আলো-অন্ধকার

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০১/০৯/২০১৪ - ৫:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দুপুর প্রায় ১২:৩০টা বাজছে। কমপক্ষে ২০ মিনিট হোল হাফিজ সাহেবের গাড়ি মোটামুটি একই জায়গায় দাঁড়ানো। স্কুল ছুটির কাছাকাছি সময়ে এই রাস্তাটায় আসাই ভুল হয়ে গেছে আসলে।

হাফিজ সাহেব গাড়িতে উঠেই মন দিয়ে একটা বই পড়তে শুরু করেছিলেন, আর ড্রাইভার ইয়াসিন এইসব ব্যাপারে একেবারেই অপদার্থ। ছেলেটা গাড়ি খারাপ চালায়না, ব্যাবহারও খুব ভদ্র। কিন্তু মাথায় কিছু নেই বললেই চলে। যেকোনো জায়গায় যাবার বড়জোর একটা পথই সে মনে রাখতে পারে, আর দিনের কোন সময় ঢাকার কোন রাস্তায় কেমন ভিড় হতে পারে এই ধরনের বিষয় মনে রাখার ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনটাই ইয়াসিন-এর নেই।
জুন মাস। বাইরে প্রচণ্ড রোদ। রাস্তার মানুষজনের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে গরমটাও খুব চড়া। তবে হাফিজ সাহেবের দামী, কালো কাঁচ লাগানো গাড়ির ভেতর বারমাসই শীতকাল থাকে। এই মুহূর্তেও গাড়ির ভিতরে ঝিরঝির আওয়াজে ফুল স্পীডে এসি চলছে। ইয়াসিন একদমই ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারেনা, তাই ওর দিকের ভেন্ট বন্ধ করে রাখা। তবে তাতে খুব একটা প্রভাব পড়ছেনা। গাড়ির ভিতরে পুরোটাই হিমশীতল হয়ে আছে।
হাফিজ সাহেব হাতের বইটা ভাঁজ করে রেখে চামড়া মোড়ানো সিটে গা ছেড়ে আরাম করে বসলেন। এই জ্যাম সহজে ছুটবে বলে মনে হচ্ছেনা। সেমিনারে পৌছতে দেরি হয়ে যাবে, তা হোক। আয়োজকরা নিশ্চয়ই আশা করে বসে নেই যে প্রধান অতিথি একদম সময়মত আসবেন। এইসব অনুষ্ঠান একটু দেরি করে শুরু হওয়াটাই নিয়ম, আর এমনিতেও তাঁর বক্তব্য শেষের দিকে। হাফিজ সাহেব মাত্র একটু চোখ বুজেছেন, এমন সময় একটা আওয়াজ শুনে চোখ মেলে তাকালেন। ড্রাইভার ইয়াসিন নিজের দিকের জানালা নামিয়ে মাথা বের করছে।
“এই ব্যাটা, এইদিকে জায়গা নাই! পিছে যা, পিছে যা!”
নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করা যায়না ইয়াসিনের মত হ্যাংলা-পাতলা শরীর থেকে এমন বাজখাঁই আওয়াজ বের হতে পারে। চিৎকারের পাশাপাশি ইয়াসিন প্রবল গতিতে ডান হাত দিয়ে একটা কাক তাড়ানোর মত ভঙ্গি করে চলেছে। তবে যার উদ্দেশ্যে এই হাত-গলার যুগলবন্দী সেই বুড়ো রিকশাওয়ালার তেমন কোন বিকার আছে বলে মনে হচ্ছেনা। বুড়ো অসীম মনোযোগের সাথে তাদের গাড়ির গা ঘেঁষে নিজের রিকশা উল্টোদিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইয়াসিন আবার তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, “চাচা মিয়া, তোমারে কিন্তু একবার কইসি, এদিক জায়গা হবেনা। রিকশা পিছে নাও তোমার।”
কিন্তু বুড়োকে দেখে মনেই হচ্ছেনা সে ইয়াসিনের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে। সে একইরকম ভাবে পরম মনোযোগের সাথে নিজের রিকশাটা সামনে ঠেলে চলেছে। প্যাডেল করছেনা, নেমে হাতে টেনে পার করার চেষ্টা করছে। ইয়াসিন আবার কিছু বলার আগে এইবার স্বয়ং হাফিজ সাহেব জানালা নামিয়ে গম্ভীর গলায় ধমকে উঠলেন।
“কি হচ্ছে কি? তোমাকে বলছে না এইদিকে জায়গা হবেনা? গাড়িতে ধাক্কা লাগাবে তো!”
সাহেব নিজে কষ্ট করে ধমক দিচ্ছেন, বোধহয় তারই সম্মান রাখতে বুড়ো এইবারে মুখ তুলে তাকালো। ক্লান্ত, ঘামে-ভেজা চেহারায় একটু মলিন হাসি ফুটিয়ে হাফিজ সাহেবকে আশ্বাস দিতে যাবে, তার আগেই হঠাৎ করে অঘটনটা ঘটে গেলো।
রিকশাটা এমনিতেই গাড়ির অনেক কাছে চলে এসেছিলো, বুড়োর মনোযোগ একটু অন্যদিকে যেতেই সামনের চাকা এসে গাড়ির ডানদিকে গোত্তা খেলো। হেডলাইটে না লাগলেও গাড়ির বডিতে ঘষা লেগে সাথে সাথেই বেশ বড় একটা দাগ পড়ে গেলো। ইয়াসিন কাতর গলায় হায় হায় করে উঠলো।
“এই যে হারামজাদা! দিলি তো সব শেষ করে! তোরে কতবার কইলাম...স্যার আমি ওরে কইছিলাম, আমার দোষ নাই স্যার!” রিকশাওয়ালাকে গালাগালির ফাঁকে ইয়াসিন নিজেকে বাঁচানোর কাজটাও সেরে ফেলতে চায়। তবে তার কোন দরকার ছিলোনা। হাফিজ সাহেব জানেন বুড়োটাই কোন কথা না শুনে তার এই ক্ষতিটা করেছে। তার মেজাজ মুহুর্তের মাঝে ভয়ংকর খারাপ হয়ে গেলো। মোটাসোটা মানুষ হলেই প্রয়জনে হাফিজ সাহেব বেশ দ্রুত চলাফেরা করতে পারেন। এখনও সেইরকম ক্ষীপ্র ভাবেই গাড়ি থেকে নেমে সোজা রিকশার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।
রিকশাওয়ালা বুড়ো মনে হয় বিপদ আঁচ করতে পেরেই কয়েক পা পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু তার আগেই হাফিজ সাহেব পরপর দুইবার বেশ জোরে লোকটাকে চড় মেরে বসলেন। তিনি বিশালদেহী মানুষ, গায়ের জোরও নেহায়েত কম না। তবে চড় খেয়ে বুড়োটা যতটা না ব্যথায় তারচেয়ে বেশি অপমানেই কেমন যেন কুঁকড়ে পিছিয়ে গেলো। গোটা শরীরটা কেমন যেন ভাঁজ করে, হাতদুটো মাথার উপরে তুলে নিজেকে আড়াল করে ফেলেছে লোকটা। তবে হাফিজ সাহেব তাতে দমে না গিয়ে আরও কয়েকবার এলোপাথাড়ি হাত চালিয়ে গেলেন। তারপর এইভাবে সুবিধা হচ্ছে না দেখে বুড়োর ঘাড়ে ধরে একটানে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসলেন।
“হারামজাদা, তোরে এতবার মানা করলো, কথা কানে যায়না? গাড়িতে ধাক্কা না লাগাইলে তোদের পেটের ভাত হজম হয়না, না?”
হাফিজ সাহেবের গলা অত্যন্ত পরিশীলিত, অত্যন্ত সুন্দর। নিজের কান শুনেও যেন বিশ্বাস হয়না যে এমন সুন্দর কণ্ঠস্বরের একজন মানুষ এমন কর্কশভাবে কথা বলতে পারে। কাকের ডাক কাকের গলায় তাও সয়ে আসে, কিন্তু কোকিলের গলায় একেবারে খাপছাড়া লাগাটাই স্বাভাবিক।
বুড়ো রিকশাওয়ালা এতক্ষণে মুখ খুললো।
“স্যার, ভুল হইয়া গেসে স্যার! আমি বুঝিনাই স্যার! আমি ভাবসিলাম...”
বুড়ো কি ভেবেছিলো সেটা বলতে না দিয়েই হাফিজ সাহেব আবার কয়েকটা থাপ্পর বসিয়ে দিলেন। সেই সাথে চলতে লাগলো গালিগালাজ।
“শূয়রের বাচ্চা, তোরে ভাবতে কে বলসে? গাড়ির রঙটাই বরবাদ করে দিলি হারামির বাচ্চা!”
এতক্ষণে ইয়াসিনও নেমে তার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। স্যার-এর এই রুপ ইয়াসিন আগেও অনেকবার দেখেছে। কয়েকবার নিজেও চড়-থাপ্পর খেয়েছে। এই মুহুর্তে ইয়াসিন একটু ভয়ই পাচ্ছে। রাগের মাথায় স্যার বাড়াবাড়ি কিছু করে ফেললে চারপাশের লোকজন সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। ইয়াসিন দুই পা এগিয়ে অনেকটা স্যার-এর সামনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো।
রেগে গেলে হাফিজ সাহেবের আসলেই নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। এই মুহুর্তে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে রিকশাওয়ালার চুল ধরে টেনে লোকটার মুখ নিজের গাড়ির ছাদের ওপর চেপে ধরে সমানে গালাগালি করে চলেছেন। পাশ থেকে এক লোক মৃদুস্বরে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করতেই হাফিজ সাহেব চট করে তার দিকে ঘুরে হুংকার দিয়ে উঠলেন।
“আপনি কে ভাই? এইখানে আপনার কি কাজ? গাড়ি আপনার না আমার? একগাদা টাকা লাগবে এখন কাজ করাতে! আপনি দিবেন? দিলে ভালো, নাহলে রাস্তা মাপেন!”
ঢাকার রাস্তায় কিছু হলেই দেখতে দেখতে অনেক লোক জমে যায়, এবং সবাই দুই-দশটা মন্তব্য করেই। এই পথচারী ভদ্রলোকও আসলে তার ব্যতিক্রম কিছু না। তার সামান্য কথার প্রেক্ষিতে হাফিজ সাহেবের এমন অগ্নিমুর্তি দেখে ভদ্রলোক একদম হকচকিয়ে গিয়ে মানে মানে সরে পড়লেন। অন্য যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের মুখেও কেমন একটা বিস্ময় আর অস্বস্তির ছাপ। আসলে রাস্তায় এই ধরনের খুচরো এক্সিডেন্ট দিনে কত হাজারবার হয় তার কোন হিসাব নেই। হাফিজ সাহেবের এমন বাড়াবাড়ি প্রতিক্রিয়ায় তাই রাস্তার মানুষজন তো বটেই, তার নিজের ড্রাইভার ইয়াসিনও কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেছে। ইয়াসিন অবশ্য আন্দাজ করছে বাসায় ম্যাডাম বা ছোট সাহেবের কোন ব্যাপার নিয়ে স্যারের মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিলো, বেচারা রিকশাওয়ালা তারই খেসারত দিচ্ছে।
হাফিজ সাহেব রিকশাওয়ালার ঘাড় একহাতে ধরে রেখেই ইয়াসিনের দিকে তাকালেন।
“ভালো করে দেখো কতখানি লেগেছে, কিরকম খরচ হবে।” ইয়াসিন জায়গাটা ইতিমধ্যে দেখে নিয়েছে, সে বেশ ভয়ে ভয়েই বললো, “স্যার চার-পাঁচ হাজার লাগবে, তাও ঠিক এই রঙ মনে হয়না মিলাইতে পারবে।”
হাফিজ সাহেবের রাগে যেন আর জ্বালানী পড়লো। অনেক শখ করে তিনি এই মেটালিক গ্রীন রঙ্গটা পছন্দ করেছিলেন, কিন্তু এখন সামনের ডানদিকে সবুজের অন্য কোন একটা শেডের একটা কুৎসিত পোঁচ নিয়ে চলতে হবে। একরকম অবচেতনভাবেই তার হাত বুড়োর ঘাড়ে আরো শক্ত হয়ে এঁটে বসলো। ইয়াসিন অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে। আজকে কপালটা খারাপ। স্যার বড় একটা কেলেঙ্কারি করেই ছাড়বেন বলে মনে হচ্ছে। ঠেকানোর চেষ্টা করে লাভ তো হবেই না, উলটো ওকেই কয়েক ঘা খেতে হতে পারে। রিকশাওয়ালার জন্য তাও রাস্তার লোকজন দুই-চারটা কথা বলতে পারে, তাকে কেউই বাঁচাতে আসবেনা। কাজেই ইয়াসিন হাফিজ সাহেবের থেকে যতখানি সম্ভব দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো ঘটনা কোনদিকে যায়।
হাফিজ সাহেব এইদিকে বুড়ো রিকশাওয়ালার ঘাড় ধরে গাড়ির উপর চেপে ধরে রেখেছেন। লোকটা কিছুক্ষণ নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। হাফিজ সাহেব হুঙ্কার দিয়েই চলেছেন, “হারামজাদা! গাড়িটার রঙ্গটাই নষ্ট করে দিলি! দে, এই কাজ করানোর টাকা বের কর! নইলে আজকে তোরে এইখানেই শেষ করে দিবো!”
রিকশাওয়ালা এইদিকে একচুলও নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে আছে। বেচারা বুঝতে পারছে না এ কেমন বিপদে পড়লো। তার দোষ হয়েছে এইটা ঠিক, কিন্তু এইরকম দুই একটা দুর্ঘটনা ঢাকার রাস্তায় রোজই হচ্ছে, তার জন্য কেউ এতটা রেগে যের চিৎকার তে পারে এইটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। কিন্তু হাফিজ সাহেবের শেষ কথার পরে সে অনেক সাহস করে বললো, “স্যার, আমি গরিব মানুষ, এতো টাকা কই পাবো! মাফ করে দেন স্যার!”
বুড়ো কথাটা যতটা সম্ভব মিনমিন করেই বলেছিল, কিন্তু হাফিজ সাহেব আবার চিৎকার করে উঠলেন। “টাকা তো দিতে পারবিনা জানি। দাঁড়া, আজকে তোকে এমন শিক্ষা দিবো আর কোনদিন কোন গাড়ির ধারেকাছেও আসবিনা।” বলতে বলতেই হাফিজ সাহেব লোকটার ডান হাত চেপে ধরলেন। অন্যহাতে তিনি একটানে গাড়ির দরজা খুলে ফেললেন, এবং তারপর বুড়োর হাতটা গাড়ির যেইখানে দরজার উপরদিকটা লাগে সেইখানে চেপে ধরলেন। ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে ইয়াসিন বুঝতে পারলো স্যার কি করতে যাচ্ছেন। একটা বোবা আতংক যেন ইয়াসিনের বুকে চেপে বসলো। ইয়াসিন দ্রুত অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। এই দৃশ্য সে দেখতে চায়না।
হাফিজ সাহেব শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে গাড়ির দরজাটা আছড়ে বন্ধ করলেন। এমনিতে এত জোরে বাড়ি দিয়ে দরজা বন্ধ করলে গাড়ির বডি আর দরজার ধাক্কায় একটা জোরালো ধাতব আওয়াজ হওয়ার কথা। কিন্তু এইবারে তা হলোনা, কারন দরজা আর গাড়ির বডির মাঝখানে একটা মানুষের হাত বন্দি হয়ে ছিলো।গাড়ির দরজা ভীষণ জোরে রিকশাওয়ালার হাতের উপর গিয়ে পড়লো। একবারে রাগ কমলো না বলেই হয়ত হাফিজ সাহেব আরো দুইবার দরজা দিয়ে লোকটার হাতের উপর বাড়ি মারলেন। তিনবারই ধাতব আওয়াজের জায়গায় একটা ভোঁতা, বীভৎস আওয়াজ করে লোকটার আঙ্গুলগুলো থেঁতলে যেতে লাগলো। রিকশাওয়ালার প্রচণ্ড আর্তনাদের আড়ালে সেই আওয়াজ আর কেউ শুনতে না পেলেই ইয়াসিন ঠিকই শুনতে পেলো। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও ওর মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হোল না। ইয়াসিন স্রেফ হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। অবশেষে হাফিজ সাহেব এক ধাক্কা দিয়ে বুড়োটাকে রাস্তার একপাশে ফেলে দিয়ে, চারিদিকে একবারও না তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন। তিনি এই শহরের লোকজনকে চেনেন। কিছু চিন্তা করার সময় না দিয়ে এখনই এইখান থেকে সরে পড়তে হবে। রাগের মাথায় তিনি যা করে ফেলেছেন তা এতটাই ভয়ঙ্কর যে সবার সামলে উঠতেও একটু সময় লাগবে। সেই সময়টুকুই তার ভরসা।
স্যারকে গাড়িতে উঠতে দেখেই ইয়াসিনও ছুটে গাড়িতে উঠে বসলো। সামনের দিকে এখনো হালকা ভিড় আছে, কিন্তু প্রচণ্ড ভয়েই যেন ইয়াসিনের মাথা খুব ভাল করে কাজ করা শুরু করেছে। গাড়িটা একটানে ব্যাকে দিয়ে সে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে চলে গেলো। যেন এই হঠাৎ আওয়াজেই পেছন থেকে অনেকে “ধর, ধর” বলে শোরগোল শুরু করলো। কিন্তু ইয়াসিন জানে ধরা পড়লে কি হবে। প্রচণ্ড গতিতে গাড়িটা ঘুরিয়ে, দ্রুত পরপর কয়েকবার লেন পালটিয়ে সে গাড়িটা বের করে আনলো।
গাড়ি ঘটনা থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরে আসার পর হাফিজ সাহেব অবশেষে গা ছেড়ে হেলান দিয়ে বসলেন। হঠাৎ করে মাথা গরম করে অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন, এইটা এখন তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন। সকাল থেকে এমনিতেই মেজাজ খারাপ, সময়মতো রাশ টেনে ধরতে পারেননি। যাইহোক, এখন আর কিছু করার নেই। হালকা অপরাধবোধ লাগলেও আর ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। তিনি ভাল করতে গেলেও এখন লোকজন গাড়ি ভাঙচুর আর গণপিটুনি ছাড়া কথাই বলবে না। যা হওয়ার হয়েছে, এখন আর এইসব নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। এইদিকে সেমিনারে পৌঁছাতেও দেরি হয়ে গেলো। হাফিজ সাহেব একটু চোখ বুজে বসে মনের ভিতর বয়ে যাওয়া ঝড়টাকে শান্ত করার চেষ্টা শ্ববিদ্যালয়ে
মেইন রোডের উপরেই বহুতল দালানটার সামনে গাড়ি পার্ক করে ইয়াসিন আস্তে করে হাফিজ সাহেবকে ডাক দিলো। “স্যার, এসে গেসি।” হাফিজ সাহেব চোখ খুলে খানিকটা সময় কেমন যেন ঘোরলাগা ভাব নিয়ে বসে থাকলেন, তারপর দ্রুত পাশ থেকে কাগজগুলো গুছিয়ে হাতে নিতে শুরু করলেন। আজকে এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার একটা সেমিনারে বক্তব্য রাখার কথা। এরমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকজন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বের হয়ে এসেছে। হাফিজ সাহেব তাড়াতাড়ি নেমে তাদের একজনের সাথে করমর্দন করলেন।
“সরি, একটু দেরি হয়ে গেলো আসতে। রাস্তায় একটা ছোট অ্যাকসিডেন্ট...”
“অ্যাকসিডেন্ট? আপনি ঠিক আছেন তো স্যার?” একটা অল্পবয়স্ক ছেলে প্রায় আঁতকে উঠলো।
“না না, আমার কিছু হয়নি। তেমন মেজর কিছু না, এই একটু দেরি করিয়ে দিলো আর কি!”
“সমস্যা নেই স্যার। আমরা প্রোগ্রাম শুরু করে দিয়েছি, বলা হয়েছে আপনি এসে সমাপনি বক্তব্য রাখবেন। আসুন স্যার।” ছেলেটা তাকে পথ দেখিয়ে অডিটোরিয়াম-এর দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। হাফিজ সাহেব কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যেই তার পিছন পিছন চললেন।
সেমিনারের একদম শেষ পর্যায়ে এসে হাফিজ সাহেব স্টেজে উঠলেন। কিছু বলার আগে উপস্থিত ছাত্রদের হাততালির তোড় থামার জন্য প্রায় দুই মিনিট অপেক্ষা করতে হলো তাকে। অবশেষে যখন তিনি তার কথা শুরু করলেন, তখন ইয়াসিন হলঘরের এক কোনায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সব অনুষ্ঠানেই ইয়াসিন স্যারের কথার সময় ইয়াসিন দাঁড়ীয়ে শোনে। স্যার ইংরেজিতে বলেন, ইয়াসিন একটা শব্দও বুঝতে পারেনা, তাও তার খুব ভাল লাগে। এইরকম নামীদামী একজন মানুষের গাড়ি চালায় ভেবে ওর বেশ খুশি খুশি লাগে। কিন্তু আজকে ইয়াসিনের তেমন কিছু মনে হচ্ছেনা। আজকে সে স্যারের সুললিত গলাও শুনতে পাচ্ছেনা, এতগুলি মানুষের হাততালিও শুনতে পাচ্ছেনা। আজকে ওর কানে একটু পরপর শুধু মটমট করে হাড় ভাঙার আওয়াজ বেজে চলেছে। আজকে ওর কানে শুধু একজন বুড়ো মানুষের বুক-কাঁপানো আর্তনাদ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছেনা।

হাম্মাদ আলি


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

রিকশাওয়ালাকে টর্চারের বর্ণনাটা অত্যন্ত visceral; পড়ার সময় মনে হচ্ছিল আমাকেই টর্চার করা হচ্ছে।

Emran

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভালো লিখেছেন, তবে ঢাকার রাস্তায় এরকম কান্ড করে বের হয়ে আসাটা অবিশ্বাস্য।

আরও গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম।

শুভেচ্ছা হাসি

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

চলুক

মরুদ্যান এর ছবি

একমত। তিন তিন বার আঙুল থেঁতলানোর জন্য যে পরিমাণ সময় লাগবে, ততক্ষণে পাব্লিক গাড়ির সানডে মানডে ক্লোজ করে দিবে, তাও আবার জ্যামের মধ্যে দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।