সন্ধ্যা ছটায় আগত মেয়েটি

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: শনি, ১৩/০৩/২০২১ - ৬:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[ভূমিকা: সব অনুবাদের ভূমিকা লাগে না। কিন্তু এই অনুবাদটির পেছনে একটি গল্প আছে। আমি কেন এই অনুবাদটি করতে গেলাম? বাংলাদেশে মার্কেজ খুব জনপ্রিয় একজন লেখক। সম্ভবত বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশী অনুবাদ হয়েছে মার্কেজের গল্প উপন্যাস। বাংলা অনুবাদের অবস্থা তেমন সুবিধার না বলে আমি বহুকাল বাংলা অনুবাদ পড়ি না। সত্যি বলতে গেলে সেই কৈশোর থেকে সেবা প্রকাশনী ছাড়া অন্য কারো বাংলা অনুবাদে আমি স্বস্তি পাইনি। কিছুকাল আগে আমি মার্কেজের ছোটগল্প নিয়ে একটা কাজ করি। হাতের নাগালে থাকা বাংলা অনুবাদগুলো পড়ে ইংরেজি অনুবাদের সাথে মেলাতে বসি। যেহেতু স্পেনিশ ভাষা জানি না তাই ইংরেজিটাই আমার কাছে মূল গল্পের ভিত্তি। কাজ করতে গিয়ে 'গল্পপাঠ' ওয়েবজিনে বেশ কয়েক জনের অনুবাদ পড়ার পর আমি খুব হতাশ হয়ে পড়লাম। তারপর খোঁজ নিয়ে জানলাম বাংলা ভাষায় মার্কেজের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুবাদক অমিতাভ রায়। কলকাতার দে'জ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনুদিত 'মার্কেজের গল্পসমগ্র'। বইটা সংগ্রহ করার পর ভাবলাম এবার হয়তো কিছুটা উন্নত অনুবাদের দেখা মেলবে।

গুডরিডসে বাঘা বাঘা লোক তাঁকে পাঁচতারা দিয়ে রেখেছেন। আশাবাদী হয়ে বইটা উল্টে পড়তে থাকলাম সাথে সাথে ইংরেজি মেলাতে লাগলাম। ভুল পেলে পেন্সিলে দাগ দিচ্ছি। পরপর কয়েকটা অনুবাদ পড়ার পর দাগ দিতে দিতে আমার পেন্সিল ভোঁতা হয়ে গেল। কিছু কিছু জায়গায় এত খারাপ অবস্থা যে মনে হলো অনুবাদকের সাধারণ ইংরেজি বিদ্যাও নেই। কী ভয়ানক অবস্থা। মূল গল্প থেকে অনুবাদ কত হাত দূরে গেছে সেটা জানলে মার্কেজ হয়তো অজ্ঞান হয়ে যেতেন। তখনই খুব দুঃখের সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম খুন হওয়া কয়েকটি গল্পকে বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করবো। আমার অনুবাদ খুব উন্নত বলে দাবী করার মতো স্পর্ধা নেই, কিন্তু এটুকু আত্মবিশ্বাস আছে যে আমি অন্তত কোন গল্পকে খুন করিনি। আমার অনুবাদে কেউ ভুলত্রুটি পেলে দয়া করে মন্তব্যে জানাবেন, আমি শুধরে নেবো। এই অনুবাদটি গুগল ডকে ভয়েস টাইপে করা, কিছু টাইপো থাকা অস্বাভাবিক নয় ]

সন্ধ্যা ছটায় আগত মেয়েটি

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

ঝুলন দরোজাটা খুলে গেল ঝট করে। হোসের রেস্তোরাঁয় তখনো কোন খদ্দের আসেনি। দেয়াল ঘড়িটায় সবেমাত্র ৬ টার ঘন্টা বাজলো। সে জানে তার নিয়মিত খদ্দেররা এতই সময়ানুবর্তী যে সাড়ে ছটার আগে কেউ আসবে না। দরজা ঠেলে একটি মেয়ে ঢুকলো রেস্তোঁরায়। সে প্রতিদিন ঠিক এই সময়েই আসে। ঢুকেই সে নিঃশব্দে কাউন্টারের এক পাশের টুলে বসে পড়ল। তাঁর দুই ঠোঁটের মাঝখানে একটি অপ্রজ্জ্বলিত সিগারেট।

-হ্যালো রানী, কী খবর তোমার?
মেয়েটা বসার সাথে সাথে রসিকতার সাথে হাঁক দিয়ে বলল হোসে। তারপর কাউন্টারের ভেতরের দিকে দাঁড়িয়ে একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে তার উপরিভাগটা মুছতে লাগলো। যখনই কোন খদ্দের রেস্তোঁরায় প্রবেশ করে হোসে মোছামুছির কাজটা শুরু করে। এমনকি এই মেয়েটা যার সাথে তার একটু আলগা খাতির, তার আগমনেও ব্যতিক্রম হয় না।

মোটাসোটা গোলগাল শরীরের হোসে এই রেস্তোঁরার মালিক। সে তার হোটেলকর্মী সুলভ রসিকতা দিয়ে খদ্দেরদের মন জুড়ায়। কাউন্টারের অন্যপ্রান্ত থেকে হোসে আবারও বলে উঠল-

-আজ তুমি কী খেতে চাও বলো?
- কী খাবো সেটা বলার আগে তোমাকে ভদ্রতা শেখানো দরকার।

মেয়েটা কাউন্টারে তার কনুই দুটো রেখে দুই ঠোঁটের মাঝে না ধরানো সিগারেটটা এমনভাবে চেপে রেখেছে যেন সেটা হোসের নজরে পড়ে। ঠিকই নজরে পড়লো হোসের। তাড়াতাড়ি বলে উঠলো সে-
-আহহা আমি খেয়াল করিনি রানী।
-তুমি অনেক কিছুই খেয়াল করতে শেখোনি হে। একটু বাঁকা সুরে মেয়েটা বললো।

মোছামুছির কাপড়টা রেখে পিছন ফিরে স্যাঁতসেঁতে থালমারির(কাবার্ড) ভেতরে হাত দিয়ে একটা দিয়াশলাই বের করে আনল হোসে। দিয়াশলাই জ্বালাতেই মেয়েটা ঝুঁকে তার রুক্ষ খসখসে দুই হাতের মধ্যে মুখটা নামিয়ে সিগারেটটা ধরালো। সেই অবকাশে হোসে মেয়েটার সস্তা পুরু ভেসলিন লাগানো চুলের বাহার এবং উন্মুক্ত কাঁধের উপর দিয়ে গোলাপী অন্তর্বাসের ফুলের কাজগুলো দেখতে লাগলো। মেয়েটা যখন মাথা তুলল তখন তাঁর স্তনের উর্ধাংশের সুডৌল ভাঁজেও চোখ গেল তার। জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে মেয়েটা মাথা তুলতেই হোসে বললো-
- আজ তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে রানী।
- বাকোয়াজি রাখো। ওসব মিষ্টি কথা বলে আমার কাছ থেকে পয়সা আদায় করতে পারবে না। ঝামটা দিয়ে বলে উঠলো মেয়েটা।
- আরে না! আমি সেজন্য বলিনি রানী। তবে আমি বাজী রেখে বলতে পারি আজ তোমার দুপুরের খাবারটা তেমন জুতসই হয়নি। হোসে বলল।

মেয়েটা তার হাত দুটো কোনাকুনি ভাঁজ করে, কাউন্টারের ওপর কনুইয়ের ভর দিয়ে সিগারেটে একটা জোরালো টান দিয়ে পুরু ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়লো। তারপর রেস্তোরাঁর প্রশস্ত জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে কেমন এক বিষন্ন নিঃসঙ্গতা ছড়ানো।
- তোমাকে জম্পেশ একখানা কাবাব ভেজে দেই, কী বলো? হোসে বলল।
-আমার হাতে কিন্তু এখনো কোনো টাকা পয়সা আসেনি। মেয়েটা সতর্ক করে দিল তাকে।
-গত তিন মাস ধরেই তো তোমার হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই, তবু তো আমি তোমার জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। হোসে আশ্বস্ত করলো।

-আজকের কথা একটু আলাদা। মেয়েটা তখনো বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
-প্রতিদিন একই ব্যাপার। ঘড়িতে ছটা বাজলে তুমি এসে উপস্থিত হও, তারপর বলো তুমি কুকুরের মত ক্ষুধার্ত এবং আমি তোমার জন্য ভালো কিছু তৈরি করে দেই। আজকে এটুকুই ব্যতিক্রম যে তুমি এসে বলোনি কুকুরের মত ক্ষুধার্ত তুমি।
-হ্যাঁ এটা ঠিক বলেছো। আজ এটাই ব্যতিক্রম। মেয়েটা তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল।

সে তখন কাউন্টারের অন্য প্রান্তে ফ্রিজের পাশে গোছগাছের কাজ করছিল। মেয়েটা তার দিকে দুই তিন সেকেন্ড তাকিয়ে নিরীক্ষা করলো। তারপর থালমারির(কাবার্ড) উপরে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো ছটা বেজে তিন মিনিট। সে মুখ দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গলায় একটু ভাব এনে বলে উঠল-
- আজ আমি ছটার সময় আসিনি কিন্তু হোসে। সে কারণেই আজ ব্যতিক্রম হল।

দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে হোসে বললো- আমি আমার হাত কেটে ফেলবো যদি ঘড়িটা এক মিনিটও স্লো হয়।
-না হোসে মোটেও ঠিক বলছো না তুমি। আমি আজ ছটার সময় আসিনি। বলল মেয়েটা।
-কিন্তু তুমি যখন দরোজা দিয়ে ভিতরে ঢুকছিলে তখনই এটা ছটার ঘন্টা বাজানো শেষ করেছিল। বলল হোসে।
-সে যাই বলো আমি এখানে আসার ১৫ মিনিট পার হয়ে গেছে কিন্তু।

হোসে তার ডান চোখের পাতাটা হাতের আঙ্গুল দিয়ে ফাঁক করে মেয়েটার মুখের উপর মাথাটা নিয়ে গিয়ে বললো
- আমার এখানে একটা ফুঁ দাও দেখি।

মেয়েটা ঝট করে মাথাটা পেছনে সরিয়ে নিল। তার চোখে তখন এক ধরনের ক্লান্তি আর বিরক্তি, তবু তাতে কেমন একটা মায়া আর বিষাদের যুগপৎ ছায়া খেলা করছিল।
-বোকার মত কথা বলোনা হোসে। ভেবেছো মাতাল হয়েছি আমি। তুমি জানো গত ছ'মাস আমি মদ খাইনি। বললো মেয়েটা।
-ওসব চাপাবাজি অন্য কোথাও করো, আমার কাছে নয়। আমি নিশ্চিত এখানে আসার আগে তুমি কমপক্ষে দুয়েক পাঁইট মদ গিলে এসেছো।
-অ্যাঁ? কিভাবে টের পেলে? ঠিক ধরেছো দেখি। এদিকে আসার আগে এক বন্ধুর সাথে কয়েক পেগ গিলে এসেছি। দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল মেয়েটা
-এবার বুঝতে পেরেছি ঘটনা। হোসে বলল হেসে।
-ওতে বোঝাবুঝির কিছু নেই হোসে। ব্যাপার হলো আমি এখানে ১৫ মিনিট ধরে আছি।

মেয়েটার কথা শুনে কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করে নিরুপায় ভঙ্গী করে হোসে বলল- ঠিক আছে যদি তাই চাও, তাহলে তাই হবে। দিলাম তোমাকে ১৫ মিনিট। মানলাম তুমি ১৫ মিনিট আগেই এসেছ। তবে ১০ মিনিট আগে-পরে হলে এমন কীইবা এসে যায়?

-অনেক বড় ব্যাপার হোসে। যদিও ঘটনাটা ওরকম হোক তা আমি চাইনি। সে যাকগে, আসল কথা আমি এখানে ১৫ মিনিট ধরে আছি। মেয়েটা তার হাত দুটো কাউন্টারের ওপর টানটান করে ছড়িয়ে দিল, সেই সাথে অনির্দিষ্ট কিছুর প্রতি এক ধরনের নির্বিকার অবহেলা ছু্ঁড়ে দিল যেন।
-ঠিক আছে রানী আমি তোমাকে গোটা একটা দিন এবং রাত দিয়ে দেব। তাতেই যদি তুমি সুখী হও। হেসে বলল হোসে। কথাবার্তা চালাবার পুরোটা সময় জুড়ে হোসে কাউন্টারের পেছনে তার জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছিলো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় রাখছিল। সে তার নিজের কাজটা করে যাচ্ছিল অভ্যস্ত হাতে।

-আমি আসলে তোমাকে সুখী দেখতে চাই। বলেই থেমে গেল হোসে। তারপর কী মনে করে মেয়েটার দিকে অন্যরকম একটা দৃষ্টি দিয়ে বলল- তুমি কি জানো আমি তোমাকে কত ভালবাসি?

মেয়েটা এবার কেমন একটু শীতল চাহনি দিয়ে তার দিকে তাকালো। তারপর বলল-

-সত্যিই???? কী আশ্চর্য আবিষ্কার হোসে!!!! তুমি কি মনে করো এক লাখ টাকা দিলেও আমি তোমার সাথে শুতে যাব?
-না না আমি ঠিক সেটা বোঝাতে চাইনি রানী। আবারো বলছি, তোমার দুপুরের খাবারটা সুবিধার হয়নি। কিছুটা বিব্রত হয়ে পাশ কাটাবার জন্য তড়িঘড়ি করে বলল হোসে।
-আমিও কিন্তু অন্য কিছু ভেবে কথাটা বলিনি। বলতে চেয়েছি কোন মেয়ে এক লাখ টাকার বিনিময়েও তোমার ওই বিশাল শরীরের ওজন নিজের গায়ের ওপর নিতে রাজী হবে না। মেয়েটা এবার একটু তরল কণ্ঠে বলল।

কথাটা শুনে হোসে লজ্জায় একটু লাল হয়ে গেল। সে মেয়েটার দিকে পেছন ফিরে শেলফের জিনিসপত্র গোছাতে থাকল। মাথা না ঘুরিয়েই সে বলল-
- সত্যি তোমাকে আজ অসহ্য সুন্দর লাগছে রানী। আমার মনে হয় সবচেয়ে ভালো হয়, কাবাবটা খেয়ে তুমি বাড়ি গিয়ে ঘুম দাও।
-আজ আমার খিদে নেই। বলে মেয়েটা আবারও জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকাল। ধূসর সন্ধ্যায় রাস্তায় চলাচলকারী লোকজনের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন ভাবে। মুহূর্তের জন্য রেস্টুরেন্টের ভিতর নিস্তব্ধতা নেমে আসলো। হোসের কাপ প্লেট নাড়াচাড়ার টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

হঠাৎ করে মেয়েটা বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে হোসের দিকে তাকিয়ে কোমল সুস্থির আবেগময় কন্ঠে বলে উঠল-
-তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো হোসে?
-হ্যাঁ সত্যিই। এবার একটু শুকনো কন্ঠে হোসে জবাব দিল।
-আমি তোমাকে যে সব কথা বললাম তা সত্বেও তুমি আমাকে ভালোবাসো?
-কই, কী বললে তুমি আমাকে? হোসে তার দিকে না তাকিয়ে কন্ঠে কোনরূপ ওঠানামা ছাড়াই জানতে চাইল।
-সেই যে এক লক্ষ টাকার ব্যাপারটা বললাম। মেয়েটা তাকে স্মরণ করিয়ে দিল।
-ওহ ওটার কথা আমি তখনই ভুলে গেছি। হোসে বলল।
-তার মানে তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো? মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
-হ্যাঁ নিশ্চয়ই। বলল হোসে।

আবারো কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজন। হোসে মেয়েটার দিকে না তাকিয়ে আপন মনে কাজ করছে। মেয়েটা আরেক গাল ধোঁয়া ছেড়ে তাঁর বুকের ভারটা কাউন্টারের উপর রেখে মুখে একটু দুষ্টুমির ভঙ্গি করে জিভে কামড় দিয়ে লাস্যময়ী স্বরে বলল- -এমনকি আমার সঙ্গে বিছানায় না গিয়েও তুমি আমাকে ভালোবাসবে?

এবার হোসে চোখ তুলে স্পষ্টভাবে মেয়েটার মুখের দিকে তাকালো।
- তুমি কী জানো, আমি তোমাকে এত ভালোবাসি যে আমি কখনোই তোমার সাথে বিছানায় যাব না। বলল সে। তারপর হেঁটে এসে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার পেশীবহুল হাত দুটো কাউন্টারের ওপর দিয়ে মেয়েটার সামনে রেখে সরাসরি মেয়েটার চোখে চোখ রেখে বলল,
-আমি তোমাকে এমনভাবে ভালোবাসি যে প্রতি রাতে তোমার সাথে যে পুরুষটি বিছানায় যায়, তাকে আমি খুন করি মনে মনে।

এটা শুনে মেয়েটা প্রথমে একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তারপরই সামলে নিয়ে গভীর মনোযোগী দৃষ্টি দিয়ে হোসের দিকে তাকাল। তাঁর চেহারায় এক ধরনের বিচিত্র সহানুভূতি ও রসিকতার ছায়া একসাথে খেলছিল। কিছুক্ষণের জন্য মেয়েটা চুপ থাকলো। তারপর উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললো-
-তুমি একটা হিংসুটে হোসে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমি এরকম বেয়াড়া রকমের হিংসুটে হতে পারো!

লজ্জায় আবার লাল হয়ে গেল হোসে। গোপনে কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়া শিশুটির মতো লজ্জিত হয়ে মিনমিন স্বরে কোনমতে বলল,
-যাহ কী যা তা বলছো! আজ কী হয়েছে তোমার বলতো? মনে হচ্ছে তুমি কেমন অবুঝ আচরণ করছো। কেমন জানি অচেনা-অবুঝ আচরণ করছো তুমি। আসলে তোমার এই নষ্ট জীবনটাই হয়তো ভোগাচ্ছে তোমাকে। বলতে বলতে সে হাতের কাপড়টা দিয়ে ঘাম মুছল।
- তো... তুমি বলতে চাইছো তুমি ঈর্ষান্বিত নও? মেয়েটা এবার একটু অদ্ভুত বিচিত্র এক দৃষ্টি দিয়ে হোসেকে বিদ্ধ করল, যে দৃষ্টিতে সংশয় এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই মিশে আছে।

-হয়তো... হয়তো আমি ঈর্ষান্বিত। কিন্তু তুমি যেভাবে ভাবছো সেভাবে না।
হোসে তার শার্টের কলারটা একটু ঢিলা করে হাতের কাপড়টা দিয়ে গলা এবং ঘাড়ের ঘাম মুছতে থাকলো।
- তাহলে কিভাবে?
-আমি তোমাকে এত বেশি ভালোবাসি যে তুমি যেসব কাজ করো সেটা দেখতে আমার খারাপ লাগে, কষ্ট হয়।
-কী কাজ?
-এই যে একেক দিন একেক জনের সাথে বিছানায় যাওয়ার ব্যাপারটা...
-তুমি কি সত্যিই একজন মানুষকে খুন করবে আমার সাথে বিছানায় যাওয়া ঠেকানোর জন্য?
-না। বিছানায় যাওয়া ঠেকানোর জন্য তাকে খুন করবো না। সে তোমার সাথে বিছানায় গেছে সে কারণে খুন করবো।
-ওই একই কথা হলো। মেয়েটা বলল।

এবার দুজনের কথাবার্তার মধ্যে আরো খানিকটা ঘনিষ্টতা ভর করলো। মেয়েটা নিচু স্বরে কোমল মুগ্ধতার সাথে কথা বলছিল। দুজনে এত কাছাকাছি যে মেয়েটার মুখটা যেন হোসের গোলগাল বলিষ্ঠ কিন্তু শান্ত চেহারার সাথে সেঁটে যাবে। হোসের বুকের ভেতর তোলপাড় চলছিল। সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেও মেয়েটার উচ্চারিত শব্দগুলো তার মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তুলছিল।
- তা ঠিক। হোসে বলল।
- তাহলে স্বীকার করছো তুমি একজন মানুষকে খুন করার উপযুক্ত। কথাটা বলার সময় মেয়েটা এক হাত দিয়ে হোসের খসখসে বাহুটা আঁকড়ে ধরে অন্য হাতটা দিয়ে তার পাছায় একটা চাপড় দিল।
- আমি যে কারণটা বলেছি সেই কারণের জন্য হলে আমি খুন করতে দ্বিধা করবো না। হোসের কণ্ঠেও এক ধরনের নাটকীয়তায় এসে ভর করল।

এবার মেয়েটা ঠাট্টা ও রসিকতায় মেশানো হাসিতে মেতে উঠে বলল-

-কি আজব কথা বলোতো? হোসে মানুষও খুন করতে পারে! এই মোটাসোটা গোলগাল চর্বিওয়ালা পেট মোটা বোকা লোকটা খুনখারাবির মতো কাজও করতে পারে? যে কিনা প্রতিদিন আমাকে সুস্বাদু খাবারের যোগান দেয়, বিনিময়ে একটা পয়সাও নেয় না। যে আমাকে প্রতিদিন মজার মজার গল্প শোনায় এবং আমি নতুন মানুষ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দেয়, সে কিনা মানুষ খুন করতে পারে এটাও কি বিশ্বাস করবে কেউ? কি অদ্ভুত ব্যাপার। তুমি তো রীতিমত আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছো হোসে।

হোসে এবার একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল। বোধকরি একটু অপমানিতও বোধ করল। সম্ভবত মেয়েটা যখন ওরকম করে হাসতে শুরু করলো তখন তার মনে হলো সে ভুল কিছু বলেছে, মনে হলো তাকে ঠকানো হয়েছে।

-তুমি মাতাল। তাই পাগলামি করছো। যাও বাড়ি গিয়ে ঘুমোও। মনে হয় না আজকে তোমার কিছু খাওয়া হবে। হোসে একটু বিরক্ত সুরে বলল।

মেয়েটার হাসি থেমে গেল সাথে সাথে। সে এখন গম্ভীর হয়ে বেদনালিপ্ত চেহারায় কাউন্টারের উপর তার মাথাটা রাখলো। তাকিয়ে দেখতে থাকলো লোকটা দূরে সরে গিয়ে ফ্রিজের কাছে গেল, ফ্রিজের দরজাটা খুলে খামাকা আবার বন্ধ করে দিল। তারপর কাউন্টারের অন্য প্রান্তে চলে গেল। সেখানে গিয়ে পরিষ্কার গ্লাসগুলোকে খামাকা মোছামুছি করল, শুরুতে যেমনটি করেছিল।

তখন মেয়েটা আবার তার দিকে তাকিয়ে স্থির শান্ত কণ্ঠে বলল -তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো পেপিলো?

প্রিয় নামে ডাকা সত্ত্বেও সাড়া দিল না হোসে। সাড়া না পেয়ে মেয়েটা এবার একটু গলা তুলে ডাকলো- হোসে।

কিন্তু পেপিলো ওরফে হোসে তার দিকে ফিরেও তাকাল না।

-হোসে!! এবার গলা আরো উঁচিয়ে ডাকলো মেয়েটা। ডাক শুনে নিরুত্তাপ গলায় হোসে বলল।

-বাড়িতে যাও রানী এবং ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুমোবার আগে ভালো করে গোসল করে নিও তাহলে ঘুম ভালো হবে।
-আমি সত্যি বলছি। আমি সিরিয়াস হোসে। বিশ্বাস করো আমি মাতাল নই। কন্ঠে আকুলতা নিয়ে বলল মেয়েটা।
-তাহলে তুমি পাগল হয়ে গেছো। হোসে বলল।
-আরে শোনো না। তোমার সাথে আমার আরো কথা আছে। এদিকে আসো তো। আবেগঘন স্বরে ডাকলো মেয়েটা। এবার হোসে ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। কিছুটা আনন্দ কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে।
-আরো কাছে আসো প্লীজ। বলল মেয়েটা।

এবার মেয়েটার একদম কাছাকাছি গিয়ে ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়ালো হোসে। মেয়েটা একটু ঝুঁকে দুই হাত দিয়ে তার চুলগুলো মুঠোর মধ্যে ধরে আদর করে টানতে টানতে বলল-
-তুমি আমাকে সেই কথাটা আবার বলবে শুরুতে যা বলেছিলে?
-কি বলছো তুমি? কোন কথা? হোসের মাথার চুল মেয়েটার হাতের মুঠোয় আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে বলল।
-সেই যে বললে তুমি সেই লোকটাকে খুন করবে আমার সাথে বিছানায় যাওয়ার কারণে। মেয়েটা বলল।
-হ্যাঁ সেটা তো ঠিকই। তোমার সাথে যে বিছানায় যাবে তাকেই আমি খুন করবো।

মেয়েটা এবার তার চুল ছেড়ে দিল।
-সেক্ষেত্রে তুমি নিশ্চয় আমাকে রক্ষা করবে যদি আমি নিজেই সেই লোকটাকে খুন করি।

মেয়েটা খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল হোসের শুয়োরের মতো বিশাল মাথাটিতে নিষ্ঠুর এক ঝাঁকুনি দিয়ে। কিন্তু হোসে কোন জবাব না দিয়ে হাসলো শুধু।
- জবাব দাও হোসে। তুমি কি আমাকে রক্ষা করবে যদি আমিই তাকে খুন করি? বলল মেয়েটা।
-সেটা নির্ভর করবে অবস্থার উপর। ব্যাপারটা তুমি যত সহজে বলছো অত সহজ নয়। বলল হোসে।
-কিন্তু পুলিশ তোমার কথা যতটা বিশ্বাস করবে আর কাউকে ততটা বিশ্বাস করবে না। বলল মেয়েটা।

তার উপর মেয়েটার এতখানি আস্থার কথা শুনে হোসে খুব সম্মানিত ও সন্তুষ্ট বোধ করল এবং হাসলো। মেয়েটা কাউন্টারের উপর দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে বলল-
-এটা খুব সত্যি হোসে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমি জীবনে কখনো মিথ্যে কথা বলোনি।
-কিন্তু এতে করে তোমার কী লাভ হবে?
-লাভ আছে। পুলিশ তোমাকে চেনে এবং বিশ্বাস করে। সে কারণে তারা তোমাকে কোন কিছুই দুবার জিজ্ঞেস করবেনা। বলল মেয়েটা।

কাউন্টারের ওপাশে কিছুটা কম্পিত চিত্ত নিয়ে হোসে ভেবে পাচ্ছিল না সে কি বলবে। মেয়েটা আবারো জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকালো। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে গলার স্বর একটু বদলে কোন খদ্দের আসার আগেই আলাপটা শেষ করার সুরে বলল-
- তুমি কি আমার জন্য স্রেফ একটা মিথ্যা কথা বলবে হোসে? শুধু একটা। আমি সিরিয়াস। বলবে তুমি?
এবার হোসে মেয়েটার দিকে অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। মেয়েটা তার দিকে এমন ধারালো চোখে তাকিয়ে আছে সেই দৃষ্টির ধার থেকে নিসৃত ভয়ানক কোন চিন্তা তার মগজের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেল। সে তার গলাটাকে সিরিয়াস করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল-
- আচ্ছা রানী ঠিক করে বলোতো তুমি কী ঝামেলা পাঠিয়েছো? সত্যি সত্যি বলো আমাকে কি হয়েছে তোমার?
সে কাউন্টারের উপর হাত দুটো ভাঁজ করে রেখে মেয়েটার দিকে ঝুঁকে বলল। সেই সময় হোসের ভুঁড়িটা কাউন্টারের সাথে চাপ খাওয়ার কারনে তার মুখ দিয়ে অ্যামোনিয়ার তীব্র দুর্গন্ধ যুক্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এসে মেয়েটার নাকে অসহ্য ধাক্কা দিচ্ছিল।
-এটা সত্যি খুব ভয়ানক ব্যাপার! আমাকে বলো তুমি কী ঝামেলার মধ্যে পড়েছ? হোসে আবারো জানতে চাইল।

মেয়েটা এবার অস্বীকার করার ভঙ্গিতে উল্টোদিকে তার মাথাটা নাড়ালো।
-নাহ। তেমন সিরিয়াস কিছুনা হোসে, আমি তোমার সাথে মজা করছিলাম আসলে।

হোসে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলো মেয়েটার দিকে। তখন মেয়েটা আবার বলল- না হোসে, কাউকেই তোমার খুন করা লাগবে না।
-ওহ তাই! আমিও তো আসলে কখনোই কাউকে খুন করার কথা ভাবি নি। হোসেও এবার আগের কথা থেকে সরে এসে হতাশার সুরে যেন নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো।
-কোনো পুরুষকে তোমার খুন করতে হবে না। কারণ আর কারো সাথে আমি বিছানায় যাবো না। মেয়েটা বলল।
- এই তো এতক্ষণে তুমি লাইনে এসেছো। আমি তো সবসময়ই ভেবেছি তোমার এসব আজেবাজে কাজে জুড়ে থাকার কোন মানে হয় না। তুমি যদি এসব ছেড়ে ভালো হয়ে যাও আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে প্রতিদিন বিনা পয়সায় সবচেয়ে ভালো কাবাবটা খাওয়াবো। হোসে বলল।
-ধন্যবাদ হোসে। কিন্তু আসলে সে কারণে নয়। কারণ হচ্ছে আমি নিজেই আর কখনো কারো সাথে বিছানায় যেতে পারবো না। বলল মেয়েটা।
-তুমি আবার সবকিছু গুলিয়ে ফেলছো দেখি। হোস এবার একটু অধৈর্য সুরে বলল।
-আমি কিছুই গুলিয়ে ফেলছি না হোসে। বলল মেয়েটা। আসনের ওপর মেয়েটা শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বসলে হোসের চোখে পড়ল তার ব্রার ভেতরে চ্যাপ্টা হয়ে থাকা বিষন্ন স্তনজোড়ার দিকে।
-আমি আগামীকালই চলে যাচ্ছি এখান থেকে । কথা দিচ্ছি আমি আর কখনো ফিরে আসবো না। তোমাকে কখনো বিরক্ত করব না। আমি আরো প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি আর কখনো কারো সাথে বিছানায় যাব না। বলল মেয়েটা।
-ওই অদ্ভুত ধারণা কখন আসলো তোমার মাথায়?
-মাত্র এক মিনিট আগে। মাত্র এক মিনিট আগে আমি বুঝতে পারলাম যে এটা খুব খারাপ একটা কাজ। বলল মেয়েটা।

টেবিল মোছার কাপড়টা নিয়ে হোসে আবারও গ্লাস মোছামুছি কাজ শুরু করল। মেয়েটার দিকে না তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করল-
- অবশ্যই । যেভাবে তুমি ওসব করো, এটা খুবই নোংরা কাজ। তোমার ওটা অনেক আগে বোঝা দরকার ছিল।
-অনেক আগে থেকেই আমি জানতাম কাজটা খারাপ কিন্তু একটু আগেই আমি ব্যাপারটা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম। আসলে পুরুষদের ঘেন্না করি আমি।

বোকার মত হাসলো হোসে। সে তার মাথাটা তুলে মেয়েটার দিকে তাকাল। সেও তখন হাসছে। কিন্তু সেই হাসিটা খুব বিভ্রান্তিকর, যার মধ্যে এক ধরনের গভীর রহস্য লুকোনো। মেয়েটার মুখটা এখন শরতের অপরিপক্ক শস্যের মতো চিকচিক করছে। মেয়েটা জানতে চাইল-

-আচ্ছা তুমি কি মনে করো পুলিশ সেই মেয়েটাকে ছেড়ে দেবে যে একজন পুরুষকে হত্যা করেছে তার সাথে শোবার জন্য। তার সাথে যারা যারা শুয়েছে তাদের সবাইকে সে ঘেন্না করে। সে কী ক্ষমার যোগ্য বলো?

-অত খারাপ কিছু ভাবছো কেন? ওরকম কিছু হবার কোন সম্ভাবনা নেই। বলল হোসে। এবার তার কণ্ঠের মধ্যে একটু করুণা ছাপ।

-যদি এমন হয়, সব সেরে সেই পুরুষটি যখন জামা-কাপড় পরছিল তখন মেয়েটার মনে হলো এই লোকটাকে সে ঘৃণা করে অথচ তার সাথেই সারা দুপুর সে বিছানায় গড়াগড়ি খেয়েছে। তাকে এত ঘেন্না লাগছে যে কিছুতে সেই গন্ধ দূর করা যাচ্ছে না।
-ওসব গন্ধ বেশিক্ষণ থাকে না। সাবান দিয়ে ধুলে চলে যায়। সেজন্য কাউকে খুনটুন করার দরকার নেই। মাফ করে দাও। হোসে একটু পরিবর্তিত কন্ঠে বলল।

কিন্তু মেয়েটা আগের সুরে বলে যাচ্ছে - কিন্তু যদি এমন হয় লোকটাকে তার ঘেন্না হয় বলার পরও সে যদি পোষাক পরা বাদ দিয়ে তার উপর আবারো ঝাপিয়ে পড়ে চুমু খেতে শুরু করে এবং আবারো সেই কাজটা করে, তখন কী করার বলো?
-এমন কাজ কোন ভদ্রলোক করতে পারে না।
বলল হোসে।
-যদি সেটা করে বসে? যদি সে লোকটা ভদ্রলোক না হয়, যদি সেই মেয়েটার মনে হয় যে লোকটাকে সে এতো ঘেন্না করে যে তার মরে যাওয়া উচিত। তখন সেই মেয়েটার যদি ইচ্ছে করে তার পেটের মধ্যে একটা ছুরি ঢুকিয়ে দিতে? মেয়েটা বলল।
-ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু তুমি যে রকম বলছো সেরকম কোন খবিস লোক দুনিয়াতে আছে বলে মনে হয় না। হোসে বলল।
- অবশ্যই আছে এবং ওরকম কাণ্ড করতেও পারে। ধরে নাও আমি যা বলেছি সেটাই সে করেছে।
-তাহলে মনে হয় খুন করার ব্যাপারটা অত অযৌক্তিক হবে না। হোসে বলল নির্বিকার ভঙ্গিতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাউন্টারের উপরিভাগ মোছামুছির কাজটা করতে করতে। যেন এই মুহুর্তে কাজটা সে উপভোগ করছে। আলাপে তেমন মন নেই তার।

-তুমি একটা অশিক্ষিত জানোয়ার হোসে। বলো হোসে, তুমি আমাকে বল, লোকটাকে আমার খুন করা উচিত কিনা। মেয়েটা তার শার্টের হাতা ধরে জোরে টান দিল।
-আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। মানলাম তুমি যেটা বলছো সেরকম হলে খুন না করে উপায় কী।
-ওটাকে কি আত্মরক্ষা বলা যায় না? মেয়েটা তার শার্টের হাতায় আবারো টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
-নিশ্চয়ই। প্রায় আত্মরক্ষাই বলা চলে সেটাকে। হোসে তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বললো। তার চেহারায় এক ধরনের রসিকতা এবং ভয়ের ছাপ একসঙ্গে কাজ করছে।
-যদি কোন নারী ওই কাজটা করতে বাধ্য হয় তুমি কি তাকে রক্ষা করার জন্য একটা মিথ্যে কথা বলবে? মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
-সেটা নির্ভর করে..
-কিসের উপর নির্ভর করে? জানতে চাইল মেয়েটা।
-নির্ভর করে সেই মেয়েটার উপর।
-মনে করো এটা সেই মেয়ে যাকে তুমি খুব ভালোবাসো কিন্তু তাকে পেতে চাও না। যেমনটি তুমি বলেছিলে। তুমি শুধু তাকে ভালোবাসতে চাও। আর কিছু না।
-ঠিক আছে রানী তুমি যাই বলো তাই হবে। একটু অলস বিরস কন্ঠে বলল হোসে। তারপর চুপ হয়ে গেল আবার।

হোসে ঘড়ির দিকে তাকালো। দেখল সাড়ে ছটা বাজতে আর বেশি দেরি নাই। সে ভাবছে অল্প সময়ের ভিতর রেস্তোরাঁ লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে। এটা মনে করে সে আরো দ্রুতগতিতে গ্লাসগুলো মুছতে শুরু করল সেই সাথে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে লাগল। মেয়েটা সেই একইভাবে টুলের উপর বসে রইল। বসে বসে গভীর মনোযোগের দৃষ্টি দিয়ে হোসের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করতে করতে তার বিষন্নতা কিছুটা বুঝি কমে আসে। একটা প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে যেরকম উজ্জ্বলতা নিয়ে জ্বলতে থাকে, সেই দৃষ্টি দিয়ে হোসেকে দেখতে লাগল। হঠাৎ করে সে তার কন্ঠ পরিবর্তন করে মরিয়া হয়ে ডাক দিল-

-হোসে!

মেয়েটার ডাক শুনে হোসে একটা নির্বিকার অলস স্থির বিষন্ন মাদী ঘোড়ার দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকালো। যেন সে তার কথা শোনার জন্য তাকায়নি। সে ওখানে আছে কিনা সেটা দেখার জন্য তাকিয়েছে। সেই দৃষ্টিতে কোনরকম মুক্তি বা নিশ্চয়তার আশ্বাস নেই। যেন সে একটা তামাশা দেখছে।

-আমি তোমাকে বলেছি আমি আগামীকালই চলে যাচ্ছি। তুমি তো কিছু বললেনা। বলল মেয়েটা।
-হ্যাঁ শুনেছি কিন্তু কোথায় যাচ্ছ সেটা তো বললে না। বলল হোসে।
-এমন কোন জায়গায় যেখানে কোন পুরুষের সাথে আমাকে শুতে হবে না।
- ওহ তাহলে তুমি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছ? হোসে এমন ভাবে বললো যেন সে এইমাত্র সচেতন হল ব্যাপারটা নিয়ে।

-সেটা নির্ভর করছে তোমার উপর। তুমি যদি ঠিকমত বলতে পারো আমি এখানে কটার সময় এসেছি। তাহলে আমি কালকে চলে যাবো এবং আর কখনো এসব ঝামেলায় জড়াবো না। সেটা নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে। মেয়েটা বলল।

হোসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো এবং এ ব্যাপারে তার প্রতিশ্রুতি দান করল। মেয়েটা তখন তার দিকে ঝু্ঁকে এসে বলল, -কিছুদিন পর ফিরে এসে আমি যদি দেখি এই চেয়ারে বসে তুমি অন্য একটা মেয়ের সাথে গল্প করছো তখন কিন্তু আমার খুব হিংসে হবে।

-যদি তুমি ফিরে আসো আমার জন্য বিশেষ কোনো উপহার নিয়ে আসবে তো? হোসে জানতে চাইল।
-কথা দিচ্ছি আমি তোমার জন্য একটি ভারী লক্ষী ভালুকছানা খুঁজে আনব। মেয়েটা বলল।

হোসে হাসল এবং হাতের কাপড়ের টুকরোটা দুজনের মাঝখানে এমন ভাবে ঝুলিয়ে দিলো যাতে মনে হচ্ছে সে যেন একটা অদৃশ্য কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করছে। মেয়েটাও হাসল এবং সে হাসিতে প্রশ্রয় এবং প্রণয়ের যুগপত ছাপ। এরপর হোসে কাউন্টারের অন্য প্রান্তে গিয়ে গ্লাসগুলো মুছতে শুরু করল।
-তারপর? হোসে জানতে চাইল।
-তোমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে- তুমি সত্যি বলবে তো আমি এখানে পৌনে ছটার সময় এসেছি? মেয়েটা জানতে চাইল।
-কিন্তু কেন? হোসে জিজ্ঞেস করল।
-কেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। ব্যাপার হচ্ছে তুমি এই কথাটা বলবে, ঠিক আছে?

হোসে তখন তাকিয়ে দেখল সুইং ডোর ঠেলে একজন খদ্দের ঢুকছে। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বরাবর সাড়ে ছটা বাজে এখন।
-ঠিক আছে রানী তুমি যা বলছ তাই করব আমি। তুমি যা চাও তাই হবে। একটু বিক্ষিপ্ত স্বরে বলল হোসে।
-এই তো লক্ষি ছেলে। এবার যাও আমার জন্য সুন্দর করে মাংসের কাবাবটা ভেজে আনো। বলল মেয়েটা।

লোকটা ফ্রিজ খুলে এক টুকরো মাংস বের করে প্লেটের উপর রাখলো। তারপর চুলাটা জ্বালাল।
হোসে বলল- আমি তোমার জন্য খুব ভালো একটা বিদায়ী কাবাব ভাজবো এখন।
-ধন্যবাদ পেপিলো। মেয়েটা বলল।

তারপরই মেয়েটা হঠাৎ করে চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ল। সে যেন একটা কর্দমাক্ত ঘিনঘিনে বস্তি এলাকার ভিড়ের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলে ঘুরে মরছে। কাউন্টারের ওপাশে তেলে চুবানো মাংস ভাজার শব্দ তার কানে প্রবেশ করলো না। হোসে যখন চুলার মধ্যে মাংসটা ভাজার জন্য উল্টে পাল্টে দিচ্ছিল তখন সমগ্র রেস্তোঁরায় ছড়িয়ে পড়া মৌ মৌ সুগন্ধটাও তার নাক স্পর্শ করলো না। সে অতল চিন্তার গভীর সমুদ্রে একবার ডুবছে, একবার ভাসছে, কোথাও কূল কিনারা পাচ্ছেন না। কিছুক্ষণ পর সে হঠাৎ করে মাথা তুলে তাকাল যেন এইমাত্র মৃত্যুগহ্বর থেকে ফিরে এসেছে। সে তাকিয়ে দেখল জ্বলন্ত চুলার প্রফুল্ল আগুনের আভায় হোসের মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে আছে।
-পেপিলো...
-কি সোনা?
-কী ভাবছো তুমি?
-ভাবছি তুমি আমার জন্য লক্ষ্মী একটা ভালুকছানা খুঁজে পাবে কিনা
-অবশ্যই খুঁজে পাবো কিন্তু আমি চাই যে যাওয়ার আগে তুমি আমাকে আরো একটা বিদায়ী উপহার দেবে। মেয়েটা বলল।
স্টোভের কাছ থেকে হোসে মেয়েটার দিকে বিস্মিত চোখে তাকালো।
-একটু রসো.. এই তো শেষ হয়ে বলে। তা.. তুমি কি এই কাবাব ছাড়া আরও কিছু চাও?
-হ্যাঁ চাই। মেয়েটা বলল।
-কী সেটা? হোসে জিজ্ঞেস করল।
-আমি তোমার কাছে আরো পনের মিনিট সময় চাই। মেয়েটা জবাব দিল।

হোসে একটু পিছিয়ে গেল। তারপর ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে কাউন্টারের অন্যদিকে বসা চুপচাপ বসে থাকা খদ্দেরের দিকে তাকাল। তারপর চুলায় ভাজা হতে থাকা কাবাবের দিকে তাকিয়ে বলল,

-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না রানী।
-বোকার মতো কথা বলো না তো হোসে। তুমি ভাল করেই জানো আমি সাড়ে পাঁচটা থেকে এখানে বসে আছি। ওটা ঠিকমত বুঝতে পারলেই হবে।

.........................................................................................................
( The Woman Who Came at Six O’Clock – Gabriel Garcia Marquez)

(ভাষান্তর: হারুন রশীদ)


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

চমৎকার লাগল।

..................................................................
#Banshibir.

নীড় সন্ধানী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ অনুবাদ পাঠের মতো কষ্টকর কাজ করার জন্য। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সত্যপীর এর ছবি

কষ্ট হয় নাই তো, একটানেই পড়ে গেলাম চলুক

..................................................................
#Banshibir.

হিমু এর ছবি

গল্পটা এখনও পড়িনি, শুধু ভূমিকাটা পড়েছি, সেটার জন্যে আগাম পাঁচতারা ঠুকে দিয়ে গেলাম। গল্প পড়ে পরবর্তী মন্তব্য করবো।

সেবা প্রকাশনীর অনুবাদের মানও এখন আর আগের মতো নেই। সত্তর-আশি দশকে যাঁরা অনুবাদ করতেন (শেখ আবদুল হাকিম, নিয়াজ মোরশেদ, জাহিদ হাসান, সেলিম হোসেন টিপু, প্রমুখ), তাঁরা আক্ষরিক অনুবাদের চেয়ে দেশিকীকরণে (localisation) জোর দিয়েছিলেন (সম্ভবত কাজী আনোয়ার হোসেনের সেটাই চাওয়া), তাই সবকিছুই খুব মসৃণ মনে হতো। ঐ ছায়ানুবাদগুলোর সুখপাঠ্যতা হালের অনুবাদকদের কাজে জোরালোভাবে অনুপস্থিত। পারিশ্রমিকের ব্যাপারে প্রকাশকের কার্পণ্য হয়তো এক বড় প্রভাবক, কিন্তু ইদানীং নানা কাগজে প্রকাশিত কিছু অনুবাদ পড়লে মনে হয় নবম শ্রেণীর কোনো পড়ুয়া ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়ির কাজ করতে বসেছে।

আরও কিছু ইতস্তত চিন্তা মাথায় খেলে গেলো। সেসবের একাংশ এ মন্তব্যের খাতায় যোগ করবো, বাকিটা আপনাকে পরে একান্তে জানাচ্ছি।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

সেবার সাম্প্রতিক অনুবাদের সাথে পরিচয় নেই। আশি নব্বই দশকের পর সেবার অনুবাদ পড়া হয়নি। সেই সময় খুব সুখপাঠ্য ছিল সেবার অনুবাদ। সেবার সর্বোত্তাম অনুবাদের নজির হচ্ছে এটিএম শামসুদ্দিনের অনুবাদ 'ত্রিরত্নের নৌবিহার'। যদিও কিছুটা সংক্ষেপিত তবু বাংলা ভাষায় এমন অনুবাদ আর একটিও নেই। সেবার অনুবাদের মধ্যে এই বইটি সেরা মনে হয় আমার কাছে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু এর ছবি

গল্পটা পড়তে পড়তে খেয়াল হলো, বাংলায় কাবার্ডের জন্যে কোনো আলাদা শব্দ নেই। বাংলা একাডেমি অভিধানে কাবার্ডের ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু একক বিকল্প নেই। সংসদ অভিধানে আছে আলমারি, কিন্তু আলমারি শুনলে যে জিনিসটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেটা ঠিক কাবার্ড না। বিকল্পে থালমারি কি বলা যায়?

অনূদিত গল্পেই নতুন বাংলা শব্দের প্রবর্তন আর প্রচলনের সুযোগ সবচে বেশি, কিন্তু সে সুযোগ আবার নানা শর্তে বারিত। সেটা জেনেও পাঠক হিসেবে অনুবাদকদের কাছে নতুন শব্দ চাওয়ার অভ্যাসটা ধরে রাখা জরুরি মনে করি।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

থালমারি শব্দটা চমকপ্রদ। মানে থালাবাসন রাখার আলমারি। পরীক্ষামূলকভাবে শব্দটা প্রয়োগ করতে আগ্রহী আমি।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু এর ছবি

পরীক্ষায় আমিও যোগ দিলাম।

হিমু এর ছবি

মূল হিস্পানি (মুহ়ের) আর তার ইংরেজি অনুবাদে (উয়োম্যান) নারী চরিত্রটিকে আভাসে যৌবনের পড়ন্ত প্রান্তে রাখা। বাংলায় মেয়ে বললে তাকে তরুণী মনে হয়, হ়োসের কাণ্ডবাণ্ড তখন স্বাভাবিক লোলপুরুষামি ঠ্যাকে। কিন্তু যদি মূলানুগ থেকে "সন্ধ্যা ছ'টায় আগতা মহিলা" পড়তাম? হ়োসেকে তখন বেশ ভিন্ন আলোয় দেখতাম আমরা। শিরোনামে আরেকটু রহস্য রেখে দেওয়া যেতো যদি শুধু "সন্ধ্যা ছ'টায় আগতা" থাকতো।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনার কথায় যুক্তি আছে। মহিলা বললে মূলানুগ হতো। আমি শুরুতে মহিলাই লিখছিলাম। কিন্তু কেন জানি মহিলা মহিলা লিখে ঠিক আমেজটা পাচ্ছিলাম না। মাথামোটা হোসের সাথে তরুণী কাউকে কল্পনায় আসলো। আর সেই কল্পনাকে সমর্থন করলো এই শর্টফিল্মটা। ফলে মহিলাকে 'মেয়ে' হিসেবেই উপস্থাপন করতে হলো।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।