স্বর্গের কাছে পিঠে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৮/০৫/২০১০ - ১:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জহিরুল ইসলাম নাদিম

ওকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই আমার বুকে একটা দোলা লেগেছিল। পাঠশালার ঘন্টিতে হাতুড়ি ঠুকলে যে রকম ধুন্ধুমার কান্ড ঘটে যায় সেরকম কিছু নয়। তবে সাড়া একটা পড়েছিল ঠিকই। টিউনিং ফর্ককে আন্দোলিত করলে যে রকম তিরতির করে কাঁপে সেটা, আমার হৃদয়ও সেদিন ওই রকম কেঁপেছিল। কাঁপাকাঁপি হলে শরীরের তাপমাত্রা নাকি বেড়ে যায়! আমি অজান্তে আমার কপালে আঙ্গুল ছুঁইয়েছি। ওমা! কপাল যে পুড়ে যাচ্ছে? আসলে সেদিন হয়তো একটু বেশি গরম পড়েছে। কিম্বা লোডশেডিংয়ের মাশুল গুণে ওপরকার ফ্যান ধ্যানমগ্ন ছিল। এমনও হতে পারে সেদিন আগে থেকেই একটু জ্বর জ্বর ভাব ছিল আমার। আজ সেসব আর মনে নেই। শুধু মনে আছে আমার এই ছোট্ট হৃদয়টা কেঁপেছিল। বিজ্ঞানের নিত্যতা সূত্র বলে কোনো কিছুই নিঃশেষ হয়ে যায় না। শক্তির বিনাশ নেই। এই আমি যে কথা বলছি তা হয়তো একটু পরে আর শোনা যাবে না। তবে সেটা হারিয়েও যাবে না। ইথারে কাঁপন তুলে সেই তরঙ্গ দিগ-দিগন্তে কেবল ছড়িয়েই পড়বে। সেই ভাবে ওই কাঁপনটিও নিঃশেষ হয়নি বা আমি নিঃশেষ হতে দেইনি। এখন আর স্পষ্ট বোঝা যায় না তবে অনুভব করা যায়। আমার মনের একদম গোপন সিন্ধুকে ওই কাঁপনের অনেকটুকু আমি ধরে রেখেছি। মাঝে মাঝে তার কপাট খুলে কাঁপনটাকে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে নেই। একটা ভাল লাগার আবেশে জারিত হয়ে ফের তাকে যথাস্থানে যত্নে তুলে রাখি।

খুব যে রোমান্টিক একটা আবহে ওই দেখাদেখি হয়েছিল এমন নয়। রোমান্টিক শব্দের প্রকৃত প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। তবে পরিস্থিতিটা ওই রকমই ছিল। স্যার ওকে ডেকে নিয়েছেন। ওকে বসতে হয়েছে নামাজের ভঙ্গিতে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে। স্যারের হাতে বিশাল পুরুত্বের লাঠি। এই পর্যায়ে এসে পড়া না পারার জন্য স্যারের হাতে বেত্রাঘাত পেতে হবে ভাবতেও পারছিলাম না আমরা কজন। প্রথম ডেমো ক্লাস ছিল ওটা। বিশাল ল্যাবের এক প্রান্তে গোটা বিশেক রিভলভিং চেয়ার। মাঝে প্রকান্ড টেবিল-তার ওপাশে স্যার বসেছেন। স্যারের নিয়মই হল কঠিন দৃষ্টিতে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করা। যার চোখ একটু কেঁপে গেছে তো তার আর রক্ষে নেই। চেয়ার ছেড়ে বসতে হবে মেঝেতে। স্যার মুখে প্রশ্ন ছুঁড়বেন আর হাতে লাঠি নাচাবেন। প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে সাধু। আধুলি কী একটা পুরো সুপোরি উপহার হিসেবে জুটে যেতে পারে। আর মিস হলেই---সপাৎ!
প্রথম ‘দেখাদেখি’ কথাটিও পুরো সত্য হলো না। ও সেদিন বসেছিল আমার দিকে পেছন ফিরে বা একটু অ্যাঙ্গেলে। কমলা বা কাছাকাছি রঙের জামা পরেছিল ও। আমি ওর প্রোফাইলটা শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম। সুন্দর ফর্সা মুখটা কেমন লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। লোকে পয়সা উড়িয়ে যে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখতে যায় তাই আমি ওর মিষ্টি মুখশ্রীতে এক লহমায় দেখে ফেললাম। একহারা গড়নের মেয়েটি আমার হৃদয়ে ঢুকে গেল সবার অজান্তে।
এরপর আরও অনেকবার দেখেছি ওকে। চোখাচোখি হয়েছে-মিষ্টি হাসি খেলে গেছে ওর ঠোঁটে। কথা হয়েছে অনেক। আসলে রোল পাশাপাশি হওয়াতে বিভিন্ন কারণে কাছাকাছি আসতেই হচ্ছিল। যতই দিন যাচ্ছিল ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম আমি। দুজনের অনেক কিছু কমন হওয়াতে আমার সুবিধাই হচ্ছিল। আমার খুব বই পড়ার নেশা। দেখলাম ওর নেশা কিছুমাত্র কম নয়। ফলে বই চালাচালি চলছিল ভালই। সাধারণ রগরগে প্রেমের বই ছিল না সেগুলো। বাংলা এবং ইংরেজী সাহিত্যের ক্লাসিক কিছু বইয়ের কালেকশন ছিল দুজনেরই। ফলে এই বই বিনিময় অতি উৎসাহীদের গুড়ে বালিই দিচ্ছিল কেবল। ছেলে মেয়েতে দুটো কথা হলেই এখানকার ক্যাম্পাসে প্রেমের যে কাহিনী লতিয়ে ওঠে তা থেকে রক্ষা পেয়ে গেলাম আমি। এটা বেশ ভালই হলো। ওই রকম কিছু হলে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতাম না হয়তো। সামান্য লেখালেখির অভ্যেস ছিল আমার। মাঝে সাঝে ওকে পড়তে দিতে পারলে খুবই ভাল লাগত। ও যেরকম অ্যাপ্রেশিয়েট করত তাতে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে আশান্বিত হয়ে ওঠা কঠিন কিছু ছিল না। তবে সবকিছুতেই ওর পরিমিতি বোধ ছিল অসাধারণ। ফলে ওকে নিয়ে আমার কল্পনারা লাগাম ছিঁড়ে উড়তে পারত না। সহপাঠী থেকে বেশি কিছু হয়েও আরও বেশি কিছু হওয়া হয়ে ওঠেনি আমার।
এক বছর পরের ঘটনা। একটা কাজে ঢাকায় এসেই আমরা ক্যাম্পাসে ফিরছি। তাড়াহুড়োর কারণে আগে কেবিন বুক করতে পারিনি। তাই ডেকের যাত্রী হয়েই মেঘনা পাড়ি দিতে হচ্ছে। লঞ্চ সদরঘাট না ছাড়া অব্দি এক দল যাত্রীর সাথে ডেকেই বসে থাকলাম। সবাই যে যার মত জায়গা দখল করে শোয়ার বন্দোবস্ত করেছে। কেউ কেউ দুচারজন সঙ্গী জুটিয়ে বসে গেছে তাসের আড্ডায়। অনেক পর্দানশীন ফ্যামিলি শাড়ি দিয়ে তৈরী করা এনক্লোজারে চালান হয়ে গেছে। আমি কেবল অস্থির হয়ে আছি। সঙ্গীহীন এরকম নৌভ্রমণে অভ্যস্থ নই। উদ্বাস্তুর মতো সবার সাথে শুয়ে রাত কাবার করার কথা ভাবতেই পারিনা। আগেও দুএকবার এভাবে গেছি। তখন লঞ্চ কিছুদূর চলে এলে নিজের ব্যাগেজ পাশের যাত্রীর জিম্মায় রেখে সোজা চলে গেছি ফার্স্ট ক্লাসের দিকে। সামনের উন্মুক্ত অংশে পাতা চেয়ারে বসে আকাশের তারা গুণে আর নদীর ভেঁজা বাতাস গায়ে জড়িয়ে সময় পার করে দিয়েছি। উদ্দেশ্য ছিল এবারও তাই করব। কিন্তু ফার্স্ট ক্লাসে এসে হতাশ হতে হলো। বেশ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি হচ্ছে। খোলা অংশে দাঁড়ালে মুহূর্তেই ভিজে যেতে হবে। অগত্যা কেবিনের একপাশে বৃষ্টি বাঁচিয়ে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছি। আকাশ মেঘলা থাকায় চাঁদ হারিয়ে গেছে। ফলে মাঝে মাঝে আবছা বিজলীর আলো ছাড়া চারদিক ডুবে আছে ঘন অন্ধকারে। এমন সময় এক পশলা হাসির ধারালো শব্দ বাতাস বাহিত হয়ে এসে একেবারে আমার হৃদয়ে বিঁধে গেল। অন্ধকারে ঠাওর পাইনি যে আমি যেখানে দাঁড়িয়েছি তার ঠিক দশ গজ পেছনে তিন তলায় ওঠার সিঁড়ির ধাপে বসে গল্প করছে কজন মেয়ে। গলা শুনে বুঝতে বাকি রইল না যে এরা আমারই ইয়ারমেট। সঙ্গে অন্য কেউ থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই ওখানে গিয়ে আড্ডায় ঢুকে পড়া যেত। কিন্তু একাকী ওখানে যাবার সাহস সঞ্চয় করতে পারলাম না। তাছাড়া খুব হৈ চৈ করার ধাত আমার নয়। হঠাৎ করেই একটা কন্ঠ বেশ করে চমকে দিল আমাকে। ওর গলা! তার ও আছে এদের দলে। খুব ইচ্ছে করতে লাগল ওর সাথে কথা বলার। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? মনে পড়ল একবার শুনেছিলাম যে কাউকে হৃদয় দিয়ে খুব করে চাইলে তাকে ঠিক পাওয়া যায়। ঘোর লাগা মানুষের মত ওই আবছায়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমি খুব করে ওকে পাশে পেতে চাইলাম। ও আসুক-আসুক-আসুক.....! কতক্ষণ এরকম চেয়েছি মনে নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা ব্যথা করে ওঠাতে ঘোর ভাঙ্গল। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজের ওপরই প্রচন্ড রাগ হলো। একি করছি আমি! টেলিপ্যাথির কথা তো থাকে কেবল বইয়ের পাতায়। বাস্তবে তা ঘটে নাকি? এবার এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। হুট করে নেমে গেলে ওরা কী ভাবে তাই বারান্দা ধরে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলাম। টয়লেট সারতে এসেছিলাম এরপর চলে যাচ্ছি¬¬- ভাবটা এরকম। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই তড়িতাহতের মতো অসাড় হয়ে যেতে হলো আমাকে। এক বান্ধবীকে সাথে করে ও দাঁড়িয়ে আছে।
‘অ্যাই তোমার সাথে গল্প করতে এলাম.....’, আমি নিশ্চিত এর চেয়ে মিষ্টি কোনো প্রস্তাবনা আমার কান আজতক শোনেনি। ‘বিরক্ত হলে নাকি?’ ওর চোখে চোখ রেখে আমি কেঁপে উঠেছিলাম। আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার সুযোগে ওর কপট প্রশ্ন।
‘আরে না! কী বলছ? আমি ..ইয়ে..’
আমি প্রবল ভাবে আপত্তি করতে গিয়ে সবকিছু গুলিয়ে ফেলতে শুরু করি। আমার মন অসম্ভব ভাল লাগায় পূর্ণ হয়ে যায়। এক ছুঁতোয় বান্ধবীটি প্রস্থান করলে কেবল ও আর আমি থাকি। ওকে চেয়ারে বসতে দিয়ে আমি ওর মুখোমুখি রেলিংয়ের ওপর উঠে বসি। এভাবে বসাটা একটু বিপজ্জনক, বিশেষত এই ঝড় বৃষ্টির রাতে। কিন্তু পৃথিবীর তাবৎ বিপদ তখন আমার কাছে অপাঙক্তেয়। ওর উপস্থিতির মিষ্টি গন্ধকে শোষণ করতে করতে বুঝতে পারি স্বর্গের অবস্থান মানুষের কাছে পিঠেই ।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ভালো লাগল।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

মূলত পাঠক এর ছবি

স্বাগতম! আপনার লেখার হাত সুন্দর লাগলো, তবে শেষ হয়ে হইলো না শেষ মনে হলো যে? কিছু বানানটানানের ব্যাপার আছে, নিচে দিলাম, তবে সে তেমন কিছু নয়। আর গোড়াতেই যে নিজের নামটা দিয়েছেন, এইটাও ভালো লাগলো: নীড়পাতা থেকে দেখা যায়। নতুন অতিথিরা এটা অনুসরণ করতে পারেন।

সিন্দুকে
পুরুত্বের লাঠি? মোটা লাঠির ক্ষেত্রে পুরুত্ব ব্যবহার হওয়া বেশি চোখে পড়ে না।
সুপোরি > সুপারি/সুপুরি
ভেজা
কণ্ঠ (মূর্ধণ্য ণ)

দুটো রোল রিভার্সাল গোছের ব্যাপার ঘটে গেছে দেখি! শিক্ষকেরা মেয়েদের পেটান, আর ছেলেরা চেনা মেয়েদের সাথে নিজে থেকে কথা বলতে যেতে লজ্জা পায়। হাসি

লিখতে থাকুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

সবাই যে লজ্জা শরম ছাড়া হবে তা কে আপনাকে বলল!!
যাহোক বানান শুদ্ধির জন্য ধন্যবাদ। জীবন মানেই হলো বৈচিত্র। কখন কী ঘটবে তা বলা যায়? আর স্যারের মার দেয়ার ব্যাপারটা আমার নিজের অভিজ্ঞতাপ্রসূত তাই এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার ব্যাপার নেই।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

ইথারে কাঁপন তুলে সেই তরঙ্গ দিগ-দিগন্তে কেবল ছড়িয়েই পড়বে

ইথার বলে আসলে কিছু নেই কিন্তু হাসি

ভাল লাগল পড়তে, আরও লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ইথার বলে এখন কিছু নেই সত্যি। তবে বহুবছর বিজ্ঞানীরা এ রকম একটা জিনিস আছে বলেই ভেবে এসেছেন। তাছাড়া মহাশূণ্যে একদম কিছু নেই ভাবার চেয়ে ওরকম একটা জিনিসের অস্তিত্ত্ব আছে এমন ভাবা যাক না!

অতিথি লেখক এর ছবি

লাজুক প্রেমের গল্প ভাল লাগল। লিখতে থাকুন।

কৌস্তুভ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা সবার জন্য।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

টেলিপ্যাথি বলে কি আসলে কিছু নেই?
আমার কিন্তু বিশ্বাস করতে ভালো লাগে, আছে। অবশ্যই আছে।
আপনার লেখা ভালো লাগলো। হাসি

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি বিশ্বাস করি আছে।

বইখাতা এর ছবি

অনুভূতিগুলোর প্রকাশ/বর্ণনা খুব চমৎকার লাগলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার মন্তব্য আমার চমৎকার লাগল!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে। ব্যস্ততার মাঝেও যে অতিথি লেখকদের লেখা পড়ছেন তা সত্যি প্রশংসার্হ।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- লেখায় স্পেস দিয়েন ভাই। প্যারার পরিমান বাড়ালে অনেকেই সেটা সহজে পড়তে পারবেন।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

অতিথি লেখক এর ছবি

টেকনিক্যাল উপদেশ দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা। পরের লেখায় অবশ্যই স্পেস দেব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।