স্যুরিয়াল ফিল্ম - পর্ব ২ (ডেভিড লিঞ্চ ও দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৯/০৫/২০১৩ - ১২:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


“দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান” এর চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে ১, স্যার ফ্রেড্রিক ট্রেভেস (Sir Frederick Treves) এর “The Elephant Man and Other Reminiscences” ২, অ্যাশলে মন্টেজ (Ashley Montagu) এর “The Elephant Man: A Study in Human Dignity” এই দুইটা বই অবলম্বনে। এবং বই দুইটাই একজন বিকৃত চেহারার মানুষ ‘জোসেফ মেরিক’ এর বাস্তব জীবন অবলম্বনে।
এই চিত্রনাট্য নিয়ে প্রযোজক মেল ব্রুকস প্রথমে যান টরেন্স মালিক এর কাছে, কিন্তু মালিক সিনেমাটা তৈরিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ব্রুকস বেছে নেন ডেভিড লিঞ্চ কে। এটা লিঞ্চের দ্বিতীয় সিনেমা, তার আগে তার একমাত্র সিনেমা ‘ইরেজার হেড’ দিয়ে সিনেমা জগত কে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তার প্রথম ফিল্মের সফলতার কারনেই ব্রুকস বেছে নেন লিঞ্চ কে। এবং এই সিনেমা লিঞ্চের থলিতে নিয়ে আসে তার জীবনের প্রথম অস্কার।

‘দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান’ এর কাহিনী গড়ে উঠেছে ‘জোসেফ মেরিক’ এর বাস্তব জীবন থেকে, যদিও সিনেমায় নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘জন মেরিক’ অভিনয় করেছেন ‘জন হার্ট’ আর জসেফ মেরিক এর ডাক্তার ‘ফ্রেড্রিক ট্রেভেস’ এর ভুমিকায় অভিনয় করেছেন ‘অ্যান্থনি হপকিন্স’

“People of Orphalese, beauty is life when life unveils her holy face.
But you are life and you are the veil.
Beauty is eternity gazing at itself in a mirror.
But you are eternity and you are the mirror.”
- দ্য প্রফেট , কাহলিল জিবরান

জিবরান বলেছিলেন- ‘সৌন্দর্য মুখাবয়বে নয় , সৌন্দর্য অন্তরের ভেতরের এক আলো’
জন মেরিক জিবরানের সেই কিম্ভুত দর্শন কিন্তু আলোকিত মানুষ। তার মাথা, মুখ বিকৃত অনেকটা হাতির মাথার সাথে মিল আছে। তার এক হাত ও পা ও বিকৃত। সমাজ তার বিকৃত শরীর কে গ্রহন করেনি, বীভৎসতার ধুয়ো তুলে সমাজ তাঁকে করেছে বিচ্ছিন্ন। তাঁকে নিয়ে গিয়েছে পশুর কাতারে। নাইট পর্টার (মাইকেল এলফিক) মেরিকের বিকৃত শরীর কে পুজি করে সার্কাস শোতে অর্থ উপার্জন করে, মেরিক কে ব্যবহার করা হয় পশুর মত।

ডাক্তার ট্রেভেস সার্কাস শো এর এক ছোট্ট স্টলে জন মেরিক কে খুঁজে পান। নাইট পর্টার এর কাছ থকে তিনি মেরিক কে নিয়ে আসেন হাসপাতালে। বিশেষজ্ঞরা মেরিকের ডিফর্মড শরীর দেখে বিস্মিত হন। তার পেছনের নির্দিষ্ট কোন কারণ তারা খুঁজে পান না। যে মেরিক সারাজীবন পশুর মত ব্যবহার পেয়ে এসেছে সেই মেরিক হাসপাতালে পায় একজন স্বাভাবিক মানুষের মত ব্যবহার। হাসপাতালে বই পড়ে ও ও কাগজ দিয়ে ক্যাথিড্রাল এর নকশা তৈরি করে তার দিন কাটে। মেরিক খুব দ্রুতই কথা বলতে শেখে। ডক্টর ট্রেভেস মেরিক কে নিয়ে যান তার বাসায় তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে এক চায়ের দাওয়াতে। সেখানে প্রথম মেরিক কোন নারীর ভাল ব্যবহার পায় এবং অভিভূত মেরিক কেদে ফ্যালে। তারপর জীবনে প্রথমবার মেরিক ভদ্র সমাজে মানুষের মত এবং সামাজিক অধিকার নিয়ে একটা চমৎকার সন্ধ্যা কাটায়।
ধিরে ধিরে মেরিকের বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ পায়। সে দ্রুত শিখে ফ্যালে সামাজিক আচরন ভালবাসে বই পড়তে, চা এর দাওয়াতে সে উচ্ছল গল্প করে, থিয়েটারে গিয়ে নাটক দ্যাখে, মহিলাদের সাথে খোশগল্প করে। ধীরে ধীরে চলতে থকে কিম্ভূতকিমাকার মেরিকের সামাজিক হয়ে ওঠার প্রচেস্টা।
আর এক দিকে ডক্টর ট্রেভেস হয়ে ওঠেন উদ্বিগ্ন। মেরিকের ব্যাপারে তাঁর ভুমিকা নিয়ে তিনি সন্দেহাতীত হয়ে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন না তিনি ও কি মেরিক কে ব্যবহার করছেন সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য? নাকি তিনি যা করছেন তা মানবতা থেকেই করছেন? তিনি ভুগতে থাকেন মানবিক টানাপোড়নে।
মেরিক যখন হাসপাতালে সুখে বাস করতে শুরু করেছে তখন ঘটে এক ভয়াবহ ঘটনা, সামাজিক মানুষগুলো তাঁদের কুৎসিত রুপ দেখিয়ে দ্যায়। এক রাতে মেরিক কে করা হয় লাঞ্ছিত, এবং তাঁকে সার্কাস মাস্টার পর্টার আবারো ধরে নিয়ে যায় পুরোনো শো এর কাজে। আবারো মেরিক হয়ে ওঠে পশু। মেরিক সেখান থকে পালানর কথা ভাবে, সে কি পালিয়ে আসতে পারবে? আবারো মিশতে পারবে সভ্য সমাজে? সভ্য সমাজ কি তাঁকে সাদরে গ্রহন করবে?

কিন্তু মেরিকের মত ডিফরমড শরিরের মানুষ কে সমাজ আসলে কি চোখে দ্যাখে? সে আচার আচরনে , জ্ঞানে , বুদ্ধিতে যতই সামাজিক হোক না কেন, সমাজ কি পারে তাঁকে পুরোপুরি গ্রহন করতে? সমাজ কি পারে তাঁর কুৎসিত শরীরের পরিবর্তে আত্মিক জন মেরিক কে বিবেচনা করতে? আমরা দেখতে পাই সমাজের একটা অংশ কতটা ব্যর্থ , চোখে মুখে নাকে সুশীলতার মুখোশ লাগিয়ে আমরা সামাজিক জীবেরা ফুটিয়ে তুলি আমাদের কুৎসিত রুপ। আমাদের এই তথাকথিত সভ্যতার জাঁতাকলে পরে কি অবস্থা হয় জন মেরিক দের মত চমৎকার মানুষদের? সিনেমায় জন মেরিক উত্থান পতন শেষে হয়তো বা গ্রহনীয় হয়। কিন্তু বাস্তবে ‘জোসেফ মেরিক’ কিন্তু আত্মহত্যা করেছিল।

ভালো লাগার মত অসংখ্য ব্যাপার পুরো সিনেমা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ডেভিড লিঞ্চ তাঁর সৃষ্টিশীলতায় বার বার আমাদের ধাক্কা দিয়েছেন।
সিনেমায় জন মেরিক এক সময় ট্রেন ষ্টেশনে আক্রান্ত হয় মানুষ তাঁকে পশু মনে করে আক্রমন করে, ভয়াবহ একটা দৃশ্য – জন মেরিক চিৎকার করতে করতে বলেন-

“ I am not an elephant! I am not an animal! I am a human being! I am a man!”

মেরিকের ভুমিকায় ‘জন হার্টের’ অভিনয় অতুলনীয়। কেবল প্রশংসা দিয়ে তাঁর অভিনয়ের গুণকীর্তন গাওয়া সম্ভব নয়। শুটিঙ্গের সময় বেচারি কে টানা আট ঘন্টা ধরে মেকআপ করতে হয়েছে! ভাবতেই দুঃসহ লাগে। অ্যান্থনি হপকিন্স কে নিয়ে নতুন করে তো কিছু বলার নাই, আপ্নাতেই তিনি অনবদ্য অভিনয় করেন। তবে দর্শকরা তাঁর বিখ্যাত হাসি মিস করবেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত। কোথাও তাঁর সেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত হাসি টা পাবেন না।

লিঞ্চের সিনেমায় সাধারনত সেন্টিমেন্টালিজমের ভর কম থাকে কিন্তু এক জায়গায় তিনি প্রকোট সেন্টিমেন্টালিজম নিয়ে এসেছেন যা আমার ভালো লাগে নি- ট্রেনিঙের পর মেরিক কথা বলতে শুরু করেছে মাত্র সে সময় আবেগ আপ্লুত হয়ে মেরিক আওড়াতে থাকে বাইবেল এর (কিং জেমস) তেইশ নম্বর সাম-

“The Lord is my shepherd, I shall not want.
He makes me lie down in green pastures, he leads me beside quiet waters,
He restores my soul. He guides me in paths of righteousness for his name’s sake.Truly, though I walk through the valley of the shadow of death, I will fear no evil, for You are with me; your rod and your staff, they comfort me.You prepare a table before me in the presence of my enemies. You anoint my head with oil; my cup overflows.Surely goodness and love will follow me all the days of my life, and I will dwell in the house of the Lord forever."

যদিও এই সাম টা আমার নিজেরো পছন্দের কিন্তু তারপরেও এ ধরনের হঠাত সেন্টিমেন্টালিজম দর্শক এর পর্যবেক্ষণ শক্তি কে দুর্বল করে তুলতে পারে। একান্ত আমার ভাবনা। অন্যের কাছে ভিন্ন মনে হতে পারে।
সিনেমাটা অন্যান্য স্যুরিয়াল ফিল্মের চেয়ে অনেক বেশি সাবলীল। প্রথম দিকের স্যুরিয়াল ফিল্মের মত ঘন ঘন স্বপ্ন দৃশ্য নাই। তারপরেও লিঞ্চ তাঁর বিজারে কিছু ভাবনা ঢুকিয়েছেন। যেমন শুরুতেই দ্যাখা যায় জন মেরিকের মা অনেকগুলো হাতি দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছেন, সেখানে হাতিগুলো কি কেবল তাঁকে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে নাকি তিনি হাতিদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছেন তা সহজে বোঝা যায় না।
পুর সিনেমা জুড়ে লিঞ্চ কাজ করেছেন মানব মনের সুক্ষ সুক্ষ সুতা নিয়ে। তিনি কখনো সুতায় টান দিয়েছেন কখনো ছেড়ে দিয়েছেন। সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে সমাজের মনস্তাত্ত্বিক দিক গুলও। সমাজ কতটা কুৎসিত কতটা সুস্রী তাঁর অনেক ব্যাপার ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। কিন্তু আসলে গ্রহণীয় কি? তা তিনি আমাদের বোঝান নি, তা একান্তই আমাদের ওপরে নির্ভরশীল। লিঞ্চ বলেছিলেন

“It's better not to know so much about what things mean or how they might be interpreted or you'll be too afraid to let things keep happening. Psychology destroys the mystery, this kind of magic quality. It can be reduced to certain neuroses or certain things, and since it is now named and defined, it's lost its mystery and the potential for a vast, infinite experience.”

সর্বোপরি দিস ইজ আ মাস্টারপীস।

-----
পিনাক পাণি (নিবন্ধিত নাম)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ!!! স্যুরিয়াল ফিল্মের ভক্ত হয়ে গেলাম । পাশাপাশি ডেভিড লিঞ্চের এবং আপনার রিভিউয়েরও ! চালিয়ে যান ।

তালেব মাষ্টার

পিনাক পাণি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তারেক অণু এর ছবি

দেখব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।