ও আমার দেশের মাটি, কলঙ্কভালে হলে রাজটিকা

ঝরাপাতা এর ছবি
লিখেছেন ঝরাপাতা (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৭/২০০৭ - ৫:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

টানা তিনদিন ঝুম বৃষ্টির পর আজ আকাশের মুখভারটা বেশ কিছুটা কেটে গেছে। তবুও মেঘবালিকাদের ইত:স্তত ঘোরাঘুরি, ওড়াওড়ি চাঁদের চারপাশে- কখনো বা তাকে ঢেকে দিয়ে। এ কি কোন গোপন প্রণয়? সুধাংশুবালা আজ যেন সদ্য যৌবনে পা দেয়া ষোড়শীর মত উছলে উঠেছে ভরা রূপ-লাবণ্যে। তবে কি আজ পূর্ণিমা? হবে হয়তো! কে তার খবর রাখে? কি অদ্ভুত! যে আমি জ্যোৎস্নাকে ভালোবাসতে শেখার পর থেকে এমন একটি চন্দ্রালোকিত পূর্নিমা রাতও কাটাইনি রূপোলি আলোতে অবগাহন না করে, বৃষ্টিকে ভালোবাসতে শেখার পর থেকে বর্ষার প্রথম জলে নিজেকে তুমুল ভেজাতে ভুল করিনি একটিবারও, কষ্টকে উপশম করতে জানার পর থেকে সুনীল শান্ত আকাশের পানে অগনন মুহুর্ত স্থির তাকিয়ে থেকে জীবনের পরম সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে দেরী করিনি একটুও- সেই আমি সব ভুলে কেমন সম্মোহিতের মতো পার করছি জরতী সময়, একই বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া দিনগুলি। এই দীর্ঘ এক বছরে আমি কোন ফুল দেখিনি, পাখি দেখিনি, নদী-আকাশ-বৃষ্টি-মেঘ কিছুই দেখিনি একান্ত অনুভবের দৃষ্টি মেলে।

কেন আমি সবকিছুর মাঝারে থেকেও বিছিন্ন ছিলাম সবার কাছ থেকে? কেন আমি চোখ থাকতেও দৃষ্টিহীন হয়ে আছি? তার কারণ- এ মাটির সোঁদা গন্ধে আমার হৃদয়ে কাঁপন জাগে না, এই রূপোলি জ্যোৎস্নায় আমার দু'চোখে চাতকের তৃষ্ণা জাগে না, এই বর্ষণে আমার শ্যমিলিমা দেশমাতৃকার চঞ্চলতা নেই।কখনো আপন মনে হয়নি এখানকার কোন কিছুই। তাই একটিবারও ইচ্ছে হয়নি খালি পায়ে হেঁটে যাই অনেকটা পথ- অনুভবে জীবন্ত হয়ে উঠুক মাটির মমতা- যেমনটি আমার দেশের মাটির বুকে পা রাখলে ইচ্ছে করতো। চোখের সামনে কেন জানি আজ বার বার ভেসে উঠছে একটি অসহায় মুখ- কষ্টে ভেঙ্গে যাওয়া একটি বুক- রাজ্যের হাহাকার নিয়ে দেশান্তরী হওয়া সেই মানুষটি- বাবার বন্ধু স্বপন আংকেল। জলের দামে চৌদ্দ পুরুষের ভিটে-মাটি বিক্রি করে দিয়ে, পরিবার নিয়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন সীমান্তের ওপাড়ে। যাওয়ার সময় সে কি কান্না তার! এতো বড় মানুষটাকে এভাবে বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতে দেখে আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম সেদিন। খুব ছোট ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি- কতোটা নিরুপায় হলে এক বুক হাহাকার নিয়ে একজন মানুষ তার তিল তিল করে গড়া স্বপ্নের সৌধকে নিজ হাতে কবর দিয়ে পা বাড়ায় অনিশ্চয়তার দিকে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্বপন আংকেল সেদিন মাটিতে প্রণাম করেছিলেন কাঁদতে কাঁদতে। মাটি ভিজেছিলো তার চোখের পানিতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- সে দাগ এখনো মুছে যায়নি- যাবে না কোনদিন। বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন খুব, বাবাকে মনে হচ্ছিল ভীষণ অপরাধী- যে জন্য স্বপন আংকেলকে সব ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে বাবা যে সেই সমাজেরই প্রতিনিধি। বাবা পকেট থেকে রুমাল বের করে আংকেলের কপাল থেকে ধুলো মুছে দিতে গেলেন। আংকেল বাধা দিয়ে বললেন- মুছিস নারে, আমার দেশের কিছুই তো সাথে নিতে পারলাম না, এই ধুলোটুকু থাক না হয় কপালে লেগে, এ আমার রাজটিকা।

কালের স্রোতে হয়তো মুছে যাবে সেই ধুলোর দাগ কিন্তু কখনো কি মুছবে বুকের ভেতরের গভীর রক্তক্ষরণের গোপন কষ্টের দাগ?

*** অনুপ্রেরণা : ধুসর গোধূলির একটি পোস্টের প্রেক্ষিতে মাসকাওয়াথ হাসানের "অদ্ভুত আধাঁর এক" উপন্যাসটি।

*** প্রিয়তমাসু সিরিজের আরেকটি লেখা।


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

কালের স্রোত!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অসাধারণ। হৃদয়-ছোঁয়া লেখা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

'অঞ্জনা'রা ফিরে আসে না আর - - -
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

কারুবাসনা এর ছবি

বেঁচে আছি তাই।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

ঝরাপাতা এর ছবি

অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।