ছবির দেশ থেকে নকশী কাঁথার দেশে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২০/০৭/২০১৬ - ২:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১)
অপারেশন শেষ হয়েছে। হাসপাতালের বিছানায় আধশোয়া, হাতে গল্পের বই, সুনীলের লেখা ভ্রমণ কাহিনী - ছবির দেশে কবিতার দেশে। সামনের বারান্দায় চোখ পড়তেই ধাঁধা লাগলো - আমার সামনে দাঁড়ানো শামসুর রাহমান!

২)
শৈশবে আমার জ্বর আসতো ঘন ঘন। অনেক জ্বর। ১০৭-এ নাকি আমি দুবার পা দিয়েছি। কৈশোরে এসে এর ধরণ বদলে যায়। জ্বর ঘন ঘন আসতো ঠিকই, তবে তাপমাত্রা থাকতো ৯৯-এর কোঠায়। তা নিয়ে অবশ্য আমার খুব বেশী আপত্তি ছিল না, মানিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু আমার বাবা মানতে নারাজ। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোস্টেল থেকে ছুটিতে ফিরলেই শুরু হতো নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা। সমস্যা হলো, কোনো সমস্যারই সাক্ষ্য প্রমান ডাক্তার আমার দেহে খুঁজে পান না। শুধু লিভারে খানিকটা সন্দেহের আভাস পাওয়া গেলো।

বাবা বুঝিয়ে চলে, লিভার মানব দেহের সবচে বড় এবং খুবই গুরুত্তপূর্ণ অর্গান। লিভার এতই বড়ো যে এর এক অংশে সমস্যা শুরু হয়ে গেলেও বাদবাকী অংশ তার কর্ম ঠিকই সিদ্ধ করে যায়। সাধারণ বায়োপ্সি করে লিভারের স্যাম্পল এনে সব কিছু জানা যায় না। লিভারের যে অংশ থেকে স্যাম্পল আনা হলো তা যদি সমস্যামুক্ত অংশের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে টেস্টে সব কিছু নাকি ধরাও পড়ে না।

মুশকিল থাকলে আশানও আছে। পেট কেটে, পাইপ দিয়ে ক্যামেরা ঢুকিয়ে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিভারের নানা অংশ দেখে, সবচে সন্দেহজনক অংশ থেকে স্যাম্পল নিয়ে এলেই হলো। কিন্তু ব্যাপারটা জটিল! তাই আমাকে ফুল এনেস্থেসিয়া নিতে হবে। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা প্রথমে মনে হচ্ছিলো অপত্য স্নেহের চরম পরাকাষ্ঠা। তবে ফুল এনেস্থেসিয়ার এডভেঞ্চারে এই পর্যায়ে এসে আমি শিহরিত; আমার মা কিঞ্চিৎ ভীত। বাবা’র এক কথা, শেষটা জানা দরকার।

৩)
ফুল এনেস্থেসিয়া হলো, লিভার স্যাম্পলও এলো। কিন্তু, এতো কিছুর পর তো আর সাথে সাথে বাড়ী ফেরা যাবে না। রিকভারী পিরিয়ড হাসপাতালে কাটাতে হবে। সেটা বড় কোনো সমস্যা না। বারডেম হাসপাতালের বন্দোবস্ত তখন খুবই ভালো - পরিচ্ছন্ন বিছানা, পরিপাটি খাবার, সময়মত দেখভাল। আর সাথে আছে সুনীলের ভ্রমণ কাহিনী; প্যারিস থেকে ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা পর্যন্ত বিনা ভাড়ায় ঘুরছি।

বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই বাবা আসবে। গল্পের বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি সামনের বারান্দায় চোখ বুলাই। চোখে পড়ে - বড় চশমা’র ফ্রেমের আড়ালে ঢাকা, পক্ক কেশে মোড়া, একটি সৌম্য দর্শন মুখ। শামসুর রাহমানকে সামনাসামনি প্রথম দেখলাম। চিনতে দ্বিধা হয়নি একটুও। এগিয়ে গেলাম। অল্প বয়সে জড়তা কম থাকে, কথা বলাও শুরু করলাম সাবলীলভাবে। তাঁর সমসাময়িক অন্য একজন লেখক পাশের রুমে আছেন। সেজন্যই কবি এসেছেন।

হাতে ধরা ছবির দেশে কবিতার দেশে বইটি কবিকে দিলাম। কবি লিখলেন, “আমরা যে মানুষ এই সত্য যেন চরম দুঃসময়েও ভুলে না যাই”।

৪)
এক সময়ে গল্পের বই পড়তাম, সংগ্রহে রাখতাম। সেসবের প্রায় কিছুই আজ কাছে নেই। তবে এই বইটি সাথে আছে। ছবির দেশ থেকে শুরু করে নকশী কাঁথার দেশ পর্যন্ত সর্বত্রই মানবতা আজ পর্যুদস্ত। অপরাধ সংগঠন এবং অপরাধের পক্ষে সাফাই গাওয়া আজ প্রত্যহিকতায় পর্যবসিত। খবর শোনাও এখন আতঙ্কের নামান্তর! টিভি বন্ধ করে পুরোনো বই হাতড়াই। চোখ পড়ে ছবির দেশের উপর। নিস-কান সহ ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরাতে কাটানো চমৎকার ছুটির দিনগুলি অলীক মনে হয়।

শামসুর রাহমান অনেক আগেই লিখেছিলেন, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। সেই যাত্রা বেগবান হয়েছে। সমস্যার অস্তিত্ব অস্বীকার করার সংস্কৃতি সমস্যাকে বরং তীব্রতর করেছে। নিষ্ঠূর সময়ের নিপীড়িত ক্রীতদাস হয়ে এইসব খবর শুনি, শঙ্কিত হই, চেনা জানা মানুষের খোঁজ খবর নেই। পরদিন ঘুম ভেঙে টিভি ছাড়তে ভয় পাই!

যাদের মনের অবস্থা আমার মতন, তাদের জন্য শার্ল বোদলেয়ারের একটি কবিতা শোনাই (সুনীল অনূদিত):

সব সময় তোমাকে অবশ্যই মাতাল হতে হবে। …
সময়ের বীভৎস বোঝা যাতে অনুভব করতে না হয়,
যা তোমার কাঁধ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে,
নুইয়ে দিচ্ছে মাটির দিকে,
মাতাল তোমাকে হতেই হবে,
একটুও থামলে চলবে না।
কিসে মাতাল হবে,
সুরা, কবিতা, অথবা উৎকর্ষ,
যেটা তোমার পছন্দ।
কিন্তু মাতাল হও।

একটি কথা শুধু যোগ করি - নিজে শিল্পের নেশায় বুদ হয়ে থাকলেই চলবে না। সবাইকে টেনে নিন, পরিবার থেকেই শুরু করুন। যে মানুষ সুনীল-শামসুর পড়ে, রবীন্দ্র-নজরুল গায়, ছবি আঁকে, ভাস্কর্য গড়ে - দিন শেষে সে শুধুই মানুষ, কোনো ভয়াবহ দানব নয়।

- অভিজিৎ দেব


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংলগ্ন লেখা। প্রটাগনিস্ট নিজের অসুস্থতাকে, শামসুর রাহমানকে, সুনীলের লেখাকে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে জোরজার করে এক ফ্রেমে আঁটানোর চেষ্টা করেছেন। টুকরো টুকরো জিনিস ঠিকমতো সেলাই করে জুড়তে না পারলে কোন একটা কাঁথা হবে বটে, তবে নকশীকাঁথা হবে না।

অতিথি লেখক এর ছবি

জোরজারের ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। ঠিক কেন উপরোল্লিখিত বিষয়গুলি আপনার অসংলগ্ন মনে হলো জানালে বুঝতে পারতাম। তবে হ্যা, আমারও মনে হয় হঠাৎ করেই উপসংহার টেনে শেষ করে দিয়েছি। তার দায় নেহায়েতই আমার আলস্যপূর্ণ স্বভাবের। পড়ার ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ - অভিজিৎ দেব

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

ভালো। আরো দীর্ঘ হতে পারত। দ্রুত শেষ হয়ে গেলে লেখা মগজে বসেনা সহজে।

লেখা চলুক।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক এর ছবি

ফেইসবুক স্ট্যাটাস হিসেবে এটি লিখেছিলাম। সেই অনুপাতে তখন এটি বেশ লম্বাই মনে হচ্ছিল। ব্লগের প্রবন্ধ / গল্প হিসাবে চিন্তা করলে আমারও মনে হয় হঠাৎ করেই উপসংহার টেনে শেষ করে দিলাম। সামনে যদি আরো লিখি তো এদিকটা খেয়াল রাখবো। পড়ার ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। - অভিজিৎ দেব

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটি ভালো লাগলো। অন্যান্যদের সাথে সহমত যে খুব হঠাৎ করে শেষ হয়েছে। আমাদের জীবনে অসংলগ্ন চিন্তা ও ঘটনা জড়াজড়ি করে থেকে, ট্রেনের জানলা দিয়ে জীবনকে দেখার মত , সুতরাং অসংলগ্নতা আমার কাছে মন্দ লাগেনি। অসুস্থ অবস্থায় শামসুর রাহমানকে স্বপ্ন দেখার এবং তার সাথে কথোপকথনের একটি বর্ননা আছে সদ্য প্রকাশিত সিনহা আবুল মনসুরের "জীবন এত ছোট কেন ?" বইতে । একটু দেখে নেবেন।
ধন্যবাদ
শাহাব আহমেদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।