ফ্রাইডে কি হলো জানো -----?’ নীরাআপার কণ্ঠের উচ্ছলতায় আমি একটু আগের দ্বিধা ভুলে লাষ্ট ফ্রাইডে’র গল্প শোনার জন্য উৎসুক হয়ে উঠি ।
‘ ছুটির দিন আমি ভাবলাম একটু বেশী ঘুমাই ।ও-মা ন’টা বাজতে না বাজতে আমার বরের ধাক্কাধাক্কি ,খিদে লেগেছে নাস্তা দাও । আমি বিরক্ত হয়ে ডাইনিং টেবলে যেয়ে দেখি বাপ-বেটা মিটিমিটি হাসছে । টেবিলে খিচুড়ী আর গরুর মাংস ভুনা ।আমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে দু’জনে মিলে রান্না করেছে সকালে উঠে ।’
‘ ভালই আছেন , প্রেমে আছেন । আমাদের প্রেম তো উর্ধধমুখী বাজার দরের সাথে সামন্জস্যহীন হয়ে ক্রমাগত নিম্নমুখী ।যেন সী স খেলা । দৈনিক সকালে টাটকা একটা ঝগড়া না হলে দিনটাই শুরু হতে চায় না ।’ আমাদের গল্পের শেষের দিকে উর্মি এসে যোগ দিতে দিতে বলে ।উর্মির কথায় আমি আর নীরা আপা হেসে উঠি ।
‘ এই শুনেছেন কিছু ?’ উর্মি গলার স্বর নীচু করে গোপনীয় কিছু বলার পারিপার্শ্বিকতা তৈরী করে ।
‘ কি ?’ আমি আর নীরাআপা স্বমস্বরে প্রশ্ন করি ।
‘ লাবনী ভাবীর দুই মেয়ে থাকার পরও ছেলে ছেলে করে আবার একটা চান্স নিলো,তিন নম্বরটাও মেয়ে !
‘ তাই নাকি !বেচারী ! শুনে খারাপ লাগছে ।’আমি সমবেদনার কন্ঠে বলি ।
‘তারচে’ বড় কথা হলো লাবনীর হাজব্যান্ড খুব মাইন্ড করেছে বৌ আবার কন্যা বিয়ানোর জন্য ’ উর্মি চাপা হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত কওে বলে ।
‘ আমি তো বলি ভাল হয়েছে । মেয়েদের মানুষ মনে করে না ,তিন মেয়েই এখন বাপকে মানুষ করে ছাড়বে । আহারে , আমার বরের যে কি মেয়ের সখ । একটা মেয়ে যদি থাকত তার-কি আহ্লাদিই না করত ! নাম রাখত নাকি নিপ্পু ।ছেলে মানুষ ! একেবারে ছেলে মানুষ ! ’ নীরাআপা আদুরে ভাব নিয়ে বলে ।
‘আর একটা বাচ্চা নেন না কেন । দেখবেন এবার ঠিক মেয়ে হবে । এখন মেয়ের সিজন চলছে ।’ উর্মি বলে ।
‘ সিজন বদলে যদি পরপর তিন ছেলে হয়ে যায়-তখন ?’ নীরাআপার কথায় আমরা হেসে উঠি স্বমস্বরে ।

আমার কাজিন একজন ,বছর দুয়েক আগে লালমাটিয়াতে আড়াই হাজার স্কয়ার ফিটের এক ফ্যাট নিয়েছে । নেবার পর থেকে ওর নতুন ফ্যাট দেখবার জন্য অনেক সাধাসাধি করবার পরও নানান কারনে আমার ঠিক যাওয়া হয়ে উঠছিল না । শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি ভেতরে ভেতরে এমন বিশ্রী রুপ নিচ্ছিল যেন ওর ফ্যাট কেনায় আমি খুবই মর্মাহত এবং সে রাগে-দুঃখে ওর ফ্যাটে যাচ্ছি না । একদিন ধুম্ করে ডিসিশান নিয়ে ফেলি শানুর নতুন (আমার জন্য )ফ্যাট দেখতে যাব । আমার দুই মেয়েকে নিয়ে সিএনজি চড়ে এক সময় শানুর ফ্যাটের দোর গোড়ায় পৌঁছেও যাই । ফ্যাটে যারা থাকে তারা সব সময় যেন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তাই তো সিকিউরিটি গার্ড , ইন্টারকম সব মিলিয়ে কেমন জবরদস্ত কান্ডÑসব ক’টি এপার্টমেন্টে । প্রথমে নাম-ঠিকানা জানতে চাওয়া তারপর ইন্টারকমে জানানো ,উপর থেকে পারমিশন পাওয়া গেলে তবে লিফ্টে চড়ে কাংতি গন্তব্যে যাওয়া যাবে । আমরা সব বাঁধা ডিঙ্গিয়ে লিফটে চড়ে উপর দিকে উঠতে উঠতে ভাবি , কিছুদিন পর হয়ত এসব এপার্টমেন্টে ঢোকার মুখে হাত-মুখের স্কেন করতে হবেÑযেমনটা হলিউড-বলিউডের মুভিতে দেখে থাকি । চিন্তার সাথে পাল্লা দিয়ে লিফট ছ’তলায় এসে থামলে দরজা খুলতে শানুর মুখোমুখি হয়ে যাই । হাসিমুখে ও সম্ভাষন করে বলে ,‘শেষ পর্যন্ত তবে এলি ।’
‘ দেখতেই পাচ্ছিস সশরীরে তোর সামনে দাড়িয়ে । ভাবছিলাম আগ্রা যাব না তোর এখানে আসব, শেষে তোর কাছে আসার ডিসিশানই নিলাম ।’
‘ এই জনমের জন্য এই ফ্যাট আমার তাজমহল বটে !’ পথ দেখিয়ে আমাদের তার ফ্যাটে নিয়ে যেতে যেতে শানু বলে । আমি না বসে প্রথমে ওর ফ্যাটটা ঘুরে দেখি , দেখে দেখে মুগ্ধ হই । আধুনিক রুচিসম্মত ফিটিংস আর ইন্টেরিয়র ডিজাইন , দেখতে দেখতে ঢাকায় নিজের একটি ফ্যাটের স্বপ্ন সামনে এসে দাড়ায় ।স্বপ্ন পূরন না করতে পারার ব্যর্থতাও পাশাপাশি দাড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে ভেংচি কাটে । নিজের ভেতরের দীর্ঘশ্বাস গোপন করি , শানুকে বলি ,‘ খুব সুন্দর হয়েছে তোর ফ্যাট । চমৎকার সাজিয়েছিস ।’
‘ থ্যাংকস ।’শানু আমার কথা শুনে আনন্দিত হয়ে উঠে ,এমন আনন্দিত হয়ত সম্রাট শাহজাহানও হতেন তাজমহলের প্রসংশা শুনে। আনন্দিত শানু ড্রাইভার পাঠিয়ে পিজ্জা হাট থেকে ফ্যামিলি সাইজ পিজ্জা আনায় ।
‘ এক ফোরে কয়টি করে ফ্যাট ?’ আমি জানতে চাই ।
‘ দু’টি করে । আমার ভাগ্য খারাপ, প্রতিবেশী হিসাবে একটা ব্রোকেন ফ্যামিলী পেয়েছি আমার ফোরে ।’
‘ ব্রোকেন ফ্যামিলী হলে তোর সমস্যা কি ?’
‘ মেলামেশার ব্যাপার আছে না ! মা আর ছোট একটা বাচ্চা ছেলে থাকে । ওরাও কারো সাথে তেমন মিশে না ,আমরাও মিশতে চাই না । আমার বাচ্চাদের এসব রিএ্যাক্ট করতে পারে । তবে ওদের মা-ছেলেকে দেখলে মায়া হয় । মহিলা যথেষ্ট সুন্দরী । প্রেম করে বিয়ে করে নিজের আত্মিয়-স্বজন সবাইকে ছাড়ে । এই ফ্রাটটা মহিলা’র মা নাকি মৃত্যুর আগে মেয়েকে দিয়ে যায় । ওরা আমাদের আগে ফ্যাটে উঠে ,ওর স্বামী সম্ভবত ফ্যাটেও উঠেছিল ,তারপর অন্যজনের সাথে আবার প্রেমের সম্পর্ক তৈরী হলে বৌ-বাচ্চা ফেলে সে মেয়েকে নিয়ে আলাদা সংসার পেতেছে । মাঝে এই মহিলার কষ্ট ,নিজ আত্বীয়দের সাথেও সম্পর্ক ভাল নয়,তারপর রয়েছে বাচ্চাটি । মহিলা এখনো স্বামীর অপোয় আছে । আমি দেখেছি ,মহিলা মাঝে মাঝে দরজা খুলে “কে ? কে ?” বলে এদিক ওদিক কারোকে খুঁজে ।তখন মহিলার জন্য খুব কষ্ট লাগে ।’
‘ আহারে ! দুঃখি মহিলা ।’ শানুর কথা শুনে আমি বলি ,‘ তোরা মিশিস না কেন ? তোরা যদি মিশিস মহিলার হয়ত ভাল লাগতে পারে ।তাছাড়া সংসার ভাঙ্গার জন্য মহিলা তো দায়ী নয় ,সেও তো সাফারার ।’
‘ সেটা আমিও বুঝি । আসলে আমার বর চায় না আমরা ঐ মহিলার সাথে মেলামেশা করি ।’
অল্প সময়ের জন্য আমি আর শানু চুপ করে থাকি ,হয়ত মনে মনে দু’জনেই নিজেদের সিকিউরড লাইফটা একবার স্কেন করে দেখে নেই ,কোথাও কোন ডিফেক্ট নেই তো !

জম্পেশ আড্ডা আর ভারী নাস্তা শেষ করে আমরা যখন বিদায় নেবার জন্য লিফটের কাছে দাড়ালাম তখন লিফটের দরজা খুলে আমাদের সামনে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো নীরাআপা আর তার ছেলে মুগ্ধ । আমাকে সম্মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি ভড়কে যান । আমিও বিস্মিত হই ,জানতে চাই ,‘নীরা আপা আপনি ?’
‘ হ্যাঁ আমি ।‘ তুমি এখানে ?’ কিংকর্তব্যবিমুঢ় নিরাআপা ম্লান কণ্ঠে জানতে চায় ।
‘ এই যে শানু ,আমার কাজিন । ওর এখানেই এসেছিলাম ।’
‘ অÑ!তাই নাকি Ñ?’ বাকপটু নীরা আপা যেন কথা খুঁজে পায় না ।
‘ তুই উনাকে চিনিস নাকি ?’শানু জানতে চায় ।
‘ হ্যাঁ চিনি তো । নীরা
আপার বাচ্চা আর আমার বাচ্চারা একই স্কুলে পড়ে আর আমরা মায়েরা বসে আড্ডা দেই ।’ হঠাৎ স্তব্ধ দৃষ্টিতে দেখি , নীরাআপার কপাল জুড়ে লালটিপ ঘিরে চৈত্রের খাঁ খাঁ শূন্যতা ফণা উঁচিয়ে , আমি হোঁচট খাই । লাইনারে আঁকা কালো আর গভীর চোখ জোড়া শংকা আর বিষন্নতায় বিমূঢ়। দিশেহারা চোখের দৃষ্টি, পলায়নপর , লুকাতে চায় ,নিজেকে আড়াল করতে চায় যেন নীরাআপা।
‘ আচ্ছা আমি আসি । পরে দেখা হবেÑ।’ নীরা আপা ছেলের হাত ধরে তাড়াহুড়ায় শানুর পাশের ফ্যাটের দরজা খুলে ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যায় । একবারও পিছন ফিরে তাকায় না । আমি শানুর দিকে তাকাই ,শানুর নিরব দীর্ঘশ্বাসের ছোঁয়া আমাকে টলিয়ে দেয় । আগমনের মত বিদায়পর্ব মুখরতায়পূর্ণ হয়ে উঠে না । মনের গহীনে চোর কাঁটার আঁচড় নিয়ে আমি ফিরে চলি।

বিষাদ মন নিয়ে আমি শানুদের ফ্যাট থেকে ফিরে আসি ।সারা রাত নীরা আপার কথা ভাবি । যে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে সে স্বামীর দৈনিক ঘটনার বর্ননা ,ভালবাসার গল্প সবার কাছে নীরা আপা এমন ভাবে বলছে যেন স্বামীটি তার কাছে থাকে । নীরা আপা এমন কেন করে ? স্বামীকে তিনি খুব ভালবাসেন নাকি তিনি যে প্রতারিত হয়েছেন তা ঢাকতে চান বলে ? ভাবনা গুলো আমার মাথায় সারা রাত কিলবিল করতে থাকে ।
পরের দিন আমি স্কুলে যাই নীরা আপাকে খুঁজি তিনি আসেননি স্কুলে ।
পরপর কয়েকদিন আমি নিরবে নীরা আপাকে খুঁজিÑতাকে বা তার ছেলে কারোকে দেখি না ।উর্মি একদিন বলে ,‘ নীরা আপা এখন আর স্কুলে আসে না ।ছেলেকে স্কুল বাসে দিয়েছে ।’
আমি বুঝতে পারি নীরা আপা নিজের প্রতারিত মুখ ঢাকতে ক্রমশ আড়াল হয়ে যাচ্ছেন ।
৩০.৭.০৭
৯১/এইচ,৭-এ ধানমন্ডি ।ূূূূ


মন্তব্য

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

টুইস্ট টা বেশ। পড়ে ভাল্লাগলো।

নাজনীন খলিল এর ছবি

ভাল লাগল।

শুভেচ্ছা।

অনীক আন্দালিব এর ছবি

গল্পটা ভাল লাগলো। কথোপকথন বেশ ঝরঝরে, একটানে পড়ে ফেলা যায়। বেশ অনেকগুলো জায়গায় অক্ষর গাপ হয়ে যাওয়ায় যা একটু সমস্যা!
===
অনীক আন্দালিব
http://www.jochhonabilashi.blogspot.com

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারন একটা লেখা এখান থেকে হয়তো কিছু মানুষ নতুন করে ভাবতে শিখবে ........

(জয়িতা)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।