এক সন্ধ্যায় মঙ্গল ও পৃথিবী

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: বুধ, ১৬/১১/২০১১ - ১১:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সন্ধ্যার মুখে মুখে পৃথিবী যখন ঘুমানোর আয়োজন করছিল তখন দূর থেকে হন হন করে বুড়া মঙ্গল মিয়াকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। মঙ্গলকে দেখে পৃথিবীর মনে অমঙ্গল আশংকা দানা বেঁধে উঠলো। এরকম বিনা নোটিশে কখনো আসে না সে। লালমুখোকে তার খুব হিংসা। ঝুট ঝামেলা থেকে বহুদূরে ব্যাটা কোটি কোটি বছর ধরে নাকে কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে আয়েশ করে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। যখন ইচ্ছে ঘুমোয়, যখন ইচ্ছে জাগে। বিরক্ত করার কেউ নেই। দুটো বেঢপ চাঁদ আছে, তাদের মুখেও কোন রা নেই। পৃথিবীর বুকেই যত যন্ত্রনা হাউকাউ চিৎকার চেঁচামেচি। যুদ্ধ বোমা সন্ত্রাস অনাহার মহামারী সব এখানেই। ফি বছর একটা না একটা লেগেই আছে। একটা থামালে আরো দশটা লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় জাতিসংঘরে জুতানো দরকার।

পৃথিবীর বুকে এই সব অনাচারের জন্য দায়ী মাত্র একটা প্রাণী। তার পেটে বুকে জীবিত লক্ষ কোটি প্রাণীর মধ্যে মানুষ জাতের একটা মাত্র প্রাণী গোটা দুনিয়ার সব অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অকৃতজ্ঞ এই জাতির অভিযোগ অনুযোগ প্রার্থনা শুনতে শুনতে পৃথিবীর কান ঝালাপালা। এত জ্বালা তোদের তবু লোকসংখ্যা কমাস না। জন্ম নিয়ন্ত্রনের টাল বাহানা করে করেও ৭০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছিস সংখ্যায়। অসম্ভব বিরক্ত লাগে তার। চাইলে সে নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারে পুরো মানবজাতিকে। কিন্তু তাতে বাকী প্রাণীকূলেরও ধ্বংস হয়ে যাবার আশংকা আছে বলে সে অক্ষম রাগে কখনো ফোঁস ফোঁস করে, কখনো ঝাঁকুনি দেয়, কাঁপুনি দেয়, যাতে ভয় পায় মানুষের জাত। কিন্তু সব সাময়িক। পরিস্থিতি শান্ত হলে সাংবাদিক ডেকে লেকচার দিয়ে জানাবে এসব হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান এসব নিয়ন্ত্রন করে ফেলবে। বায়ু নিয়ন্ত্রন করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

গাধার গাধা মানুষের বাচ্চা। মনে মনে গালি দেয় পৃথিবী।

মানুষকে সহজে কাবু করতে না পেরে কিছুদিন যাবত একটা বিকল্প প্ল্যান মাথায় ঘুরছিল তার। মঙ্গল মিয়াকে নিয়েই। মানুষের কানে ফুসকানি দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে তামাশা দেখছে বসে বসে। পুরো প্ল্যানে মঙ্গলের অমঙ্গল লুকিয়ে থাকলেও কাউকে সেটা বলেনি সে। কিন্তু কেউ কি বেফাঁস মুখে মঙ্গলের কানে তুলে দিয়েছে কথাটা ? সেই কারণেই কি মঙ্গল মিয়া এই অসময়ে আসছে? কে ফাঁস করলো? নাহ সে বুধ কিংবা শুক্র কাউকেই বলেনি। শনির সাথে তো তার দেখাই হয় না। আর বৃহস্পতির কাছে যাবার সাহসই নেই তার।

আর ভাবতে পারলো না। বায়ুমন্ডলের দোরে এসে কড়া নাড়তে শুরু করলো মঙ্গল।

-কি হে জেগে আছো না ঘুমিয়ে গেছো (গলায় মধু ঢেলে জিজ্ঞেস করলো মঙ্গল)

-এই তো চোখটা লেগে আসছিল প্রায়। তা এই অসময়ে কি মনে করে, নাকি শুক্রের বাড়ি যাচ্ছিলি টাংকি মারতে? (গলায় ব্যাপক ক্লান্তির ছাপ আনতে চেষ্টা করলো পৃথিবী)

-আরে না, তুমি কি সব বলো না, শুক্রের যে তেজ বাড়ছে আজকাল, কাছে যাওয়াই মুশকিল। সেদিন হুমকি দিয়ে বলেছে আর এক পাও এগোলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে।

-তাইলে এদিকে কিসের মতলবে, আমার কিন্তু সকাল সকাল উঠতে হবে ম্যালা কাজ পড়ে আছে......

-তা জানি। তোমার শরীরটা কেমন যাচ্ছে? খুব খাটাখাটনি হচ্ছে বুঝি আজকাল (দরদ উথলে উঠতে দেখে পৃথিবী আরো সন্দেহপ্রবন)

-হ রে ভাই, শরীর স্বাস্থ্য তেমন ভালো যাচ্ছে না আজকাল। বয়স তো কম হলো না। সাড়ে চারশো কোটি বছর বয়সের মধ্যে শেষ এক কোটি বছর মোটামুটি শান্তিতে কাটিয়েছিলাম। বুকে পেটে গ্যাস্ট্রিকের যন্ত্রনা কমে এসেছিল। নিয়মিত ঘুম হচ্ছিল। গত বিশ হাজার বছর তো একদম নিরুপদ্রপ ঘুমানো গেছে। কিন্তু তাবত প্রাণীকুলের শীর্ষ নিমকহারাম মানবজাতি গত একশো বছর ধরে আমার পেটের মধ্যে এমন গুঁতোগুতি শুরু করেছে আর নাকের উপর দুর্গন্ধ বায়ু ছাড়তে শুরু করেছে যে তাতে হাঁচি কাশি জ্বর পেট ব্যাথা, ডায়রিয়া বমি আবার শুরু হলো বলে। হারামীর বাচ্চারা নিজেদের কুকাজগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘাড়ে চাপিয়ে দায়িত্ব এড়াতে চাইছে। যন্ত্রনায় বাঁচতে ইচ্ছে করছে না আর। আমার কথা বাদ দে, তুই কেমন আছিস বল? তুই তো তো শান্তিতে ঘুমাচ্ছিস বহুকাল। তোকে দেখলেও হিংসা হয়। আহা তোর বয়সে আমারও কতো সুখ গেছে.........।

-আরে না, যার যন্ত্রনা সেই জানে। আমি এই খাঁ খাঁ শীতল মরুভূমি নিয়ে কোটি কোটি বছর কাটিয়ে দিচ্ছি। এতকাল তোমার দিকে তাকিয়ে হা হুতাশ করতাম, বিধাতা আমার বুকে কেন একটা সন্তান দিল না। একটা ফুলের বীজ, একটা পাখির ছানা, কিছু একটা তো দিতে পারতো। আমার কোটি বছরের আক্ষেপে বিধাতার মনে দয়া হলো বুঝি একদিন। সেদিন তোমার বুক থেকে একটা ফড়িং এসে আমার বুকে বসলো, চড়ে বেড়ালো, আমার সেদিন ঈদের আনন্দ। যাক এতদিনে আমার একাকীত্ব বুঝি কাটলো। কিন্তু কিছুদিন পর আরেকটা ফড়িং এসে নামলো, এটা আগের চেয়েও সুন্দর। কিন্তু এই ফড়িংটা বদ কিসিমের। আমার চামড়ায় কেবল খোঁচাখুচি খামচাখামচি করে দিনরাত। আমার এখনো তেমন ব্যাথা লাগছে না, কিন্তু কেমন যেন চুলকানির মতো লাগে। ফোসকা পড়ে যাবে এরকম চলতে থাকলে। অসহ্য হয়ে উঠছে দিনকে দিন। বুঝলাম না আমার গায়ের উপরে এত লক্ষ বর্গমাইলের ধূ ধূ খালি জায়গা পড়ে থাকতে পেটের ভেতর কেন গুঁতোগুঁতি করা শুরু করছে? তাই ভাবলাম তোমারে একবার জিজ্ঞেস করি।

-ভাইরে, আর কইস না। এই হারামীরা আমার পেট ফানাফানা করে সব লুটেপুটে নিছে। এখন তোর দিকে নজর পড়ছে, তোর কাছ থেকে যা পাওয়া যায় তাও লুটে নিবে। কোন কুক্ষণে যে এদেরকে বাঁদর থেকে মানুষ হতে দিলাম, সেই থেকে আমার চোখে ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

-এটা কিরকম দুঃসংবাদ দিলা। আমি আমার ঠান্ডা পেট নিয়ে এতদিন গর্ব করতাম। গ্যাস্ট্রিক ডায়রিয়া কিছুই নাই। আগুন পানি কিচ্ছু লাগে না, সব হজম করে শান্তিতে ঘুমাচ্ছি। কেবল কথা বলার জন্য মাঝে মাঝে আনচান করে, একটু সবুজের জন্য, একটা পাখির গানের জন্য একটু হা হুতাশ লাগে। তোমার বুকে এত পাখি এত বন পাহাড়, এত গান দেখে শুনে চোখ জুড়িয়ে যায়। দুয়েকটা পাহাড় জঙ্গল আর পাখপাখালি যদি উড়ে এসে বসতো আমার বুকে। তা না, আসলো তোমার নেমক হারাম মানুষ। ওরা কি চায় আমার কাছে?

-ওরা জানতে চায় তোর বুকে পানি আছে কিনা।

-কেন তোমার বুকে পানির অভাব? চারভাগের তিনভাগ পানি আছে কইলা না সেদিন?

-আরে পানি তো আমার ম্যালাই আছে। কিন্তু তোর পানির ব্যাপার অন্য......

-কি ব্যাপার সেটা?

-তোর বুকে পানি থাকা মানে তোর বুকে অক্সিজেন আছে, অক্সিজেন থাকা মানে প্রাণের সম্ভাবনা, তার মানে তোর বুকটা বাসযোগ্য জায়গা, আর বাসযোগ্য জায়গা পেলেই আদম ব্যবসা....সাথে রিয়েল এস্টেট...বিশাল অট্টালিকা শত শত বুরুজ-আল-মঙ্গল খাড়া করবে তোর বুকে।

-অ্যাঁ??? এই সর্বনেশে বুদ্ধি কে দিল তাদের?

-হে হে, আবার জিগায়। তোর ভালোর জন্যই করলাম। ভাবলাম ছোটভাই অনেক বছর ঠান্ডার মধ্যে একা একা দিন কাটাইতেছে, এইবার একটু ঘর সংসারের স্বাদ নিক, আর আমিও একটু ভারমুক্ত হই। এত মানুষ হজম করা কঠিন হয়ে গেছে আমার। এই মাসে ৭০০ কোটি পার হয়ে গেছে মানুষের বাচ্চা। ১০০০ কোটি হলে তো আমার জান শেষ। তার আগেই.......

-ওরে হারামীর বাচ্চা হারামী, গোলামের বাচ্চা গোলাম...... তাইলে তোর কুবুদ্ধিতেই আজকে আমার সর্বনাশ হতে যাচ্ছে!!!! আমি যদি আর একটারেও আমার পেটের উপর বসতে দেই, উল্কা মেরে তাড়াবো সব....তোর উপর ধুমকেতুর লানত নাজিল হোক...তোর চাঁদ সুরুজ নিপাত যাক!!!!

-আরে অমন চেতে উঠলি কেন? এই ভর সন্ধ্যেবেলা মুখ খারাপ করতে আছে? আমি বুদ্ধি না দিলেও ওরা তোর দিকে যেতোই। এক আম্রিকান হারামী দীর্ঘদিন ধরে তোর দিকে তাকিয়ে ছিল জুল জুল করে। সে আরো বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে মঙ্গল সমাজ গঠন করেছে। তোর বুকে কিভাবে লোকজন নামাবে তার পরিকল্পনা করেছে। মনে হচ্ছে তারা শুধু বসবেই না লেপ্টে গড়িয়ে শুয়ে থাকবে। তয় লোক কিন্তু খারাপ না একেবারে। সবগুলো সভ্য দেশের মানুষ। এইখানে দেখ তোর মেহমানদের সম্ভাব্য তালিকা

তালিকা দেখে মঙ্গল মিয়া মুর্ছা গেল।

[ছবি: উইকিপিডিয়া]

ছবি: 
29/07/2008 - 2:17pm

মন্তব্য

শাব্দিক এর ছবি

হাসি

উচ্ছলা এর ছবি

এক নিশ্বাসে পড়লাম হাসি এককথায় চমৎকার চলুক চলুক চলুক চলুক চলুক

নিটোল এর ছবি

চমৎকার! চলুক চলুক চলুক

_________________
[খোমাখাতা]

শিশিরকণা এর ছবি

চলুক

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

একটা অ্যাপার্টমেন্ট বুকিং দিতে চাই। ঠিকানাটা জানাইয়েন।

তারেক অণু এর ছবি
কল্যাণF এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।