টেকসই উন্নয়ন ও কাঁচামালের দূষণ প্রসঙ্গে

শামীম এর ছবি
লিখেছেন শামীম (তারিখ: বুধ, ১১/০৭/২০০৭ - ১১:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে দূষণ কমানো অপরিহার্য। দূষণের বিভিন্ন উৎসের মধ্যে শিল্প-কারখানা একটি। বর্তমানে দূষণ কমানোর জন্য চেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ শিল্পপণ্যে ISO 14000 14001 ইত্যাদি সনদ নেয়াও অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশেষত রপ্তানীজাত পন্যের ক্ষেত্রে ISO 9000 সিরিজের সনদ, যা সাধারণত কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার ও শ্রমিক ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষতা নির্দেশ করে, ছাড়াও এই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা সূচক ISO 14000 সিরিজের সনদ জরুরী হয়ে পড়েছে।

এরকম বাধ্যবাধকতা থাকুক আর না থাকুক টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবেশ দূষণ রোধ করা সচেতন নাগরিকমাত্রেরই দায়িত্ব। বর্তমানে দেশে যে সকল প্রযুক্তি ও বিধিনিষেধ দিয়ে দূষণ কমানোর চেষ্টা করা হয় সেগুলো শিল্পবর্জ্য (তরল, কঠিন, বায়বীয়) পরিশোধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ধরণের ব্যবস্থাকে End of the pipe technology বলা হয়ে থাকে, কারণ এতে সর্বশেষে সমস্যাটাকে ঠিক করার চেষ্টা করা হয়। আরও একটি ভাল প্রক্রিয়া হতে পারে উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে পর্যায়ক্রমে দূষণ কমানোর চেষ্টা করা, এতে বর্জ্য পরিশোধনের পরিমানও কমে যাবে।

এজন্য দরকার হবে কম দূষণ করে এমন কাঁচামাল। কিংবা, এমন কাঁচামাল যেখান থেকে তুলনামূলকভাবে কম বর্জ্য উৎপন্ন হবে। তবে, সেই কাঁচামালটিই যদি এটার (কাঁচামালের) উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচুর দূষণের কারণ হয়, তাহলে এটা ব্যবহার করলেও সামগ্রীক পরিবেশ দূষণ পরিস্থিতিতে কোন ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে না। তাই, এই ব্যাপারগুলি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়ার জন্য দরকার একটি দূষণের মাত্রাজ্ঞাপক পরিমাপ বা সূচক, যা প্রতিটি কাঁচামালের জন্য নির্ধারণ করা হবে (কোন তত্বাবধানকারী সংস্থার দ্বারা)।

ব্যাপারটাকে অনেকটা এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যায়ঃ যেমন ধরুন একটা বৈদ্যূতিক যন্ত্র যদি অনেকগুলো যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে গঠিত হয়, তবে যন্ত্রটির মোট বিদ্যূৎ চাহিদা প্রতিটি যন্ত্রাংশের চাহিদার সমষ্টির সমান হবে। প্রতিটি যন্ত্রাংশের চাহিদা আলাদা আলাদা ভাবে জানা থাকলে, কম চাহিদাসম্পন্ন কিন্তু একই রকম কাজ করে এমন যন্ত্রাংশ দিয়ে বিদ্যূৎ সাশ্রয়ী যন্ত্র বানানো যায়। কাঁচামালের দূষণের মাত্রাটাও যদি এমনভাবে (যন্ত্রাংশের বিদ্যূৎ চাহিদার মত) জানা থাকে তবে কম দূষণযুক্ত কাঁচামাল ব্যবহার বা বেছে নিতে সুবিধা হবে।

টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে এমন কাঁচামাল নির্বাচন করা উচিৎ যা এর উৎস থেকে আহরন করা থেকে শুরু করে বর্জ্য হিসেবে পরিত্যক্ত হওয়া পর্যন্ত কম দূষণ করবে। একটি কাঁচামাল এটার শুরু থেকে বর্জ্যে রূপান্তরিত হওয়ার আগপর্যন্ত যতভাবে দূষণে ভূমিকা রাখে তাকে কাঁচামালের দূষণ-জীবনচক্র বলা যেতে পারে। এজন্য এটার উৎপত্তিস্থল থেকে বর্জ্য হিসেবে ফেলা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে বিভিন্ন ফিনিশড প্রোডাক্ট উৎপাদনে যতগুলো ক্ষেত্রে দূষণ করে, সবগুলো দূষনের সমষ্টিকে বিবেচনা করা যেতে পারে। ব্যাপারটাকে আরেকটি উদাহরণ দিয়ে আরেকটু ভালভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করিঃ

একটা আসবাবের হাতলের জন্য আমাদের কাছে দুটি উপায়ের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হল। ১. ধাতব হাতল ২. কাঠের হাতল।

অনেকই হয়ত একবাক্যে কাঠেরটিকে বেছে নেবেন। আবার, অনেকেই বৃক্ষ নিধনের বিপক্ষে অবস্থান নিতে কাঠের হাতল চাইবেন না। কিন্তু দূষনের কথা যদি চিন্তা করি তাহলে হিসেব করতে হবে কাঠের হাতল তৈরীতে শুরু থেকে কতটুকু দূষণ হয়েছে; একই ভাবে লৌহ হাতল তৈরীতে খনি হতে লোহা উত্তোলন থেকে শুরু করে সমস্ত যান্ত্রিক প্রক্রিয়া শেষে এই হাতল আকারে আসতে হাতলপিছু কত দূষণ হয়েছে। এরকম যদি প্রতিটি কাঁচামালের জন্য একটি দূষন সূচক থাকে তাহলে আমরা সহজেই সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব বস্তুটা বেছে নিতে পারব।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, দূষনকারী বস্তুর বা উৎপাদের জন্য দূষন মুচলেকা চালু আছে বেশির ভাগ উন্নত দেশে (polluters pay) .... তাই অধিক দূষনকারী বস্তুর জন্য চড়া মুচলেকা দিতে বাধ্য হওয়াতে এর দাম/খরচ বেশি পড়ে, ফলে দূষণ নিরুৎসাহিত হয়। কিন্তু সমস্যা হয় তৃতীয় বিশ্বের অনেক জায়গায়, যেমনঃ আফ্রিকার খনি সমৃদ্ধ রাস্ট্রগুলো থেকে কাঁচামাল আমদানি করলে দেখা যাবে যে অধিক দূষণকারী কাঁচামালের জন্যও খরচ কম পড়ছে কারণ ওখানে দূষণ প্রতিরোধে এমন কড়াকড়ি কোন বিধিনিষেধ আরোপ বা মানা হয়না। তবে উন্নতবিশ্বের দেশগুলি শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে এসকল কড়াকড়ি আরোপের আগ পর্যন্ত যত দূষণ করেছে সেই কথা চিন্তা করলে তৃতীয় বিশ্বের দূষণকারীগণকে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকারক বলেই মনে হয়।

প্রতিটি পন্যেই যদি এমনভাবে দূষণ সূচক দেয়া থাকে তাহলে সেটা ব্যবহার করে অন্য শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। তাছাড়া, সেই সকল বস্তুর দূষণ মাত্রা অনুযায়ী (যা সূচক থেকে বোঝা যাবে) শিল্পতে বর্জ্য পরিশোধনের মাত্রা কিংবা দূষণ মুচলেকার মাত্রা সহজে নির্ধারণ করে দেয়া যাবে। এতে সামগ্রীক ভাবে দূষণ কমবে বলেই মনে হয় যা টেকসই উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।

(লেখাটি পরিবেশ প্রকৌশলীর প্যাচাল ব্লগেও প্রকাশ করেছি)


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

অনেক ভাবনার খোরাক মিললো। এই ব্যাপারে জনসচেতনতা দরকার। আমাদের দেশের মত জনবহুল দেশে তো আরো বেশি দরকার।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

শামীম এর ছবি

নীতি নির্ধারক লেভেল পর্যন্ত এই খোরাকটা পৌছাইতে পারলে হয় ... ... দেঁতো হাসি

সাধারণ পর্যায়ে সচেতনতাটাও জরুরী। বিদেশে যেমন প্রতিটি খাবার কেনার সময় ইনগ্রেডিয়েন্টস দেখে কিনি। সেরকম কোন হোম অ্যাপ্লায়েন্স কেনার সময়ও এনার্জি স্টার/দূষণ কমমাত্রার এরকম কোন সূচক দেখে কেনার মত সচেতনতা জরুরী।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

অপালা এর ছবি

আরেকবার পড়তে হবে

সাধক শঙ্কু এর ছবি

পুরা বিষয়টাই আসলে নির্ভর করতাছে কে সিদ্ধান্ত নিবো তার উপর।
লেখা ভালো হইছে।


গড়ি দালানকোঠা ফেলে দিয়ে শ্মশাণে বৈঠকখানা

হাসান মোরশেদ এর ছবি

এই লাইনের মানুষ না । তারপর ও সহজপাঠ্য জরুরী লেখা- পড়ে ফেললাম ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শামীম এর ছবি

অপালা:
রসকষহীন লেখা ...আরেকবার পড়ার পরেও অশান্তি থাকবে চোখ টিপি

সাধক শঙ্কু:
সিদ্ধান্তটাকে ক্রেতারাও প্রভাবিত করে। যদি বিদেশী ক্রেতা ISO স্ট্যান্ডার্ড না দেখে কিনতো তবে কি ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টরা এত দ্রুত মানোন্নয়ন করত? একই ভাবে, অভ্যন্তরীন ক্রেতাগণও যদি সচেতন হয়ে ওঠেন, দূষণের ধারা পরিবর্তনে বাধ্য হবেন উৎপাদকগণ। তাই নীতিনির্ধারকগণের পাশাপাশি সাধারণ লেভেলেও সচেতনতা জরুরী।

ধন্যবাদ হাসি

হাসান মোরশেদ:
ধন্যবাদ হাসি
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।