বাতায়ন পথে আসা গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৭/০৫/২০১৯ - ১২:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার রসুই ঘরের জানালা বরাবর যে বাড়ীটা রয়েছে সেটা খুবই নিকটবর্তী অবস্থানে দাঁড়িয়ে। সেই বাড়ীটার তৃতীয় তলার বারান্দায় একটি বালিকাকে দেখা যায়। তবে কয়েক পলকের মধ্যেই সে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। সে মূলত আসে কাপড় শুকাতে দিতে। নিশ্চয় প্রতি দ্বিপ্রহরেই আসে সে তবে আমি দেখতে পাই কেবল আমার ছুটির দিনগুলোতে। আমি তাকে দু একবার দেখেছি পথিমধ্যে। তখন তার আপাদমস্তক ঢাকা ছিল মুসলিম নারীর জন্য নির্ধারিত আবরনে। বারান্দায় সে আসে অনাবৃত। সদ্য স্নাত বালিকার লম্বা ভিজে কেশ এলিয়ে পরে তার পিঠ জুড়ে। কাঁচা হলুদ গায়ের রঙ। ছিপ ছিপে শরীর। মুখের গড়ন খানিকটা লম্বা। কর্ণে দোলে স্বর্ণের ছোট ঝুমকা। বড় শান্ত, বড় মিষ্টি। চাহনিটা যেন শশকের মত । মিটিমিটি, শঙ্কিত এবং আকাঙ্খাহীন। তাকে ঠিক বাঙালী মনে হয়না। একটু যেন বিহারী গড়ন। বাংলাদেশে আটকে পরা পাকিস্তান শিবিরের মেয়ে কি! তবে লেখাপড়া করেছে সেটা বোঝা যায়। আমি যে তাকে লক্ষ্য করি সেটা তার কাছে ধরা পড়ে যাই। তবে সে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। খুব দ্রুত কাজ সেরে সে ঘরে ঢুকে যায়। বাইরেটা দেখার সব ইচ্ছে যেন সে দমিয়ে রাখে।

এক সুদর্শন যুবক কদাচিৎ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তবে বালিকার দিকে তাকায় না বিশেষ। সে ব্যস্ত থাকে ফোনে। কথাবার্তা যা শোনা যায় তাতে বোঝা যায় ব্যবসা বাণিজ্য করে। এই যুবকই যে ওই বালিকার পতি আমার সে ধারণা বেঠিক নয় নিশ্চয়। একই ঘরে এই বারান্দা সংলগ্ন আরেকটি বারান্দা আছে। সেখানে দেখা যায় একজন মধ্যবয়স্ক নারী। খুব ফর্সা তার গায়ের রং। দিনের অধিকাংশ সময় তিনি বারান্দায় বসা থাকেন। ওখানে বসে বসেই তিনি শাকটা কোটেন, কাঁচা মরিচের বোটা ছাড়ান। কখনও শুকনো কাপড় গুলো ভাঁজ করেন। বোঝা যায় বিশ্রামের জীবন । আরো দু-একটি বালিকা সেখানে বিচরণ করে। তাদেরও উজ্জ্বল গৌড় বর্ণ। তারা প্রাণচঞ্চল। তারা ছুটে ছুটে আসছে, যাচ্ছে। গল্প করছে, ফোন করছে, কাজ করছে, হাসাহাসি করছে। বোঝা যায় তাদের সবার নিজের বাড়ী এটি। এরা যে খাঁটি বাঙালী সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

ও বাড়ীর কোন বারান্দায়ই কোন গাছ ছিল না। হঠাৎ একদিন দেখলাম একটি লতা গাছের টব। রাতারাতি সে গাছ বাড়তে লাগল, যেন বড্ড তাড়াহুড়া। জানালার গ্রীলে জড়িয়ে জড়িয়ে বাড়ছে সে। একেবারে সজীব। আমার একটু হিংসাই হচ্ছিল। আমার ঘরের গাছ গুলো এত বাড়ন্ত নয়। তবু আমার গাছটিকে খুব ভাল লাগছিল। খুব ভোরে রসুই ঘরে এক কাপ চা খেতে খেতে আমার কর্মময় দিন শুরু করার এক ফাঁকে গাছটির দিকে তাকিয়ে আমি একটু প্রশান্তি নিতাম। এভাবেই কাটছিল আমার সকাল গুলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখি গাছটি প্রাণহীন লেপটে আছে বারান্দার গ্রীলের সাথে। পাতাগুলো শুকিয়ে গেছে। আমার বুকটা একেবারে মুচড়ে উঠল। প্রশ্ন জাগল মনে কেন গাছটা মরে গেল। মনে মনে ভাবলাম যদিও আলাপ নেই তবু ওই বালিকা বধূকে আমি প্রশ্ন করবই। প্রতিবেশী হিসেবে এই প্রশ্নটি করা নিশ্চয় একেবারে গর্হিত কাজ হবে না। তবে পরবর্তী ছুটির দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো।

ছুটির দিন আসল। ছুটির দিন অধিকাংশ সময় আমার রান্নাঘরেই কাটে। আমার শত কাজের মাঝে আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন আসবে বালিকা বধূ। দুপুর গড়িয়ে পড়লে সদ্য স্নাত বালিকা বধূ ভিজে চুল এলিয়ে দিয়ে হাতে ভিজে কাপড় নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আমি দ্রুত গলা উঁচিয়ে তার দিকে প্রশ্ন ছুড়লাম"তোমাদের গাছটি মরে গেল কেন? বেশী জল দিয়েছিলে অথবা সার?" মেয়েটি আমার দিকে তাকাল। সে মুখ থেকে কোন অভিব্যক্তি পড়া যায় না। শান্ত, নির্লিপ্ত। কোন উত্তর সে দিল না আমার প্রশ্নের। কেবল মুচকি একটু হাসি দিয়ে, ঠোঁট উল্টটিয়ে- আমি এর কিছুই জানিনা এমন একটা ভাব করে সে ঘরের ভিতরে চলে গেল।

জানিনা কেন আমার হৃদয়ে গানটি বেজে উঠল-

" উচাটন মন ঘরে রয়না, প্রিয়া মোর
নিজ গৃহে বনবাস সয়না, প্রিয়া মোর।"

লেখক- করবী মালাকার


মন্তব্য

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

গল্পটি ধরতে ধরতে পালিয়ে গেল।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অবনীল এর ছবি

চলুক

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এটি একটি গল্পের সুত্রপাত হিসেবে চমৎকার। ভেবেছিলাম গল্প আরো আগাবে। কিন্তু গল্পটা কেবল একটি দৃশ্যপট হয়েই শেষ হয়ে গেল।
তবে এখানে একটা বার্তা আছে। অন্যের বাগানে শুকিয়ে যাওয়া গাছের জন্যও মন খারাপ হতে পারে যদি সেই গাছে আমার মানসিক আশ্রয় থাকে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

করবী মালাকার এর ছবি

পঠন এবং মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
গাছ ও বালিকা বধূর মাঝে আমি হয়ত মিছেই সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছি আর বিষাদের সুরটাও হয়ত মিছেই বেজেছে - নিজ গৃহে বনবাস সয় না। লইজ্জা লাগে

কীর্তিনাশা এর ছবি

ভাল লাগলো। আরো গল্প আসুক।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।