শাহবাগের প্রজন্ম চত্ত্বরে গড়ে ওঠা আন্দোলন আমাদের গোটা জাতিকে একটি ক্রান্তিকালীন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে! আজকে সময় এসেছে আত্ম-উপলব্ধির, সময় এসেছে আত্ম-সমালোচনার, সেই সাথে শত্রু মিত্র-কে বোঝার – যা আমাদেরকে ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা প্রদান করবে।
এই গণজ়োয়ারকে অস্বীকার করবার উপায় নেই। ধারনা করবার অবকাশ নেই যে এটি নিছক একটি দলের বা কিছু বিশেষ দলের কর্মী সমর্থকদের সাংগঠনিক প্রচেষ্টার ফসল। এই আন্দোলনের সৃষ্টি, আর বিকাশের সাথে মিশে আছে সাধারন জনগণ। সেই জনগণ যারা গার্মেন্টস-এর আগুনে পোড়ে, স্টক মার্কেটে নিঃস্ব হয়, যারা সড়ক দুর্ঘটনাতে প্রিয়জনকে হারায়; বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লোড সেডিং, দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি যাদের নিত্য সংগী। তারা সব জানে, সব বোঝে, তারপরেও তারা ফুঁসে উঠে না। তাই বলে তারা চিরকাল নীরব থাকবারও পাত্র নয়। অনেক দিন পরে তারা সুযোগ পেয়েছে হৃদয়ের রক্তক্ষরণে পরিশুদ্ধ হবার, অতীত প্রজন্মের সাফল্যকে অর্থবহ করার, একই সাথে তাদের ব্যার্থতার ঋণ শোধ করার।
এই আন্দোলন আবার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে বাংলাদেশের মানুষ প্রচলিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে পুরোপুরি একাত্ম হতে পারছে না। দুটি প্রধান দলের কর্মকাণ্ডে সাধারন জনগনের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটছে না। জনগণের ইচ্ছাকে যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ বা প্রতিফলন করতে না পারে তবে সেই নেতৃত্বের ধ্বংস সময়ের ব্যাপার মাত্র। ৫২-র ভাষা আন্দোলনের সাথে একাত্ম হতে পারে নি বলে মুসলিম লীগকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল।১৯৫৪-র নির্বাচনে তাদের ভরাডুবী থেকে তারা আর উঠে আসতে পারে নি। বিএনপি ২০০৮-এর গণমানুষের আকাংক্ষাকে বুঝতে পারে নি, পড়তে পারেনি তাদের মনের ভাষা, জামায়তের সাথে তাদের সখ্যতাকে বাচিয়ে রেখেছিল প্রবল জনরোষের বিরুদ্ধে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি-র দুঃসময়ে যদিও জামায়াত নিরাপদ দুরত্ব রেখে চলেছিল, নির্বাচনে বিএনপি জামায়তকে পুরস্কার দিতে কার্পণ্য করে নি। এর ফলশ্রুতি সবার জানা। তারপরেও শিক্ষা বিএনপি পায় নি। আজ়ও তারা একই ভুলের পথে পা বাড়িয়েছে।
একটি পতিত বা পতনশীল দলের সবচেয়ে বড় শত্রু হতে পারে তার বলয়ভূক্ত বুদ্ধীজিবী সম্প্রদায়। গণদাবীর বিরুদ্ধে চাটুকার পণ্ডিতম্মন্য সুশীল সমাজ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভুল পথে চালিয়েছে – এহেন উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় পাতায়। আজকের মাহমুদুর রহমান বা পিয়াস করিমরা গণমানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য ভবিষ্যতে নিন্দিত হবেন। জামায়াত ইসলামীকে বাঁচানোর কুটকৌশল চালাবার জন্য ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।পিয়াস করিম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, প্লাটফরমে একটি প্রগতিশীল ভরম ধরে জামায়তকে সমর্থন করেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন মানবতাবিরোধী বিচারকে সমালোচনা করে।নিজের প্রতিক্রীয়াশীল রূপ লুকিয়ে সুচতুরভাবে নিজেকে প্রগতিবাদী হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।এমনকি শাহবাগ আন্দোলন যখন আঁতুড়ঘরে তখন তার প্রিয় আমার দেশ পত্রিকা-তে লিখেছেন – “জনপ্রিয় আন্দোলন থেকেও ফ্যাসিবাদ জন্ম নিতে পারে”। যখন সারা দেশের মানুষ একটি অভিন্ন বিষয়ে এক হয়েছে, তখন তার মত পচনশীল ভূইফোঁড় বুদ্ধীজিবীর পক্ষেই এমন জনবিরোধী অবস্থান নেয়া সম্ভব।জামায়াত ইসলামী একটি ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী, তাদের ইতিহাস, গঠনতন্ত্র আর রাজনৈতিক দর্শনকে হিটলারের নাজ়ী দল বা মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট পার্টির সাথে তুলনা করা সম্ভব।সেই জামায়তকে সমর্থন করে আজকের শাহবাগের শান্তিকামী তরুণদেরকে ফ্যাসিবাদী বলাটা শুধু হাস্যকরই নয় বরং ধৃষ্টতাপূর্ণ। এ ব্যাপারে পিয়াস করিমের দোসর মাহমুদুর রহমান তার নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দেওলিয়াপনা-কে আবার প্রমাণ করলেন।সম্প্রতি বাংলা লিক্স-এ প্রচারিত হওয়া তার অডিও রেকর্ড থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় কতখানি নীচু মন নিয়ে তিনি সাংবাদিকতা করেন আর কত ঘৃণ্য তার দৃষ্টিভংগী শাহবাগ আন্দোলনকারীদের প্রতি। তার আমার দেশ পত্রিকা অল্প সময়ের মধ্যেই শাহবাগের উত্তাল তরুণদের ঘৃণার পাত্র হয়েছে। তারপরেও পত্রিকাটি নির্লজ্জভাবে বিভ্রান্তিকর খবর ছাপিয়ে যাচ্ছে।জামায়তের প্রতি তার অকুন্ঠ ভালবাসা আজ আর কারও অজানা নয়, এমনকি জামায়তকে প্রশংসা করতে গিয়ে তার নেত্রী ম্যাডাম জিয়াকে তাচ্ছিল্য করতেও তিনি পিছুপা হন না।
আরেকদল সুবিধাবাদী আছেন, যারা কিছুদিন আগেও মধ্যরাতের TV Talk Show মাতিয়েছেন ট্রাইবুনাল-কে সমালোচনা করে, জ়ামাতী নেতাদের পক্ষ নিয়ে, তাদেরকেও চিনে রাখা দরকার, যদিও তারা এখন পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত।তারা কখন যে কাদের সেটাই বোঝা ভার।আসিফ নজরুল-কে এই প্রাণীভূক্ত বলে গন্য করা যেতে পারে। কয়দিন আগেও সুচতুরভাবে আসিফ নজরুল একটি TV Talk Show তে বলেছিলেন যে সাঈদী যুদ্ধাপরাধী ছিল না।এখন তিনি সুর পালটে ফেলেছেন।একইভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে ত্যানা পেচিয়ে যাচ্ছেন অনেক সুশীল ব্যাক্তিবর্গ। সময় সুযোগ পেলেই তারা ফিরে যাবেন তাদের আসল রূপে।
অতীতে আমরা অনেক গনবিরোধী বুদ্ধিজ়ীবিদের চিনতে পারি নি, তাদের ডিগবাজী দেখেছি, আবার ভুলে গেছি, তারা রঙ বদলে সমাজে পুনর্বাসিত হয়েছে, এবং সমাজকে কলুষিত করেছে।
আশা করি – আজকের শাহবাগ কেন্দ্রিক এই বিপ্লব মানুষের চোখ খুলে দিবে। এভাবেই শিক্ষিত বিদ্যানদের আর তাদের অর্ধশিক্ষিত রাজনৈতিক প্রভুদের স্বরূপ উন্মোচিত হবে সাধারন মানুষের কাছে, যারা তাদের সচেতনতা দিয়ে প্রতিরোধ করবে এই দুষ্টচক্র। নেতাদের প্রত্যাখান করা হবে ব্যালটের মাধ্যমে, যেমনটি করা হয়েছে অতীতে।
আর ফাঁপা ডিগবাজীবিদ বিদ্যানদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। তারা যেই পত্রিকা-তে লিখবে সেই পত্রিকা কেউ পড়বে না, যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে সেখানে ছাত্ররা এবং অন্য শিক্ষকরা প্রতিরোধ করবে, তাদের সাথে কেউ TV talk show তে যাবে না, তাদেরকে কেউ কোন সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আনবে না। জাতিকে বিভ্রান্ত করার অপরাধে এবং জাতীয় চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার দায়ে তাদের উপর সামাজিক বয়কট আরোপ করা হবে। তাহলেই শাহবাগ আন্দোলন থেকে একটি সামাজিক অর্জন সম্ভব হবে।
মন্তব্য
ম্যাডামকে তাচ্ছিল্য করলেও ম্যাডাম কিন্তু ওনাদের ভারি ভালবাসেন।
--------------------------------
বানান ভুল থাকলে ধরিয়ে দিন!
আমার মনে হয়, এইসব বুদ্ধিজীবিদের নাম টুকে রেখে তা প্রকাশ করা উচিত। সাথে তাদের অবস্থান এবং বক্তব্য তুলে রাখা প্রমাণ হিসেবে। এতে পরবর্তিতে তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
স্বয়ম
ভাল লাগলো
খুব সুন্দর লিখেছেন। আরো লেখা প্রত্যাশা করছি।
নতুন মন্তব্য করুন