সাদিক মোহাম্মদ আলম এর 'ফাকা আবেগ' তত্ব ও কলবের আয়না

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: সোম, ৩০/০৪/২০০৭ - ৮:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


এই ব্লগে যারা আমার সুহ্রদ আছেন, সাদিক মোহাম্মদ আলম নিঃসন্দেহে তাদের একজন । প্রিয় ব্লগার তালিকায় তার নাম একটা স্থুল উদাহরন হতে পারে ।
সুহ্রদ সাদিক তার পোষ্টে আমার মন্তব্যের জবাবে আন্তরিক এক উপদেশ দান করেছেন । বলেছেন আমার 'এই এটিচুড' বদলানোর জন্য । কেনো বদলানো? কি লাভ বদলালে? 'এই এটিচুড' যতো দ্রুত বদলানো যাবে, তত দ্রুত নাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত হবে ।

'এই এটিচুড' কি রকম 'এটিচুড'? সাদিকেরই লেখ্যমতে 'এই এটিচুড' হলো- মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগী পোষ্ট দেয়া, মুক্তিযুদধ বিষয়ক 'ফাকা' আবেগ দেখিয়ে দেশ উদ্ধার করা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছবি, কবিতা লিখে পত্রিকার পাতা ভরানো ।
সাদিকের উপদেশ আমাকে যথেষ্ট ভাবায় । আমার কিংবা আমার পুর্ববর্তী জেনারেশনের করার ক্ষমতা সাদিক কে 'বহুত ফেড আপ ' করে । সাদিকের 'বহুত ফেড আপ' আবার আমাকে বিচলিত করে । আমি স্মৃতি হাতড়াই । আমি কিংবা আমার জেনারেশন কতটুকু করেছিল? কতটুকু করতে পারতো ।

১৯৯২ এ ২৬ মার্চ বৃহস্পতিবার ছিলো । এই তারিখ যে বৃহস্পতিবার ছিলো, সেটা আমার মনে আছে,কেনোনা একটা শ্লোগান মনে আছে আজো ' ২৬শে মার্চ বিষুদবার-যুদ্ধ হবে আরেকবার' । জানিনা সেই ২৬ মার্চ সাদিকের বয়স কতো ছিলো । জানিনা সাদিকের স্মৃতিতে সেই বিষুদবার আছে কিনা? সেই দিনে সারা বাংলাদেশের তরুনেরা কি করে ফুঁসে উঠেছিল ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে সে খবর সাদিক রাখে কিনা? সেটা রাজনীতি ছিলোনা । সেটা আওয়ামী লীগ বি এন পি ছিলোনা । ছিলো একজন শহীদের মায়ের আহবান । নির্মুল কমিটির সুইসাইড স্কোয়াডে কত হাজার তরুন স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়ে ছিলো, সে হিসেব কি সাদিক জানে? সরকার সেদিন ঘাতক দালালদের রক্ষা না করলে, জাহানারা ইমামের এক নির্দেশেই ডাইরেক্ট একশন হয়ে যেতো ।

ব্যক্তি আমি ছিলাম কি ছিলাম সেটা মুখ্য নয় । কিন্তু আমার বন্ধুরা ছিলো । আমার বন্ধুরা রক্তাক্ত হয়েছে ঘাতক দালালদের ধারালো ছুরিতে । হ্যাঁ , আক্ষরিক অর্থেই হয়েছে । ঘাতক দালালের উত্তরসুরীদের হামলা মোকাবেলা করেই আমার বন্ধুরা বৈশাখী উতসবের প্রচলন করেছে । জাহানারা ইমামের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরন করতে দেয়া হবেনা ।আমার বন্ধুরা প্রান হাতে নিয়ে এই সিদ্বান্তের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে ।

ঘাতক দালালদের বিচার হয়নি এটা ব্যর্থতা । এই ব্যর্থতার পিছনে অনেক রাজনীতি, অনেক দেশীয় আন্তর্জাতিক হিসেব নিকেশ আছে । কিন্তু এই ব্যর্থতার বিপরীতে হিরন্ময় সফলতা এই ,৩৬ বছর পর ও বিচারের দাবী উচচারন বন্ধ করা যায়নি ।
৩০ বছরের অধিক কাল ধরে সকল ক্ষমতাসীনরাই তো ঘাতকদের রক্ষা করে গেলো । তবু বিচারের দাবী উচচারন স্তিমিত করা গেলো না কেনো? কে বাঁচিয়ে রাখলো খুনীদের বিচার দাবী করার অদম্য সাহস?

বাংলাদেশের রাজনীতি ঘাতক দালালদের সাথে আপোষ করেছে, করেছেন হাসিনা খালেদা । ঘাতক দালালদের সাথে আপোষ করেনি বাংলাদেশের সংস্কৃতি । আপোষ করেনি বাংলাদেশের কবিতা, নাটক, চিত্রকলা । ৩০ টা বছর ধরে রাজনীতিক রা যতোটা ওম দিয়ে গেছেন, কবিতা নাটক গল্প উপন্যাস ততোটাই ধিক্কার জানিয়ে গেছে ঘাতক দালালদের ।
তাই সাদিক যখন বলেন , মুক্তিযুদ্ধের ছবি , কবিতা লিইখা কাজের কাজ কিছুই হয় নাই- আমার জানতে ইচ্ছে করে কে তবে আর কি করে 'কাজের কাজ' করে ফেললেন বলুন তো?

ছবি , কবিতার কাজ তো ঘাতক দালালের বিচার করা নয়, বিচারের দাবি যাতে কেউ বিস্মৃত না হয় মানুষের সেই অনুভুতিকে জাগিয়ে রাখা ।
সেই অনুভুতি মরে যায়নি বলেই ১৯৯২ এ আঠারো বছরের যে তরুন নিজের প্রান হাতে নিয়ে রাজপথে নেমেছিলো ঘাতক দালালের বিচারের দাবীতে, মধ্য ত্রিশের এই ২০০৭ এ ও সে তার দাবী থেকে সরে যায়নি । হয়তো ক্ষেত্র বদলেছে সময়ে । কারো বেলায় এটা পত্রিকার কলাম হয়েছে, কারো বেলা ব্লগের পোষ্ট, কারো বেলায় স্বগতঃ ভাবনা ।

পৃথিবীর ইতিহাসের বহু অন্যায় বহু হত্যা বহু ধবংসের ই বিচার হয়নি । বিচার হয়নি বলেই ঘাতকের প্রতি ধিক্কার থেমে থাকেনি । আমার জানা যদি ভুল না হয়,মুসলমানদের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস কারবালা হত্যাকান্ডের ও বিচার হয়নি শেষ পর্যন্ত । বিচার হয় নি বলে কারবালাকে ঘিরে মর্সিয়া, শোক গাথা বিষাদ সিন্ধু কি 'ফাকা' , 'কেবলই ফাকা' আবেগ হয়ে যায়?

দুঃখিত সাদিক, আপনার এই 'ফাকা আবেগ' তথ্য আমার পোষালোনা ।
আমি রাজনীতির ডালভাত খাইনা । এই ব্লগে যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেন, সম্ভবতঃ তাদের কেউই সরাসরি রাজনীতির মানূষ না । আমি যা লিখি, সেটা আমার নিজের কাছে নিজের দায়বদ্ধতা থেকেই । সম্ভবতঃ অন্যরা ও । এই দায়বদ্ধতায় কোন রাজনীতি নেই, দুধ ভাত নেই ,এমন কি পুন্য লাভের কোন লোভ ও নেই । একে নিয়ে দালালের বাচচা রা টিটকারী মারলে, চেনা যায় । কিন্তু আপনি যখন টিটকারী মারেন, নিজের সাথে বোঝাপড়াটা করতে একটু খারাপ লাগে ।

আমার বা আমাদের কারো লেখায় ঘাতক দালালদের বিচার হয়ে যাবে, অবশ্য ই না । যেমন আপনার লেখায় হয়ে যাবেনা ধর্মের সংস্কার । তবু আপনি আপনার ধর্মলেখা লিখে যান । আমি কিন্তু বলিনা-- 'এই সব কোনো কাজের কাজ না । ধর্ম নিয়ে ফাকা আবেগ ' ।

আপনার কথিত 'এটিচুড' এ আসলেই সমস্যা আছে সাদিক । 'এটিচুড' সত্যিই পালটানো দরকার ।
কলবের আয়নায় কার ছায়া ঘনিয়েছে, একটু তালাশ করে দেখুন তো মরমীসাধু সাদিক মোহাম্মদ আলম ।


মন্তব্য

স্যাম এর ছবি

চলুক চলুক
সেই কবেকার লেখা এখনো প্রাসঙ্গিক।

ঘাতক দালালদের বিচার হয়নি এটা ব্যর্থতা । এই ব্যর্থতার পিছনে অনেক রাজনীতি, অনেক দেশীয় আন্তর্জাতিক হিসেব নিকেশ আছে । কিন্তু এই ব্যর্থতার বিপরীতে হিরন্ময় সফলতা এই ,৩৬ বছর পর ও বিচারের দাবী উচচারন বন্ধ করা যায়নি ।
৩০ বছরের অধিক কাল ধরে সকল ক্ষমতাসীনরাই তো ঘাতকদের রক্ষা করে গেলো । তবু বিচারের দাবী উচচারন স্তিমিত করা গেলো না কেনো? কে বাঁচিয়ে রাখলো খুনীদের বিচার দাবী করার অদম্য সাহস?

বাংলাদেশের রাজনীতি ঘাতক দালালদের সাথে আপোষ করেছে, করেছেন হাসিনা খালেদা । ঘাতক দালালদের সাথে আপোষ করেনি বাংলাদেশের সংস্কৃতি । আপোষ করেনি বাংলাদেশের কবিতা, নাটক, চিত্রকলা । ৩০ টা বছর ধরে রাজনীতিক রা যতোটা ওম দিয়ে গেছেন, কবিতা নাটক গল্প উপন্যাস ততোটাই ধিক্কার জানিয়ে গেছে ঘাতক দালালদের ।
তাই সাদিক যখন বলেন , মুক্তিযুদ্ধের ছবি , কবিতা লিইখা কাজের কাজ কিছুই হয় নাই- আমার জানতে ইচ্ছে করে কে তবে আর কি করে 'কাজের কাজ' করে ফেললেন বলুন তো?
ছবি , কবিতার কাজ তো ঘাতক দালালের বিচার করা নয়, বিচারের দাবি যাতে কেউ বিস্মৃত না হয় মানুষের সেই অনুভুতিকে জাগিয়ে রাখা । সেই অনুভুতি মরে যায়নি বলেই ১৯৯২ এ আঠারো বছরের যে তরুন নিজের প্রান হাতে নিয়ে রাজপথে নেমেছিলো ঘাতক দালালের বিচারের দাবীতে, মধ্য ত্রিশের এই ২০০৭ এ ও সে তার দাবী থেকে সরে যায়নি । হয়তো ক্ষেত্র বদলেছে সময়ে । কারো বেলায় এটা পত্রিকার কলাম হয়েছে, কারো বেলা ব্লগের পোষ্ট, কারো বেলায় স্বগতঃ ভাবনা ।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সাড়ে পাঁচ বছর আগের লেখা, খুঁজে পেলেন কী করে?

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

স্যাম এর ছবি

আপনার একটা লেখা থেকে আজকের ব্যানারটার কবিতা নেয়ার সময় চোখে পড়েছিল! দারুন ছিল!

তানিম এহসান এর ছবি

লেখাটা অনুপ্রাণিত করলো মুর্শেদ ভাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।