পাষাণপুরী ( পর্ব -৩)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৮/০২/২০১৩ - ১১:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্ব - http://www.sachalayatan.com/node/48180
আফসার মুক্তিযুদ্ধে দেয় এবছরের জুনে। বেশ ভালো ট্রেনিং সে এতিমধ্যে নিয়ে ফেলেছে। রণাঙ্গন হিসেবে বেছে নিয়েছে কুষ্টিয়া। দেশের হয়ে লড়াই করা যাবে। সেই সাথে পরিবারের আশেপাশে থাকা যাবে। কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার পর সে চলে আসে কাশীপুরে। যোগ দেয় আজিমের গেরিলা দলে।
মধুপুর গ্রামে আফসারের অবস্থান সম্পর্কে রিনা ইতিমধ্যে জেনে গেছে। কিন্তু, তার বাবা-মা এখনো বিষয়টি জানে না। রিনাকে বলতে নিষেধ করেছে। রিনা বলে নি। তার জীবন গেলেও সে কাউকে বলবে না, এটা আফসার জানে। রিনা ব্যতিত কেবল দুজন মানুষ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে অবগত। তারা হল বকুল ও সুস্মিতা।
বকুল, রিনাদের প্রতিবেশী। রিনার শ্বশুরবাড়ির পাশে কাঁচাপাকা রাস্তা। তার অপর পাশে বকুলদের বাড়ি। বকুল আফসারের সমবয়সী। সে আফসারের ছোট বেলার বন্ধু। পেশায় স্কুল শিক্ষক। আফসারের বাবার প্রায়মারী স্কুলে সে শিক্ষকতা করে। বকুলের বাবা-মা বছর পাঁচেক আগে গত হয়েছেন। তার কোন ভাইবোন নেই। বাড়িতে কেবল সে আর সুস্মিতা থাকে। সেই সাথে আছে একটি ১২ বছর বয়সী কাজের মেয়ে।
বকুল মনে প্রানে একজন মুসলমান। গ্রামে তার নামে কেউ কোনদিন সুনাম ব্যতিত দুর্নাম করে নি। কিন্তু, চাঁদের কলঙ্ক যেমন আছে। বকুলেরও আছে। যদিও সেই কলঙ্ককে বকুল তার জীবনের সেরা অলংকার বলে মনে করে। সে হল সুস্মিতা। সুস্মিতা হিন্দুর মেয়ে। প্রেম করে বিয়ে করেছে এ বছরের জানুয়ারি মাসে।
হিন্দু মুসলমান বিয়ের ব্যাপারটা গ্রামবাসী খুব একটা ভাল ভাবে নিতে পারে নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষেপেছিল গ্রামের বর্তমান রাজাকার মজিদ খা। তার একটাই কথা, গ্রামে এই পাপ থাকতে দেয়া যাবে না। তার সমাধান যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত। বকুলকে তালাক দিয়ে সুস্মিতাকে আগে মুসলমান হতে হবে। বিয়ে করতে হবে গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক লোকটিকে। হিল্লা বিয়ে। তারপর সেই বুড়োকে তালাক দিয়ে পাপমুক্ত হতে হবে। তারপর আবার বকুলকে বিয়ে করতে হবে। পবিত্র বিবাহ। যদিও মজিদের এ প্রস্তাবনাতে ধর্মের আসল রীতির যে বিকৃত সাধন হয়েছে, এই নিয়ে মসজিদের ইমাম বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু, মজিদ গ্রামে যে কোন বিষয়ে আর সকলের চাইতে বেশি বোঝে।
বর্তমানে হিল্লা বিয়ে করার অধিকার পাবে ৮৫ বছর বয়স্ক আকবর বুড়ো। অবশ্য তার ৩৫ বছর বয়সী একটি বৌ বর্তমান আছে। ৮৫ বছর বয়স হলেও সে সন্তান জন্ম দানে যথেষ্ট সক্ষম। পুরুষের প্রতি খোদার এ এক অসীম দয়া। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পুরুষ সৃষ্টিশীল। তবে, হিল্লা বিয়ে করা যে মজিদের নিজ মনের গোপন ইচ্ছা এ ব্যাপারে গ্রামবাসীর মনে তেমন কোন সন্দেহ নেই।
বকুল এসবে কান দেয় নি। সুস্মিতার সঙ্গে তার ঘরসংসার বেশ ভাল ভাবেই চলছে। সুস্মিতা মুসলমান হয় নি ঠিকই তবে সে হিন্দু ধর্মের কোন আচার অনুষ্ঠান বাড়িতে করে না। তার স্বামীর সমস্যা হতে পারে, একথা ভেবে। যদিও তার স্বামী কখনো এসব ব্যাপারে তাঁকে কোন কথা বলে নি। তবে, সুস্মিতা মাথায় সিঁদুর পড়ে। এটা তার মনের শখ। বিবাহিত হিন্দু মেয়ে আর কিছু করুক আর না করুক, মাথায় সিঁদুর দেবে না, এটা হয় না।
তবে, প্রথম দিকে সিঁদুর পড়া গ্রামে ব্যাপক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। গ্রামবাসী ধারণা করতে শুরু করে, বকুল হয়ত হিন্দু হয়ে গেছে। সুস্মিতা হয়ে যায় গ্রামের রাক্ষসী। মুসলমান এতিম ছেলেকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাঁকে হিন্দু বানিয়েছে।
সুস্মিতা সিঁদুর পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু বকুল চায় না, মানুষের কথা শুনে সে তার ইচ্চা বিসর্জন দিক। সে কারো কথার ধার ধারে না। বরং বকুল মনে মনে তার স্ত্রীর সিঁদুর পড়ার বিষয়টি পছন্দ করে। পছন্দ করে তার শাড়ি পড়ার ধরন। সে যে যুদ্ধে যেতে চেয়েও পারে নি, এর কারণ সুস্মিতা। মেয়েটি কিছুতেই তার স্বামীকে চোখের আড়াল হতে দিতে চায় না। সে বেশ আল্লাদি স্বভাবের। বকুল ছাড়া তার আর কিছুই নেই। অসম্ভব রূপবতী এই মেয়েটি পরিবার থেকে বিতাড়িত। বকুলকে বিয়ে করার কারণে তার বাবা-মা তাঁকে ত্যাজ্যকন্যা করেছে। বকুলের কেউ নেই। তারও কেউ নেই। বকুল তার সমগ্র পৃথিবী। সে চাই না, তার সেই পৃথিবীতে কোন প্রলয় আসুক।
সুস্মিতার কথা চিন্তা করে বকুলের সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া হয়ে ওঠে নি। কিন্তু, এখন তারা দুজন মিলে যা করছে, তা সম্মুখ সমরের চাইতে কোন অংশে কম নয়। বকুল শিক্ষকতা করে রোজগার করে। সুস্মিতা ছয় জনের খাবার রাধে। বাড়ির তিনজন সহ গ্রামে আগত তিন মুক্তিযোদ্ধার। আফসার, আজাদ ও কামাল।
বকুল স্কুলে গেলে মাঝে মাঝে বাসাবাড়ির কাজ শেষ করে সুস্মিতা ঘুরতে যায় রিনাদের বাসায়। রিনার সাথে তার খুব ভাল সম্পর্ক। রিনা প্রায় আসে তার বাড়ি। রিনার শ্বশুরবাড়িতে রিনার তেমন কোন কাজ নেই। সারাদিন বই পড়া বা বাবুর সাথে খেলা করা। আর না হলে শ্বশুরশাশুড়ির সাথে বসে আড্ডা দেয়া। এই রিনার জীবন।
সুস্মিতার বাড়ির দরজাতে খটখট শব্দ। এই বেলাতে কেবল রিনা আসে। আর কারো আসার কথা না। সুস্মিতা মনে মনে খুশি হয়। দ্রুত দরজার কাছে যায়। দরজা খোলে। কিন্তু, এত রিনা নয়। এ হল মজিদ খান। খা সাহেব। দুজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে সে হাজির। বকুল বহুবার সুস্মিতাকে বলেছে, দরজা খোলার আগে নাম জিজ্ঞাসা করতে। সুস্মিতা এই ভুলটি প্রায় করে। আজও করল। খারাপ মানুষকে দেখাটাও একটা খারাপ অভিজ্ঞতা।
কি ব্যাপার, হিন্দুরানী ? কেমন আছো ?
আপনি ?
তোমাদের দেখতে আইলাম। গ্রামে থাকো। আমাগো তো একটা দায়িত্ব আছে।
ভাল আছি। এরপর খোঁজ খবর নিতে চাইলে বিকেলের পর আসবেন। এখন বকুল বাড়ি থাকে না। আর কিছু ?
না, আর কিছু না। ঠিক আছে, আমি যাই। তবে, তোমার সিঁদুর পড়া এখনো বন্ধ হইল না।
আপনাদের কি কোন সমস্যা হয় ?
না, আমার না। তয়, সমাজে সমস্যা হয়। তুমি কোন রূপের যাদুতে বকুলের মত একটা পোলারে বশ কইরা যে দোযখের পথে নিয়া গেলা, সেটাই বুঝি না।
কি করার আছে, বলুন? দোযখে তো আমাদের মত মানুষেরা যাবে। আমরা স্বর্গে গেলে, সেখানে আপনাদের ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আমার স্বামী চায় আমার সাথে দোযখে যেতে। তাঁকে যেতে দিন। আপনি স্বর্গে শান্তিতে থাকেন।
এত তেজ ভাল না। মুরব্বী মানুষের সাথে কেমনে কথা বলতে হয় তা জানো না ?
না। আপনার কোন কাজ না থাকলে যেতে পারেন। আমার কাজ আছে।
খুব বিরক্ত হইলা, মনে হয় ?
না। বিরক্ত হই নাই। খোঁজ খবর নেবার জন্য ধন্যবাদ।
তয়, একটা কথা জিগাই। তোমার বাপ-মা কেমন আছে ?
ভাল।
ভাল আছে বলে তো মনে হয় না। তোমার সাথে তাগো সম্পর্ক নাই বইলা শুনছিলাম।
ভুল শুনেছেন। তারা ভালই আছে ।
এখন তো ভাল থাকবোই। তমাগো দেশ তো এই দেশটারে দখল করতে চায়।
আমাদের দেশ মানে ? এটাই তো আমাদের দেশ।
মজিদ তার দু’সহচরের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাঁসি দিল।
এই মেয়ে কয় কি ! তোমাগো দেশ তো হিন্দুস্থান।
আমরা কি হিন্দুস্থানে থাকি ? আমাদের কোন পূর্বপুরুষ হিন্দুস্থানে গেছে বলে তো মনে হয় না।
তোমাদের কাবাতো হিন্দুস্থানে।
সৌদি আরব পাকিস্তানের আশেপাশে হলে কি আপনারা নিজেদের সৌদি বলে পরিচয় দিতেন ?
মজিদ আবার মুচকি হাসলো।
কি যে কও ! তোমরা এই দেশে আইছো এই দেশটারে শেষ করতে। তোমাদের পাঠানো হইছে। বকুলের মত পোলাপানগুলোর মাথা খাইয়া এই দেশটারে হিন্দুস্থানের বাজার বানাইতে।
আপনি দয়া করে এবার যান। আমার কাজ আছে।
ঠিক আছে। তোমার সাথে কথা কইলে আমার চলবো না। আমারো অনেক কাজ আছে। দেশের কাজ। তয়, এতদিন বিয়া হইলো, পোয়াতি হইবা কবে ?
আপনি যান। আমি দরজা বন্ধ করবো।
ঠিক আছে। তয় দেখুম, পোলাপান হইলে তারে হিন্দু বানাও নাকি মুসলমান বানাও।
পোলাপান হলে তারে মানুষ বানাবো। এটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।
সুস্মিতা দরজা বন্ধ করে দিল। মজিদ রাগান্বিত হয়ে হাঁটতে শুরু করলো। তার এক সহচর ছাতা ফুটিয়ে তার মাথার উপর ধরে আছে। তার পাশে হাঁটছে। সাথে আছে আরো একজন। তার নাম জামাল। সে মজিদের অতি বিশ্বস্ত। পবিত্র ডান হাত। বা হাত বলা যাবে না। বা হাত অপবিত্র। তা দিয়ে শৌচ কাজ সম্পাদিত হয়। তবে, জামাল মজিদের জন্য এখন পর্যন্ত কোন পবিত্র কাজ করেছে বলে কারো জানা নেই।
মন্দ লোকের সহচরে অভাব হয় না। তারা অধিকাংশ সময় একতাবদ্ধ থাকে। ভাল হতে সময় লাগে। মন্দ হতে তেমন লাগে না। মন্দ হওয়া তুলনামুলক ভাবে সহজ। মন্দ হতে শুধু মন্দ মানুষের সঙ্গে থাকলেই হয়। পীরের সহচরেরা খুব কমই পীর হয়। সাধু হয়। কিন্তু, শয়তানের সব সহচর যে শয়তান হয়, এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
গ্রামের মানুষ জামালকে জানোয়ার বলে ডাকে। একদা জামাল ছিল পাশের গ্রামের ছিঁচকে চোর। ছোট বেলা থেকেই চুরি করতো। গ্রামের বাজারে ভীরের মাঝে এটা সেটা চুরি করতো। বয়স বাড়লে তার পদোন্নতি হয়। তখন সে মসজিদের জুতা চোরের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়।
একসময় বিয়ে করে। বয়স বেড়েছে বলে কথা। তারও তো জৈবিক চাহিদা আছে। এই চাহিদার বাধনে সবাই বাধা। কেউ তা উপেক্ষা করতে পারে না। যে পারে, সে হয়ে যায় সন্ন্যাসী। জামাল চোর হতে পারে, কিন্তু সে একজন মানুষ। রক্ত মাংসের মানুষ।
বিয়ে করে কুষ্টিয়া সদরে। তার বৌ কুষ্টিয়া সদর বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে থাকতো। খারাপ মেয়ে ছিল। জামালকে বিয়ে করে পবিত্র হয়েছে। মজিদ খা নিজে তার পাপ মোচনের তওবা পড়িয়েছেন।
জামালের সাথে মজিদের পরিচয় হয় নাটকীয়ে ভাবে। বিয়ের পরে সংসারের চাহিদা মেটাতে জামাল শুরু করে সিঁদেল চুরি। রাতের আধারে স্বতন্ত্র ডাকাতি।
চুরিবিদ্যায় সে ছিল একরকম অব্যর্থ। শুধু একবারই পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। গ্রামের বাজারে। সবাই মিলে তাঁকে গণধোলাই দিয়েছিল। সেটা ছোটবেলার কাহিনী। ছোটবেলায় হোঁচট না খেলে জীবনে দৌড়বে কিভাবে ?
সেবার মজিদ খা তার জীবন বাঁচিয়েছিল। তার স্পষ্ট মনে আছে। তারপর বহুকাল দেখা হয় নি।
বড় হয়ে সিঁদেল চুরি করতে সে ঘটনাক্রমে যায় মজিদের বাড়ি। কিন্তু মজিদের ছেলের হাতে ধরা পড়ে। মজিদের মাদকাসক্ত ছেলে তার হাড় মাংস এক করে দিয়েছিল। দয়াময় মজিদ আবার তার জীবন রক্ষা করে। জামাল অবাক হয়। এই নিয়ে দুবার দয়াময় মজিদ তাকে যমের হাত থেকে বাঁচালো।
মজিদ খা অতঃপর জামালের জীবন কাহিনী শুনে মুগ্ধ হয়। সে তাঁকে দীনের পথ দেখায়। এখন তার পড়নে থাকে পাঞ্জাবি। মুখে খোঁচা খোঁচা জামাতি দাড়ি। কিন্তু, ছুঁচোর গায়ে আতর দিলেও, ছুঁচোর গন্ধ যায় না।
জামাল মৃদু স্বরে মজিদকে বলে, “হুজুর, যদি আজ্ঞা দেন, একটা কথা বলি ?”
বল।
হুজুর, মাইয়ার তেজ দেখছেন !!
দেখলাম। বেয়াদব মাইয়া। শরীর থেইক্যা হিন্দু হিন্দু গন্ধ বার হচ্ছিলো। আজাবী গন্ধ। কম বয়সী যুবক পাগল করা গন্ধ।
হুজুর আপনারে সে সালাম পর্যন্ত দেয় নি। এটাই আমার কষ্ট।
সালাম দিব কেমনে? নাপাক মাইয়া।
তয়, হুজুর, হিন্দু মাইয়ারা ভাল সংসারী হয়। তাগো কাছে পতি পরমেশ্বর। স্বামী সোহাগী। আমাগো মুসলমান মাইয়ারা হয় দেমাগি। স্বামীর লগে মুখ উচা কইরা কথা বলে।
আজকাল কার মাইয়ারা ধর্ম কর্ম ভুলে গেছে। সবই সময়। বুঝলি। সবই সময়। শয়তানের দোসর হইল এইসব নাপাকি মাইয়া। দেশটারে দখল করার জন্য শয়তান এগোরে লাগাইছে।
দেশ দখল কইরা কি করবো, হুজুর? হিন্দুতান তো অনেক বড়। এত বড় দেশ থাকতে, এই দেশের মত ছোট দেশ দখল কইরা ওগো লাভ কি ?
অনেক লাভ। পরের বৌরে সব সময় নিজের বৌয়ের চাইতে ভাল লাগে। এই দেশ দখল কইরা সব মুসলমান মাইয়া গুলারে হিন্দু পোলার লগে বিয়া দিবো। তাগো হিন্দু বানাবো। আর হিন্দু মাইয়া গুলা বকুলের মত পোলা গুলারে নষ্ট করবো। হিন্দু বানাবো। হিন্দুর সংখ্যা বাড়বো। সব কিছুতেই তো ওগো লাভ। আমাগো নেতারা হিন্দু মাইয়ার ফাঁদে পইরা ভারতের সাথে হাত মিলাইছে।
তয়, হুজুর, এই মাইয়াটারে কিন্তু আমার অনেক ভাল লাগে।
সাবধান, চোখ নিচে রাখবি। আল্লাহ গজব দিবো। জোয়ান, কমবয়সী মাইয়া। তার উপর আবার হিন্দু। সারাদিন শাকসবজি খায়। রুপ কি আর এমনি এমনি আসে। আমার ছোট বৌটারে কত কই বেশি কইরা শাকসবজি খাইতে। কথা শোনে না। যৌবন ধইরা রাখবো কেমনে ?
আল্লাহ আমাগো এইসব শয়তানের হাত থেইক্যা রক্ষা করুক।
এই সব জাহানাম্মের লাকড়ির কারণে পুরুষের ইমান নষ্ট হয়। মনে বদ কামনা জাগে। শরীর নাপাক হয়। এগো চোখে দেখাও পাপ। তওবা কর।
তওবা।

৭.
কাশীপুর গ্রামের পাকবাহিনীর ক্যাম্পে রাজাকার হাফিজের জরুরী তলব।
হুজুর, আমাকে তলব করেছেন ?
তুমি সারাদিন কর কি ?
আপনার খেদমত। কোন ভুল হইছে হুজুর ?
ভুল ? কালরাতে আমার লোকেদের উপর মুক্তিরা হামলা চালিয়েছে। ছয়জনকে মেরেছে। একজন হারিয়ে গেছে। বাকিরা কোনমতে জীবন নিয়ে পালিয়েছে। এই নাশকতার দায়ভার কে নেবে ?
হুজুর ভারতের দালাল গুলা কাপুরুষ। পেছন থেকে মারে। সামনাসামনি পাইলে হত। দেখায় দিতাম।
দেখায়ে এখন আর কি হবে। আমার সেনারা যে মারা গেল, তার কি হবে ?
হবে, হুজুর। আল্লাহ বিচার করবে।
আল্লাহ বিচার করবে, বলেই তো তোমাদের মত খাদেমদারদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। তোমাদের অবহেলাতে যদি পাক রক্ত জমিনে পড়ে, তাহলে তোমাদের দায়ী করা হবে।
হুজুর, খোদার নামে কসম। আমার শরীরের পাক রক্তের কসম। পাকিস্তানের জন্য জীবন দিতে পিছপা হব না। পাকিস্তান না থাকলে আমাদের বেঁচে থেকে কি লাভ ?
জীবন দিতে হবে না। “ মুঝে মুক্তি চাহিহে, মুক্তি। মুক্তিকো ঢুনকে মুঝে পাস লে আও”। ( আমার মুক্তি চাই। মুক্তি খুঁজে আমার কাছে নিয়ে আসো। )
হুজুর, কাশীপুরের হিন্দুবাড়ি গুলো মুক্তির গোপন আড্ডাখানা। ওরা মুক্তিগুলোরে ঘরে লুকায় রাখে। সাঁচ্চা মুসলমান কখনো পাকিস্তানের খেলাপ করবে না। আপনি যদি হুকুম দেন, ওগো ভিটেমাটি ছারা করবো।
আমি আগেও একবার লোক পাঠিয়েছিলাম। তারা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করেছে। “ লেকিন, একভি মুক্তি নেহি মিলা”। ( একটা মুক্তিও খুঁজে পাওয়া যায় নি )
হুজুর, আপনার সেনারা আপনার মত ভাল বাংলা বলতে পারে না। তারা বাংলা বোঝেও না। আমরা ছাড়া তারা অচল। আপনি আমাকে কিছু লোকদেন। আমি ওদের দেখতাছি। আমারে এত সহজে দালাল গুলো ফাঁকি দিতে পারবো না।
ঠিক আছে। কিন্তু, আমি মুক্তি চাই। মুক্তি।
চিন্তা করবেন না, হুজুর। আজরাতে আপনার সামনে মুক্তি হাজির করা হবে। মাটির যত উপরে বা যত নিচেই থাকুক, আমার হাত থেকে ওগো মুক্তি নাই। আমাদের পাক ভাইয়েদের রক্ত বৃথা যাবে না। আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখেন। পূর্ণ ভুমি পাকিস্তানের জয় হোক।

সেই রাতে হাফিজ রাজাকার, পাকসেনার বহর নিয়ে বের হল। মেজর জাফর প্রেসারের রুগী। ১৯৬৬ এর যুদ্ধে তিনি কাশ্মীরে যুদ্ধ করেছেন। সেই যুদ্ধে তিনি ভারতপাক সীমান্তে যুদ্ধে করেছেন। সেই যুদ্ধে তিনি গুলি খেয়েছিলেন। সেই থেকে দুঃসাহসী মেজরের মনে কিছুটা হলেও মরনের ভয় ঢুকে গেছে। এরপর সেরে উঠলেও আর আগের মত তেজ দেমাগ নেই। শরীরের প্রতি তিনি এখন বেশ সচেতন। পাকিস্তানে তার স্ত্রী পুত্র আছে। তাদের জন্য চিন্তা হয় সব সময়। তার যদি কিছু হয়ে যায়, তাদের কি হবে ?
একারণে সচারচর তিনি অপারেশনে সরাসরি যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। তার উপর আবার গেরিলা যুদ্ধ। সম্মুখ যুদ্ধ হলে কথা ছিল। বলা নেই, কওয়া নেই, যেখান সেখান থেকে এসে গুলি করে মেরে ফেলবে। তিনি বুঝে ওঠার আগেই স্বর্গে চলে যাবেন। তার জীবন এত তুচ্ছ নয়। মরলে ভারতের সাথে যুদ্ধ করে বীরের মত মরবেন। এই সব পুঁচকে মুক্তির গুলি খেয়ে মরাটা তার জীবনের জন্য অসম্মানের। এদের জন্য রাজাকার হাফিজের মত আউল ফাউল লোক যথেষ্ট। মশা মারতে কামান দাগানোর কি দরকার ?
গুরুত্বর প্রয়োজন না হলে তিনি হাফিজের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কর্ম সম্পাদন করেন। হাফিজ যে কিছুটা উল্টাপাল্টা ধরনের লোক, এটা তিনি ভাল করেই জানেন। কিন্তু, তার দরকার কাজ। হাফিজ লোকটা বেশ কাজের। এই গ্রামে কোথায় কি হয়, কে কেমন, এসব প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। তার জানার কথা না। কিন্তু হাফিজ এই গ্রাম সহ আশপাশের চোদ্দ গ্রামের খবরাখবর রাখে। হাফিজ তার চোখের মত। হাফিজ ছাড়া পাক মিলিটারি অন্ধ হয়ে পড়বে। বাংলা ভাষাটা কোন সৈনিক তেমন বোঝে না। সে অনেক কষ্ট করে রপ্ত করেছে। এখন সে অনেক শুদ্ধ করে কথা বলতে পারে। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানী টান থেকেই যায়। সে যদি গায়ে গামছা আর লুঙ্গী পড়ে গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলে তবুও যে কেউ বুঝে ফেলবে, সে একজন পাকিস্তানী। এই দিন থেকে হাফিজের মত লোকেরা অমূল্য। হিটলারের গেস্টেপো বাহিনীর মত। আই.এস.আই যতনা তাদের কাজে আসে, তার চাইতেও এই সব বাঙ্গালী চোর গুলো তাদের ভাল কাজে লাগে। ভাষাগত কারণে পূর্ব পাকিস্তানে, ভারতীয় গোয়েন্দা সস্থা ( র) সব সময় একধাপ এগিয়ে ছিল। ভারতে প্রচুর বাংলা ভাষী মানুষ আছে। তারা সহজে এই দেশের মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে। তারা একই রকম দেখতে। তাদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তীয় কর্ম সম্পাদন তাই অনেক সহজ। এই কারনেই হয়ত পাকিস্তানী শাসকেরা একসময় পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বদলাতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। যদিও তার মতে, সেটা ছিল মস্ত বড় ভুল। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সত্তা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। উর্দু যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষেরই ভাষা নয়, সেখানে এরা কিভাবে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মেনে নেবে। একই ভুল পাকিস্তানের বেলুচিস্থানেও করা হয়েছে। আজ বাঙ্গালীরা স্বাধীন হতে চাচ্ছে। কাল হয়ত বেলুচিরা চাইবে। পাকিস্তানের উচিৎ এখনই বিষয়টি মাথা দিয়ে মোকাবেলা করা। বাহুর শক্তি জোরে নয়। ঠিক যেমনটা ভারত নিজে করেছে তার সংখ্যা লঘু বা ভিন্ন ভাষাভাষীর বা ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি। দমন নিপীড়ন দিয়ে এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে আটকে রাখা এতটা সহজ হবে না। মৌচাকে গুলি করে কিছু হয় না। মৌমাছির কামড় খেতে হয়। মৌমাছির জন্য দরকার হয় ধোয়া। মাথার বুদ্ধি।
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে গুলি করতে মেজর জাফরের আজকাল কিছুটা সমস্যা হয়। ভারতীয় সেনা হলে এক কথা ছিল। লুঙ্গি গামছা পড়া গোবেচারা। অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে। এদের বুকে গুলি করা বেশ কঠিন কাজ। চোখে চোখ পড়লে তো আর কথা নেই। সেই রাতে ঠিক মত ঘুম হয় না তার।
বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেল। প্রায় চার ঘণ্টা। কে জানে, হাফিজ কি করছে ? তার হাতে থাকা প্রায় অর্ধের সেনা এখন হাফিজের সাথে। এই মুহূর্তে ক্যাম্পে মুক্তি বাহিনী হামলা করলে তার সমস্যা হতে পারে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়। রাত বেশ গভীর হয়ে এল। তবে, আজ পূর্ণিমা। আকাশে অনেক বড় চাঁদ। অন্ধকারে তাই বেশ ভালই দেখা যাচ্ছে।

গা

আফসার মুক্তিযুদ্ধে দেয় এবছরের জুনে। বেশ ভালো ট্রেনিং সে এতিমধ্যে নিয়ে ফেলেছে। রণাঙ্গন হিসেবে বেছে নিয়েছে কুষ্টিয়া। দেশের হয়ে লড়াই করা যাবে। সেই সাথে পরিবারের আশেপাশে থাকা যাবে। কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার পর সে চলে আসে কাশীপুরে। যোগ দেয় আজিমের গেরিলা দলে।
মধুপুর গ্রামে আফসারের অবস্থান সম্পর্কে রিনা ইতিমধ্যে জেনে গেছে। কিন্তু, তার বাবা-মা এখনো বিষয়টি জানে না। রিনাকে বলতে নিষেধ করেছে। রিনা বলে নি। তার জীবন গেলেও সে কাউকে বলবে না, এটা আফসার জানে। রিনা ব্যতিত কেবল দুজন মানুষ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে অবগত। তারা হল বকুল ও সুস্মিতা।
বকুল, রিনাদের প্রতিবেশী। রিনার শ্বশুরবাড়ির পাশে কাঁচাপাকা রাস্তা। তার অপর পাশে বকুলদের বাড়ি। বকুল আফসারের সমবয়সী। সে আফসারের ছোট বেলার বন্ধু। পেশায় স্কুল শিক্ষক। আফসারের বাবার প্রায়মারী স্কুলে সে শিক্ষকতা করে। বকুলের বাবা-মা বছর পাঁচেক আগে গত হয়েছেন। তার কোন ভাইবোন নেই। বাড়িতে কেবল সে আর সুস্মিতা থাকে। সেই সাথে আছে একটি ১২ বছর বয়সী কাজের মেয়ে।
বকুল মনে প্রানে একজন মুসলমান। গ্রামে তার নামে কেউ কোনদিন সুনাম ব্যতিত দুর্নাম করে নি। কিন্তু, চাঁদের কলঙ্ক যেমন আছে। বকুলেরও আছে। যদিও সেই কলঙ্ককে বকুল তার জীবনের সেরা অলংকার বলে মনে করে। সে হল সুস্মিতা। সুস্মিতা হিন্দুর মেয়ে। প্রেম করে বিয়ে করেছে এ বছরের জানুয়ারি মাসে।
হিন্দু মুসলমান বিয়ের ব্যাপারটা গ্রামবাসী খুব একটা ভাল ভাবে নিতে পারে নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষেপেছিল গ্রামের বর্তমান রাজাকার মজিদ খা। তার একটাই কথা, গ্রামে এই পাপ থাকতে দেয়া যাবে না। তার সমাধান যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত। বকুলকে তালাক দিয়ে সুস্মিতাকে আগে মুসলমান হতে হবে। বিয়ে করতে হবে গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক লোকটিকে। হিল্লা বিয়ে। তারপর সেই বুড়োকে তালাক দিয়ে পাপমুক্ত হতে হবে। তারপর আবার বকুলকে বিয়ে করতে হবে। পবিত্র বিবাহ। যদিও মজিদের এ প্রস্তাবনাতে ধর্মের আসল রীতির যে বিকৃত সাধন হয়েছে, এই নিয়ে মসজিদের ইমাম বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু, মজিদ গ্রামে যে কোন বিষয়ে আর সকলের চাইতে বেশি বোঝে।
বর্তমানে হিল্লা বিয়ে করার অধিকার পাবে ৮৫ বছর বয়স্ক আকবর বুড়ো। অবশ্য তার ৩৫ বছর বয়সী একটি বৌ বর্তমান আছে। ৮৫ বছর বয়স হলেও সে সন্তান জন্ম দানে যথেষ্ট সক্ষম। পুরুষের প্রতি খোদার এ এক অসীম দয়া। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পুরুষ সৃষ্টিশীল। তবে, হিল্লা বিয়ে করা যে মজিদের নিজ মনের গোপন ইচ্ছা এ ব্যাপারে গ্রামবাসীর মনে তেমন কোন সন্দেহ নেই।
বকুল এসবে কান দেয় নি। সুস্মিতার সঙ্গে তার ঘরসংসার বেশ ভাল ভাবেই চলছে। সুস্মিতা মুসলমান হয় নি ঠিকই তবে সে হিন্দু ধর্মের কোন আচার অনুষ্ঠান বাড়িতে করে না। তার স্বামীর সমস্যা হতে পারে, একথা ভেবে। যদিও তার স্বামী কখনো এসব ব্যাপারে তাঁকে কোন কথা বলে নি। তবে, সুস্মিতা মাথায় সিঁদুর পড়ে। এটা তার মনের শখ। বিবাহিত হিন্দু মেয়ে আর কিছু করুক আর না করুক, মাথায় সিঁদুর দেবে না, এটা হয় না।
তবে, প্রথম দিকে সিঁদুর পড়া গ্রামে ব্যাপক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। গ্রামবাসী ধারণা করতে শুরু করে, বকুল হয়ত হিন্দু হয়ে গেছে। সুস্মিতা হয়ে যায় গ্রামের রাক্ষসী। মুসলমান এতিম ছেলেকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাঁকে হিন্দু বানিয়েছে।
সুস্মিতা সিঁদুর পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু বকুল চায় না, মানুষের কথা শুনে সে তার ইচ্চা বিসর্জন দিক। সে কারো কথার ধার ধারে না। বরং বকুল মনে মনে তার স্ত্রীর সিঁদুর পড়ার বিষয়টি পছন্দ করে। পছন্দ করে তার শাড়ি পড়ার ধরন। সে যে যুদ্ধে যেতে চেয়েও পারে নি, এর কারণ সুস্মিতা। মেয়েটি কিছুতেই তার স্বামীকে চোখের আড়াল হতে দিতে চায় না। সে বেশ আল্লাদি স্বভাবের। বকুল ছাড়া তার আর কিছুই নেই। অসম্ভব রূপবতী এই মেয়েটি পরিবার থেকে বিতাড়িত। বকুলকে বিয়ে করার কারণে তার বাবা-মা তাঁকে ত্যাজ্যকন্যা করেছে। বকুলের কেউ নেই। তারও কেউ নেই। বকুল তার সমগ্র পৃথিবী। সে চাই না, তার সেই পৃথিবীতে কোন প্রলয় আসুক।
সুস্মিতার কথা চিন্তা করে বকুলের সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া হয়ে ওঠে নি। কিন্তু, এখন তারা দুজন মিলে যা করছে, তা সম্মুখ সমরের চাইতে কোন অংশে কম নয়। বকুল শিক্ষকতা করে রোজগার করে। সুস্মিতা ছয় জনের খাবার রাধে। বাড়ির তিনজন সহ গ্রামে আগত তিন মুক্তিযোদ্ধার। আফসার, আজাদ ও কামাল।
বকুল স্কুলে গেলে মাঝে মাঝে বাসাবাড়ির কাজ শেষ করে সুস্মিতা ঘুরতে যায় রিনাদের বাসায়। রিনার সাথে তার খুব ভাল সম্পর্ক। রিনা প্রায় আসে তার বাড়ি। রিনার শ্বশুরবাড়িতে রিনার তেমন কোন কাজ নেই। সারাদিন বই পড়া বা বাবুর সাথে খেলা করা। আর না হলে শ্বশুরশাশুড়ির সাথে বসে আড্ডা দেয়া। এই রিনার জীবন।
সুস্মিতার বাড়ির দরজাতে খটখট শব্দ। এই বেলাতে কেবল রিনা আসে। আর কারো আসার কথা না। সুস্মিতা মনে মনে খুশি হয়। দ্রুত দরজার কাছে যায়। দরজা খোলে। কিন্তু, এত রিনা নয়। এ হল মজিদ খান। খা সাহেব। দুজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে সে হাজির। বকুল বহুবার সুস্মিতাকে বলেছে, দরজা খোলার আগে নাম জিজ্ঞাসা করতে। সুস্মিতা এই ভুলটি প্রায় করে। আজও করল। খারাপ মানুষকে দেখাটাও একটা খারাপ অভিজ্ঞতা।
কি ব্যাপার, হিন্দুরানী ? কেমন আছো ?
আপনি ?
তোমাদের দেখতে আইলাম। গ্রামে থাকো। আমাগো তো একটা দায়িত্ব আছে।
ভাল আছি। এরপর খোঁজ খবর নিতে চাইলে বিকেলের পর আসবেন। এখন বকুল বাড়ি থাকে না। আর কিছু ?
না, আর কিছু না। ঠিক আছে, আমি যাই। তবে, তোমার সিঁদুর পড়া এখনো বন্ধ হইল না।
আপনাদের কি কোন সমস্যা হয় ?
না, আমার না। তয়, সমাজে সমস্যা হয়। তুমি কোন রূপের যাদুতে বকুলের মত একটা পোলারে বশ কইরা যে দোযখের পথে নিয়া গেলা, সেটাই বুঝি না।
কি করার আছে, বলুন? দোযখে তো আমাদের মত মানুষেরা যাবে। আমরা স্বর্গে গেলে, সেখানে আপনাদের ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আমার স্বামী চায় আমার সাথে দোযখে যেতে। তাঁকে যেতে দিন। আপনি স্বর্গে শান্তিতে থাকেন।
এত তেজ ভাল না। মুরব্বী মানুষের সাথে কেমনে কথা বলতে হয় তা জানো না ?
না। আপনার কোন কাজ না থাকলে যেতে পারেন। আমার কাজ আছে।
খুব বিরক্ত হইলা, মনে হয় ?
না। বিরক্ত হই নাই। খোঁজ খবর নেবার জন্য ধন্যবাদ।
তয়, একটা কথা জিগাই। তোমার বাপ-মা কেমন আছে ?
ভাল।
ভাল আছে বলে তো মনে হয় না। তোমার সাথে তাগো সম্পর্ক নাই বইলা শুনছিলাম।
ভুল শুনেছেন। তারা ভালই আছে ।
এখন তো ভাল থাকবোই। তমাগো দেশ তো এই দেশটারে দখল করতে চায়।
আমাদের দেশ মানে ? এটাই তো আমাদের দেশ।
মজিদ তার দু’সহচরের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাঁসি দিল।
এই মেয়ে কয় কি ! তোমাগো দেশ তো হিন্দুস্থান।
আমরা কি হিন্দুস্থানে থাকি ? আমাদের কোন পূর্বপুরুষ হিন্দুস্থানে গেছে বলে তো মনে হয় না।
তোমাদের কাবাতো হিন্দুস্থানে।
সৌদি আরব পাকিস্তানের আশেপাশে হলে কি আপনারা নিজেদের সৌদি বলে পরিচয় দিতেন ?
মজিদ আবার মুচকি হাসলো।
কি যে কও ! তোমরা এই দেশে আইছো এই দেশটারে শেষ করতে। তোমাদের পাঠানো হইছে। বকুলের মত পোলাপানগুলোর মাথা খাইয়া এই দেশটারে হিন্দুস্থানের বাজার বানাইতে।
আপনি দয়া করে এবার যান। আমার কাজ আছে।
ঠিক আছে। তোমার সাথে কথা কইলে আমার চলবো না। আমারো অনেক কাজ আছে। দেশের কাজ। তয়, এতদিন বিয়া হইলো, পোয়াতি হইবা কবে ?
আপনি যান। আমি দরজা বন্ধ করবো।
ঠিক আছে। তয় দেখুম, পোলাপান হইলে তারে হিন্দু বানাও নাকি মুসলমান বানাও।
পোলাপান হলে তারে মানুষ বানাবো। এটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।
সুস্মিতা দরজা বন্ধ করে দিল। মজিদ রাগান্বিত হয়ে হাঁটতে শুরু করলো। তার এক সহচর ছাতা ফুটিয়ে তার মাথার উপর ধরে আছে। তার পাশে হাঁটছে। সাথে আছে আরো একজন। তার নাম জামাল। সে মজিদের অতি বিশ্বস্ত। পবিত্র ডান হাত। বা হাত বলা যাবে না। বা হাত অপবিত্র। তা দিয়ে শৌচ কাজ সম্পাদিত হয়। তবে, জামাল মজিদের জন্য এখন পর্যন্ত কোন পবিত্র কাজ করেছে বলে কারো জানা নেই।
মন্দ লোকের সহচরে অভাব হয় না। তারা অধিকাংশ সময় একতাবদ্ধ থাকে। ভাল হতে সময় লাগে। মন্দ হতে তেমন লাগে না। মন্দ হওয়া তুলনামুলক ভাবে সহজ। মন্দ হতে শুধু মন্দ মানুষের সঙ্গে থাকলেই হয়। পীরের সহচরেরা খুব কমই পীর হয়। সাধু হয়। কিন্তু, শয়তানের সব সহচর যে শয়তান হয়, এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
গ্রামের মানুষ জামালকে জানোয়ার বলে ডাকে। একদা জামাল ছিল পাশের গ্রামের ছিঁচকে চোর। ছোট বেলা থেকেই চুরি করতো। গ্রামের বাজারে ভীরের মাঝে এটা সেটা চুরি করতো। বয়স বাড়লে তার পদোন্নতি হয়। তখন সে মসজিদের জুতা চোরের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়।
একসময় বিয়ে করে। বয়স বেড়েছে বলে কথা। তারও তো জৈবিক চাহিদা আছে। এই চাহিদার বাধনে সবাই বাধা। কেউ তা উপেক্ষা করতে পারে না। যে পারে, সে হয়ে যায় সন্ন্যাসী। জামাল চোর হতে পারে, কিন্তু সে একজন মানুষ। রক্ত মাংসের মানুষ।
বিয়ে করে কুষ্টিয়া সদরে। তার বৌ কুষ্টিয়া সদর বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে থাকতো। খারাপ মেয়ে ছিল। জামালকে বিয়ে করে পবিত্র হয়েছে। মজিদ খা নিজে তার পাপ মোচনের তওবা পড়িয়েছেন।
জামালের সাথে মজিদের পরিচয় হয় নাটকীয়ে ভাবে। বিয়ের পরে সংসারের চাহিদা মেটাতে জামাল শুরু করে সিঁদেল চুরি। রাতের আধারে স্বতন্ত্র ডাকাতি।
চুরিবিদ্যায় সে ছিল একরকম অব্যর্থ। শুধু একবারই পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। গ্রামের বাজারে। সবাই মিলে তাঁকে গণধোলাই দিয়েছিল। সেটা ছোটবেলার কাহিনী। ছোটবেলায় হোঁচট না খেলে জীবনে দৌড়বে কিভাবে ?
সেবার মজিদ খা তার জীবন বাঁচিয়েছিল। তার স্পষ্ট মনে আছে। তারপর বহুকাল দেখা হয় নি।
বড় হয়ে সিঁদেল চুরি করতে সে ঘটনাক্রমে যায় মজিদের বাড়ি। কিন্তু মজিদের ছেলের হাতে ধরা পড়ে। মজিদের মাদকাসক্ত ছেলে তার হাড় মাংস এক করে দিয়েছিল। দয়াময় মজিদ আবার তার জীবন রক্ষা করে। জামাল অবাক হয়। এই নিয়ে দুবার দয়াময় মজিদ তাকে যমের হাত থেকে বাঁচালো।
মজিদ খা অতঃপর জামালের জীবন কাহিনী শুনে মুগ্ধ হয়। সে তাঁকে দীনের পথ দেখায়। এখন তার পড়নে থাকে পাঞ্জাবি। মুখে খোঁচা খোঁচা জামাতি দাড়ি। কিন্তু, ছুঁচোর গায়ে আতর দিলেও, ছুঁচোর গন্ধ যায় না।
জামাল মৃদু স্বরে মজিদকে বলে, “হুজুর, যদি আজ্ঞা দেন, একটা কথা বলি ?”
বল।
হুজুর, মাইয়ার তেজ দেখছেন !!
দেখলাম। বেয়াদব মাইয়া। শরীর থেইক্যা হিন্দু হিন্দু গন্ধ বার হচ্ছিলো। আজাবী গন্ধ। কম বয়সী যুবক পাগল করা গন্ধ।
হুজুর আপনারে সে সালাম পর্যন্ত দেয় নি। এটাই আমার কষ্ট।
সালাম দিব কেমনে? নাপাক মাইয়া।
তয়, হুজুর, হিন্দু মাইয়ারা ভাল সংসারী হয়। তাগো কাছে পতি পরমেশ্বর। স্বামী সোহাগী। আমাগো মুসলমান মাইয়ারা হয় দেমাগি। স্বামীর লগে মুখ উচা কইরা কথা বলে।
আজকাল কার মাইয়ারা ধর্ম কর্ম ভুলে গেছে। সবই সময়। বুঝলি। সবই সময়। শয়তানের দোসর হইল এইসব নাপাকি মাইয়া। দেশটারে দখল করার জন্য শয়তান এগোরে লাগাইছে।
দেশ দখল কইরা কি করবো, হুজুর? হিন্দুতান তো অনেক বড়। এত বড় দেশ থাকতে, এই দেশের মত ছোট দেশ দখল কইরা ওগো লাভ কি ?
অনেক লাভ। পরের বৌরে সব সময় নিজের বৌয়ের চাইতে ভাল লাগে। এই দেশ দখল কইরা সব মুসলমান মাইয়া গুলারে হিন্দু পোলার লগে বিয়া দিবো। তাগো হিন্দু বানাবো। আর হিন্দু মাইয়া গুলা বকুলের মত পোলা গুলারে নষ্ট করবো। হিন্দু বানাবো। হিন্দুর সংখ্যা বাড়বো। সব কিছুতেই তো ওগো লাভ। আমাগো নেতারা হিন্দু মাইয়ার ফাঁদে পইরা ভারতের সাথে হাত মিলাইছে।
তয়, হুজুর, এই মাইয়াটারে কিন্তু আমার অনেক ভাল লাগে।
সাবধান, চোখ নিচে রাখবি। আল্লাহ গজব দিবো। জোয়ান, কমবয়সী মাইয়া। তার উপর আবার হিন্দু। সারাদিন শাকসবজি খায়। রুপ কি আর এমনি এমনি আসে। আমার ছোট বৌটারে কত কই বেশি কইরা শাকসবজি খাইতে। কথা শোনে না। যৌবন ধইরা রাখবো কেমনে ?
আল্লাহ আমাগো এইসব শয়তানের হাত থেইক্যা রক্ষা করুক।
এই সব জাহানাম্মের লাকড়ির কারণে পুরুষের ইমান নষ্ট হয়। মনে বদ কামনা জাগে। শরীর নাপাক হয়। এগো চোখে দেখাও পাপ। তওবা কর।
তওবা।

৭.
কাশীপুর গ্রামের পাকবাহিনীর ক্যাম্পে রাজাকার হাফিজের জরুরী তলব।
হুজুর, আমাকে তলব করেছেন ?
তুমি সারাদিন কর কি ?
আপনার খেদমত। কোন ভুল হইছে হুজুর ?
ভুল ? কালরাতে আমার লোকেদের উপর মুক্তিরা হামলা চালিয়েছে। ছয়জনকে মেরেছে। একজন হারিয়ে গেছে। বাকিরা কোনমতে জীবন নিয়ে পালিয়েছে। এই নাশকতার দায়ভার কে নেবে ?
হুজুর ভারতের দালাল গুলা কাপুরুষ। পেছন থেকে মারে। সামনাসামনি পাইলে হত। দেখায় দিতাম।
দেখায়ে এখন আর কি হবে। আমার সেনারা যে মারা গেল, তার কি হবে ?
হবে, হুজুর। আল্লাহ বিচার করবে।
আল্লাহ বিচার করবে, বলেই তো তোমাদের মত খাদেমদারদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। তোমাদের অবহেলাতে যদি পাক রক্ত জমিনে পড়ে, তাহলে তোমাদের দায়ী করা হবে।
হুজুর, খোদার নামে কসম। আমার শরীরের পাক রক্তের কসম। পাকিস্তানের জন্য জীবন দিতে পিছপা হব না। পাকিস্তান না থাকলে আমাদের বেঁচে থেকে কি লাভ ?
জীবন দিতে হবে না। “ মুঝে মুক্তি চাহিহে, মুক্তি। মুক্তিকো ঢুনকে মুঝে পাস লে আও”। ( আমার মুক্তি চাই। মুক্তি খুঁজে আমার কাছে নিয়ে আসো। )
হুজুর, কাশীপুরের হিন্দুবাড়ি গুলো মুক্তির গোপন আড্ডাখানা। ওরা মুক্তিগুলোরে ঘরে লুকায় রাখে। সাঁচ্চা মুসলমান কখনো পাকিস্তানের খেলাপ করবে না। আপনি যদি হুকুম দেন, ওগো ভিটেমাটি ছারা করবো।
আমি আগেও একবার লোক পাঠিয়েছিলাম। তারা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করেছে। “ লেকিন, একভি মুক্তি নেহি মিলা”। ( একটা মুক্তিও খুঁজে পাওয়া যায় নি )
হুজুর, আপনার সেনারা আপনার মত ভাল বাংলা বলতে পারে না। তারা বাংলা বোঝেও না। আমরা ছাড়া তারা অচল। আপনি আমাকে কিছু লোকদেন। আমি ওদের দেখতাছি। আমারে এত সহজে দালাল গুলো ফাঁকি দিতে পারবো না।
ঠিক আছে। কিন্তু, আমি মুক্তি চাই। মুক্তি।
চিন্তা করবেন না, হুজুর। আজরাতে আপনার সামনে মুক্তি হাজির করা হবে। মাটির যত উপরে বা যত নিচেই থাকুক, আমার হাত থেকে ওগো মুক্তি নাই। আমাদের পাক ভাইয়েদের রক্ত বৃথা যাবে না। আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখেন। পূর্ণ ভুমি পাকিস্তানের জয় হোক।

সেই রাতে হাফিজ রাজাকার, পাকসেনার বহর নিয়ে বের হল। মেজর জাফর প্রেসারের রুগী। ১৯৬৬ এর যুদ্ধে তিনি কাশ্মীরে যুদ্ধ করেছেন। সেই যুদ্ধে তিনি ভারতপাক সীমান্তে যুদ্ধে করেছেন। সেই যুদ্ধে তিনি গুলি খেয়েছিলেন। সেই থেকে দুঃসাহসী মেজরের মনে কিছুটা হলেও মরনের ভয় ঢুকে গেছে। এরপর সেরে উঠলেও আর আগের মত তেজ দেমাগ নেই। শরীরের প্রতি তিনি এখন বেশ সচেতন। পাকিস্তানে তার স্ত্রী পুত্র আছে। তাদের জন্য চিন্তা হয় সব সময়। তার যদি কিছু হয়ে যায়, তাদের কি হবে ?
একারণে সচারচর তিনি অপারেশনে সরাসরি যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। তার উপর আবার গেরিলা যুদ্ধ। সম্মুখ যুদ্ধ হলে কথা ছিল। বলা নেই, কওয়া নেই, যেখান সেখান থেকে এসে গুলি করে মেরে ফেলবে। তিনি বুঝে ওঠার আগেই স্বর্গে চলে যাবেন। তার জীবন এত তুচ্ছ নয়। মরলে ভারতের সাথে যুদ্ধ করে বীরের মত মরবেন। এই সব পুঁচকে মুক্তির গুলি খেয়ে মরাটা তার জীবনের জন্য অসম্মানের। এদের জন্য রাজাকার হাফিজের মত আউল ফাউল লোক যথেষ্ট। মশা মারতে কামান দাগানোর কি দরকার ?
গুরুত্বর প্রয়োজন না হলে তিনি হাফিজের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কর্ম সম্পাদন করেন। হাফিজ যে কিছুটা উল্টাপাল্টা ধরনের লোক, এটা তিনি ভাল করেই জানেন। কিন্তু, তার দরকার কাজ। হাফিজ লোকটা বেশ কাজের। এই গ্রামে কোথায় কি হয়, কে কেমন, এসব প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। তার জানার কথা না। কিন্তু হাফিজ এই গ্রাম সহ আশপাশের চোদ্দ গ্রামের খবরাখবর রাখে। হাফিজ তার চোখের মত। হাফিজ ছাড়া পাক মিলিটারি অন্ধ হয়ে পড়বে। বাংলা ভাষাটা কোন সৈনিক তেমন বোঝে না। সে অনেক কষ্ট করে রপ্ত করেছে। এখন সে অনেক শুদ্ধ করে কথা বলতে পারে। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানী টান থেকেই যায়। সে যদি গায়ে গামছা আর লুঙ্গী পড়ে গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলে তবুও যে কেউ বুঝে ফেলবে, সে একজন পাকিস্তানী। এই দিন থেকে হাফিজের মত লোকেরা অমূল্য। হিটলারের গেস্টেপো বাহিনীর মত। আই.এস.আই যতনা তাদের কাজে আসে, তার চাইতেও এই সব বাঙ্গালী চোর গুলো তাদের ভাল কাজে লাগে। ভাষাগত কারণে পূর্ব পাকিস্তানে, ভারতীয় গোয়েন্দা সস্থা ( র) সব সময় একধাপ এগিয়ে ছিল। ভারতে প্রচুর বাংলা ভাষী মানুষ আছে। তারা সহজে এই দেশের মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে। তারা একই রকম দেখতে। তাদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তীয় কর্ম সম্পাদন তাই অনেক সহজ। এই কারনেই হয়ত পাকিস্তানী শাসকেরা একসময় পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বদলাতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। যদিও তার মতে, সেটা ছিল মস্ত বড় ভুল। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সত্তা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। উর্দু যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষেরই ভাষা নয়, সেখানে এরা কিভাবে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মেনে নেবে। একই ভুল পাকিস্তানের বেলুচিস্থানেও করা হয়েছে। আজ বাঙ্গালীরা স্বাধীন হতে চাচ্ছে। কাল হয়ত বেলুচিরা চাইবে। পাকিস্তানের উচিৎ এখনই বিষয়টি মাথা দিয়ে মোকাবেলা করা। বাহুর শক্তি জোরে নয়। ঠিক যেমনটা ভারত নিজে করেছে তার সংখ্যা লঘু বা ভিন্ন ভাষাভাষীর বা ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি। দমন নিপীড়ন দিয়ে এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে আটকে রাখা এতটা সহজ হবে না। মৌচাকে গুলি করে কিছু হয় না। মৌমাছির কামড় খেতে হয়। মৌমাছির জন্য দরকার হয় ধোয়া। মাথার বুদ্ধি।
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে গুলি করতে মেজর জাফরের আজকাল কিছুটা সমস্যা হয়। ভারতীয় সেনা হলে এক কথা ছিল। লুঙ্গি গামছা পড়া গোবেচারা। অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে। এদের বুকে গুলি করা বেশ কঠিন কাজ। চোখে চোখ পড়লে তো আর কথা নেই। সেই রাতে ঠিক মত ঘুম হয় না তার।
বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেল। প্রায় চার ঘণ্টা। কে জানে, হাফিজ কি করছে ? তার হাতে থাকা প্রায় অর্ধের সেনা এখন হাফিজের সাথে। এই মুহূর্তে ক্যাম্পে মুক্তি বাহিনী হামলা করলে তার সমস্যা হতে পারে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়। রাত বেশ গভীর হয়ে এল। তবে, আজ পূর্ণিমা। আকাশে অনেক বড় চাঁদ। অন্ধকারে তাই বেশ ভালই দেখা যাচ্ছে।
( পাষাণপুরী -ফয়সাল শোভন )


মন্তব্য

babunee এর ছবি

কন্টেন্ট দুই বার আসলো মনে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।