কিন্নরব্রত ।। জুয়েইরিযাহ মউ

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি
লিখেছেন জুয়েইরিযাহ মউ [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০৫/২০০৯ - ১০:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লোহার গারদ পেরিয়ে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে আলোর বিম নেমে এসেছে মেঝে বরাবর। বিমের ভেতর দৃশ্যমান ধুলিকণার গতিময়তা অপলক দৃষ্টিতে দেখছে চপল। হঠাৎ ছোট্ট দুরন্ত এক ন্যাংটো ইঁদুর মেঝেতে তৈরি বৃত্ত পেরিয়ে যেতেই চঞ্চল চোখের তারা ওর পিছু নেয়। এই ইঁদুরগুলোকে মা বলতেন “বাত্তি ইন্দুর”। মেঝেতে কুচি কুচি কাগজের টুকরো, কাপড়-চোপড় আগলে রাখার কষ্ট, মায়ের জন্য সৃষ্ট যন্ত্রণা। কিন্তু চপলের বেশ ভালো লাগে এই দুরন্ত প্রাণীটিকে। এখনও মনে হয় চারদেয়ালের মাঝের স্থবির সময়কে গতি এনে দেয় ইঁদুরটি।
বাইরে নরম আলো গায়ে মেখে দুপুর গড়িয়ে পড়ছে বিকেলের কোলে। পর্যাপ্ত জলকণায় ভরপুর বাতাস ঘামকণা শুষে নিতে পারেনা। চটচটে অস্বস্তি নিয়ে ভাত ঘুম ভেঙ্গে গেলে মায়ের কথা মনে পড়ে, গাঁয়ের সেই ছনের ঘর চোখে ভাসে। নড়বড়ে ঘরের জানালা খুলে দিলে আদুরে বাতাসের সোহাগে আবার ঘুমানো যেত। স্মৃতিকাতরতা জেঁকে ধরলে নিজেকে নিজেরই বড্ড ভয় করে। ব্লাউজের ভেতর হাতড়ে বিশ টাকার নোট বের করে আনে। এক কাপ চায়ের তৃষ্ণা প্রবল হলে ঘরের বাইরে পা বাড়ায়।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে কাজলে চোখ আঁকছে লক্ষী। হাতে সস্তা আয়নায় একটা মাত্র চোখের প্রতিচ্ছবি।
‘হামার নাগর আইবো।’- চপলের কৌতুহল আন্দাজ করে,ভ্রু নাচিয়ে উত্তর দেয়। হাসির রস ছন্দ আনে জীবনে।
চায়ের টংঘর, চাপকলের সীমানা, আরেকটু এগিয়ে গেলেই নদী। চরের সীমানা পেরিয়ে যেখানে বুড়িগঙ্গার দেহ শুরু; সেখানেই রাজ্যের আবর্জনা, বাঁশের তৈরি গোসলখানা, মল-মূত্রের আস্তরণ। চা শেষে বিড়ি ধরিয়ে নদীর ধারে এসে দাঁড়ায় চপল। একটা ইটের উপর পা ছড়িয়ে বসে উরু চুলকে নেয়। নদীতে উদাস দৃষ্টি যেন হাহাকার তোলে। এখান থেকে অনেকদূর আম্নিয়া গ্রাম, তবু কখনও কেউ যদি খবর নিয়ে আসতো -খালপাড়ের আমগাছের, মক্তবঘরের, নড়বড়ে ছন ঘরের কিংবা পরিচিত জনের। খেলার সাথীরা সব সামর্থ পুরুষ এখন, তাদের কি কখনও চপলের কথা মনে পড়ে? কিন্তু চপলের মনে পড়ে, প্রথম জমির ওর গজিয়ে ওঠতে থাকা স্তনবৃন্তে হাত রেখে বলেছিলো - “তোর বুক তো দেহি মাইয়্যাগো লাহান হইয়্যা যাইতাছে।”
সত্যি, বন্ধুদের সাথে সাথে ওর নিজেরও বিস্ময় জাগে! কী অদ্ভুত বিস্ময় নিজেরই শরীরজুড়ে ছড়াতে থাকে। থমকে যাওয়া পৌরুষ আর নারীত্বের খানিক স্পর্শের মাঝে ওর সমস্ত স্বত্ত্বা এক প্রশ্নবোধক চিহ্ণ। প্রকৃতির এক খেয়ালী সৃষ্টি, সাধারনের চোখে তখন অচ্ছুত, আস্পৃশ্য। খেলার সাথীরা ছুটে যায়, উচ্ছল কিশোরীদের চোখে স্পষ্ট কৌতুক। তারপর.......
তারপর, অবিরাম ভাসতে থাকা। ছোট্ট নগর-বন্দর ঘুরে এই শহরে এসে ওঠা। নদীর পাড়েই গ্রাম গজিয়ে ওঠবে এই যেন বাংলার ন্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। আম্নিয়ার পাশের নদীও বলতো কত শহর,বন্দর আছে দূর-দূরান্তে। সেইতো জানা হল, তবে বিপন্ন অস্তিত্ববোধের মাঝে সে এক ‘বনবাস যাপন’! বনবাস কি এখনও চলছে? কবে শেষ হবে এই বনবাস?
সমাজসৃষ্ট এই শহুরে ‘বনবাস’এ অপেক্ষার পালা শেষ হয়না, শুধু শেষ হয়ে যায় এক একটা কিন্নরজীবন। এভাবেই চলতে থাকে।
সভ্য সমাজ দেখে চমকালো সাজসজ্জা আর কৃত্রিম উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে কিছু প্রাণী চাদার জন্য বিরক্তি চরমে ওঠায়, অনেকে ভয় ও পায়। চাঁদার টাকা শেষ হলে ক্ষিধেয় পেট খলবলিয়ে ওঠে। তখন ‘নাগর’ জোটাতে হয় ওদের। এই প্রশ্নবিদ্ধ যৌনতা বিকৃত রুচির মানুষদের কাছে বিকোয় সস্তার বাজারে।
উঠে দাঁড়ায় চপল, ঘরমুখো হয়। পাশাপাশি কয়েকটি ঘর একে অপরের সাথে লেপ্টে আছে, এখানেই কিন্নর-কিন্নরীদের সংঘবদ্ধ বসবাস। সামনের সীমাবদ্ধ পরিসরে নাচ-গানের ধুম পড়েছে। চপলকে দেখে গোলাপ ওকে কাছে টানে নাচের ঢঙে। গুরু মা, ওদের দলপ্রধান, সবচে বয়স্ক কিন্নরী, ওদের উচ্ছলতায় সুখ খোঁজেন। ম্লান হাসেন। ঢোলের তালে তালে পা ফেলে নেচে যায় - চপলা, সরলা, গোলাপ, লক্ষী, মাজেদা। এক উন্মাতাল, উন্মাদনায় চাপা কান্না শূণ্যে মিলায়। বিকেলের কমলা রঙা রোদ আলতোভাবে ছুঁয়ে যায় ওদের।
--------------------------------------------------------------------


মন্তব্য

শাহেশাহ সিমন এর ছবি

সম্ভত সচলে এটাই আপনার প্রথম গদ্য। ভাল লাগল পড়ে। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি
জুয়েইরিযাহ মউ

মূলত পাঠক এর ছবি

আপনার কবিতা পড়েছি, কিন্তু গদ্য পড়ে মুগ্ধ হলাম। বিষয়নির্বাচনও খুব অনন্য। একটা কথা, এই জাতীয় বিষয় নিয়ে লিখলে একটু বড়ো পরিসরে লিখলে ভালো হয়, কারণ অনেক পাঠকই আছেন যাঁরা কিণ্ণর শব্দের এই অর্থ সম্বন্ধেই অবহিত নন। কাজেই ধরুন ঢাকা শহরের একটা সকালের গল্পে যেমন দু-চার কথাতে ছবি আঁকলেই লোকে ধরতে পারে, এখানে তার চেয়ে বেশি বিশদের প্রয়োজন হয়। আর নতুন বিষয় বলে কৌতূহলী পাঠক আরো পড়তে চাইবেন।

যে যুগে পুরুষেরা মঞ্চে নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন তখনকার এক নারীভূমিকাভিনেতা ছিলেন এই নামে (চপলকুমারী), আপনার চরিত্রটির নামকরণ কি সেইখান থেকে অনুপ্রাণিত নাকি একেবারেই কাকতালীয়?

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে ‘হিজড়া’ শব্দটি এতোটা নেতিবাচক অর্থে আমাদের এই সমাজে ব্যবহৃত হয় যে শব্দটি ব্যবহার করতে ইচ্ছে হল না। তবে আমার মনে হয় কেউ গল্পের শেষ পর্যন্ত পড়লে অবশ্যই ‘কিন্নর-কিন্নরী’ শব্দগুলোর অর্থ অনুধাবন করতে পারবেন।
চরিত্রের নামকরণের বিষয়টি কাকতালীয়।
গল্পটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জুয়েইরিযাহ মউ হাসি

মূলত পাঠক এর ছবি

আমি কিন্তু এই শব্দের ব্যবহারের প্রশংসাই করেছি। হাসি

এই গল্পটাকে সূচনা ভেবে একটা বড়োমাপের কিছু লিখুন না। এবং আরো গদ্য লিখুন, আপনার গদ্যের হাত ভালো, লিখতে লিখতে আরো খুলবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

তা আমি বুঝতে পেরেছি।
আমার প্রকাশিত ৩য় গল্পগ্রন্থ "অস্তিত্বে কুহেলিকা কিংবা টুকরো টুকরো প্রাণের কথকতা"তে কিন্নর-কিন্নরী দের নিয়ে আরও একটি গল্প আছে।
আমার ও ইচ্ছা আছে ওদের নিয়ে এই দুটো গল্পের পটভূমিতে একটি বড় কাজ করার।
ধন্যবাদ আপনাকে হাসি

মূলত পাঠক এর ছবি

কী সর্বনাশ, আপনার তিন তিন খানা বই আছে আর আপনাকে লিখে লিখে হাত খুলবে এই কথা বললাম! আগে বলবেন তো মশাই!

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনিতো ঠিকই বলেছেন সম্মানিত সচল, পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।