সোমালি জলদস্যু এবং ওরা চার হতভাগা

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি
লিখেছেন রাতঃস্মরণীয় [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০৮/০৮/২০১০ - ১১:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ওদের নাম দেলোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ আবুল বাশার, মোহাম্মদ বাবুল মিয়া এবং মোহাম্মদ আমিন। ওরা পেশায় আদম। জ্বী ওদেরকে আমরা আদম বলেই জানি। আমরা যারা পেটের দায়ে দেশ-মাটি ছেড়ে বিদেশে কাজ করতে আসি, আমরা সবাই আদম। নিজেকে আদম পরিচয় দেওয়া অন্ততঃ আমার কাছে গর্বের। অনেকদিন আগে যায়যায়দিন পত্রিকায় একটা আর্টিক্যলে আদম সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিলাম “আদি পিতা আদমের সাথে আমাদের পার্থক্য হচ্ছে যে ত ...ওদের নাম দেলোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ আবুল বাশার, মোহাম্মদ বাবুল মিয়া এবং মোহাম্মদ আমিন। ওরা পেশায় আদম। জ্বী ওদেরকে আমরা আদম বলেই জানি। আমরা যারা পেটের দায়ে দেশ-মাটি ছেড়ে বিদেশে কাজ করতে আসি, আমরা সবাই আদম। নিজেকে আদম পরিচয় দেওয়া অন্ততঃ আমার কাছে গর্বের। অনেকদিন আগে যায়যায়দিন পত্রিকায় একটা আর্টিক্যলে আদম সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিলাম “আদি পিতা আদমের সাথে আমাদের পার্থক্য হচ্ছে যে তিনি নবুয়ত পেয়েছিলেন কিন্তু আমরা পাইনি। এছাড়া তিনিও আমাদের মতো একজন রক্ত-মাংশের মানুষ ছিলেন।”

দেলোয়ারের বাড়ি ফেণি আর বাকী তিন জনের বাড়ি হাতিয়ায়। এরা চারজন ওমানে কাজ করেন, জেলে, এডেন উপসাগরে মাছ ধরেন। ওদের মালিক একজন ওমানি, নাম আলি। ওরাও জানেননা ওদের মালিক আলির পুরো নাম কি।

পহেলা নভেম্বর ২০০৯, রোজকার মতো ওরা এডেন উপসাগরের বেশ গভীরে কিন্তু ওমানের সমূদৃসীমার মধ্যে মাছ ধরছিলেন। ওরা জানতেন যে এখানে মাঝে মধ্যেই সোমালি জলদস্যুরা হানা দেয়। কিন্তু ওই ভয়ে ভয়ে থাকলে তো আর চাকরি থাকবে না। ট্রলারে ওরা ছিলেন ৯ জন। ওরা ৪ জন বাংলাদেশী, সাথে আরও ৫ জন ইনডিয়ান। এই ইনডিয়ানদের মধ্যে আবার একজন ট্রলারের সারেং। বিকাল ৪টা মতো বাজে। ওরা দেখতে পান একটা সন্দেহজনক স্পিডবোট ওদের দিকে ধেয়ে আসছে। সারেং বিপদ আঁচ করতে পেরে ট্রলারের গতি বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু স্পিডবোটের গতির সাথে তো ট্রলারের পারার কথা না। তার পরও সারেং গতি কমালেন না। ট্রলারের কাছাকাছি এসে স্পিড বোট থেকে জলদস্যুরা গুলি ছুড়তে শুরু করলো। একে ৪৭ এ্যাসল্ট রাইফেলো একটা গুলি সারেংএর পায়ে লাগলে আর কিছু করার থাকলো না। কয়েক মিনিটের মধ্যে ট্রলার সোমালি জলদস্যুদের আওতায় চলে গেলো।

বশির সাইদ হাসান, বয়সে তরুন কিন্তু কর্মদক্ষ এবং খোলা মনের একজন মানুষ। বশিরের মতো কুচকুচে কালো মানুষ গোটা আফ্রিকাতেই বোধহয় খুব কম দেখা যাবে কিন্তু বন্ধুরা ওকে ডাকেন নূর বলে, যার মানে হলো আলো। বশিরের গায়ের রংটা যেমন কালো, ওর ভিতরটা তেমনই উজ্জল। ও আমার বিশেষ স্নেহাষ্পদ। আমাকে বশির হঠাৎ এক বিকেলে বললেন যে তোমার কয়েকজন ইমপ্যাট্রিয়েটস্ সোমালি পাইরেটসদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন? এরপর বশির এই ব্যাপারে আমাদের সংস্থার একজন কর্মি, নাম আইয়ানলে, যিনি এমএমটিএফ বা মিক্স মাইগ্রেশন টাস্ক ফোর্সের একজন সমন্বয়কারী, তার একটা ইমেইল আমাকে ফরোয়ার্ড করে দিলেন। আইয়ানলে জানতেন না যে আমি বাংলাদেশী, আমাকে ভেবেছিলেন ইনডিয়ান বা পাকিস্তানী। দোষ দেবো না ওকে।

দেরি না করে ফোন করলাম নাইরোবিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে। কথা বললাম থার্ড সেক্রেটারি ও হেড অব চ্যান্সেরী সাখাওয়াত হোসাইনের সাথে। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে তারপর তাকে মেইল করতে। আমি তবুও তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে এরকম পরিস্থিতিতে সাধারনতঃ তারা কি করতে পারেন। তিনি বললেন বিষয়টা বেশ জটিল কারণ সোমালিয়ায় বাংলাদেশী এমব্যাসি নেই। তবে স্বাভাবিক অবস্থায় ওদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াই করা হয়। ওদের পরিবারকে খবর দেওয়া হয় টিকেট পাঠানোর জন্য। তবে সত্যি কথা বলতে কি, সাখাওয়াত সাহেবকে যথেষ্ঠ উদ্বিগ্নই মনে হলো। পরে এই ঘটনার ফলে কেনিয়াস্থ বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাহেব আমাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং সাখাওয়াত সাহেব তার বাসায় দাওয়াত করে খাইয়েছেন গত ২০০৯ ঈদুল আজহার রাতে। উনি বয়সে তরুন, আমার থেকে বেশ ছোট, বিসিএস ক্যাডারের অফিসার্, এক্স ক্যাডেট। আমি মুগ্ধ তার আচরণে এবং মানবিক বোধে। এরাও আমার দেশের সোনার মানুষ। ব্যাক্তিগতভাবে ব্যুরোক্র্যাটদের আমি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও সাখাওয়াত সাহেবের সাথে পরিচয় হয়ে আমি সত্যিই মুগ্ধ।

আইয়ানলেকে ফোন করলাম ওদের অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্যে। সে জানালেন যে ওরা এখন একটা হোটেলে আছে পুলিশ প্রহরায়। যেহেতু আইয়ানলের কর্মস্থল ওই যায়গা থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে, সে তার একজন বন্ধু, এমএমটিএফ সহকর্মী আবদীমাহদীকে আমার সাথে যোগাযোগ করতে বললেন। পরদিন আবদীমাহদী আমাকে ফোন করে জানালেন যে কিছু হৃদয়বান মানুষ ওদের হোটেল ভাড়া মেটাতে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। গতকাল সেই টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় হোটেল মালিক ওদেরকে আর রাখতে রাজি হননি। অবশেষে আজ সকালে ওদের আনা হয়েছে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে। অন্য কোনও ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ওদেরকে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসেই রাখা হবে রাষ্ট্রীয় অতিথির মতো।

আমার পরদিন থেকে ছুটিতে যাওয়ার কথা। কিন্তু মন সায় দিলো না এই অবস্থায় ওই মানুষগুলোকে রেখে যেতে। ছুটি ও ফ্লাইট বাতিল করলাম। আমি আমার বসের সাথে কথা বললাম, কয়েকটা ইউএন সংস্থার আনঅফিসিয়ালি সাথে কথা বললাম। কিন্তু সমস্য হলো এই যে, ওরা কোনও অবস্থাতেই রিফিউজি বা মাইগ্রান্ট স্টাটাসের শর্ত পূরন করেন না। এমনকি মিক্স মাইগ্রেশনের আওতায়ও ওরা পড়েন না। পড়লে আমার সংস্থা ওদের যাবতীয় দায়িত্ব নিতে পারতো। তবে বস কথা দিলেন যে ওদের সহায়তার জন্যে যদি কোনও রকম রাস্তা আমি বের করতে পারি, তিনি আমাকে সহায়তা করবেন। কিন্তু চেষ্টা বিফল। সবশেষ পরিকল্পনা হলো প্রয়োজনবোধে ওদের ৪ জনের আত্মীয়দের সাথে কথা বলে দেশে ফেরত যাবার টিকেটের ব্যবস্থা করবো। ওরা দেশ থেকে ই-টিকেট পাঠিয়ে দিলে আমি ওদের সোমালিয়া থেকে কেনিয়া বা আদ্দিস আবাবা বা দুবাই যাবার ব্যবস্থা করে দেবো। বস বললেন তিনি ইউরোপিয়ান কমিশনের ফ্লাইটে ওদের ফ্রি নাইরোবি পাঠাতে পারবেন একটা এনডোর্সমেন্ট দিয়ে। আর যদি দুবাই বা আদ্দিস হয় তবে হয়তো ওরা বাড়িতে ফোন করে দেবেন আমার এ্যাকাউন্টে টিকেটের দাম জমা করে দেওয়ার জন্যে। আর নিতান্তই যদি না পারেন, তবে অন্য কথা। তবুও মানুষগুলোকে ফেরত তো পাঠাতে হবে। একই সাথে ভাবছিলাম পুন্টল্যান্ড সরকারের ইনটেরিয়র মিনিষ্টার জেনারেল (অব) আবদুল্লাহি আহমেদ জামার সাথে একটু কথা বলবো কি না। পরিচয় দিলে উনি চিনবেন, ওনার সাথে বেশ কয়েকবার মিটিংএ দেখা ও কথা হয়েছে। ইতোমধ্যে বারবার কথা বলছি ইউএনএইচসিআর এ কর্মরত বাংলাদেশী বন্ধু আসাদুজ্জামান সিকদারের সাথে কি করা যায় এই নিয়ে। আসাদ ও আমি একমত হলাম যে টিকেটের ব্যবস্থা করতেই হবে দুবাই বা আদ্দিস আবাবা পর্যন্ত, যায় যাক পকেটের পয়সা।

১৭ নভেম্বর ২০০৯, সকালেই আবদীমাহদীর ফোন পেলাম। ও প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে ঢুকেছেন এবং ওই ৯ জনের সাথেই আছেন। আবদীমাহদী ফোন দিলেন দেলোয়ার হোসেনের কাছে। শক্ত নার্ভের মানুষ ওরা, কথা বলে টের পেলাম। দেলোয়ার বললেন বিস্তারিত কাহিনী।

ধরা পড়ার পর একটানা ৬ দিন ট্রলার চালিয়ে ওরা পুন্টল্যান্ড প্রদেশের ঈল বন্দরের খুব কাছে একটা চরে ট্রলার উঠিয়ে দেন। তারপর ওদেরকে নিয় আসা হয় ঈল শহরের একটা বাড়িতে। এই ঈল বন্দর পাইরেটসদের বিরাট ঘাটি। এখানে এদের প্রকাশ্য বিচরণ। যদিও পুন্টল্যান্ড সরকার পাইরেট বিরোধী অবস্থানের কথা বলে থাকেন এবং বেশ কিছু পাইরেটকে বন্দীও করেছেন, তার পরও এখানে এদের অবাধ বিচরণ। সরকারবিরোধী মহল বলে বেড়ান যে সরকারের কিছু মন্ত্রী ও আমলা নিয়মিত পাইরেটদের কাছ থেকে ভাতা নেয়। আমি দেলোয়ারকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে ওদেরকে ধোলাই দিয়েছে কি না বা কোনও রকম দুর্ব্যবহার করেছে কি না। জবাবে দেলোয়ার বলনেন যে না। প্রয়োজনমত পানি, সিগারেট, ওষুধ, আহত সারেংএর জন্যে ব্যান্ডেজ, ইত্যাদিও দিয়েছে। ওদের ট্রলারে বাজার-সদাই করা ছিলো। পাইরেটরা ওদেরকে একটা গ্যাসের চুলাও দিয়েছে রান্না করার জন্যে। এরই মধ্যে পাইরেটরা ওদেরকে সব খবর আপডেট করছে। ওরা বলেছে যে ওদের মালিক আলি তার কর্মচারীদের জন্যে কোনওরকম মুক্তিপণ দিতে রাজি না। সে টাকা দেবে যদি তার ট্রলার ভালো অবস্থায় ফেরত পাঠানো হয়। তার কাছে কর্মচারীদের জীবনের থেকে তার ট্রলার অনেক বেশি দামী। কিন্তু ট্রলার তো বিকল। সারেং জানালেন যে ইঞ্জিন বসে গেছে অতিরিক্ত চাপের কারণে।

অবশেষে একদিন পাইরেদের একজন এসে বললো যে তোমরা তো কাঙ্গাল পার্টি, তোমাদের আটকে রেখে আর কোনও লাভ নেই। যে খচ্চর মালিকের ষ্টাফ তোমরা, একটা পয়সাও দেবে না। তবে আলিরও কপালে খারাবি আছে। ওর কোনও ট্রলারের আর রেহাই নেই আমাদের হাত থেকে। ব্যাটাকে আমরা ফতুর বানিয়ে ছাড়বো। এখন থেকে আমরা ওর ট্রলারগুলো ধরে ধরে আমাদের অপারেশনে লাগাবো্। ব্যাটা বুঝবে ছ্যাচড়ামির ফল। যাইহোক পাইরেটদের সর্দার বললো যে তোমাদেরকে এখন আমরা অথরিটির হাতে তুলে দেবো। এরপর সরকার বুঝবে তোমাদের নিয়ে কি করবে। এরপর ১৩ নভেম্বর পাইরেটরা কয়েকজন স্থানীয় এলডার্সের মাধ্যমে অথরিটির লোক খবর দিয়ে এনে এই ৯ জনকে তাদের হাতে তুলে দেয় এবং সরকারী লোকেরা ওদের পুন্টল্যান্ডের রাজধানী গারেয়েতে নিয়ে যায়।

প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, এই পাইরেটদের সম্পর্কে আপনাদের ভালো ধারণা না থাকাই স্বাভাবিক। ধরা পড়লে মুক্তিপনের সর্বনিম্ন রেট হচ্ছে জনপ্রতি ৫০০,০০০ ডলার। পাইরেটদের অনেকগুলো দল আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে কোনও সোমালি মানুষই এই পাইরেসির গ্যাংষ্টার নয়। যতদূর শুনেছি একজন ইটালিয়ান, একজন জার্মান, দুইজন আর্মেনিয়ান, এবং আরও কিছু বিদেশী লোক এই দলগুলো চালায়। তবে কিছু সোমালি এদের অপারেশনসগুলো ম্যানেজ করে নাইরোবি বসে। এই গ্যাংষ্টার এবং সিনিয়র পাইরেটরা সবাই কেনিয়ায় থাকে, বিলাশবহুল বিশাল বাড়িতে থাকে, মার্সিডিস, বিএমডব্লিউ, এইসব গাড়ি চালায়, বাচ্চাদের বিদেশে পড়ায়।

আর সোমালিয়াতে যারা সরাসরি পাইরেসি করে, এরা মূলত গ্যাংষ্টার বা সিনিয়রদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। এরা যখন কোনও কাজ শেষে তার ভাগ পায়, যেমন, ৫০,০০০ ডলার। এটা শেষ করতে এদের ১-২ মাসের বেশি সময় লাগে না। টাকা পেলে এরা প্রথমেই যে কাজটা করে তা হলো সুন্দরী কোনও গৃহবধুকে বিয়ে করা। ওই গৃহবধুর স্বামীকে এরা ১০,০০০ সময়ভেদে ২০,০০০ ডলার দিয়ে তালাক করিয়ে নেয়, তারপর বিয়ে করে। সমস্য হয় যখন এদের হাতের পয়সা ফুরিয়ে আসে। লিবিডোও পয়সার সাথে সাথে কমতে থাকে। একটু বিচক্ষন পাইরেটরা বিয়ে না করে বরং ইথিওপিয়া, সোমালিল্যান্ড বা জিবৌতি থেকে মেয়ে নিয়ে আসে কিছু দিনের জন্যে। পয়সা পাওয়ার পর এরা আর যে কাজ করে তা হলো মদ পান করে, ভায়াগ্রা, মীরা ও কাট সেবন করে। মীরা ও কাট হচ্ছে হর্ণ অব আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী নেশ। পরে অন্য সময়ে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত লিখবো। একটু বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন পাইরেটরা ইদানিং টাকা পেলেই টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার জীপ কেনে ভাড়ায় দেওয়ার জন্যে। সোমালিয়ায় ব্যাপক এনজিও কার্যক্রমের জন্যে প্রচুর জীপ ভাড়া হয়। যদিও এনজিওগুলো খুব সতর্ক যাতে তারা কোনও পাইরেটের জীপ ভাড়া না করে। কিন্তু পাইরেটরাও ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষনা দেয় না যে এই গাড়ি ওমুক পাইরেটের।

আর একটা আজব কাজ এই পাইরেটরা করে, শুনলে হাস্যকর মনে হতে পারে তবে আমার নিজের দেখা উদাহরণ আছে। এরা মাতাল অবস্থায় গাড়ি উঠিয়ে দেয় মানুষের বাড়ির দেয়ালের উপরে এবং তারপর হুংকার দিয়ে বলে আমার চলার রাস্তার উপর দেয়াল কেনো। এই বলে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর এরা আবার ফিরে আসে ওই বাড়ির সামনে। বাড়িওয়ালাকে ডেকে তার গায়ের উপর ১,০০০-২,০০০ ডলার ছুড়ে দেয়। আমি নিজে এরকম দুটি দেয়াল দেখেছি যা সহকর্মীরা আমাকে দেখিয়েছেন। তবে শোনা যায় পাইরেটরা তাদের মোট আয়ের ২০% গরীব মানুষকে দিয়ে দেয় আমোদ ফুর্তি শুরু করার আগেই।

আমার এই শহর শারিরীক প্রতিবন্ধী আর মানসিক ভারসম্যহীন মানুষে ভর্তি। বহুবছরের গৃহযুদ্ধের ফলে অনেকেই অঙ্গ হারিয়েছেন আর অনেকেই আপনজন হারিয়ে শোকাহত হয়ে মানসিক ভারসম্য হারিয়েছেন। একটা মেয়েকে মাঝে মাঝে দেখি আমাদের এলাকা দিয়ে ঘোরাফেরা করে। একদিন আমার অফিসের পাশে আবর্জনার স্তুপের ভিতরে কি যেন খুঁজছে। আমার কমান্ডোদের একজন একে ৪৭ নিয়ে তাকে তাড়া করলে আমি বারন করলাম; বললাম ওর কাজ একে করতে দাও; আর কখোনোই ওকে তাড়া করবে না। পরে আমার এক সহকর্মী জানালেন যে ওই মেয়েটি কোনও গৃহযুদ্ধের স্বীকার না। বছরখানেক আগে এক পাইরেট ওই মেয়েটিকে প্রলুব্ধ করে পাশের গ্রাম থেকে নিয়ে আসে। কথা ছিলো মেয়েটা তার সাথে একরাত হোটেলে থাকবে এবং পাইরেট তাকে ৩০০ ডলার দেবে। এরপর তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে হোটেলে ওঠে। মেয়েটা মানসিকভাবে আগেই প্রস্তুত ছিলো সেক্স করার জন্য, নাহলে তো আসতোই না। কিন্তু পাইরেট তাকে এমনভাবে নির্যাতন করে যে এক পর্যায়ে ব্যাপারটা মেয়েটার সহ্যশক্তির বাইরে চলে যায়। পাইরেট তার সাথে জোর করে এ্যানাল সেক্সও করে। অবশেষে মেয়েটা চিৎকার করতে শুরু করে। ততক্ষণে পুরো বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাইরেট বিছানার উপর ৩০০ ডলার ফেলে রেখে লোক জড় হওয়ার আগেই পালিয়ে যায়। এরপর পাশের রুমের বোর্ডার, হোটেল কর্মচারীরা এসে ঘটনা আবিষ্কার করে। মেয়েটা এক পর্যায়ে বাধ্য হয় তার সঠিক ঠিকানা বলতে। তার বাড়ির লোক ডাকা হলে তারা মেয়েটাকে গ্রহন করতে অস্বীকার করে চলে যায়। এদিকে হোটেল কর্তৃপক্ষ বিছানা নোংড়া করার অপরাধে মেয়েটার কাছ থেকে ওই ৩০০ ডলারও রেখে দিয়ে মেয়েটাকে বের করে দেয়। তারপর থেকেই মেয়েটা মানসিকভারসম্য হারিয়ে ফেলে এবং এখন প্রায় প্রতি রাতেই ধর্ষনের স্বীকার হয়। তবু যদি ধর্ষনকারী খাবার কেনার জন্যে ২-৫টা ডলার দেয়!

পাইরেটদের স্পেশাল কিছু কানেকশনস আছে, যখন কোনও কারণে এদের ঝামেলা হয়, ওই কানেকশনস কাজে লাগিয়ে এরা দ্রুত ইউরোপ, আমেরিকায় চলে যায়। ওই কানেকশনস সম্পর্কে এখানে লেখা স্পর্শকাতর বলে কিছুই উল্লেখ করলাম না। তবে কেউ জানতে চাইলে আমাকে ব্যাক্তিগতভাবে জিজ্ঞাস করবেন। কিন্তু লিখতে পারবো না, বলতে পারবো। খুবই ইন্টারেষ্টিং।

যাইহোক, দেলোয়ারকে জিজ্ঞেস করলাম যে তারা কি ভাবছেন। দেশে ফিরে যেতে চান নাকি অন্য কিছু? যদি দেশে ফিরে যেতে চান তবে আমি দূতাবাসের মাধ্যমে তার পরিবারকে খবর দেই টিকেট পাঠানোর জন্যে। দেলোয়ার বললো দয়া করে এটা করবেন না। আমরা দেখি পুন্টল্যান্ড সরকার কি করে। সরকার ডোনার খুঁজছে গারোয়ে-জিবৌতি-মাস্কাট টিকেটের জন্যে। দেলোয়াররা আরো অপেক্ষা করতে চায় যদি সরকার টিকেটের ডোনার পায় এই আশায়। বাংলাদেশে ফিরতে ওরা কোনমতেই রাজী নয়। আমাকে যদিও ওদের আত্মীয়স্বজনদের ফোন নাম্বার দিলেন তবে অনুরোধ করলেন ফোন না করতে। যদি ওরা মারা যান তবে যেন ফোন করি। এরপর আমি বললাম যে আমাকে যদি প্রয়োজন হয় তবে ওরা যেন আবদীমাহদীকে বলেন। তিনি ফোনে ধরিয়ে দেবেন। আমি আবদীমাহদীকে আমার কেনিয়ার ফোন নাম্বারও দিলাম যদি কোনও কারণে প্রয়োজন হয় কারণ আমাকে ১৯ তারিখ কেনিয়া যেতেই হবে, এবার আর পিছানোর উপায় নেই। আবদীমাহদী আমাকে বললেন যে এরা আপনার ইমপ্যাট্রিয়েট, আমি এদের জন্যে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবো। সরকারের সাথে কথা বলবো। আপনি নিশ্চিন্তে চলে যান। কেনিয়া যাবার আগে আমি আরও ২ জন পরিচিত ডিরেক্টর জেনারেলের কাছে অনুরোধ রাখলাম যেন তারা ওদের বিষয়টা একটু দেখেন। তারাও কথা দিলেন যে যতদুর সম্ভব তারা দেখবেন। আমি আসাদকে বলে গেলাম বিষয়টার দিকে একটু খেয়াল রাখতে।

আবদীমাহদী ও আইয়ানলের অনেক চেষ্টার ফলে পুন্টল্যান্ড সরকার ওদের ৬,০০০ ডলারের একটা অনুদান দিয়েছেন ট্রলার মেরামত করার জন্যে। আর সরকার লোক মারফত পাইরেটদের সাথেও একটা রফা করেছেন যে ওমানে ফেরার পথে যেন ওদের আবার ধরা না হয়।

শেষ কথায় আসি, আসলেই তো, দেশে ফিরে গিয়ে ওরা কি করবেন? ওরা চারজনই খুব গরীব পরিবারের সন্তান। জমি বেচে-বন্ধক রেখে বিদেশে এসেছেন। এখনও ঘাড়ে অনেক দেনা, মাসে মাসে শোধ করতে হচ্ছে। আর এই অবস্থায় যদি দেশে ফিরে যেতে হয়, পাওনাদার তো বন্ধকী জমি কেড়ে নেবে। আর অন্য পাওনাদাররা যে কি করবে তার ঠিক নেই, তবে নিশ্চিত মার খেতে হবে। আর তারপর? পুরো পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে।

বিঃদ্রঃ বিবিসি-র এই লিংটায় ক্লিক করলে পাইরেটদের সম্পকে কিছু তথ্য পাবেন: http://news.bbc.co.uk/2/hi/africa/8103585.stm


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

চতুর্থ প্যারায় এসে তাল কেটে গেল। দেখি, পরে আবার পড়তে হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

পিপি ভাই, ধন্যবাদ যে অন্ততঃ ওইটুকু পড়েছেন। আমি আমার নিজের মতো করে লিখি আর তাতেই লেখা বড় হয়ে যায়। তবে এখানে যা'ই লিখেছি, নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি।

রাতঃস্মরণীয়

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আমার মনে হয় প্যারালাল ঘটনার বর্ণনা দিলে পার্থক্য-বোধক চিহ্ন থাকলে বুঝতে সুবিধা হয়।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আপনার অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে সিরিজ আকারে লেখা পড়তে ভালো লাগবে।
তবে পর্বগুলো যদি ছোট হয়, তাহলে মনে হয় মনোযোগ ধরে রাখতে সুবিধা হবে পাঠকের।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আরিফ ভাই। আরো দুএকটা বড় লেখা আছে, তারপরেরগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট। আমি ফেসবুকে একটা সিরিজ লিখছি "ভবঘুরের পায়ে পায়ে" নামে। ৬ টা পর্যন্ত পোষ্ট করেছি। এখানে লিখছি মূলতঃ বড় পাঠকগোষ্ঠীর সামনে উপস্থাপন করার জন্যে। তবে আমি স্থির না। হয়তো হঠাৎ করেই লেখা বন্ধ করে দেবো। আগে যেমন অনেকবার করেছি। তবে আপনাদের অনুপ্রেরণাতেই লিখি। ভালো থাকবেন ভাই।

রাতঃস্মরণীয়

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

রাতঃস্মরনীয় ভাই, আপনার এইসব অভিজ্ঞতা নিয়ে সিরিজ শুরু করেন।

কিন্তু আমি শকড মেয়েটির এই র্দুভাগ্য দেখে। মেয়েটির এই ঘটনা শুনে বিশ্বাস করেন আমার হা-পা কাপছিল।

দুর্দান্ত এর ছবি

লেখাটি ভাল লেগেছে। শেষের দিকে হঠাত বাংরেজী বাড়তে থাকায় হোঁচট খেয়েছি। আপনার অভিজ্ঞতার কথা আরো লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

শান্ত ভাই ও দুর্দান্ত ভাই, আপনাদের মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, প্রেরণা পাচ্ছি।

রাতঃস্মরণীয়

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এ্যাজ প্রমিজড, পুরোটা পড়লাম। আপনার জীবন তো অভিজ্ঞতায় ভরা। ভালো লাগলো। এরকম বর্ণনা আরো পড়তে চাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

পিপি ভাই, কিছুক্ষন আগের ঘটনা শোনেন-

বাইরে গিয়েছিলাম। একসময়ে আমার দুইজন কমান্ডো এসে সিগারেট চাইলো। বক্স খুলে দেখি সিগারেট আছে মোট দুটো। ওরা দুজনেই বললো আমাকে একটা রেখে দিতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাকী একটা কে টানবে, ওরা তো দুজন। আর ওরা আমাদের মতো বিড়ির পাছা টানেনা। একজনেই একটা টানে। এ ওকে বলে যে তুমি টানো আবার ও একে বলে যে তুমি টানো। শেষমেশ রফা হলো যে আগে আমার কাছে সিগারেট চেয়েছে সে'ই টানবে। প্রবলেম সলভড্‌।

রাতস্মরণীয়

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

আমি একটানে পড়ে গেলাম! এখন পুরাই বাকরুদ্ধ। মন খারাপ
আর মেয়েটার কথা জেনে আমার মন মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল।
আপনি অনুগ্রহ করে এই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে আরো লিখুন। আর ছোট ছোট পর্বের সিরিজ করলে ভালো হয় আসলে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।