শব্দগল্পদ্রুম ০২

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: রবি, ০২/০৭/২০১৭ - ৫:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দ্রুম মানে বৃক্ষ। এই পোস্টটি গাছ নিয়ে, বা আরো খুঁটিয়ে নির্দেশ করতে গেলে, গল্পের গাছ নিয়ে; এর শিরোনাম তাই গল্পদ্রুমশব্দ রাখা যেতো। দ্রুমশব্দগল্প রাখলেও সম্ভবত ভুল হতো না।

বাংলা ক্রান্তীয় ঊর্বরাঞ্চলের মানুষের ভাষা, ক্রান্তীয় উদ্ভিদমণ্ডলের নাম সাধারণ মানুষের মুখে আর আয়ুর্বেদশাস্ত্রের পাতায় তাই সুলভ। কিন্তু যদি বাংলায় এমন একটি গল্প আমরা লিখতে চাই, যেখানে জলবায়ু ভিন্ন, তখন ইংরেজির সাহায্য না নিয়ে কতোটুকু এগোতে পারবো?

বাংলাভাষী এলাকার গণ্ডি ছেড়ে খুব বেশি এগোতে হবে না। উত্তরদিকে কয়েকদিন হাঁটলে, কিংবা কয়েক ঘণ্টা গাড়ি হাঁকালে আমরা এমন সব বৃক্ষরাজির মাঝে নিজেদের আবিষ্কার করবো, যেগুলোর নাম পরিভাষীকরণের অভাবে বা অভিধানে ভুক্তি যোগ না করায় বাংলায় জনপ্রিয় হয়নি। হিমাঞ্চলীয় দ্রুমগোষ্ঠী আমাদের ঘরের কাছে, কিন্তু এদের সাথে আমাদের বিশদ পরিচয় ইংরেজির ঘটকালিতে। এমনটা কেন ঘটলো?

আমাদের গল্প-কবিতা-প্রতিবেদনগুলোয় হিমাঞ্চল নিতান্ত অনুপস্থিত নয়। অনুবাদ সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়েও হিমাঞ্চলীয় পরিবেশ উঠে এসেছে, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে লেখক-সাংবাদিকেরা বৃক্ষসমূহকে বাংলায় ডাকতে স্বস্তিবোধ করেননি। উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রগুচ্ছ হয়ে গাছগুলোর ইংরেজি নাম আমাদের মাঝে ফুটে আছে। ওক, বার্চ, ফার, পপলার, মেপল, স্প্রুস, সাইপ্রেস, বিচ, চেরি, চেস্টনাট, পাইন, সিডার, হেমলক, ইউ, এল্ম, জুনিপার... এগুলো ছাড়া হিমাঞ্চলীয় আবহের গল্প অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। এই গাছগুলো কেবল ইংরেজের দেশের নয়, কিন্তু আমরা ইংরেজি নামগুলোই বয়ে চলছি। তাই ননী ভৌমিকের মতো সুদক্ষ অনুবাদকও যখন কিরগিজিস্তানের গল্প বাংলায় অনুবাদ করেন, সেখানে ফার-বার্চ-জুনিপার শব্দগুলো চলে আসে। এগুলোকে এড়ানো যায়নি, কারণ এড়ানোর প্রয়োজন কেউ বোধ করেননি। যা কিছু "বিদেশি", সবই আমরা ইংরেজের টিনের চশমা দিয়ে দেখবো, এমনটা আমরা মেনে নিয়েছি। সে কারণেই বাংলার অন্যতম ডানপিটে চরিত্র মাসুদ রানা "পিস্তলের" "সেফটি ক্যাচ" "অফ" করে, যখন-তখন মেয়েদের "ব্রা"-এর "হুক" খোলে, কারণ বাংলায় না ছিলো পিস্তল, না ছিলো সেফটি ক্যাচ, না ছিলো ব্রা (তার আবার হুক)। হিমাঞ্চলীয় বৃক্ষসমূহকেও আমরা তাই পিস্তলের সেফটি ক্যাচের মতো চিরভিনদেশি, স্বভাষায় অগম্য করে রেখে দিয়েছি।

হঠাৎ আগত জলোচ্ছ্বাসে ভেসে পড়শির যৌনপুতুল নিজের আঙিনায় এসে পড়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা যদি সত্তর বছর বা দেড়শো বছর ধরে পড়ে থাকে, কিংবা আঙিনা থেকে সরে শয্যাঘরে ঠাঁই নেয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, এর মধ্যে কোথাও কোনো সমস্যা আছে। আমাদের তরফ থেকে সমস্যা সম্ভবত আলস্যে, কিংবা মেনে নেওয়ায়। আলাপ করতে গিয়ে দেখেছি, অনেকেই পরিভাষার প্রশ্নে খুব বিরক্ত হন। পিস্তলের সেফটি ক্যাচ, স্ত্রীলোকের ব্রায়ের হুক কিংবা ওক গাছের বাংলা পরিভাষা থাকার কি আদৌ কোনো দরকার আছে কি না, তাঁদের সে জিজ্ঞাসা অবশ্য অসঙ্গত নয়। এঁরা অনেকেই "ভাষা বহতা নদী" বলে ব্যাপারটার ওপর দার্শনিকতার প্রলেপ চড়ান। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটছে, আমাদের বাংলা ভাষা প্রশস্ত খাতে শীর্ণ নদীর মতো পড়ে আছে, ইংরেজের খুঁড়ে যাওয়া খাল বেয়ে ইংরেজির প্রমত্তা স্রোত তাতে এসে মিশছে। আমরা সেটা মেনে নিয়েছি বলেই এমনটা ঘটছে, নইলে মাসুদ রানা হয়তো কোনো তাগুতি যুবতীর কাঁচুলির খিল খুলতো। অলসের ভাষা বহতা নদী নয়, আবদ্ধ নর্দমা।

ওপরে যে হিমাঞ্চলীয় গাছগুলোর নাম লিখলাম, সেগুলো উপমহাদেশে হিমালয়ের পাদদেশে সুলভ। সে কারণেই এদের অনেকের তৎসম নাম আয়ুর্বেদে বা অন্যান্য শাস্ত্রে পাওয়া যায়। বাংলাভাষী অঞ্চলের গাছ নয় বলে এদের সবগুলোর তদ্ভব নাম বাংলায় আসেনি, কিন্তু নেপালিতে এসেছে। যেমন মেপলের সংস্কৃত নাম কুট্টিমদারু, নেপালিতে সেটা হয়ে গেছে কাঞ্চিরো। মেপলের সাথে বাঙালির পরিচয়ের আগে কাঞ্চিরোর সাথে সাক্ষাৎ ঘটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু সেটা আর হয়নি শেষ পর্যন্ত। ভূর্জপত্রের কথা আমরা বইতে পড়ি বটে, কিন্তু সেটা যে বার্চের ছাল, তা জানা না থাকায় বার্চকে আর ভূর্জ বা ভোজপাতা ডাকা হয় না, "বার্চবনে ঝড়" নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। একই কারণে ফারকে তালীশ হিসেবে চিনতে সমস্যা হয়, এল্মকে চিরবিল (চিরিবিল্বের তদ্ভবরূপ) লিখতে সংকোচ হয়, জুনিপারকে হপূষা লিখলে আমেজটা যেন ঠিকমতো ফোটে না, পাইনকে চীর বা সরল বললে নিচে টীকা লিখে দিতে হয়। সমস্যাটা যতো না গাছগুলোকে নিজ ভাষায় চেনার, তারচে যেন বেশি ইংরেজি নামগুলোকে প্রত্যাখ্যান করায়। প্রচুর শিক্ষিত মানুষ ঐ জায়গায় এসে তেতে ওঠেন, যদিও তাঁদের কোনো উদ্যানে নিয়ে ছেড়ে দিলে কোনটা ওক আর কোনটা বিচ, সেটা হয়তো তাঁরা চিনতে বা চেনাতে পারবেন না।

উপনিবেশের শেকড় আমাদের ভেতরে অনেকখানি প্রবিষ্ট, ওপড়াতে গেলে নানা নাজুক জায়গায় চোট লাগে। অনেক মানুষ যেমন আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দকে ইসলাম ধর্মের বাহন হিসেবে মেনে নিয়ে বাংলা শব্দকে হিন্দুয়ানির সাথে সমীকৃত করেন, ইংরেজিও একইভাবে আমাদের অনেকের কাছে শিক্ষা, আভিজাত্য আর জাত্যাভিমানের সাথে সমীকৃত, বাংলা সেখানে খ্যাৎপনার প্রতীক। অন্যের ঢোলা জাঙ্গিয়াকে পায়জামা বানিয়ে পরে বেড়ানোর মাঝে একটা জাতির শিক্ষিত মানুষেরা গৌরবের স্বাদ পেয়েছেন বলেই বাংলায় ভিন্ন জলবায়ুর গল্প লিখতে গিয়ে আজ লেখককে মাঝপথে থেমে গিয়ে শব্দ খুঁজতে হয়।

ভিনদেশকে যদি স্বভাষায় চিনতে না পারি, তাহলে পৃথিবীর ওপর অধিকারবোধও জন্মায় না। সেজন্যে যদি আজ নতুন করে একটা শব্দ নির্মাণও করে নিতে হয়, সেটাই সই। দুটি মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ইংরেজ বাংলায় এসে কোনো এক শ্যামল দীঘির তীরে হিজল গাছ দেখতে পেয়ে তার ইংরেজি নাম দিয়েছিলো ইন্ডিয়ান ওক। একই কায়দায় ওক গাছকে গল্পে হিমহিজল লিখে যাচ্ছি কয়েক বছর ধরে, বিচকে লিখছি হিমকরচ, স্প্রুসকে লিখছি হিমঝাউ (স্প্রুসের একটা উত্তরভারতীয় নামও আছে, "রৈ")। এ নামগুলো নিয়ে আমার সাথে একমত হতে বলছি না কাউকে, শুধু বলছি, ইংরেজি শব্দগুলোর বিকল্পসন্ধানের সুযোগ, অধিকার এবং তাড়না লেখকের থাকা প্রয়োজন। ভাষা যদি বহতা নদী হয়, লেখক সে নদীতে ভাসমান কচুরিপানা হওয়ার জন্যে কলম তুলে নেবেন না, তিনি সে নদীর ওপরে ভাসমান আষাঢ়ের মেঘখণ্ড হয়ে আসবেন।


পরিভাষায় আগ্রহীরা হিমাঞ্চলীয় লতাগুল্মবৃক্ষের তৎসম/বাংলা নাম খুঁজতে স্প্রিঙ্গার ফেরলাগ হাইডেলবার্গ থেকে প্রকাশিত সি. পি. খারে-র ইন্ডিয়ান মেডিসিনাল প্ল্যান্টস: অ্যান ইলাসট্রেটেড ডিকশনারি ঘেঁটে দেখতে পারেন। লেখক হিসেবে তৎসম শব্দকে উচ্চারণবান্ধব বাংলায় রূপান্তরের অধিকারও আপনি বহন করেন।


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

আগে খেয়াল করিনি। সত্যিই, আমরা ইংরেজির টিনের চশমা দিয়েই বিশ্বকে দেখে আসছি, আর এটা এতোই সাবলীলভাবে যে নিজের মনের কাছেও তা ধরা পড়েনা। খ্রিস্টীয় নববর্ষকে ইংরেজি নববর্ষ বলার মত ব্যাপারটা।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

এভাবে তো ভাবি না। এবার ভাববো।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

স্পর্শ এর ছবি

পরিভাষা আর তার পিছনের ভাবনাগুলো ভালো লাগলো। হিমহিজল আর হিমকরচওয়ালা গল্পগুলো এবার আসুক। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

কল্যাণ এর ছবি

ওইদিকে চণ্ডীশিরা আর ১৫০ পাতার বিজ্ঞান-কল্পগল্প!! ওঁয়া ওঁয়া

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

মন মাঝি এর ছবি

আপনি এখনও চণ্ডীশিরা নিয়ে আছেন! হা হা হা!!!! গড়াগড়ি দিয়া হাসি

****************************************

কল্যাণ এর ছবি

সে আর বলতে।

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ভাবনায় সর্বোতভাবে সহমত পোষণ করছি।

আয়নামতি এর ছবি

উত্তম জাঝা!
দারুণ লাগলো আপনার ভাবনা! 'সমস্যাটা যতো না গাছগুলোকে নিজ ভাষায় চেনার, তারচে যেন বেশি ইংরেজি নামগুলোকে প্রত্যাখ্যান করায়।' আসল সমস্যা এটাই।

হিমু এর ছবি

সিলেট নামের ব্যুৎপত্তি নিয়ে নানা মত চালু আছে, নতুন একটা পড়লাম, "শিলি-অধিষ্ঠ" বা "শিলি-ভিটা" থেকে সিলট। শিলি মানে বার্চ বা ভোজপাত গাছ (Betula utilis), এটা নতুন শিখলাম। শিলি নামটা ছোট্ট-মিষ্টি, ভূর্জ বা ভোজপাতের চেয়ে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।