ট্যাক্স, লীডিয়া, এবং লাইব্রেরী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৮/০৫/২০১৭ - ১:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এমন নয় যে অনেক দূরে অথবা ঝক্কি-ঝামেলার পথ। দুই-তিন মিনিট পূর্ব দিকে হাঁটলেই ভূমি থেকে নিম্নদিকে একতলা এবং উর্ধে দুই তলার লাল টকটকে ভবনটি কচি-কাঁচা-আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সহ প্রায় উনতিরিশ হাজার জনগনের নিবিড় জ্ঞান অর্জনের জন্য সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত সাধারণ পাঠাগার- ওয়েষ্ট লাফায়েত পাবলিক লাইব্রেরী। গত তিন বছরের প্রতিটি দিনেই এই রক্তলাল ভাবনের পাশ দিয়ে হেঁটেছি। কিন্তু, ঘূর্ণাক্ষরেও ভেতরে উঁকি দেয়ার আগ্রহ অনুভব করিনি। আমেরিকার অদ্ভূত এক নিয়মের মারপ‌্যাচে পরে আজ কাঁচের দরজা গলে ভিতরে পা দিতে হল। নিয়ম বললে পক্ষপাত হয়ে যাবে। যেখানে প্রতিদিন বহু নিয়ম ভাঙ্গা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে, সেখানে নিয়মের ঘাড়ে দায় দেয়া উচিত হবে না। সত্যিকারের কারণটা হচ্ছে- অর্থযোগ। বিষয়টা একটু খোলাশা করি। আমেরিকাতে যাদের বৈধ আয় আছে, তাদের প্রত্যেকে বছরের শুরুতে ট্যাক্স-রিটার্ন (কর-বিবরণী) জমা দিতে হয়। কর বিবরণী তৈরিতে সাহায্য করার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান থাকে। সমাজ সেবা হিসাবে ওয়েষ্ট লাফায়েত পাবলিক লাইব্রেরী বিনেপয়সাতে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করে। বিনেপয়সাতে যা পাওয়া যাবে, ইহার জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করার মতো উদার ভাববার কোনো কারণ আমার নেই। তাই, কর-বিবরণী তৈরি করার উদ্দেশ্যে লাইব্রেরির দরজাতে উঁকি দেয়া।

গোছানো পরিবেশে শ্মশানের নীরবতা। বাম পাশের শুরুর দিকে সারি সারি বইয়ের তাক, অন্য প্রান্তে কিছু কম্পিউটার। বই এবং কম্পিউটারের মাঝে পড়ার জন্য কিছু টেবিল-চেয়ারের সারি। পিছনের দিকে বসার জন্য কিছু সোফা- সম্ভাবত পড়তে পড়তে কারো চোখে ঘুম চলে আসলে এই বিশেষ ব্যবস্থা। লাইব্রেরীর এক কোনাতে ভিডিও-অডিও এর সাজ-সরঞ্জাম। ভিতেরের রুমের আয়োজন আরও কয়েক ধাপ উপরে। বাচ্চাদের জন্য বই, কিছু কম্পিউটার, বড় বড় পর্দার মনিটর। সাথে, বাচ্চাদের মধ্যে হাতাহাতি করার জন্য প্রশস্ত জায়গা। তবে, এতকিছুর পরেও যে সবটুকু আলো কেড়ে নিতে সক্ষম তিনি হাতের ডান পাশে কাউন্টারে মাত্রই যৌবনে পা দেয়া এক ত্বন্বী। এক বাক্যে বলা যায় "মুনিগন ধ্যান ভাঙ্গি শুনে পদধ্বনি"-টাইপ সুন্দরী। ছয় ফুট লম্বা দুধের সাদা গায়ের রংয়ের এমন কোনো সুদর্শণা তরুনীকে অতি সহজেই হলিউড স্থান করে দিতে প্রস্তুত। এরপরেও, সে কেন এমন বৃহৎ নীরব লাইব্ররীর কাউন্টারে কোনাতে দাঁড়িয়ে দুইপয়সা অর্জণের জন্য একঘেয়েমি কাজ করছে, কে জানে?

এমন ত্বন্বীকে উপেক্ষা করে ট্যাক্সের মতো অননুরাগ কোনো কাজে সময় দেয়া রীতিমতো অন্যায়, সাথে প্রকৃতিকেও অবহেলা করার সামিল। ওনার সাথে আলাপ করা একান্ত কর্তব্য জ্ঞান করেই জিজ্ঞাসা করলাম, "তোমার এখানে দেখছি বেশ আয়োজন। জ্ঞান অর্জনের জন্য তোমার এই আয়োজনকে সাদুবাদ জানানো উচিত।"

ত্বন্বী বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলল, "আমি লীডিয়া। তোমাকে সাহায্য করতে পেরে বেজায় খুশি। তুমি দেখছি এখানে প্রথম। আমাদের জ্ঞানর্জনের আরও ব্যবস্থা আছে।" একটি দম নিয়ে, "তুমি যদি উপর তলার ডানের রুমে যাও, তাহলে দেখবে বহু ম্যাগাজিন এবং জার্নাল আছে। তুমি চাইলেও ওখানে কিছু সময় কাটাতে পার।"

এরপরে যা বলল, তা কিছুটা অবাক করার মতো- লাইব্রেরীর মধ্যে নিত্য নতুন ভিডিও গেম খেলারও বিশেষ ব্যবস্থা আছে! বঙ্গদেশীয় রীতিনীতির সাথে বেশ বেমানান। ধর্ম সাক্ষী রেখে বলছি, বই পড়া বা ভিডিও গেম খেলা নয়, কেবল ওমন ত্বন্বীর সাথে কিছু কথা বলার জন্য যে কেউ লাইব্রেরীতে আসতে চাইবে। আমি তো বেকার যুবক!

আগ্রহ নিয়ে লাইব্রেরীতে অর্থাৎ ওনার সাথে দেখা করতে চাইলে কি কি করতে হবে জানতে চাইলেই লীডিয়া চোখে-মুখে সূর্যের আলো ছড়ানো হাসি দিয়ে দীর্ঘ্য কথা বলার যে প্রস্তুতি নিল, তা দেখে মনে হল যে লীডিয়া ওমন প্রশ্নের জন্যই এতটা সময় অপেক্ষা করছে। হলুদ রংয়ের ছোট এক টুকরা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে দীর্ঘ্য দম নিয়ে যা বলল, ইহার সারমর্ম হচ্ছে,"এই কাগজে তোমার নাম-ধাম লিখে দাও, তোমার পরিচয় পত্র দাও, আমি দুই মিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।"

কবিকূলের কোনো সনামধন্য একজন নারীর ৩১-৪০ বয়সের তুলনা করেছেন আমেরিকা সাথে- টেকনিক্যালি পারফেক্ট। অর্থৎ, চল্লিশের কোঠাতে পা দিয়ে একজন নারীর মধ্যে যে বুদ্ধি এবং বিচারের পূর্ণতা আসে, আমেরিকার রাষ্ট্র ব্যবস্থাও তেমন- অফিসের কাজ-কর্ম অতি দ্রুত এবং সরল। দেখা যাবে, জমির দলিল করে মালিকানা পরিবর্তনে সর্বসাকুল্যে সময় লাগছে সাড়ে চার মিনিট। তেমনি, করিৎকর্মা লীডিয়া দেড় মিনিটের মধ্যে আমার হাতে দুইটি লাইব্রেরীর কার্ড ধরিয়ে দিয়ে, লাইব্রেরীর অনলাইন একাউন্ট ঠিক করে দিল।

এবার নিয়মাবলীর পালা। "এখন থেকে তুমি এই গ্রন্থাগারের একজন সম্মানিত সদস্য।" এত দ্রুত যে সম্মান পাওয়া যাবে, তা আগে কখনো জনা ছিল না। যদি, ঘূর্ণাক্ষরেও জানতাম, তবে তিন বছর আগেই এখান থেকে সম্মানকে বোগলদাবা করে নিয়ে যেতাম।

মেয়েটার কিছু সময় পর পর দীর্ঘ্য দম নেবার এক বাতিক আছে। আবারও দম নিয়ে বলল,"তবে, তোমার বিশ্বস্ততা অর্জন করতে চার সপ্তাহ সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যে আমরা তোমাকে দুইটি করে বই বা ভিডিও ধার দিব, তিন সপ্তাহের জন্য। তুমি চাইলে, এখানে এসে বই গুলো পুনরায় ধার নিতে পারবে।"
- চমৎকার ব্যবস্থা। মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যেই আমি তোমার কাছে বিশ্বস্ত হয়ে উঠব। বেশ, বেশ...।
- এক মাস পরে যখন তোমার উপরে আমাদের অগাধ আস্থা অর্জিত হবে, তখন তুমি চাইলে এক সাথে ১০০ টি বই ধার নিতে পারবে। তবে, তিন সপ্তাহের মধ্যে রি-নিউ করতে হবে।

এই রূপসী মেয়ে বলে কি! এক সাথে ১০০ টি বই নিয়ে কোনো দিন পড়া হবে না-কি? কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, "১০০ টি বই কেবল সাজিয়ে রাখার জন্য নেয়া যেতে পারে, পড়ার জন্য নয়। আর যদি কোনো কারণে পড়ার ইচ্ছা একবার মাথাতে ঢুকাই, তাহলে নিজের কাজ-কম্যের জলাঞ্জলী দিয়েও তিন সপ্তাহে পড়ে শেষ করা যাবে না। এত গুলো বই রাখার জন্য তোমাদের কাছে কোনো ব্যবস্থা আছে কি? এই যেমন, বই ধার নেবার সময়, তোমারা উপযুক্ত মাপের একটা বই রাখার শেলফ ধার দিলা। বই ফেরৎ দেবার সময় শেলফটাও ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম।"

সাধারণত, প্রকৃতি অতি সুন্দরী মেয়েদের (সুন্দরী মেয়েদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি) মধ্যে কিছুটা বুদ্ধীর সামান্য অপ্রতুলতা রেখে দেয়- ভারসম্য করার জন্য। সম্ভাবত, লীডিয়াও একই ধাঁচের। আমার কথা শুনে প্রথমে তার ভাবখানা এমন হল যে, এমন আজব ধরণের কথা কেউ বলতে পারে বলে তার ধারণাতেই ছিল না। কিছুটা সময় পরে বলল,
- তোমাকে তিন সপ্তাহ পরে বই ফেরৎ দিতে হবে না। বাড়ীতে বসে অনলাইনে আবারও রিনিউ করতে পার। যখন বই পড়া শেষ হবে, তখনে নিয়ে এসো। ও, বই ফেরৎ দেবার জন্য তোমাকে লাইব্ররীতেও আসতে হবে না, তুমি যখন বাজার-সদাই করতে যাও, তখন ঐ দোকান গুলোতে বই ফেরৎ দেবার বক্স আছে, ঐ বক্সে বই রেখে দিলে চলবে। এমনকি, বিকেলে যদি তুমি পার্কে যাও, ওখানেও বই ড্রপ করার ব্ক্স আছে।

- এ তো দেখছি অপূর্ব ব্যবস্থা। বই পড়া শেষ হলে যেকোনো জায়গাতেই ফেরৎ দিতে পারব।

মাথা চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞাসা করলাম,
- এতগুলো বই ধার নিয়ে সবসময় তো ফেরৎ দেবার দিন-ক্ষণ মনে রাখা মুসকিল। ধর, আমি বই ফেরৎ দিতে ভুলে গেলাম, তখন কি হবে?
- তোমাকে আমরা জরিমানা করব। প্রতিদিনের জন্য ২৫ সেন্ট। প্রতি বইয়ের জন্য সর্বোচ্চ ২০ ডলার।
- এ তো অনেক।
- তুমি ঘাবড়িও না। তোমার যখন জরিমানা হবে, তখন আমার কাছে এসে বলবে। আমি এক ধাক্কাতেই অর্ধেক জরিমানা কমিয়ে দিব। বাকিটাও কমানোর ব্যবস্থা আছে।
- এ তো অত্যুত্তম ব্যবস্থা। তা' যখন জরিমানা মওকুপই করে দিবা, তখন জরিমানাটা না-ধরলেই তো আমার মতো লোকের মানসিক চাপ কিছুটা কমত। ওমন কোনো বিশেষ ব্যবস্থা আছে কি?

লীডিয়া কোনো কথা খুঁজে না-পেয়ে মাথা চুলকাতে-চুলকাতে দুই খানা বই আমার হাতে তুলে দিয়ে বিদায় জানাল। হাতে বই নিতেই ট্যাক্সের কথা মনে পড়ে গেল। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাতেই কিছুটা চমকে গেলাম- অন্য একদিন আসতে হবে।

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

জায়গাটার নাম ওয়েস্ট লাফিয়েত (ˌwɛst ˌlɑːfiˈɛt) হবে না! আর 'লিডিয়া' না লিখে যদি 'লীডিয়া' লেখেন তাহলে বাংলা একাডেমি'র বানান স্যারেরা আপনাকে গালমন্দ করতে পারে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। পরবর্তিতে বিষয়গুলো খেয়াল রাখব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।