বুনো জ্যোৎস্নায় মাতাল উপত্যকা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৬/১২/২০১২ - ৩:১৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সারা উপত্যকা জুড়ে আজ মাতাল জ্যোৎস্না আর ঘোরলাগা বসন্ত ।

বসন্তের এমন সুগন্ধিমাখা জ্যোৎস্নারাতে ঘুম আসেনা উপত্যকার ঘোরলাগা মানুষগুলোর । তারা জেগে থাকে জ্যোৎস্নায় ডুবে ,আর ফুলের মোহে কাতর হয়ে । তাদের কোমল হৃদয় ছুঁয়ে জ্যোৎস্না নামে, তাদের নিদ্রালস চোখ জুড়ে স্বপ্ন দোলে । প্রস্তর পৃথিবীর প্রাণজাগা এই উপত্যকায় দৃষ্টি ফেললে চোখে পড়ে এখানে ওখানে জ্বলছে কিছু আলোকমশাল । কিন্তু মশাল ঘিরে মানুষ স্থির বসে নেই । তারা আজ বসন্তের হওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝর্ণার তীরে, পুস্পশোভিত বাগানে বাগানে, কেউবা নিদ্দ্রাহীন চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে জোয়ার আসা চাঁদের দিকে ।
উপত্যকার চারপাশ ঘিরে নিবিড় অরণ্য, সেখান থেকে ভেসে আসে আরণিক শব্দমালা, প্রাগৈতিহাসিক জন্তু জানবদের শিকারের আওয়াজ । এই মানুষগুলো জানে কাল সকালে হয়ত তাদের কোন একজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না ; তারা বুঝে নেবে তাকে আর কখনই খুঁজে পাওয়া যাবে না । এরপর হয়তো শিকারে যেয়ে অরণ্যের বুকে খুঁজে পাওয়া যাবে ভয়ে গুঁড়িয়ে যাওয়া বিষণ্ণ তার হাড়গোর । তবে এসব ভেবে আজ ভীত নয় উপত্যকাবাসীরা । এই রাতে তাদের প্রাণে যে জোয়ার এসেছে তাতে ধুয়ে গেছে সমস্ত ভয় সমস্ত অন্ধকার ।

কান পাতলে শোনা যায় ঝুম নিঝুম রাতের নিঃশ্বাস আর মাদলের একটানা ...ডুং ...ডুডাং ...ডুং নিনাদ ।

ছোট ঝর্ণার জল নিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর স্বচ্ছ বুক চিকচিক করছে.....
সেখানে চোখ রেখে পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে এক প্রস্তর কুমারী ।
পেছন থেকে দেখলে তাকে যেন হিম হয়ে যাওয়া কুয়াশা বলে মনে হয় !
তার চোখে চোখ না রেখেই বলা যায় - ঐ চোখে ভাসা চাঁদের ছায়া নেই
পুস্পিত সৌন্দর্যের আভা নেই ; আছে নিদ্রাহত রাএির কর্পূর বিবর্ণতা ।

কাঁপা বসন্তে , ডোবা জ্যোৎস্নায় মেয়েটির চোখে কুয়াশা কেন ?
উত্তর কারো জানা নেই ; - না মেয়েটির, না আমাদের । মেয়েটি কেবল জানে অজানা এক ঢেউ তাকে ভাসিয়ে নিতে চায় ; - সেই ঢেউ হঠাৎ আসে ; হঠাৎ এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়, শূন্যতার অতলে নিক্ষেপ করে ।

সেই ঢেউ সেই শূন্যটা এখন তার বুকে ; যদিও জ্যোৎস্নায় প্লাবিত মেয়েটির গোটা মুখ ।

ডুবে যাওয়া জ্যোৎস্নায় ডুবে যাওয়া কুয়াশায় মেয়েটি বসে থাকে শূন্যতার অস্পষ্ট এক আদল নিয়ে । মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে ওঠে নিরেট পাথরের উপর নিথর তার সপ্তদশী অবয়বটি । তখন বোধহয় সেই দীর্ঘশ্বাস শুষে নেয় গভীর রাত্রি । মেয়েটি স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে জলে প্রতিফলিত উজ্জ্বলতার দিকে ; যদিও সেই উজ্জ্বলতা তার চোখে কোন প্রতিভাস এঁকে দেয় না । ডুবে যাওয়া জ্যোৎস্নায় ডুবে যাওয়া কুয়াশায় মেয়েটি ডুবে থাকে অপার্থিব অমল অন্ধকারে ; সেই আঁধার কেটে যায় এবং সেই আঁধার কেটে গেলে গাঢ় নীলের গভীরে চিরকাল থেকে যায় ।
মেয়েটি যে পথ ধরে নদীর পাশে এসেছিল হঠাৎ দেখা যায় সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে আবছা একটি মূর্তি । জ্যোৎস্না রাতের মতোই রহস্যময়তা তার দুই চোখে এবং সে নির্ভার স্বচ্ছন্দ পায়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে । ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালে চিকচিক জ্যোৎস্না তাকে চমকে দেয় । কিন্তু যে প্রগাঢ় দৃঢ়তা তার পদক্ষেপে ছিল সেই দৃঢ়তা নিবিঢ় করে সে এবার মেয়েটির দিকে তাকায় । মেয়েটি তার উপস্থিতির খবর জানে না । তাই ছেলেটি তার বরফ ঘষা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে জ্যোৎস্নায় পুড়তে থাকা মেয়েটির উদাস কালো চুলের দিকে । সেই চুলের দিকে তাকালে চোখে ঢেউ লাগে না বরং একপ্রস্থ অন্ধকার নেড়েচেড়ে জাগিয়ে তোলে ভেতরের শূন্যতা । তবে ছেলেটির গভীরে আজ যে দুর্বার রঙ ছড়িয়ে পড়েছে সেটা কিছুতেই মুছে যাবার নয় এবং অনেকক্ষণ পর সেটিই হয়তো মেয়েটিকে স্পর্শ করতে শুরু করে ।

মেয়েটির মনে হয় সে আর একা নয় ; যদিও সামনে সে কাউকে দেখতে পায় না বা মাথা ঘুরিয়ে পেছনেও তাকায় না ; তবুও রাত্রির অতল বুক থেকে উঠে আসা নির্বাক স্রোতমালা তার অন্তরে এমন ভাব জাগায় - তার মনে হয়, রাতের এই প্রান্তরে সে আর একা নয় । অতঃপর নির্ভার মন নিয়ে মেয়েটি স্থির তাকিয়ে থাকে চিকচিকে জলে - পোয়াতি চাঁদের উপচে পড়া মুখের দিকে । সেই মুখ শান্ত ভরাট আর গাঢ় রাত্রির মত নিঃসঙ্গ সমাহিত ।
ছেলেটিও তখন তাকিয়ে থাকে আকাশে - জ্বলতে থাকা , মানুষের স্বপ্নময় মৃত্যুকূপটির দিকে ।
এইভাবে সময় কেটে যায় এবং অনেক সময় কেটে গেলে , একসময় জ্যোৎস্নারাত মেয়েটি ও ছেলেটির মনে এক অভিন্ন ভাবের সৃষ্টি করে ।
যদিও মেয়েটি তখনও জানে নি ছেলেটির নিকট উপস্থিতির কথা আর ছেলেটিও তখনও ছুঁয়ে দেখেনি মেয়েটির শূন্যতা ।

রনি আতিক ০৫/১২/১২


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

#অনেক সুন্দর লিখেছেন, শুভেচ্ছা আপনাকে রনি আতিক, ভাল থাকুন হাসি

আশরাফুল কবীর

guest_writer এর ছবি

কষ্ট করে পড়ার জন্যে ধন্যবাদ, ভালো থাকুন সবসময় ।

রনি আতিক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।