'আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, উলফা,বাংগালী অভিবাসন'--- সঞ্জীব বড়ুয়ার একটি আলাপচারীতা[১ম পর্ব]

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: রবি, ০৫/০৮/২০০৭ - ৭:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

..

সঞ্জীব বড়ুয়া'র জন্ম শিলংয়ে ।পড়ালেখা দিল্লী ও শিকাগো'তে । বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন নিউইয়র্ক বার্ড কলেজের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগে ।
১৯৯৯ সালে University of pennsylvania Press থেকে প্রকাশিত হয় তার গ্রন্থ
India Against Itself: Assam and the Politics of Nationality
অধ্যাপক বড়ুয়া তার প্রকাশিত গ্রন্থে আসাম ও উত্তরপুর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমুহের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের স্বরূপ সন্ধান ও তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করেছেন ।

সম্প্রতি Asia Source এ তাঁর একটি আলাপচারিতা প্রকাশিত হয় যেখানে এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে আরো সুনির্দিষ্টভাবে ।

সচলয়ায়তনের পাঠকদের জন্য অনুবাদটুকু তুলে দেয়া হলো ।

********
********
ঠিক কি রকম পরিস্থতিতে 'আসাম মুভমেন্ট' এর সুচনা হয়? এই মুভমেন্ট এর গনভিত্তিই বা কতোটুকু?

১৯৭৯থেকে ১৯৮৫ এই সময়ে মুলতঃ আসাম মুভমেন্ট গড়ে উঠে 'বংগাল খেদাও' এই প্রচারনাকে ভিত্তি করে ,যা আসামের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বড় ঘটনা । আসামের বর্তমান শাসক দল 'অসম গন পরিষদ(অগপ)' এবং আসাম লিবারেশন ফ্রন্ট(উলফা) উভয় সংগঠন এই মুভমেন্ট থেকেই গড়ে উঠেছে ।
এই মুভমেন্ট জনপ্রিয়-জনপ্রিয় এই অর্থে যে হাজার হাজার মানুষ এর সমর্থনে বেরিয়ে এসেছিলো রাস্তায় । তবে এটা ও মনেরাখা জরুরী রাস্তায় বেরিয়ে আসেনি এমন মানূষ ও কিন্তু হাজার হাজার । এই মুভমেন্ট আসামের 'অভিবাসী সম্প্রদায়' কে কাছে টানতে পারেনি । বরং 'বিদেশী' ও 'বাংলাদেশী' শব্দদ্বয়ের যথেচ্ছ ব্যবহার একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও আতংকের সৃষ্ট করেছিল

সশস্ত্র আন্দোলনের শুরুতে উলফা ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিলো? এখনো কি সেরকম সমর্থন অব্যহত আছে? উলফার ফান্ড কিভাবে সংগৃহীত হয়(গুজব আছে যে,উলফা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই 'এর অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে)? সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উলফার আদর্শিক পরিবর্তন কেমন ঘটেছে?

উলফা'র ব্যাপক জনসমর্থন ছিলো, এতোটা বলবোনা আমি । বলা যায় প্রথম দিকে এদের প্রতি সাধারন অহমিয়া'দের বেশ সহানুভুতি ছিলো । আমি যখন এই বই লিখি একটা সমস্যায় পড়েছিলাম, উলফা ও সাধারন অহমিয়া সমাজের সম্পর্ক বোঝানোর জন্য ঠিক কোন টার্ম ব্যবহার করবো? শেষ পর্যন্ত আমি যে টার্ম খুঁজে পাই তা হলো 'আন্তঃকাঠামো ( )গত' । এই টার্ম মুলতঃ তাত্বিকরা ব্যবহার করেন সাহিত্যের এক মাধ্যমের সাথে আরেক মাধ্যমে সম্পর্ক বর্ননায় (কবিতা,গল্প,নাটক,সিনেমা) ।
তো, আমি যদি বলি উলফা' কে সরাসরি সমর্থন করে এমন অহমিয়ার সংখ্যা ১% এর কম, তাহলে তা কিন্তু উলফার প্রভাব সম্পর্কে সঠিক ধারনা প্রদান করেনা । মুল বিষয় হলো, উলফা যে সব ইস্যুকে তুলে ধরেছে সেগুলো অহমিয়াদের মুল ধারার প্রতিনিধিত্ব করে ।

উলফার ফান্ডিং এর ব্যাপারে সম্ভবতঃ তাদের প্রধানরা ছাড়া আর কেউ সঠিক তথ্য জানেনা । এটা ঠিক আশির দশকের দিকে তারা একটা বিশাল অংকের টাকা সংগ্রহ করেছে ব্যবসায়িদের কাছ থেকে । এমন কি আসামের বেশির ভাগ চা বাগানের মালিক,কেন্দ্রীয় ভারতের বড় বড় ব্যাবসায়ীগ্রুপ গুলো ও এদেরকে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছে । এছাড়া নিয়মিত টাকা আদায় হয়েছে স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ও । অনাবাসী ভারতীয়দের টাকা প্রদানের বিষয়ে কিছু শুনিনি ।
উলফার সাথে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই এর সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারনা চালায় ভারতীয় পত্রিকাগুলো । তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোন তথ্য কারো কাছে নেই ।

সময়ের সাথে উলফার আদর্শের পরিবর্তন হয়েছে কিনা? ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে উলফাকে প্রতিহত করেছে, আমি সন্দিহান, একটা নিয়মতান্ত্রিক আদর্শবাদী সংগঠন হিসাবে উলফার টিকে থাকা আসলেই কতটুকু সম্ভব ছিলো? উলফা, সরকার সমর্থিত পক্ষত্যাগী উলফা (সালফা-সারেন্ডার্ড উলফা),
সরকারী নিরাপত্তা বাহিনী এদের সম্মিলিত সন্ত্রাস এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্ট করেছে যেখানে ঘটে গেছে অনেক অমীমাংসিত গোপন হত্যাকান্ড । ডেথ স্কোয়াড কিংবা সিক্রেট কিলারদের হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে উলফার প্রথম সারির অনেক নেতা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা । গতবছর উলফার হাতে নিহত হয়েছেন হিন্দীভাষী অনেক মানুষ । অনেক ভারতীয় পত্রিকা এইসব ঘটনাকে পুঁজি করে প্রচারনা চালিয়েছে যে উলফা এখন জাতিগত হত্যাকান্ডের কৌশল গ্রহন করেছে । তবে পরিস্থিতি এতো ঘোলাটে যে, এইসব প্রচারনার গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় ।


উত্তর-পুর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজ্যগুলোর সাথে আসামের ভবিষ্যত কি প্রকারে সম্পর্কিত( বিশেষ করে মনিপুর ও নাগাল্যান্ড)?

উত্তরপুর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর দুর্ভাগ্য হলো যে একটি অতিঘনবসতিপুর্ন উপমহাদেশে তারা স্বল্পজনসংখ্যাময় । গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড এ আসাম,মনিপুর,মিজোরাম,নাগাল্যান্ড,মেঘালয় এর সম্মিলিত জনসংখ্যা খুব কম নয় । কিন্তু ভারতবর্ষের তুলনায় এ তেমন কিছু নয় । দিল্লীকেন্দ্রিক ভারতীয় প্রশাসন সহজেই সমগ্র উত্তরপুর্বাঞ্চলকে একটি একক এলাকা বলে ভেবে নেন, এর বৈচিত্র তাদের চোখে পড়েনা ।
দিল্লীতে বসে তারা এ অঞ্চলের পরিকল্পনা নির্ধারন করেন । কিন্তু এ অঞ্চলের প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ইতিহাস ও জীবনবোধ আছে , সেই সাথে একইমাত্রার বঞ্চনা ও ক্ষোভ আছে । সেকারনেই বিভিন্ন সময়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল,ছাত্র সংগঠন ও সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরী করেছে ।
তবে এটা ও মনে রাখা জরুরী প্রত্যেকেটা রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবী এসেছে তাদের নিজস্ব ইতিহাস থেকে । উদাহরন হিসেবে আমি মনিপুরের কথা বলতে পারি- কেন্দ্রীয় ভারতের কাছে মনিপুর মাত্র ২০ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত অতিক্ষুদ্র এক রাজ্য । কিন্তু প্রত্যেক মনিপুরীর কাছে মনিপুর সমগ্র এশিয়ার মধ্যে এক পুরনো রাষ্ট্র,যাদের স্বাধীন রাজতন্ত্রের ইতিহাস শুরু হয়েছে ৩৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে । মনিপুর বৃটিশদের করায়ত্ত হয়েছে ১৮৯১ এ, তাও 'নেটিভ রাজ্য' হিসাবে । ভারতের স্বাধীনতার চারদিন আগে মনিপুরের রাজা বুদ্ধচন্দ্র সিং নিরাপত্তা,যোগাযোগ ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে ভারতের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন । কিন্তু পরবর্তীতে 'নেটিভ রাজ্য' গুলো করায়ত্ত করার ভারতীয় আগ্রাসনের পরিনাম হিসাবেই মনিপুর ভারতের অংশ হয়ে যায় অক্টোবর ১৯৪৯ এ ।
মনিপুরের ঘটনা কাশ্মীরের মতোই । কিন্তু ক'জন ভারতীয়, এইসব ষড়যন্ত্র ও শঠতার ইতিহাস জানে?

।।পরের পর্ব।।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সঞ্জীব বড়ুয়ার বইয়ের রিভিউ আছে এই লিংকে
India Against Itself: Assam and the Politics of Nationality

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

sumon rahman এর ছবি

Bhalo laglo. Sanjib Barua-ke pochondo kori. Amader ekhane SASP departmental head pod-e tini interview dite ese ekta job-seminar diyechilen ei eki bishoyer upor.

অতিথি এর ছবি

দারুন! মন দিয়ে পড়ছি।...

অতিথি এর ছবি

দুটি পর্বই পড়লাম। সঞ্জিব বড়ুয়ার প্রজ্ঞা মুগ্দ্ধ করলো। আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। এই রকম আরো চাই।...
--বিপ্লব রহমান

দিগন্ত এর ছবি

বই-এর রিভিউ লেখাটা ভাল লাগল। বিশেষত তিনি যেখানে বলেছেন ভারতের কেন্দ্রীয়করণের রাজনীতির কথা। তার কথামত -

... largely due to India's formally federal, but actually centralized governmental structure. Baruah argues that in multiethnic polities, loose federations not only make better democracies, in the era of globalization they make more economic sense as well.


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

কন্থৌজম সুরঞ্জিত এর ছবি

বাংলায় পড়ে আরও লাভ হলো।
একটু দেরিতে এই সাইটটার খবর পেয়েছি। ইমরুল হাসানের মারফতে।
হঠাত্ করে ব্লগের লিংক সহ সব কিছু বদলানোতে সামহোয়ার এ আর তেমন যাইনা। তবে আপনার সাথে এইখানে আবার দেখা হইলো।

কন্থৌজম সুরঞ্জিত

কন্থৌজম সুরঞ্জিত

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সুস্বাগতম কন্থৌজ,
যাক কোথাও নাকোথাও তো দেখা হয়ে গেলো আবার । আপনার কবিতা এবার পড়া যাবে আরো বেশী মনোযোগ দিয়ে । এ বাড়িতে হৈ হুল্লোড় কম আছে ।
সুতরাং, শুরু করুন । আরো বেশী বেশী কবিতা হোক । আরো বেশী বেশী কবিরা আসুন সচলায়তনে ।

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।