ফিরে দেখা ১১ই অগাস্ট ১৯৮৯ঃ শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা ও বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুকের সাক্ষাতকার

হাসিব এর ছবি
লিখেছেন হাসিব (তারিখ: রবি, ২৯/১০/২০১৭ - ৪:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অবশেষে ২৮ বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর এক হামলার বিচারের রায় হল। স্বৈরাচার এরশাদ এবং এর পরবর্তী বিএনপির শাসনামলে এই ঘটনায় দায়ের করা মামলা হিমাগারে থাকার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই মামলা মামলা পুনরুজ্জীবিত হয়। এর আগে ঘটনা পরপর গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৮৯এর ডিসেম্বরে অভিযোগের সত্যতা পায়নি বলে রিপোর্ট দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি তদন্ত শেষ করে হত্যা চেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এই মামলায় আসামী করা হয় ১৬জনকে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসি হওয়ায় সৈয়দ ফারুক রহমান ও বজলুল হুদার নাম বাদ দেয়া হয়। এছাড়া দুই আসামীর মৃত্যু হওয়ায় তাদের নামও বাদ পড়ে অভিযোগনামা থেকে। [১]

আসামি করা হয় মোট ১২ জনকে।

মামলায় আসামীরা হলেন, আসামিরা হলেন- গোলাম সারোয়ার ওরফে মামুন, জজ মিয়া, ফ্রিডম সোহেল, সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ মুরাদ, গাজী ইমাম হোসেন, খন্দকার আমিরুল ইসলাম কাজল, মিজানুর রহমান, হুমায়ুন কবির (কবির), মো. শাজাহান বালু, আবদুর রশীদ, জাফর আহম্মদ ও হুমায়ুন কবির (হুমায়ুন)।

এই হামলাটা এমন এক সময়ে হয় যখন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা ফ্রিডম পার্টি নামে একটা রাজনৈতিক দল খুলে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াতো। বঙ্গবন্ধুর বাসায় গুলী-গ্রেনেড ছুড়ে পালাবার সময় আক্রমণকারীরা কর্ণেল ফারুক রশীদের নামে স্লোগান দিয়ে ফ্রিডম পার্টির অফিসে আশ্রয় নেয়। এই ঘটনা বুঝতে দৈনিক ইত্তেফাকের দু'টি খবর আবার পড়ে দেখা যাক। এই দুটি খবর ঘটনাটি ছাড়াও আশির দশকের বাংলাদেশকে বুঝতে পাঠককে সাহায্য করবে।

প্রথম খবরটি ঘটনার বিবরণ। গতকাল এবং আজ কিছু মিডিয়াতে বঙ্গবন্ধু ভবনে তখন বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে একটা গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে সেটি বিস্ফোরিত হয়নি। তো দেখা যাচ্ছে, ২১শে অগাস্টই শেখ হাসিনার উপর প্রথম গ্রেনেড হামলা নয়।

ছবিঃ ১২ই অগাস্ট, ১৯৮৯ দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদ ক্লিপ

আগস্ট ১২, ২০১৭

গত বৃহস্পতিবার দিবাগত-রাত ১২টার দিকে একদল সশস্ত্র লোক বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডীর ৩২ নম্বরের বাসভবনে হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখন বাসভবনে ছিলেন। হামলাকারীরা ৭/৮ মিনিট যাবত বঙ্গবন্ধুভবন লক্ষ্য করিয়া গুলী চালায় ও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে উহা বিস্ফোরিত হয় নাই। হামলাকারীদের গুলীবর্ষণের জবাবে কর্তব্যরত পুলিশ পাল্টা গুলী চালাইলে এবং বঙ্গবন্ধুভবনে অবস্থান রত কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে হামলাকারীরা চলিয়া যায়।

হামলাকারীদের গুলীবর্ষনে সেন্ট্রিপোস্টের নিকট দেয়াল এবং ভবনের দেয়ালের কয়েক স্থানে ক্ষতি হয়। গোলাগুলীর সময় ধানমণ্ডী, শুক্রাবাদ, সোবহানবাগ এলাকায় আতংক ছড়াইয়া পড়ে।

গতকাল বঙ্গবন্ধু ভবনে সাংবাদিকদের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারী আত্মস্বীকৃত খুনীরাই এই হামলা চালায়। পুলিশ ও কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে তাহারা পালাইয়া যায়। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আছি। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না, আল্লাহ আমারা সহায় এবং বাংলার জনগণ আমার শক্তি। তিনি উল্লেখ করেন, লাইব্রেরীতে পড়ালেখা শেষে তিনি তখন বিশ্রাম নিতেছিলেন। এমন সময় গুলীর শব্দ পাইয়া তিনি সকলকে ডাক দেন। পুলিশ ও কর্মীরা প্রতিরোধ করায় তিনি তাহাদের ধন্যবাদ জানান।

এ ব্যাপারে ধানমণ্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন বঙ্গবন্ধু ভবনে অবস্থানকারী ও আওয়ামী লীগ কর্মী নজির আহমেদ। মামলায় বলা হয়, হামলাকারীরা প্রতিরোধের মুখে পালানোর সময় এক পর্যায়ে ২টি বেবীট্যাক্সির ১টি কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হইয়া যায়। তখন তাহারা কাজল, রেজা, রাশু এই সব নাম ধরিয়া ডাকে এবং কর্ণেল ফারুক রশীদের নামে স্লোগান দেয় ও পালাইয়া গিয়া তাহারা ফ্রিডম পার্টির অফিসে উঠে। গত কিছুদিন ধরিয়া রাশু, কাজল, ফারুক রেজা, জুয়েল, খোকন, আনোয়ার, কালু, হুমায়ুন নামের এই লোকগুলিকে ৩২ নম্বরের আশেপাশে ঝিলের পাড়ে ঘুরাফিরা করতে দেখা যায়। এইসব লোক নিজেদের ফ্রিডম পার্টির সদস্য বলিয়া পরিচয় দেয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও এসব লোকদের কর্ণেল ফারুকের জীপে ঘুরাফেরা করিতে দেখা যায়। মামলায় এ ব্যাপারে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী দোষী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করিয়া আদালতে সোপর্দ করার অনুরোধ জানানো হয়।

বঙ্গবন্ধু ভবনে কর্তব্যরত পুলিশকে প্রশ্ন করা হইলে তাহারা জানান, দুষ্কৃতকারীরা ২টি বেবীট্যাক্সি যোগে পশ্চিম দিক হইতে ৩২ নম্বরের সড়ক দিয়া বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে আসিয়া প্রথমে পুলিশ চেকপোস্ট লক্ষ্য করিয়া গুলী বর্ষণ করে। ইহার পর তাহাদের একটি বেবীট্যাক্সী পশ্চিম কোণ ও অপরটি পূর্বকোণে গতিমন্থর করিয়া ৭ হইতে ৮ মিনিট যাবত গুলীবর্ষণ ও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। কর্তব্যরত পুলিশের মতে সম্ভবত অত্যাধুনিক রাইফেল, স্টেনগান ও পিস্তল হইতে গুলী করা হয়, নাম উল্লেখ করিয়া বলা হয়। শেখ হাসিনার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যেই এ হামলা চালানো হইয়াছিল। বঙ্গবন্ধু ভবনে কর্তব্যরত পুলিশের মতে দুষ্কৃতকারীরা ৭-৮ মিনিট যাবত গুলীবর্ষণ করে। রাইফেল, স্টেন ও পিস্তল হইতে গুলী ছোড়া হয়।

গতরাত্রে ধানমণ্ডি থানারা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হইলে কর্তব্যরত অফিসার জানান, তাহারা গতকাল অবিস্ফোরিত গ্রেনেড ও রাইফেলের ৮টি গুলীর খোসা উদ্ধার করিয়াছেন। দুষ্কৃতকারীদের গুলীবর্ষণের জবাবে পুলিশ ৪ রাউণ্ড গুলী ছোড়ে। তবে কাহাকেও গ্রেফতার করা হয় নাই।

বাসস'র খবরে বলা হয় অজ্ঞাত পরিচয় বন্দুকধারীরা গত বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে হামলা চালায় বলিয়া আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গিয়াছে। এ সময় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ঘরের ভিতর ছিলেন। বন্দুকধারীরা রাত একটার দিকে দুইটি অটোরিকশাযোগে আসিয়া বাসভবনে গুলী চালায়। অবশ্য গুলীতে কেহ আহত হয় নাই এবং পুলিশ প্রহরীরা পাল্টা গুলী ছুঁড়ীলে বন্দুকধারীরা পলায়ন করে। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, তাহারা এ ব্যাপারে ধানমণ্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করিয়াছেন। বাসস আরও জানায়, সরকার শেখ হাসিনা ও অপর কয়েকজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতার জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছেন। শেখ হাসিনার বাসভবনে প্রহরীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হইয়াছে। এদিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা সারাদিন নগরীতে ২২টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ক্ষতি করে। ইহার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১২টি যানবাহনের ক্ষতি করা হয় এবং নগরীর বিভিন্ন স্থানে একটি বি, আর, টি, সি বাসসহ ১০টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বৃহস্পতিবার রাত ও গতকালের ঘটনার পিছনে কি উদ্দেশ্য ছিল তাহা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় নাই।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------

গতকাল এবং আজ কিছু মিডিয়াতে বঙ্গবন্ধু ভবনে তখন বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল উল্লেখ করা হয়েছে। ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী ১টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। সেদিনকার অবজারভারের রিপোর্ট বলছে কিছু পটকা এবং ৩টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয় যার মধ্যে ২টি বিস্ফোরিত হয়। তো দেখা যাচ্ছে, ২১শে অগাস্টই শেখ হাসিনার উপর প্রথম গ্রেনেড হামলা নয়।

ছবিঃ ১২ই অগাস্ট, ১৯৮৯ দৈনিক বাংলার সংবাদ ক্লিপ

ছবিঃ ১২ই অগাস্ট, ১৯৮৯ ডেইলি অবজারভারের সংবাদ ক্লিপ

শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ফ্রিডম পার্টিকে দায়ী করায় ফ্রিডম পার্টির নেতা, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক ১২ই অগাস্ট এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। ইত্তেফাক কিছুটা সেন্সর করে বিস্তারিত এক রিপোর্ট করে। রিপোর্টটি পাঠকের সুবিধার জন্য এখানে তুলে দিচ্ছি।

ছবিঃ ১৩ই অগাস্ট দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত খুনি ফারুকের সংবাদ সম্মেলনের ছবি।


আমার পক্ষ হইতে শেখ হাসিনার জীবনের কোন ভয় নাইঃ কর্ণেল (অবঃ) ফারুক

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ই অগাস্ট, ১৯৮৯

ফ্রীডম পার্টির চেয়ারম্যান কর্ণেল (অবঃ) ফারুক গতকাল (শনিবার) সন্ধ্যায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলিয়াছেন ৩২ নম্বরের বাড়ীতে হামলা সম্পর্কে ফ্রীডম পার্টি বা তিনি কিছুই জানেন না। অন্ততঃ শেখ হাসিনার জীবনহানির কোন ভয় নাই। তিনি শেখ হাসিনাকে রাজনীতি ত্যাগ করিয়া সুইসব্যাঙ্ক হইতে অবমুক্ত তাহার পিতার সঞ্চয় ভোগ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা দীর্ঘকাল বাঁচিয়া থাকিলে তিনি সম্যক উপলব্ধি করিতে পারিবেন যে, তাঁহার পরিবার এদেশ ও জাতির কতবড় সর্বনাশ করিয়াছে।

বনানী ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির বাসভবনে জাতীয় দৈনিকসমূহের প্রতিনিধিসহ প্রায় অর্ধশত সাংবাদিকদের এই সাংবাদিক সম্মেলনে ফ্রিডম পার্টির প্রধান সমন্বয়কারী চৌধুরী ফারুক ও দলের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক উপদেষ্টা মিয়া আব্দুর রশীদ উপস্থিত ছিলেন। কর্ণেল (অবঃ) সৈয়দ ফারুক রহমান বক্তব্য পেশ ও প্রশ্নের জবাবে বলেন, রাজনৈতিক 'হল্লা-গোল্লা' বাধাইবার জন্য সরকার, কিংবা অচল রাজনীতি সচল করার জন্য শেখ হাসিনা শেখ হাসিনা নিজে আপন দলের চক্রদ্বারা, কিংবা আওয়ামী লীগের অন্তর্দন্দের প্রতিফলন হিসাবে ৩২ নম্বরে ১১ই নভেম্বর রাতের ঘটনা ঘটানো হইয়াছে। ইহাকে 'ফাজলামো ও ছেলেখেলার' মত মামুলী হামলা হিসাবে তিনি চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, বরং আমাকে হত্যা করার জন্য দায়িত্ব লইয়া কিছু লোক সীমান্ত পার হইয়া আসিয়াছেন।

তিনি বলেন, ৩২ নম্বরে যাহা করার ছিল, ১৫ আগস্ট তাহা করা হইয়াছে। এখন উহা লইয়া আমাদের আগ্রহ নাই। তাঁহার ধারণা, ৩২ নম্বরের ঘটনার ব্যাপারে ফ্রীডম পার্টিকে টানা হইয়াছে সম্ভবতঃ একটা অজুহাত সৃষ্টির জন্য। দেশে একটা রাজনৈতিক অস্থিতিশীল সৃষ্টির ছলছুতা তৈরীই ইহার উদ্দেশ্য।

শেখ হাসিনাকে নব্য উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক এজেন্ট হিসাবে উল্লেখ করিয়া কর্ণেল (অবঃ) ফারুক বলেন, 'এই মহিলা' আসিবার এক মাসের মধ্যে জিয়াউর রহমান আততায়ীদের হাতে নিহত হন। অভ্যুত্থানের নায়ক পলায়নকালে পূর্ব সীমান্তে বিডিয়ারের হাতে গ্রেফতার হন। ডেমোক্রেটিক লীগের সমাবেশে সাংবাদিকসহ ১৪জন প্রাণ হারায়। শিবিরের ৩২জন ও জামায়তের ৪জন, বিএনপি ও উহার অঙ্গসংগঠনের ১৫-২০জন, ফ্রিডম পার্টির ৫ জন সমন্বয়কারী খুন হওয়ার কথা উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন, হাসিনা ও তাহার 'দালাল'রা তাহার পিতা ও তদীয় 'দালাল'দের মতই ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস, হত্যা, হাইজ্যাকের পন্থা প্রবর্তনও অব্যাহত রাখিয়াছে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনাশ করিয়া কশটার্জিত স্বাধীনতা বিকাইয়া বাংলাদেশকে আবার বিদেশের গোলাম বানানোই ইহার উদ্দেশ্য। তিনি বলেনঃ কিন্তু আমরা বলিতে পারি, মতভেদ যতই থাকুক, বাংলাদেশের মানুষ গোলাম হইতে চাহে না। ১১ তারিখ রাতের হামলা ও পরদিন 'দেশের সম্পদ' গাড়ী যানবাহন ভাংচুরকে 'পূর্ব পরিকল্পিত' হিসাবে বর্ণনা করিয়া তিনি বলেন, ঘটনার প্রতিক্রিয়া এত দ্রুত ও হিংস্র হওয়ায় প্রমাণিত হইতেছে, এ ঘটনাপরম্পরার লক্ষ্য, অভীষ্ট ও পদ্ধতি সীমান্তের বাহির হইতে আসিতেছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা আর তাহার দালালেরা 'পঞ্চম বাহিনী'। তাহারা 'শান্তি বাহিনী' ও 'বঙ্গভূমি' ওয়ালাদের আরেক শাখা। তিনি ব্যাখ্যা দিয়া বলেন, হাসিনার 'দালাল' বলিতে তিনি আওয়ামীলীগের সকলকে বুঝান নাই।

কর্ণেল ফারুক বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের 'এজেন্সী' শেখ হাসিনার আছে, ইহা সকলের জানা। সম্প্রতি মার্কিন 'এজেন্সী' বাগাইবার মতলবে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফর করিয়া কতটুকু সফলকাম হইয়াছেন, তিনিই জানেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রকে একদা তিনি তাহার পিতার মৃত্যুর জন্য দায়ী করিয়াছিলেন।

তিনি বলেন, তবে আমাদের বিশ্বাস, শেখ হাসিনার জীবনের উপর আঘাত আসিবার আশঙ্কা আছে। শেখ হাসিনা তাহার রাজনৈতিক সহচর ও প্রভুদের "দায়" - 'লায়াবিলিটি' হইয়া উঠিয়াছে। একারণেও শেখ হাসিনা মরিয়া হইয়া উঠিতেছেন। রাজীবের সম্ভাব্য পরাজয়ের আগেই তিনি বাংলাদেশে বিদেশী হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করিতে চাহিতেছেন। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অলীক অভিযোগ তুলিয়া কলিকাতায় মিথ্যা বিবৃতি দান হইতে শুরু করিয়া ৩২ নম্বরে হামলার দৃশ্যতঃ সাজানো ঘটনা একই উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তিনি বলেন, "বরং, তাহার প্রতি আমার সদুপদেশঃ রাজনীতি পরিত্যাগ করুন। আপনার পিতার যে সঞ্চিত ধন সুইসব্যাঙ্ক হইতে বাঁটোয়ারাসহ অবমুক্ত হইয়াছে -- উহা ভোগ করুন।" -- কর্ণেল ফারুককে এ মন্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হইলে তিনি বলেন, এ ঘটনার সত্যাসত্য সরকারের নিকট যাচাই করুন। আমরা জানি, ১৯৮১-র পর দুইজন ক্ষমতাশালী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের সহায়তা ও সমর্থন পত্রের ভিত্তিতে ৩০ কোটি মার্কিন ডলারের সঞ্চিত ধন হস্তান্তরিত হয়। শেখ হাসিনা একা নহেন, তাহার পরিবারের সকলে এ ঐশ্বর্য পাইয়াছেন। এ ঘটনায় সরকারের হাত থাকার সম্ভাবনাকে "ক্ষীণ" হিসাবে উল্লেখকালে কর্ণেল ফারুক বলেন, রাজনীতি যখন হিমাংকে নামিয়াছে, তখন সরকার উহাকে নাড়া দিয়া তপ্ত নাও করিতে পারে।

প্রশ্নঃ ১৫ই আগস্ট পালনের আহবান জানাইয়া লাগানো আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের ছবি সম্বলিত প্রাচীরপত্রের উপর "পঞ্চম বাহিনীকে প্রতিহত করুন" এ স্টিকার কারা লাগাইয়াছে?
উত্তরঃ পঞ্চম বাহিনীকে প্রতিহত করুন স্টিকারেই ফ্রিডম পার্টির নাম আছে। তাহারা আমাদের পোস্টার ছিঁড়িয়া থাকে। পোস্টার পালটা পোস্টার এদেশের রাজনীতিতে প্রচলিত।

প্রশ্নঃ ৩২ নম্বরে হামলার সময় বেবিট্যাক্সি একটি বিকল হইলে হামলাকারীরা পরস্পরকে যেসব নাম ধরিয়া ডাকাডাকি করিয়াছিল, পত্রিকায় প্রকাশিত সেসব নাম ফ্রীডম পার্টির কাহারো কিনা?
উত্তরঃ ফ্রীডম পার্টির অফিসে যাহারা থাকে, আঞ্চলিক সমন্বয়কারী ফারুক রেজাসহ কয়েকজনের নাম কাগজে দেওয়া হইয়াছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পর্যায়ের কাহাকেও মাস্তানী করানোর জন্য প্রেরণ করা অবিশ্বাস্য। তিনি বলেন, আমি জানি, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে কিছু লোক সীমান্ত পাড়ি দিয়া আসিয়াছে। হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রের পালটা আয়োজন আল্লাহ তায়ালাও করেন।

প্রশ্নঃ ১৫ই আগস্ট পালনের জন্য কী কর্মসূচী গ্রহণ করিতেছেন?
উত্তরঃ উহা অতীত ইতিহাস। ১৫ই আগস্টের গুরুত্ব আছে, উহা ভিত্তিও যোগায়। তবে দলের করণীয় নির্ধারণের তাত্ত্বিক দায়িত্ব গ্রহণের পর আমি ঠিক করিয়াছি, ভবিষ্যৎ পিয়াসী কর্ম ও লক্ষ্যই বড় হইয়া উঠিবে। ১৫ই আগস্ট আংশিক স্বাধীনতা দিয়াছে। এখন নাগরিকদের অর্থনৈতিক-সামাজিক রাজনৈতিক প্রসার প্রয়োজন।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------

দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত ভার্সনের এক পর্যায়ে দেখা যায় ফারুক শেখ হাসিনাকে সন্ত্রাসী বলে সম্বোধন করছে। আজকে রায়ের মধ্য দিয়ে এইসব ঔদ্ধত্তের একটা জবাব হল।

হামলার ঘটনায় প্রথমে সাধারণ ডায়েরি করা হলেও পরে তা মামলায় রূপান্তর করা হয়। এজাহার দুর্বল থাকলেও পরে মামলার তিন আসামি আদালতের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ফলশ্রুতিতে আজ শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই মামলার ১২ আসামির মধ্যে ১১ জনকে দুটি ধারায় দশ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এই দুটি সাজা পর্যায়ক্রমে খাটতে হবে বলে আসামিদের জেলে থাকতে হবে ২০ বছর করে।

হাজতবাসের সাথে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে যেটার অনাদায়ে ছয় মাস তাদের কারাগারে থাকতে হবে। সাজার মেয়াদ থেকে হাজতবাসকালীন সময় বাদ যাবে। কোন সংবাদ মাধ্যম হিসাব দেয়নি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা কে কতোদিন সাজা খাটবে।

এজাহারে থাকা অপর আসামি হুমায়ুন কবিরকে (কবির) খালাস দিয়েছে আদালত। দণ্ডিত আসামিদের মধ্যে রশীদ, জাফর ও হুমায়ুন কবির (হুমায়ুন) পলাতক। আর জামিনে থাকা শাজাহান বালুর গরহাজির থাকায় তার অনুপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা করা হয়। জামিনে থাকা মিজান, ইমাম হোসেন, কাজল রায়ের জন্য আদালতে উপস্থিত ছিলেন। কারাগারে থাকা মামুন, সোহেল, মুরাদ ও জজ মিয়াকেও হাজির করা হয়েছিল। [১]

এই মামলা একবার হিমঘরে গিয়েছিল স্বৈরাচারের সময়। দ্বিতীয়বার এই মামলা হিমঘরে যায় বিএনপি-জামাতের হাতে। হামলার দিন থেকে রায় হবার মধ্যে সময় ১০,৩০৬ দিন। দুইবার হোঁচট খেয়ে এর মধ্যে মামলার কার্যদিবস ছিল ৬৬ দিন। এ থেকে দেশের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিচার কীভাবে ও কতোদিনে হয় সেটার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

সূত্রঃ

[১] হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা: ফ্রিডম পার্টির ১১ নেতাকর্মীর বিশ বছরের সাজা
[২] ছবি ও খবরের সূত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক কিছুই অজানা ছিল।

তৃতীয় চক্ষু

জিপসি এর ছবি

প্রেস কনফারেন্সে খুনি ফারুক কি বাংলা না ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য রেখেছিলেন? যতদূর মনে পড়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকর্মে উনি ইংরেজি ভাষায় জবানবন্দী দেয়ার অজুহাত হিসেবে বাংলা ভাষায় দুর্বলতার কথা জানিয়েছিলেন।
এরশাদের জাঁদরেল মন্ত্রীর মালিকাধীন পত্রিকায় খুনির বক্তব্য তো দেখি বেশ মুখরোচক করেই ছাপানো হয়েছিল।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।