প্রবাসের কথোপকথন ৩

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: শনি, ০৭/০৭/২০০৭ - ১:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“কেমন আছো?”
বেঁচে আছি।

“তা তো দেখতেই পারছি।”
হ্যাঁ, কিছু ব্যাপার বদলায় না। সব সময়ের মতই আছে এই জবাবটা। বেঁচে আছি। আমার এক নানা বলেন...

“...কেটে যাচ্ছে, তবে রক্তপাত হচ্ছে না। জানি। পুরান কথা। যাক, আগে বাড়ো। এখানে কেন?”
এমনিই। দেশে আসলাম সপ্তাহ খানেক হয়। তোমাদের সবার খবর নিতে আসা। আন্টি দেখছি মলিন অনেক। শুভ্র বড় হয়ে গেছে বেশ। কোন ক্লাসে এখন?

“মা ভালই আছে। শুভ্র ফাইভে এবার। ভুলে গেছো মনে হয়। অবশ্য তোমার কোনদিন এসব ব্যাপারে নজরও ছিল না। আমিই তো কত কথা শুনতাম তারিখ নিয়ে মাতামাতির জন্য। তোমার ডক্টরেট ডিগ্রির কতদূর? জীবনের সবচেয়ে ক্রিটিকাল টাইম কাটলো, নাকি বাকি আছে এখনো?”
হাহ হাহ। খোঁচা দিচ্ছো?

“হয়তো বা, হয়তো না!”
আবারো?

“কী জানি!”
ভালই চালাচ্ছো। মজা লাগছে। বুকের কোথাও একটু কেমন কেমনও লাগছে যদিও।

“হ্যাঁ, তুমি আর তোমার কেমন কেমন লাগা। কেমন কেমন লাগে, বুক ধরফর করে।”
খুব করে।

“যাক, এসব কথা কেন বলছি? আর কিছু বলবা? চা-নাস্তা দেই। আমি এখন গরম পানি ছাড়াও কিছু রান্না জানি।”
নাহ, থাক। বেশিক্ষন বসবো না। চা খাই না, জানোই তো। তবে মাঝে কিছুদিন সিগারেট ধরার চেষ্টা করেছিলাম। পোষালো না। আমার জন্য না ওসব।

“আমাকে এসব কেন শোনাচ্ছো?”
দুঃখিত। কাজের কথায় আসি। ছবি আর চিঠিগুলোর জন্য এসেছি। সাথে তোমাকে আরেকবার দেখা। আসলেই সুন্দর হয়ে গেছো। কতদিন পরে দেখলাম তোমাকে! তুমিই বলেছিলে, মেয়েরা বিয়ের পর সুন্দর হয়ে যায়। আমি শেষবার যাবার পর সুন্দর হয়েছিলে, আর হলে আমাকে ছেড়ে যাবার সময়।

“অন্যদের জড়িয়ে কথা বলা ছাড়তে পারবে না তুমি কোনদিনই। তবে দেখে ভাল লাগলো যে তুমি পরোক্ষ খোঁচা দিতে শিখেছো। এখন আর গালি দাও না। জীবনে কাজে লাগবে এই শিক্ষাটা তোমার।”
দুঃখিত। যাক, ছবি আর চিঠিগুলো।

“ওগুলো আমার। কাউকে দেবো না আমি ওগুলো।”
আমি যে কেউ না। আমি ছবি না, আমি মানুষ। যেখানে আমি নেই, সেখানে আমার ছবি কেন থাকবে?

“ঠিক আছে, এনে দিচ্ছি। আর কিছু?”
নাহ, আর কিছুই না। অনেক কষ্টে ভুলেছি তোমাকে। ভাবি নাই তুমি এই ভাবে ছুঁড়ে ফেলবে আমাকে। মন থেকেই জানতাম যে সবদিক গুছিয়ে নেবার সময়টুকু আছে। তবে ভালই হয়েছে। তোমাকে হারিয়ে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি আবার। জীবনটা এখন অনেক হালকা আবারো। আই অ্যাম ব্যাক টু দ্য হ্যাপি-গো-লাকি লাইফস্টাইল।

“আমি কাউকেই ছুঁড়ে ফেলিনি। তুমিই সময় থাকতে ঠিক হওনি। এটা আমার দোষ না। তুমি নিজেই তোমার জায়গা হারিয়েছো।”
ভুল অনেকই করেছি তোমার সাথে। মানুষ হিসাবে অপরিশীলিত ছিলাম, অনিশ্চিত জীবন ছিল। তবে আমার আরেকটু সময় প্রাপ্য ছিল। অত দ্রুত আরেক জনের সাথে এতটা জড়িয়ে না পরলেও পারতে।

“আমি তোমাকে কোন কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।”
চাচ্ছিও না। কথাপ্রসঙ্গে বলছিলাম।

“আমি একদিনে ঐ অবস্থায় যাইনি। তুমি দিনের পর দিন আমাকে একটু একটু করে ওরকম করেছো। অনেক কষ্টে আমি বের হয়ে এসেছিলাম তোমাকে ভালবাসা থেকে।”
ঠিক ততটাই সহজে সেই ভালবাসা দিলে দিলে আর কাউকে। আমি তোমার মত করে বের হতে পারিনি। আমার বুকের সবটা জুড়ে থাকা অবস্থায় ছুঁড়ে ফেললে আমাকে তুমি। তুমি আর কাউকে ভালবাসতেই পারো, তবে আমার সাথে সম্পর্কটা শেষ করে ওপথে হাঁটলেও হত।

“আমার জন্যও সহজ ছিল না। কত রাত একা কেঁদেছি তুমি ঠিক হওয়ার অপেক্ষায়। সবাই বলত কেন শেষ করে দেই না এমন সম্পর্ক। আমি বলতাম তুমি ঠিক হয়ে যাবে, তোমার জেদ কমবে এক সময়, আমার ভালবাসা তোমাকে পথে ফেরাবে এক সময়। আমি জানি না আমি ঠিক করেছি, নাকি ভুল। তবে ওতে আর কিছু আসে-যায় না আমার।”
আমারও না। অনেক কষ্টে হলেও ধাক্কাটা সামলেছি শেষ পর্যন্ত। অনেক শিখেছি জীবনের ওই অংশটুকু থেকে। অনেক শক্ত হয়েছি এখন মানুষ হিসাবে।

“যাক, আমার মত ডেড ওয়েট কিছু তো দিতে পেরেছে তাহলে তোমার মত ওজনদার মানুষকে!”
ভুলো না কিছুই তুমি। আমরা আসলেই অন্য জগতের মানুষ দুইজন। আমি ফরগেটিং হলেও ফরগিভিং না, তুমি ফরগিভিং হলেও ফরগেটিং না। আমি যতটা শক্ত, তুমি ততটাই নরম। আমি মেঘের যতটা নিচে, তুমি ততোটাই উপরে। দশ হাজার মাইলের দূরত্ব তো আছেই।

“আমাদের দূরত্ব বা পার্থক্যের জন্য আমরা আজকে আলাদা নই। তোমার আচরণের জন্যই তুমি আমাকে হারিয়েছো।”
আমার কষ্টগুলো তোমাকেই একটা স্বচ্ছন্দ জীবন দেওয়ার জন্য ছিল। পশুর মত বেঁচে কি মানুষের মত আচরণ করা যায়?

“তার চেয়ে আমার সাথে একটু ভাল ব্যবহার করলেই হত। তুমি পথে থাকলে আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।”
আমি পথে থেকেছি। আমি জানি পথে থাকার মধ্যে কোন রোমান্টিকতা নেই। তোমাকে, আমাকে, আমাদের উত্তরপ্রজন্মকে যেন কোনদিন পথে থাকতে না হয়, সেই জন্যই আমার সংগ্রামটা ছিল। তোমার কাছে আমি সময় চেয়েছিলাম বারবার। হাতের একেবারে কাছে ছিল সবকিছু। এনগেজমেন্টের আংটিটাও কিনে পাঠিয়েছিলাম।

“এসব বলে আর কী লাভ? সময়টা চলে গেছে। আমরা কেউই আগের জায়গায় নেই। একটু সময় দাও, ওগুলো এনে দেই।”
সাথে কমিটমেন্ট রিংটাও দিও। যেটা হাতে পড়ে আমার ভালবাসার অষ্টম বার্ষিকিতে বলেছিলে কোনদিন ছেড়ে যাবে না, যেটা হাতে পড়ে অন্যের বাহুলগ্না হয়েছিলে তার মাত্র দেড় বছর পর।

“কমিটমেন্ট মানে যেকোন মূল্যে সাথে থাকা না। কমিটমেন্ট মানে বিশ্বাস আর মর্যাদা দেওয়া, কমিটমেন্ট মানে একটু ভাল ব্যাবহার।”
এই তর্কের শেষ নেই। সাড়ে নয় বছর দিলাম, দুইটা আংটি দিলাম, রক্ত পানি করে তোমার জন্য একটা সুখের জীবন তৈরি করার সংগ্রাম করলাম। জানি না একটা মেয়েকে ধরে রাখতে হলে আর কী করতে হয়।

“অন্যকে জড়িয়ে বাজে কথা না বলা, বিশ্বাস, আর কিছু আন্তরিকতা। তোমরা সব ছেলেরাই এক রকম। তোমাদের সাথে কী করলাম, তারচেয়ে বড় সব সময় অন্যের সাথে কী করলাম সেটা।”
আমরা অনেক বেশি পোজেসিভ নিজেদের নারীর ব্যাপারে, হ্যাঁ। কিন্তু সেটা তো ভালবাসি বলেই।

“পোজেসিভ হওয়া কোন সমস্যা না। আমরাও সেটা পছন্দই করি। কিন্তু সব ছেলেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। সবাই।”
সাবধানতাকে সন্দেহ বলে ভুল করা কিন্তু খুব সহজ।

“তুমি আমাকে কোনদিন বিশ্বাস করতে পারো নি।”
বিশ্বাস করেছি, পাখি। তবে ভরসা করতে পারি নি। তুমি আমার উপর ভরসা করতে, আমার ভুল ধরে দিলে আমি সাধ্যমত শুধরাবো, এটা জানতে। তবে এই বিশ্বাস কোনদিন করতে পারোনি যে আমি একটা সময় নিজের ভুলগুলো নিজেই বুঝবো। সম্পর্কে বিশ্বাস আর ভরসা দুটোই লাগে। আমরা কেউই একটার বেশি করতে পারি নি।

“আমি আর তোমার পাখি না।”
সেটাই। পাখি ডাকাটাই কাল হয়েছে। পাখি ডেকেছি দেখেই হয়তো উড়ে গেছো। তোমার কথা মত জান ডাকলেই চলতো। সম্বোধনটা আর দশ জনের মত হত। সম্পর্কটাও। ভাঙনের প্রান্তে দাঁড়াতে হত না এভাবে। পাখিরা পাখাদের ছেড়ে চলে যায়, জানরা জানদের ছেড়ে যায় না।

“সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা বলে লাভ নেই। আমার আর ওসবে কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। আমিও এখন রিয়ালিস্টিক।”
দেখতেই পারছি। তা বড়লোক বাপের গাড়ি হাঁকানো প্রেমিকটা কেমন আছে?

“তুমি একটা পশুই থেকে যাবে। তোমার বাজে কথা শুনতে বাধ্য না আমি। আমার আরও কাজ আছে।”
আমার মত করে তোমাকে হাসায়?

“তোমার মত করে কাঁদায় না।”
তুমি সুখে থাকলেই খুশি আমি। আমিও মেনে নিয়েছি যে আমাদের জুড়ি লেখা ছিল না কিসমতে। কৌতূহল থেকেই জানতে চেয়েছিলাম।

“নানা কেমন আছেন?”
নেই আর।

“জানাবার প্রয়োজনও বোধ করলে না আমাকে?”
কী করতে? শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত আফসোস করে গেছে। তুমি কেন তার কাছে অভিযোগ করলে না। শুধরে দিত আমাকে, শাসন করে দিত।

“আমি খুব খারাপ। এটাই শুনতে চাচ্ছো তো?”
উহু। তেতো কথার জন্য দুঃখিত। আমি তোমাকে দোষ দেই না। তুমি ভাল থাকো, এটাই চাই। আমি তোমাকে চাইতে আসিনি। তোমাকে ভোলাতে, বা কষ্ট দিতেও আসিনি। আই অ্যাম ওভার ইউ। অনেক কষ্টে, অনেক বন্ধুর পথ ধরে। আমি আর তোমাকে আগের মত ভালবাসি না। আমি আর তোমাকে চাই না।

“হাসালে।”
কেন?

“ইউ আর নট ওভার মি।”
ভুল। খুব ভুল। তুমি চেনো না এই আমাকে। এটা নতুন আমি। তোমার প্রত্যাখ্যানের আগুনের ছাই থেকে গড়ে ওঠা নতুন এক আমি।

“তুমি এখনও আমার চোখের দিকে তাকালে নার্ভাস হয়ে যাও। বসো, এক কাপ চা দেই।”


মন্তব্য

তারেক এর ছবি

ভাল লাগল। অন্তু কি আপনি নাকি? হাসি

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ডিপেন্ডস। আমি অন্তু হলে গালি দেন তো অন্তু অজানা কেউ, মেয়ে খুঁজে দেন তো নাম বদলায় অন্তু হই ৩ ঘন্টার মধ্যে!

এই সিরিজের লেখাগুলো অনেকের অভিজ্ঞতার সংকলন। কিছু আমার, কিছু চেনা কারও। কম-বেশি হারানো আর হতাশার সব কয়টাই। প্রবাসজীবনের মূল্য অনেক। আমরা সবাইই দিচ্ছি। বাকিরা এটার সাথে রিলেট করতে পারলেই হল।

নজমুল আলবাব এর ছবি

ভালো লাগলো।

সৌরভ এর ছবি

ভালো লাগে নাই।
কষ্ট পাইছি।
এইসবে মোর কষ্ট হয় রে!

------ooo0------
বিবর্ণ আকাশ এবং আমি ...


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

হ্যাঁ রে ভাই, কষ্ট। বড় অদ্ভুত একটা অনুভূতি!

ঝরাপাতা এর ছবি

সবাই সেলফ ডিফেন্স করে নিজেকে পরিচ্ছ্ন এবং ভারমুক্ত রাখে। এই দেয়াল থেকে বেশিরভাগ মানুষই যে বের হতে পারে না, লেখাটা পড়ে এমনই মনে হলো।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

'বদলে গিয়েছো তুমি,বদলে গিয়েছি আমি,বদলে গিয়েছে সমঅঅঅঅয়!'

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অমিত আহমেদ এর ছবি

প্রচন্ড বাস্তব!


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

সিরাত এর ছবি

খুব ভাল লাগলো।

'নানা নেই'। এটা কে? তোর তো আছে!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এই পর্বটায় বাকিগুলোর চেয়ে কল্পনার মিশেল বেশি। সামনা-সামনি এই সেটিং-এ কথোপকথনের সুযোগ হয়নি। ভাঙনের রূপ ও কারণটা চোখে পড়ার মত বাস্তব উপাদানের কাঠামোর উপর সম্ভাব্য ভবিষ্যতের মাংস বসানো হয়েছন। জানি না কবে দেশে যাবো, জানি না ততদিন সবাই থাকবে কিনা। সেই সংশয় থেকেই এই কল্পনা।

পেন্সিলে আঁকা পরী এর ছবি

লেখার হাত খুব একটা ভালো না। (আরো আছে আলস্য)। তানা হলে উলটো দিকের কাহিনীও লিখে দেখাতাম ইস্তি! সেটা চরম বাস্তবতার মিশেলে। হো হো হো

-------------------------------------------------------
আমি সেই অবহেলা, আমি সেই নতমুখ, নীরবে ফিরে চাওয়া, অভিমানী ভেজা চোখ।

-------------------------------------------------------
আমি সেই অবহেলা, আমি সেই নতমুখ, নীরবে ফিরে চাওয়া, অভিমানী ভেজা চোখ।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

জানতে ইচ্ছুক। খুবই ইচ্ছুক। এই উড়ুক্কু সময়ে প্রেমের মতো ভ্রান্ত ধারমা নিয়ে এট্টু জানতে মন চায়। এই কাহিনীর একটাই দিক। সেটা তো লেখাই আছে। মন খারাপ

পেন্সিলে আঁকা পরী এর ছবি

হু, তোমার কাহিনীর একদিক। আর অন্য কোন অভিমানী ভেজা চোখের অন্য কোন দিক। জীবন বড় বিচিত্র।

-------------------------------------------------------
আমি সেই অবহেলা, আমি সেই নতমুখ, নীরবে ফিরে চাওয়া, অভিমানী ভেজা চোখ।

-------------------------------------------------------
আমি সেই অবহেলা, আমি সেই নতমুখ, নীরবে ফিরে চাওয়া, অভিমানী ভেজা চোখ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।