গল্পঃ ঝলসানো গোলাপ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৩/০৫/২০১৩ - ৩:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাস্তায় নামলাম ।

আগে ধারণা ছিল স্পিডব্রেকারে শুধু গাড়িই 'উষ্টা' খায়, আমার ধারণা ভুল । মানুষও খায় । হাঁটতে হাঁটতে এইমাত্র আমিও উষ্টা খেলাম একটা নিরীহ স্পিডব্রেকারে ।

ভরদুপুরে প্রায় জনবিরল রাজপথ । তাই ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় নেমে হাঁটছি । অনেকক্ষণ পর পর দুয়েকটা গাড়ি কিংবা বাইক হুশহাশ করে আসছে-যাচ্ছে । নিজেই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে । আমার সরে দাঁড়াতে হচ্ছে না । শুধু স্পিডব্রেকারেই ঢালু অবাধ্যতা । সরে তো জায়গা দিচ্ছেই না বরং উষ্টা খাওয়াচ্ছে ।

একটু আগেই সুস্মিতাদের কলেজটা পেছনে ফেলে এলাম । সুস্মিতাও কি আমার জীবনে স্পিডব্রেকারের মতো ? হতে পারে । স্পিডব্রেকারে উষ্টা খেয়ে অনেক সময় গাড়ির বাম্পার মচকে যায় । সুস্মিতার উপর উষ্টা খেয়ে সম্ভবত আমারও মচকেছে ।

সোজাসাপটা বলতে গেলে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে ওর পিছে 'ঘুরেছি' । কে কী নাম সংজ্ঞায়িত করবে তাতে আমার কিছু আসে যায় না, আমার কাছে এটা ভালোবাসা । যাকে বলে হান্ড্রেড পারসেন্ট লাভ । দাবির পক্ষে ভালো যুক্তিও আছে আমার । ওর প্রতি ভালো লাগা শুধু মুগ্ধতায় আটকে ছিল না, সেখানে অনেক স্বপ্নও জুড়েছিল । সুখী সংসার আর সন্তানের লালনীল স্বপ্ন । হুমায়ূন আহমেদ তাঁর একটা লেখায় বলেছিলেন, পুরুষরা নাকি প্রেমের ব্যাপারে স্বার্থপর । মেয়েরা যেখানে প্রেমে পড়লে যুগপৎ সংসার আর সন্তানের কথা ভাবে সেখানে প্রেমে পড়া পুরুষের স্বপ্নে থাকে শুধুই তার প্রেয়সী । হুমায়ূন আহমেদের থিওরিতে ভুল ছিল । ব্যাপার না, 'হোমার সামটাইমস নডস' ।

পাঞ্জাবির পকেটে গোলাপ ফুল নিয়ে হাঁটছি । দশটাকা দিয়ে ফুলের দোকান থেকে কিনেছি । গাছ থেকে তুলে আনা গোলাপ আর দোকানের গোলাপের মধ্যে বিস্তর ফারাক । গাছের গোলাপে কাঁটা থাকে, দোকানের কেনা গোলাপে থাকে না । নিষ্কন্টক গোলাপ যদি নিস্তরঙ্গ উত্থানপতনহীন প্রেমের প্রতীক হয় তবে কন্টকিত গোলাপ হওয়া উচিৎ উথালপাথাল উদ্দাম প্রেমের প্রতীক । জয় গোস্বামীর কবিতাটা মনে পড়ল-

'পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব,
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন...'

পাগলীর সঙ্গে জীবন কাটানোর স্বপ্ন পকেটের গোলাপেই মরে গেছে । আজকে জানাতে গিয়েছিলাম মুগ্ধতার কথা । বুকের ভিতর ঢাক পিটানোর শব্দ, কপাল বেয়ে শঙ্কিত ঘামের ফোয়ারা, শেষ মুহূর্তে ছুটে পালিয়ে যাবার তীব্র ইচ্ছা- সবকিছু উপেক্ষা করে বলে দিয়েছিলাম সব কথা । নার্ভাসনেসের কারণে গোলাপের কথা ভুলে গিয়েছিলাম, গোলাপ পকেটেই রয়ে গেছে । সুস্মিতা নির্বিকারভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে । তার 'ফিউচার' আছে । ফিউচার নিয়ে ভাবনা আছে ।

আর এই মুহূর্তে আমার আছে একটা বেঁচে যাওয়া লাল গোলাপ ।

প্রশস্ত রাজপথটা সোজা বরাবর অনেক দূর গিয়ে একটা পার্কের গেটে গিয়ে থেমেছে । এই অংশটায় এসে গেলে অস্বস্তিবোধ করি । দুইপাশের বড় বড় রেইন ট্রি গাছ আকাশটা ঢেকে দিয়েছে প্রায় । সেখানে প্রতিদিন অসংখ্য পাখি বসে । তারা অসংখ্যবার মলত্যাগ করে । সেগুলো বৃষ্টির মতো পুরো রাস্তাজুড়ে অজস্র ছোপ ছোপ দাগ ফেলে । আর এটা এমনই নৈমিত্তিক যে দাগ কোনোদিন পুরোনো হয় না । সেইসব স্বর্গচ্যুত প্রসাদ থেকে নিরাপদ নয় কোনো পথিকই- অস্বস্তির কারণ এটাই ।

অস্বস্তির জায়গাটা পার হয়ে এসেছি । আবারও সুস্মিতার কথা ভাবা যাক । ভাবতে ভাবতে একটা সিগারেট কিনে নিয়ে ধরালাম । সিগারেট কখনও কখনও মধ্যবিত্তের দুঃখবিলাস । মন খারাপের সময় যেহেতু দামি হুইস্কি কেনার সামর্থ্য থাকে না, সস্তা গাঁজার পুরিয়াও পায় না হাতের কাছে- তাই নিকোটিন ধোঁয়ায় কিছুটা দুঃখ ওড়ানোর অভিনয় চলে ।

বৈশাখের ঘর্মাক্ত দুপুরটা ধূমপানের জন্য সুবিধার নয়, বিশেষত আমার মতো খুচরা ধূমপায়ীর জন্য । এক টানে বেশি ধোঁয়া নিতে পারছি না । ধোঁয়া ভেতরে গিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে তুমুল । সিগারেট নিয়ে অদ্ভুত একটা স্ট্র্যাটেজি দাঁড় করিয়েছিলাম । সিগারেটের গন্ধ নিয়ে মার কাছে ধরা খাওয়ার পর থেকে আরও সাবধান হয়েছি, তবুও ছাড়ি নি । আমি জানতাম সুস্মিতা সিগারেট খাওয়া দেখতে পারে না । তবুও ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে টানতাম । যদি কোনোদিন হ্যাঁ বলে, নিশ্চয়ই সিগারেট ছেড়ে দিতে বলবে । তখন সত্যি সত্যি ছেড়ে দিতাম । আফসোস, আমার সিগারেটের খরচটা বাঁচলো না !

ফুটপাতে বসেছি । সিগারেট ফুরায় নি অর্ধেকটাও, আর টানতে পারছি না । পা আর ফুসফুস একত্রে বিদ্রোহ করে বসেছে । পকেটের গোলাপটা বের করে গন্ধ শোঁকা যাক কিছুক্ষণ । মাথায় ঝলসানো গোলাপ বিষয়ক একটা লাইন ওড়াউড়ি করছে । আবুল হাসানের লেখা কবিতাটার প্রথম লাইন-

'স্বদেশ তুমি ঝলসে যাওয়া গোলাপ কুঁড়ি...'

তারপর যেন কী ?
আমি জ্বলন্ত সিগারেটটা গোলাপের ঠিক মাঝখানে চেপে ধরলাম । এই ভরদুপুরে পতিত প্রেমিক আর ঝলসানো গোলাপের কী সম্পর্ক তা কেউ জানবে না ।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

কবিতা, গোলাপ, সিগারেট, কৈশোরের আবেগ। নস্টালজিক লেখা (ছ্যাঁক খাওয়া পাবলিকদের জন্য)।
ভালো লেগেছে লেখার স্টাইল।
শুভকামনা।

---- মনজুর এলাহী ----

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মঞ্জুর এলাহী

তালেব মাষ্টার

tokkhok এর ছবি

দাদা এখনো বিয়ে থা করেন নি, না ?

অতিথি লেখক এর ছবি

ইয়ে মানে, এহেম এহেম

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

সুবোধ অবোধ

অতিথি লেখক এর ছবি

লইজ্জা লাগে লইজ্জা লাগে লইজ্জা লাগে

তালেব মাষ্টার

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল। গল্পের কাব্যিক ভাবটা অসাধারণ লেগেছে।

===========
ক্লান্ত কালবৈশাখি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ ক্লান্ত কালবৈশাখি

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।