দাবি

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: সোম, ০২/০৮/২০১০ - ৮:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
মাঝে মাঝে আমার বের হতে ইচ্ছে করে না গাড়িটা থেকে।

কালো কাঁচ তুলে গাড়িটার ভেতরে একবার বসলে ঘোর লাগে। বাইরের বিষিয়ে যাওয়া বাতাস, সহ্যসীমা টপকে যাওয়া শব্দ, বাতাসে ভেসে বেড়ানো মানুষের ঘাম আর সিয়েনজি পোড়া ধোঁয়ার বিকট গন্ধ, লোকজনের হিংস্র হিংসুক দৃষ্টি, হামলে আসা ভিক্ষুকদের ভিড় ... এ সবকিছু থেকে নিমেষে পালিয়ে যাওয়া যায় গাড়িটার ভেতরে ঢুকলে। কেমন এক আশ্চর্য নিঝুম আশ্রমের মতো স্নিগ্ধ এর ভেতরটা, চলার সময় একটা ক্ষীণ গুঞ্জন কানে আসে শুধু। জার্মানরা গাড়ি বানাতে জানে বৈকি। তাদের ধ্রুপদী সঙ্গীতের মতোই মধুর তাদের এনজিনের কূজন।

শহরে এখন মাঝে মাঝে ঢুকি, চেষ্টা করি জরুরি মিটিংগুলো আমাদের স্যাটেলাইট শহরের কোনো রেস্তোরাঁ বা কনভেনশন সেন্টারে সেরে ফেলতে। শহরটায় ঢুকতে আর ভালো লাগে না। পাঁচ বছর আগে যখন সবকিছু সরিয়ে নিয়ে চলে গেলাম স্বর্ণদ্বীপে, তখন পেছন ফিরে তাকানোর রুচিও হয়নি। তবুও একবার তাকিয়েছি, বিবমিষা দমন করতে হয়েছে তারপর। বিবর্ণ একটা কংক্রিটের এবড়োখেবড়ো জঙ্গল, ধূসর বাতাসে ছাওয়া ঢাকা।

স্বর্ণদ্বীপ আমার মতো মানুষদের জন্যে তৈরি ছোট্ট উপশহর। দ্বীপ না হলেও, কার্যত একটা দ্বীপের চেহারাই নিয়েছে শহরটা। একটা চমৎকার পরিখা ঘিরে রেখেছে গোটা শহরকে, তার পাশে রয়েছে পার্ক, সেখানে ভোরে দৌড়োয় আমার মতো লোকজন, বিকেলে হাঁটে আমার স্ত্রী-কন্যার মতো মানুষ, টেনিস কোর্টে আমরাই দাপিয়ে বেড়াই। এই নোংরা শহরটা থেকে বেরিয়ে একটা শান্ত নির্জন বাসোপযোগী জায়গা। কোন হট্টগোল নেই, ঝামেলা নেই। পুলিশের বিশেষ শাখা এখন দূতাবাস-চ্যান্সারির পাশাপাশি এ এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। মাঝে মাঝে আমার বন্ধু সানাউলের ছেলের মতো কিছু বেয়াড়া বেয়াদব যে কিছু গণ্ডগোল ঘটায় না, এমনটা বলবো না, কিন্তু তাদেরও ভদ্রভাবে, তমিজের সাথে নিরস্ত করার প্রশিক্ষণ আছে এই বিশেষ পুলিশের।

সব মিলিয়ে, ভালো লাগে।

আজ শহরে ঢুকছি বিশেষ মিটিঙে। অর্থমন্ত্রীর সাথে কিছু কথা আছে আমার। বাংলাদেশ ইউরেনিয়াম মাইনার্স অ্যান্ড এনরিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে কিছু কথা ঐ টেকো বুড়োটাকে জানিয়ে দিতে হবে আমাকে।

২.
অর্থমন্ত্রীর নামটা বিরাট লম্বা, তবে এককালে তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো, তাই মিডিয়া আশেপাশে না থাকলে তাকে মাহুত ভাই বলেই ডাকি। মন্ত্রকে তাঁর ঘরে শুনেছি গোয়েন্দারা আড়ি পাতে, কিন্তু ঐ দুই পয়সার গোয়েন্দাদের পাত্তা দিলে আমার চলবে না। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে কফির কাপটা তুলে শুঁকি।

"খোরশেদী, তুমি এতো শোঁকাশুঁকি করো ক্যান?" মাহুত ভাই গমগমে গলায় বলেন। "এইটা সরকারি কফি না। আমার মেয়ের জামাই নিয়াসছে, ব্রাজিলের কফি, খাঁটি অ্যারাবিকা। টান দাও।"

আমি হাসি। রয়েসয়ে চুমুক দিই।

"বলো কী বলবা।" মাহুত ভাই হাত পা ছড়িয়ে হেলান দেন সোফায়।

বিইউএমইএ-র আগের সভাপতি লোকটার ওপর আমার তেমন ভক্তি নেই। অপদার্থ কিসিমের লোক, নানা কলকাঠি নড়িয়ে তাকে সভাপতির পদে বসিয়েছিলো সংগঠনের আসল রাঘব বোয়ালরা। আমি সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার ইচ্ছা যখন প্রকাশ করি. তারা সকলেই একটু নড়েচড়ে বসেছিলো, কিন্তু বেশি সুবিধা করতে পারেনি। আমি আঁটঘাট বেঁধেই নামি।

"মাহুত ভাই ...", কফির কাপটা নামিয়ে রাখি আমি, "কথা শুরুর আগেই একটা কথা বলি, আপনি কিন্তু আমাকে চেনেন। চেনেন না?"

অর্থমন্ত্রী তাকিয়ে থাকেন নিঃশব্দে।

আমি হাসি। এই হাসিতে কোনো শব্দ নেই, শুধু আমার দাঁত খানিকটা বেরিয়ে পড়ে। মাহুত ভাই দ্রুত চোখের পলক ফেলেন কয়েকবার।

"বিইউএমইএ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের নব্বই ভাগের জন্য কৃতিত্ব দাবি করে।" শুরু করি আমি। "কিন্তু আপনারা এই খাতটাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। কারণটা কী?"

মাহুত ভাই ক্লান্ত গলায় বলেন, "এইসব বালছাল স্ট্যাটিসটিক্স দিও না খোরশেদী। কাজের কথায় আসো সরাসরি। আর কফিটা ঠাণ্ডা কইরো না।"

আমি কফির কাপ তুলে নিই আবার। "ঠিক আছে। আপনার ডিজেলের দাম বাড়াইছেন আবার। আমরা এই বাড়তি দাম দিমু না। কারেন্টের দাম বাড়াইছেন, এইটার বাড়তি দাম আমরা দিমু না।"

মাহুত ভাই তাকিয়ে থাকেন।

আমি বলে যাই, "বিল যারা দেয় নাই, তাদের কারখানার কানেকশন কাটা যাবে না।"

মাহুত ভাই কিছু বলেন না।

"ডিজেলে, ফার্নেস অয়েলে ভর্তুকি দিতে হবে। পানির কানেকশন ফ্রি করতে হবে। আমাদের ট্র্যান্সপোর্ট ভেহিকেলগুলির জন্য বিভিন্ন সেতুতে যে বিপুল খাজনা দিতে হয়, সেটা পুরোপুরি তুলে নিতে হবে।" কফির কাপে চুমুক দিই আমি।

মাহুত ভাই চেয়ে থাকেন আমার দিকে।

আমি বলে যাই, "আমাদের সংগঠনের সদস্য ও তাদের পরিবারের জন্য ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট বরাদ্দ করতে হবে।"

তাকিয়ে দেখি, মাহুত ভাইয়ের কপালের রগটা লাফাচ্ছে।

বলে চলি, "এই খাতে যত যন্ত্রপাতি আছে, সবকিছুর আমদানির ওপর শুল্ক সরিয়ে নিতে হবে। আমাদের ওপর রাজস্ব বিভাগের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি সরাতে হবে।"

অর্থমন্ত্রী চেয়েই থাকেন আমার দিকে।

কফি খাই এক চুমুক। কফিটা ভালো। অদ্ভূত ধারালো ঘ্রাণ। মাথাটা একদম খুলে যায়। বলি, "স্বর্ণদ্বীপে বসবাসের জন্যে যে বিশেষ কর দিতে হয় আমাদের সংগঠনের সদস্যদের, সেটা মকুব করতে হবে।"

মাহুত ভাই বলেন, "শেষ?"

কফির কাপটা নামিয়ে রাখি। বলি, "হ্যাঁ, আরেক কাপ খাওয়ান। ... আর হ্যাঁ, ঐ মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ, সেটা থোক বরাদ্দ করতে হবে আমার দেয়া তালিকা অনুযায়ী। কুড়ি হাজার কোটি টাকা আমরা কাজে লাগাতে পারবো। ঈদে বোনাস দিতে হবে আমাদের শ্রমিকদের।"

মাহুত ভাই কিছু বলেন না, চুপচাপ কফির দামি ফ্লাস্কটা এগিয়ে দেন আমার দিকে।

কফি ঢালি। একটা রসিকতা করার ইচ্ছাকে গলা টিপে মারি। মাহুত ভাই মুরুব্বি মানুষ, আমার বড় ভাইয়ের বাল্যবন্ধু, কীভাবে বলি এসব?

আমাকে সাংঘাতিক চমকে দিয়ে মাহুত ভাই বলেন, "খোরশেদী, সরকারের পয়সায় সুন্দরী তরুণীদের রিক্রুট করে তোমাদের সংগঠনের সদস্যদের সপ্তায় সপ্তায় ব্লোজব দিতে পাঠানোর দাবি করলা না যে?"

হেসে ফেলি। কফিটা আসলেই ভালো। হৃষ্টচিত্তে চুমুক দিই।

মাহুত ভাই হাসেন না, ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন কেবল।

এই শহরে এসে গাড়ির বাইরে বেরিয়ে বহুদিন পর আবার ভালো লাগে আমার।


মন্তব্য

ওডিন এর ছবি

ঠিকাছে।

"আমাদের সংগঠনের সদস্য ও তাদের পরিবারের জন্য ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট বরাদ্দ করতে হবে।"

আমার মনে হয় এই কথাটা এরা এর মধ্যেই ইনিয়েবিনিয়ে দুয়েকবার বলে ফেলেছে।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

অতিথি লেখক এর ছবি

আগে থেকেই এসব সুবিধা পায় না??? আমার পরিচিত এক লোকের গার্মেন্টস ব্যবসা আছে, ব্যবসা শুরু করছিল বিএনপি আমলে, তারপর আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হল সরকারী মদদে। তাই এখন আর এইসব খেয়াল করি না, কইর‌্যা কি লাভ বলেন?এই সরকার দেখেন আবার নিজেদের লোকদের সুবিধা দিবে।

পলাশ রঞ্জন সান্যাল

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

রাজনৈতিক।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

রাতঃস্মরণীয় [অতিথি] এর ছবি

পড়ে ভালো লাগলো। খোর্শেদী সাহেব আর আমি আদিতে একই এলাকার লোক। তবে মাহুত স্যার একা নন, আমাদের সকল অর্থমন্ত্রীই মাহুত স্যারের মতো 'মালের আব্বা'। স্যারের নামবিশ্লেষণ করলে মনে হয় এমনই হবে। মালের আব্বা তো যেখানে-সেখানে, যাকে খুশি তাকে মাল বিলাতে পারেন এবং সুযোগ দিতে পারেন।

রাতঃস্মরণীয়

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমি মনে করছিলাম মাহুত ভাই সবশেষে একটা থাবড়া দিবো। তারপর বুঝলাম, মাহুত সাবদের কইলজা নাই
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নাশতারান এর ছবি

বানান:

কাঁচ > কাচ [কাঁচ ব্যবহৃত হয় কাঁচা অর্থে, যেমন: কাঁচকলা]

কোন হট্টগোল নেই, ঝামেলা নেই > কোনো হট্টগোল নেই, ঝামেলা নেই [কোন > কোনো]

অদ্ভূত > অদ্ভুত

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

হুমম।

দ্রোহী এর ছবি

দিলাম একটা পাঁচভুট।

চলুক


কি মাঝি, ডরাইলা?

বাউলিয়ানা এর ছবি

শেষটায় ধাক্কা খাইলাম। কি ভাবলাম আর কি হৈল!

মাহুত বেটার কোনো জিনিসই নাই!

চয়নিকা [অতিথি] এর ছবি

হা হা ব্যাপক মজা পাইলাম....গার্মেন্টস মালিক বা বিজেএমসির কাউরে পাইলে ট্যাগ কইরেন। হা হা হা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।